বৃহস্পতিবার, ২৫শে মার্চ ১৯৭১। ঢাকা, পূর্বপাকিস্তান।
রাত দশটা কি এগারোটা হবে। স্কুল পড়ুয়া কয়েকজন ছেলে বন্ধুদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আড্ডা দিচ্ছিলো। মার্চে ঢাকা ছিল উত্তাল তাই পাক-সামরিকবাহিনী ট্রাকে করে টহল দিত। বারোটার আশেপাশে, আকাশে আলো দেখা গেলো। জগন্নাথ হলের দিক থেকে...........................
প্রথম দৃশ্যঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।
অনুদৃশ্য একঃ জগন্নাথ হল।
টিএসসি-শাহাবাগে অপেক্ষমাণ পাকসেনাদের ট্রাক টিএসসি আর শহীদ মিনারের ঠিক মাঝে বিএনসিসি-এর (পূর্বে নাম ছিল ইউটিসি অর্থাৎ ইউনিভার্সিটি অফিসার্স ট্রেইনিং কোর) বিপরীতে জগন্নাথ হলের দেয়ার ভেঙে মাঠ দখল নেয় পাকসেনারা।
“ডঃ জি, সি দেব তাঁর বাংলোতে বসে পত্রিকা অথবা বই কিছু পড়ছিলেন। এমন সময় হায়নার দল হঠাৎ এসে তাঁর ওপর আক্রমন করে। তাঁকে টেনে –হিঁচড়ে বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে করে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠে, এবং সেখানে তাঁকে গালি দিচ্ছে _____ শালা, মালাউনকা বাচ্চা ...... তুম দেশ আজাদ করেগা ?
কিয়া বলতে হো ?
জয়বাংলা ?
তুম জয়বাংলা বলতে হো ?
তারপর তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলে। একই দড়িতে অনেকজন ছাত্রকে বেঁধে টেনে নিয়ে আসে হলের মাঠে এবং একসাথে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে...... সেখানেই গর্ত করে পুঁতে ফেলে।
কবি নির্মলেন্দু গুন সেদিন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, “ ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের রাতের হত্যাযজ্ঞের পর তিনি জগন্নাথ হলের করুণ অবস্থা দেখতে গিয়েছিলেন।“
তিনি বললেন, “ পথে যেতেই প্রথমেই আজিমপুরের মোড়ে একটি লাশ তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলো। এইভাবেই লাশের পরে লাশ পেরিয়ে তিনি জগন্নাথ হলে পৌঁছলে ; দেখতে পেয়েছিলেন সেখানে লাশের পর লাশ পড়ে আছে।“ জগন্নাথ হলে রক্তের ছোপ আর লাশ ছাড়া কিছুই সেদিন তিনি দেখতে পাননি। আরও একটু সামনে বাড়তে দেখেছিলেন তাঁর বন্ধু কাসেমের লাশ পড়ে আছে।
কাসেম ছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুন এবং কবি অসীম সাহার খুব কাছের বন্ধু। কাসেম এসেছিলেন কবি অসীম সাহার কাছে। অসীম সাহা জগন্নাথ হলের তাঁর রুমের চাবি বন্ধু কাসেম কে দিয়ে সম্ভবত তিনি বাইরে কোন কাজের জন্য বেরিয়েছিলেন ...... সে রাতেই কাসেম হত্যাযজ্ঞের শিকার হলেন। তিনি এসে দেখেন ঘাসের ওপর তার বন্ধু কাসেমের লাশ পড়ে আছে ; কোথাও কেউ নেই। কবি নির্মলেন্দু গুন এবং কবি অসীম সাহা তাঁদের কবিতা এবং আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের ঘটনাবলী আর দৃশ্যাবলী। সেসব কথা বলতে বলতে একসময় কবি অসীম সাহা বললেন, “কবি কাসেমের লাশ দেখে ভয়ে, শোকে, যন্ত্রনায় ব্যথায় ... রাতের আঁধারে রক্তভেজা একহাঁটু ঘাসের মাঝে কিভাবে তিনি একা একা দাঁড়িয়েছিলেন।“ সেইসব স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে তাঁরা স্তব্ধ হয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন।“ (একাত্তরের কালো প্রচ্ছদ, লাবণ্য কান্তা)
বিশ্বাস না হলে দেখে আসুন জগন্নাথ হলের মন্ডপের পিছে মাঠের উত্তরে গণকবর এবং তার সৌধ। মাঠের উত্তরদিকে আর কতজনকে পুতে ফেলা হয়েছে তার ইয়েত্তা নেই।
অনুদৃশ্য দুইঃ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল।
