একজন মুসলিম হিসেবে আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে,অসাম্প্রদায়িকতা কি ইসলাম সমর্থন করে?
খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল সেটার ভিত্তি কি ছিল? কি ছিল রাষ্ট্রের অর্থনীতি, শাসন ব্যবস্থা, আইন ও বিচার ব্যবস্থা, সমাজনীতি?
প্রথমেই দেখা যাক ইসলাম সাম্প্রদায়িকতাকে কীভাবে চিহ্নিত করেছে। একজন সাহাবী রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আসাবিয়্যাত’ (সাম্প্রদায়িকতা) কী? জবাবে তিনি ইরশাদ করলেন, অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানো।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০৭৮)
অর্থাৎ অন্যায় ও জুলুমের কাজে কাউকে শুধু এ জন্য সমর্থন করা যে, সে তার নিজ দল, গোত্র, জাতি ও ধর্মের লোক-এটিই সাম্প্রদায়িকতা। আপনি কুরআনুল কারীমের সূরা নিসার শুরু থেকে পড়ুন, দেখবেন ইসলাম মানবতার বন্ধনকে কীভাবে দৃঢ় করেছে। আল্লাহ তাআলা কীভাবে সকল মানুষকে একই পিতা-মাতার সন্তান ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে পরস্পরের আপন বানিয়েছেন।
হযরত হুযাইফা রা. বর্ণনা করেন যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল জাতি যেন তাদের বাপ-দাদা তথা বংশ নিয়ে গর্ববোধ থেকে ফিরে আসে অন্যথায় তারা আল্লাহর কাছে নাপাকির পোকামাকড় থেকেও নিকৃষ্ট গণ্য হবে।
(মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ২৯৩৮)
সুনানে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষকে আসাবিয়্যাত (সাম্প্রদায়িকতা)-এর দিকে আহবান করবে (অর্থাৎ অন্যায় কাজে নিজ দল, গোত্র, জাতিকে সাহায্য করতে বলবে) সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। যে এমন সাম্প্রদায়িকতার কারণে মৃত্যুবরণ করবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০৮০)
এ হাদীস এবং এ বিষয়ে আরো একাধিক সহীহ হাদীসের মর্ম এই যে, যে ব্যক্তি জাতীয়তা বা ভাষার ভিত্তিতে অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর সহযোগিতা করে এবং (কওমিয়্যত) দল, গোত্র, বংশের ভিত্তিতে অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মারা যায় সে জাহেলিয়াতের মৃত্যু বরণ করল। যে উম্মতের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঠিয়ে ভালোমন্দ সকলকে হত্যা করতে থাকে সে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আর বিদায় হজ্বের বিখ্যাত ভাষণের কথা তো সকলেরই জানা। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কারো উপর কারো প্রাধান্য নেই। তিনি বলেছেন, কোনো আরব অনারবের উপর (শুধু ভাষার কারণে) প্রাধান্য পাবে না। কোনো সাদা (তার বর্ণের কারণে) কালোর উপর প্রাধান্য দাবি করতে পারবে না। প্রাধান্যের একমাত্র ভিত্তি হবে তাকওয়া।
-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৩৪৮৭
নবীজী ইসলামী রাষ্ট্র পূর্ববর্তী অন্যান্য ধর্ম ও আদর্শের অনুসারীদের তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করে। এটা ধর্ম নিরপেক্ষতা বলা যেতে পারে কারন সকল ধর্মের প্রতি কল্যান ও জোর জবরদস্তী ছাড়া ধর্ম পালন করা অসাম্প্রদায়িকতার মূল লক্ষ্য। ইসলাম একটা আদর্শ, একটা জীবণ ব্যবস্থা। ইসলাম ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, সমাজের সর্বস্তরের কথা বলে।এবং ধর্ম থেকে রাষ্ট্র পৃথকি করনের কথা আগেই উল্লেখ আছে। ইসলাম স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা (হাক্কুল্লাহ্) যেমন বলে তেমনি বলে স্রষ্টার সৃষ্ট জগতের প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা (হাক্কুল ইবাদ)।
ইসলাম ধর্ম ও আদর্শের ব্যাপারে জোর জবরদস্তি সমর্থন করে না। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন বলে,
"দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী 'তাগুত' দেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।"
[২ সূরা বাকারা:২৫৬ পবিত্র কুরআন]
একইভাবে ইসলাম পূর্ববর্তী অন্যান্য ধর্ম ও আদর্শের অনুসারীদের ধর্ম পালনের স্বাধীণতা দে এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন বলে,
"বলুন, হে অবিশ্বাসীরা,
আমি এবাদত করিনা, তোমরা যার এবাদত কর।
এবং তোমরাও এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি
এবং আমি এবাদতকারী নই, যার এবাদত তোমরা কর।
তোমরা এবাদতকারী নও, যার এবাদত আমি করি।
তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্যে এবং আমার ধর্ম আমার জন্যে।"
[১০৯ সূরা কফিরুন:১-৬ পবিত্র কুরআন]
এ সম্পর্কে মদিনা সনদের উল্লেখ করা যেতে পারে।
মদিনা সনদের সারমর্ম
কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশক্রমে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জুলুম ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদীনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মালবম্বী বিশেষত ইয়াহুদীদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন যা ইতিহাসে 'মদিনা সনদ' নামে খ্যাত।
