বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। আর বিপদে যে এগিয়ে আসে সেই তো পরম বন্ধু। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা অনেককেই বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছি। আমাদের গৌরবময় অধ্যায়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আমরা পেয়েছিলাম ভিনদেশী কিছু মমতাময় মানুষকে। সেইসব দরদী বন্ধুদের নামগুলো আজও আমাদের মনে পড়ে। বিশ্বের মানবতাবাদী মানুষ আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনেক আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছিলেন। বিভিন্ন দেশের শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সংগঠন নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে দ্বিধা করেনি। ১৯৭১ এর চরম দুঃসময়ের সেই ভয়াল ৯ মাসের পুরোটাই এমন অনেক অকৃত্রিম বন্ধু পেয়েছিলাম আমরা।
দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা
দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ, জর্জ হ্যারিসন এণ্ড হিজ ফ্রেণ্ডস
‘হাজার হাজার সহস্র লোক
মরছে ক্ষুধায়
এ যন্ত্রণার নেই কোনো শেষ
দেখিনি তো এত নির্মম ক্লেশ
বাড়াবে না হাত বলো সবাই
করো অনুভব
বাংলাদেশের মানুষগুলোকে
বাংলাদেশ...বাংলাদেশ।’
আগষ্ট, ১৯৭১ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের ম্যাসিডন স্কয়ার। সেখানে চলছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। অপ্রতিরোধ্য বীর বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিট্লসের জর্জ হ্যারিসন গাইলেন, ‘বাংলাদেশ...বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গানটি। উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য অর্থ-তহবিল গঠন করা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকরসহ আরও অনেকে। একাত্তরের দিনগুলোই ছিল এমন ।
ভিন্ন দেশ, ভিন্ন স্বর, তবুও সবাই প্রাণপনে ভালোবেসে গেছে যুদ্ধাহত বাংলাদেশকে। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের রক্তাক্ত দেশটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিবেদিতপ্রাণ কাজ করে গেছে বিশ্ববাসী।
সরাসরি যুদ্ধ, যুদ্ধের একমাত্র উপায় নয়- প্রমাণ করেছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর আর বাংলার বন্ধু স্যার জর্জ হ্যারিসন। বাংলাদেশের হতভাগ্য শরণার্থীদের সহায়তার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে তাঁরা আয়োজন করেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন, রবিশংকর ছাড়াও বব ডিলান, রিংগো স্টার, এরিক ক্যাপটন, লিওন রাসেল, বিলি প্র্যাস্টন সহ বিশ্বের তাবৎ সব বাঘা বাঘা শিল্পীদের সংগীতের মাদকতায় ভেসেছিলো লাখ লাখ মানুষ। জোয়ান বায়েজ কনসার্টে আসতে না পারলেও লিখেছিলেন তাঁর অমর গান ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। যুদ্ধ কবলিত বাংলাদেশকে রার এবং সাহায্যের হাত বাড়াতেই এই কনসার্ট আয়োজিত হয়েছিল । পন্ডিত রবিশংকর এর অনুরোধে এবং উৎসাহেই কনসার্টটি আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিট জেনারেশনের সৃষ্টিকারী বিটলস-এর জর্জ হ্যারিসন । একটি দেশের স্বাধীনতার সমর্থনে, সেই দেশে চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে সেই সময়ের সারা বিশ্ব কাঁপানো সংগীত শিল্পীরা অংশগ্রহন করেন এই কনসার্টে । এবং কালে এই কনসার্ট হয়ে গেল কিংবদন্তী ।
মুলত শরনার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা এবং স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সাহায্যার্থে এই কনসার্টের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেতার সম্রাট রবিশংকর । এই কনসার্টে গানে গানে ফুটে উঠে এই কনসার্ট এর আয়োজন এর উদ্দেশ্য; পাক হানাদারদের বর্বরতা ও অধিকারহারা বাঙালির দুঃখগাথা। মুল গায়ক জর্জ হ্যারিসন ও তার মানবতাবাদী গায়ক বন্ধুরা গানে গানে এই কথাগুলোই বিশ্ববাসীকে শুনিয়েছেন, জানিয়েছেন । তার সেই উদ্যোগ শুধু আর্থিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা, চলমান গণহত্যার কথা , লাখো দেশান্তরী শরনার্থীর কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছে তারা। পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এবং বিশ্ব বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছে । সেই সময়ের আমেরিকান সরকার বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা করলেও মার্কিন জনমত ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। যার অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় এই কনসার্টটিকে ।
১৯৪৩ সালে ব্রিটেনের লিভারপুলে জন্মগ্রহণ করেন হ্যারিসন।স্কুলে পড়ার সময়ই ভাই পিটার আর বন্ধু কেলিকে নিয়ে 'দ্য রেবেলস' (বিদ্রোহীদের দল) নামের ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন হ্যারিসন। হাই স্কুলের পালা শেষ করে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি বন্ধু পল ম্যাককার্টনির ‘কুয়ারিম্যান’ রক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬০ সালে এ দলটিই 'বিটলস' নামে পরিচিতি লাভ করে। মাত্র এক দশক টিকে থাকলেও ‘বিটলস’ বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তখনকার তরুণসমাজ পাগলের মতো ছুটেছে এই দলের চার সদস্য- জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টারের পেছনে। এই চার তারকা অদ্ভুত এক সম্মোহনে আবদ্ধ করেছিলেন কোটি তরুণকে। ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর জর্জ হ্যারিসন মারা যান।
মুক্তিযুদ্ধের উন্মাতাল সময়ে লাখো মুক্তিযোদ্ধার বুকে সাহস জুগিয়েছে এই কনসার্ট। আর বিশ্বের মানুষ জেনেছে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কথা, লাখো বাঙালির দুর্দশার কথা। যুক্তরাষ্ট্রের মেডিসন স্কয়ারের এ কনসার্টে 'বাংলাদেশ' শিরোনামের গান গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে 'বাংলাদেশ' নামটির সঙ্গে অনেকের পরিচয়ই হয়েছিল স্বনামধন্য গায়কের এই গানের মাধ্যমে। সেই থেকে বাংলাদেশের দুঃসময়ের বন্ধু ও আপামর বাঙালির প্রাণের স্বজন হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন হ্যারিসন। পৃথিবী বিখ্যাত এ পপ তারকার প্রতি আজও তাই একইরকম ভালোবাসা অনুভব করে বাংলাদেশ। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সংরণকারী জাদুঘর থেকে শুরু করে বই, পোস্টার, সিডি এমনকি তারুণ্যের প্রিয় পছন্দ হয়ে টি-শার্টে স্থান করে নিয়েছেন কাঁচা-পাকা চুল আর দাড়ি ঢাকা মুখের হ্যারিসন।
হ্যারিসনের বিখ্যাত বাংলাদেশ গানটি:
হ্যারিসনের বিখ্যাত বাংলাদেশ গানটি
পর্ব - ১
পর্ব - ২
পর্ব - ৩
পর্ব - ৪ পর্ব - ৫