খশরু-মন্টু-সেলিম তিন আউলিয়া নামে পরিচিত ছিলেন। তারা হলের মাঠে ছাত্রদের ট্রেইনিং দিতেন ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পরে থেকেই। সেই হলের উপরে ক্ষোভ আজীবনই ছিল পাকবাহিনীর।
লাবণ্য কান্তার একাত্তরের কালো প্রচ্ছদ বই থেকে কয়টা লাইন তুলে ধরলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবেন।
"তারপর আসলেন আরেকজন মুক্তি যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁরা ছিলেন বর্তমানের জহুরুল হক হল, আর তৎকালীন ইকবাল হলের বাসিন্দা। তাঁর নাম খন্দকার আফসার উদ্দীন (নান্না)। তাঁর বাবা চাকরি করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বললেন, ইকবাল হল তথা জহুরুল হক হলের ঘটনাবলী।
তিনি বললেন, “মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভারতে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু নানা রকম জটিলতার কারনে তিনি প্রশিক্ষণ নিতে পারেন নি। সেখানে তাঁকে অনেক মারধোর করা হয়েছিলো। তারপর তিনি আবার ঢাকাতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সন্ধ্যায় তাঁর বন্ধু সলিমুল্লাহ হল থেকে পালিয়ে এসে তাঁকে জানালো যে, সলিমুল্লাহ হলে পাক্ বাহিনীরা আক্রমণ করেছে। তাঁর বন্ধুর বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তার বাবা কে এবং তার মামা কে পাক্ বাহিনীরা ধরে নিয়ে গেছে; সে প্রান নিয়ে পালিয়ে এসেছে এখানে।“
এসব কথা শুনে জহুরুল হক হলে যারা বসবাস করতো, তারা অনেকেই সরে যায় অন্যত্র _____ বাকি যারা ছিলো তারা আতঙ্কেই ছিলো। তৎকালীন ইকবাল হলের দারোয়ান আব্দুল জলিল সন্ধ্যায় তাঁর কর্মস্থলে আসেন...... তখন আফসার উদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন, “ চাচা, আপনী আজ চলে যান; পাক্ বাহিনীরা সলিমুল্লাহ হলে আক্রমণ করেছে –রাত্রে হয়তো এখানেও আক্রমণ করতে পারে। “
জলিল তাঁর কথা শোনেন নি। তিনি বলেছিলেন, “কিছু হবে না, আমি কিভাবে চলে যাবো, এটা যে আমার দায়িত্ব ?” সেদিন ছিলো ২৫শে মার্চ, ১৯৭১। সে রাতে পাকিস্তানী হানাদার তৎকালীন ইকবাল হলেও আক্রমন করে। তারা প্রথমেই চাচা আব্দুল জলিল কে গুলি করে হত্যা করে সেখানেই ফেলে রাখে। পরে দর্শন বিভাগের ছাত্র চিশতি হেলালুর রহমান কে ও হত্যা করে। কারন তিনি সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। আব্দুল জলিল আর শাহ হেলালুর রহমানকে একসাথে ফেলে রাখে। তারপর শালেহ আহমেদ মজুমদার, জাহাঙ্গীর মুণীর এ. টি. এম জাফর আলম, মোঃ অশরাফ আলী খান, আবুল কালাম, আবু তাহের পাঠান সহ আরও অনেক কেই গুলি করে মেরে ফেলে। কিছু লাশ ট্রাকে করে নিয়ে যায়, কিছু এদিক সেদিক ফেলে দেয়, কিছু পুকুরে ফেলে দেয়। যে লাশগুলো ট্রাকে করে নিয়ে যায়, সেগুলোর আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বর্তমানের জহুরুল হক হল, আর তৎকালীন ইকবাল হলের বাসিন্দা আফসার উদ্দীন সে সব দুঃখ জনক এবং মর্মস্পর্শী ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী । তিনি ২০১১ সালের ২৫শে মার্চের রাতে সেসব ঘটনাবলী এভাবেই তুলে ধরলেন তাঁর আলোচনায় ।
যে জলিল চাচা কে তিনি সন্ধ্যায় বলেছিলেন, “ চাচা আপনী চলে যান, আজ অবস্থা ভালো নেই; আক্রমণ হতে পারে।” সেই কথাই তাঁর সাথে শেষ কথা ছিলো। পরে আফসার উদ্দীন এসে দেখেন জলিল চাচার লাশ পড়ে আছে। তিনি সেই জলিল চাচার লাশ আর চিশতি হেলালুর রহমানের লাশ ______ এই দু’টি লাশকে দ্রুত গতিতে নিজের হাতে এই জহুরুল হক হলের ভেতরে একই কবরের মাঝে কবর দিয়েছিলেন। বাকি লাশগুলোর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি, আরো কিছু লাশ পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো ...... এসবই হলো তৎকালীন ইকবাল হলের বড় গনহত্যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
২০১১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে তিনি নিজের হাত দু’টি দেখিয়ে বললেন, “আমি এই হাত দু’টি দিয়ে জলিল চাচা আর হেলালুর কে এই জহুরুল হক হলের মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলাম।“
দেখে আসতে পারেন গণকবরটা। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের পুকুরের পূর্বপাশে অবহেলায় পড়ে আছে।
অনুদৃশ্য তিনঃ রোকেয়া-সামসুন্নাহার হল।
জগন্নাথ হল, জহুরুল হক হলের আক্রমণের মতো সব্যসাচী আক্রমণ করা হয় রোকেয়া আর সামসুন্নাহার হলে। ধর্ষনের পরে আমার মতে জানা নেই কেউ মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলো কিনা। কাউকে চুলের মুঠি ধরে টেনে নিয়ে আসা হয় এবং তিনতলা থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়।
অনুদৃশ্য চারঃ নীলক্ষেত আবাসিক এলাকা।
২৩, ২৪, ২৫, ৪০ নম্বর ভবনে টিচারদের আবাস ছিলো। রাতে পাকসেনারা জীপে করে প্রবেশ করে। টিচারদের ধরে ধরে হত্যা করে। ২৭শে মার্চ সকালে ১২ নম্বর ভবনের পানির টাংকি থেকে উদ্ধার করা হয় শিক্ষদের পচাগলা লাশ।
অনুদৃশ্য পাঁচঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।
“নীলক্ষেতের মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসের সামনে একদল ভিক্ষুককে একসাথে মেরে স্তূপ করে ফেলে রেখেছিলো হানাদার বাহিনীরা। আফসার উদ্দীন (নান্না) সে রাতে সেই কাহিনীও বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বললেন, “সেই ভিক্ষুকরা একই পরিবারের সদস্য ছিলো। একসাথে তাদের কে পেয়ে একসাথেই মেরে ফেলেছিলো।“ এই এতো এতো ঘটনা আর এতো এতো লাশের প্রত্যক্ষদর্শী এই আফসার উদ্দীন (নান্না)।“ (একাত্তরের কালো প্রচ্ছদ, লাবণ্য কান্তা)
অনুদৃশ্য ছয়ঃ শিববাড়ি।
ঘরে ঘরে ঢুকে মারা হচ্ছিলো ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের কর্মচারিদের, তবে তাদের মূল টার্গেট ছিল ছাত্রদের প্রিয় মধুদা। শিববাড়ি কোয়ার্টারে ৩/ডি নম্বর ফ্ল্যাটে তার পরিবারের প্রায় সবার সাথে মেরে ফেলায় হয়। মধুদা হয়তো নিরস্ত্র ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন দিয়াশলাই। ছাত্ররা ছিল বারুদ। তিনি যেকোনো মুহূর্তে বারুদে আগুন দেয়ার ক্ষমতা রাখতেন। তার মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে রাস্তা পার করে জগন্নাথ হলের মাঠে এনে ফেলে রাখা হয়।
দ্বিতীয় দৃশ্যঃ বুয়েট।
অনুদৃশ্য একঃ আহাসানুল্লাহ হল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলের মতো বুয়েটের হলেও আক্রমণ চালায় পাকবাহিনী। আর আহাসানুল্লাহ হল থেকে ধরে নিয়ে আসা হয় মেধাবি ভাবি প্রকৌশলিদের।
অনুদৃশ্য দুইঃ তিতুমির হল।
রাস্তার দক্ষিণদিকে শুধু এই হলেই আক্রমণ করা হয়। শুধু এই হলে কেন করা হয় জানা যায় নি। অন্যান্য হলগুলো এই যাত্রায় রক্ষা পায়।
অনুদৃশ্য তিনঃ শিক্ষক কোয়ার্টার।
বাসা থেকে ধরে আনা হয় কমপক্ষে সতেরজন শিক্ষককে। সবাইকে বুয়েটের পুরোনো ভবনের পাশে লাইন ধরে ব্রাশ ফায়ার করা হয়।
তৃতীয় দৃশ্যঃ ফজলে রাব্বি হল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস।
ঢাকা মেডিকেলে আক্রমণ না করার প্রটোকল থাকলেও ছাত্রাবাসে না করার প্রটোকল নেই। ঢামেকের হবু ডাক্তাররা সে পঞ্চাশ সাল থেকেই পাকিদের বিপদে ফেলেছিলো। ফজলে রাব্বি হল থেকে ধরে ধরে ছাত্রদের মেরে ফেলা হয়।
চতুর্থ দৃশ্যঃ পিলখানা ইপিআর।
বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট-পাকিস্তান রেজিমেন্ট নামে পরিবর্তিত হতে থাকা বাহিনীতে একমাত্র বেশি সংখ্যক বাঙালি অফিসারদের রিক্রুটমেন্ট। দেশ দখলের জন্য অবশ্যই দরকার এই বাহিনী ধ্বংসের। পিলখানায় বাঙালি সেনাদের উপরে করা হয় বর্বরোচিত আক্রমণ। অসংখ্য বইতে তার বর্ণনা পাওয়া যাবে।
পঞ্চম দৃশ্যঃ রাজাবাগ পুলিশ লাইন।
ইপিআরের মতো পুলিশবাহিনীতেও আক্রমণ করে যেন কেউ প্রতিরোধ করতে না পারে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রতিরোধের শুরু সেখানেই।
ষষ্ঠ দৃশ্যঃ বাবুপুরা রেলবস্তি।
ফুলবাড়িয়া রেলস্ট্যাশন থেকে একসময় রেললাইন বক্সিবাজার হয়ে, পলাশি হয়ে, হাতিরপুল হয়ে কাওরানবাজারে মিলত। তখন কমলাপুর স্ট্যাশন ছিলোনা। এই রেললাইনের দুইধারে বস্তিতে লক্ষলক্ষ লোক বাস করতো। সেদিন নীলক্ষেত এলাকায় অপারেশন শেষ করে ওই বস্তিতে আক্রমণ করা হয়। কমপক্ষে, আবার বলছি কমপক্ষে পঁচিশহাজার সেই বস্তিতে মারা যায় বলে বাবুপুরায় গেলে লোকেরমুখে শুনা যায়। রেইললাইনের দুইধারে লাশ আর লাশ। কয়েকদিনেও কেউ লাশগুলোকে তুলে দাফন করতে আসেনি। পচে গেছে বেশিরভাগ ঐখানেই।
সপ্তম দৃশ্যঃ নয়াবাজার।
বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বাবুবাজার ব্রীজের কাছে নয়াবাজারে টিনের একটা বাজার ছিল। সেখানে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনাকারীরা মিলিত হতো, আশ্রয় নিত। নয়াবাজারেও চানালো হয় হত্যাকান্ড। মিশিয়ে দেয়া হয় বাজার।
ষষ্ঠ দৃশ্যঃ তাঁতিবাজার।
হিন্দু অধ্যুষিত তাঁতিবাজারে ছিল আক্রমণের জন্য চরম আরাধ্য স্থান। বেশিরভাগই হিন্দুর বাস ঐ এলাকায় বলে জানা যেত। তাই হিসেব করে মারার দরকার ছিল না। ঘরে ঢুকে ঢুকে নিশ্চিন্তে তাঁতিবাজারকে জনমানবহীন করে দেয়া হল কয়েকঘন্টায়।
সপ্তম দৃশ্যঃ সকালে কার্ফিউ।
২৬শে মার্চ খুব ভোরে সারা ঢাকায় রিকশায় করে মাইকিং করা হল যে আজ কার্ফিউ। ঘোষণা করছিলো তাদের বাঙালি দোসর ছিল যারা, তারাই বাংলা ভাষায়। কার্ফিউ দেয়ার একমাত্র কারণ ছিল যেন মানুষ বের না হয়, কি ঘটে যাচ্ছে দেখতে না পায়। আর বাসায় থাকার জন্য আরামসে বাসায় যেয়ে মারা যাবে। সেইসপ্তাহে প্রায় তিনলক্ষ লোক মেরে ফেলা হয় একেবারে ঠান্ডা মাথায়।
অষ্টম দৃশ্যঃ রমনা কালীবাড়ি।
২৬শে মার্চ বেলা বাড়ার সাথে সাথে রমনা কালীমন্দির আর মা আনন্দময়ীর আশ্রম এলাকা ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। বর্তমানে সোহরোয়ার্দি উদ্যানেই তো ছিল এই মন্দির। পাকবাহিনীর ক্ষোভ ছিল সাতই মার্চের ভাষণের উপর, রেসকোর্স ময়দানের উপরে। সাথে মন্দির থাকা মানে সনায় সোহাগা। মন্দিরে থাকা ভক্ত আর বাসিন্দাদের ব্রাশ ফায়ার করে মারা হয়। মৃতদেহগুলোকে মন্দিরের সাথে বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয়।
যারা এই গণহত্যা দেখেছেন কিছুটা বলার পরেও থমকে যান। আর কিছু বলেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকে।
বিশ্বাস না হলে ঘুরেই আসুন না সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে রমনা কালীবাড়ি থেকে। সেখানে একটা শহীদ ফলক আছে যা রোজ কেউ না কেউ অবমাননা করে উপরে উঠে যায়। আপনারা ফলকে সেদিনের শহীদের নাম দেখে আসতে পারেন।
ভুলে যাইনি। ভুলিনি শহীদদের রক্ত আত্মত্যাগ। আপনি ভুলে যান।
তর্কে মেতে উঠুন তিনলক্ষ নাকি ত্রিশলক্ষ।
সূত্র-স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ বিকাল ৫:০৫