বিশ্বের প্রথম স্বাধীন মুসলিম প্রদেশ মদিনার সংবিধান (অনেকে একে শান্তিচুক্তিও বলে থাকেন) রচনা করেছিলেন স্বয়ং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তিনি চাইলে কোরআনকে মদিনার সংবিধান হিসেবে চালু করতে পারতেন, ইসলামকে মদিনা শহর বা প্রদেশর প্রধান ধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিতে পারতেন। কিন্তু নবী করিম (সাঃ) তেমন কিছু করেননি বরং তাঁর সংবিধানে মদিনার মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রকে কারও ধর্মের বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়া হয়নি এবং অমুসলিমদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কারণে ৬২২ সাল মহানবী (সাঃ) কর্তৃক প্রণীত মদিনার সংবিধানকে গণ্য করা হয় বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হিসাবে।
নিজ ধর্মের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অন্য ধর্মের অনুসারীদের হত্যা বা নির্যাতন করবার বিধান বিশ্বের কোনও ধর্মেই নেই। ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ ধর্মের জন্য নয়। একজন মানুষ যখন ভুলে যায় ধর্ম-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-বিত্ত-ভাষাগত পরিচয়ের আগে সে মানুষ তখনই সাম্প্রদায়িকতা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে, মানুষ পরিণত হয় অমানুষে।
উল্লেখ্য, মদিনা সনদে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা নেই বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কথাও নেই। কারন মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী সবাই মুসলমান ছিল না। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে ‘বিসমিল্লাহ’ নেই এমন কি আমাদের প্রিয় নবী করিম (সাঃ) এর নাম সেখানে মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ নয়, লেখা আছে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ কারন এই চুক্তি ছিল মুসলিম এবং অমুসলিমদের মধ্যে।
ঠিক একইভাবে, কোন দেশের সংবিধান হলো মদিনা সনদের মত, ঐ রাষ্ট্রের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে এক সাথে বসবাস কারার চুক্তি। ইচ্ছা করলেই সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা যায় না বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করা যায় না, এটা ইসলাম সমর্থিত নয়।
আসুন, একনজরে দেখে নেই মদিনা সনদের শর্তসমূহ-
১. সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ একটি সাধারণ জাতি গঠন করবে।
২. কোন সম্প্রদায় গোপনে কুরাইশদের সাথে কোন প্রকার সন্ধি করতে পারবে না কিংবা মদীনা বা মদীনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কুরাইশদের কোনরুপ সাহায্য-সহযোগীতা করতে পারবে না।
৩. মুসলিম, খ্রীস্টান, ইহুদী, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারো ধর্মীয় কাজে কোন রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
৪. মদিনার উপর যে কোন বহিরাক্রমণ কে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে। এবং সেই আক্রমণ কে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে।
৫. রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
৬. অসহায় ও দূর্বলকে সর্বাবস্থায় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
৭. সকল প্রকার রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদীনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে।
৮. কোন লোক ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিচার করা হবে। তজ্জন্য অপরাধীর সম্প্রদায় কে দায়ী করা যাবে না।
৯. মুসলমান, ইহুদী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরষ্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।
১০. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্র প্রধানের এবং তিনি হবেন সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বোচ্চ বিচারক।
১১. মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুমতি ব্যতীত মদীনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
১২. মুসলমানদের কেউ যদি ঘোর অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্নীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।
১৩. ইহুদিদের মিত্ররাও সমান নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে।
উপরোক্ত শর্তসমূহের আলোকে এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হয় যে, অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থাকে ইসলাম সমর্থন করে। মদিনা সনদ ধর্মভিত্তিক কোন রাজনীতিকে সমর্থন করে না। শুধু তাই নয়, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা মদিনা সনদে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে।