সৃষ্টি বড়ই রহস্যময়। এর পরতে পরতে পরতে লুকিয়ে নানা রহস্য। এ রহস্যময় সৃষ্টির কতটুকুই বা আমরা জানতে পেরেছি? খুব কম। সৃষ্টির যতো রহস্য সমাধা হয়েছে তা বিন্দু সমান, আর যা বাকি তা যেন গোটা এক মহাসমুদ্র! যুগে যুগে শত সাধনায় মানুষ রহস্যসমুদ্রে হাতড়ে জট খুলে কিছু মনি মানিক্য পেয়েছে ব্যাখ্যা রূপে। আজকে বিশ্বের ইন্টারেস্টিং সেসব রহস্য নিয়ে লিখতে বসে পরলাম।
১) ম্যারি সেলেস্তে; একটি ভৌতিক জাহাজ!
রহস্য: ১৮৭২ সালে এটলান্টিক মহাসাগরে এজোরেস দ্বীপে ম্যারি সেলেস্তে নামের একটি জাহাজ উদ্ধার করা হয়। জাহাজটি মাসখানেক ধরে ভেসে বেড়াচ্ছিল সাগরে। তখনো ছয় মাসের মতো খাবার ও পানির মজুদ ছিল। জাহাজটিতে জীবিত বা মৃত কোন সদস্য পাওয়া যায়নি। একজনও নয়! তবে এর সকল জিনিসপত্র একদম সাজানো গোছালো ছিল। যাত্রীদের মালপত্র একদম সেখানেই ছিল যেখানে থাকার কথা! দেখে বোঝা যায় এই জাহাজটিতে মানুষের আনাগোনা ছিল। তবে তারা কোথায় গেলেন? বাতাসে মিলিয়ে তো যেতে পারেন না! জলদস্যুদের কবলে জাহাজটি পরেনি কেননা কোন হস্তাহস্তির চিহ্ন বা লুটপাট হয়নি। কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা ঝড়ের আভাসও সেই এরিয়ায় সে সময়ে পাওয়া যায় নি। সবমিলিয়ে অলৌকিক কোন শক্তিতে জাহাজের সব মানুষ উধাও হয়ে গিয়েছিল তাই মনে করা হত একটা লম্বা সময় ধরে। একারনেই ম্যারি সেলেস্তেকে একটি ভৌতিক জাহাজ বলা হয়ে থাকে।
ব্যাখ্যা: রহস্য লুকিয়ে নয়টি শুন্য মদের বোতলে! জাহাজটিতে ১৭০১ ব্যারেল মদ ছিল, যার মধ্যে নয়টি খালি পাওয়া যায়। সেই নয়টি ব্যারেল লিকড হয়েছিল। লাল ওকের তৈরি ছিল ব্যারেলগুলো। লাল ওক অনেক বাষ্প এমিট করে থাকে। যেকোন ধরনের স্পার্ক তা কোন ধূমপায়ী যাত্রীর পাইপ হতে আসতে পারে বা ব্যারেলগুলোর ঘষাঘষিতেও হতে পারে প্রচুর বাষ্প এমিট করতে পারত। যা দেখে সাথে সাথে জাহাজের ক্যাপ্টেন সকল যাত্রীকে লাইফবোটে করে নেমে যেতে বলেন জাহাজটি থেকে বিষ্ফোরণের ভয়ে। যদিও ম্যারি সেলেস্তে বিষ্ফোরিত হয়নি শেষ পর্যন্ত, ব্যাস ব্যারেলগুলো পুরোপুরি নিঃশেষিত হয়েছিল ধোঁয়া ছড়িয়ে। জাহাজটির লাইফবোট এবং দড়ি মিসিং ছিল। টেবিলে গোছানো অর্ধসমাপ্ত ব্রেকফাস্ট পরে ছিল। এসবই প্রমান করে হুট করে তারা সকালবেলা সরে পরেন। যদিও সেই লাইফবোট বা কোন সদস্যের হদিস কখনো পাওয়া যায়নি। বিশ্বাস করা হয়ে থাকে বৈরী পরিবেশে, ক্ষুদায় তারা সবাই মারা যান! আর ম্যারি সেলেস্তে পরে থাকে জনমানবহীন অবস্থায় নয়টি শুন্য মদের ব্যারেল নিয়ে!
২) পায়রার বাড়ির ফেরা এবং হারানো!
রহস্য: যে পায়রার রহস্য গল্প করতে যাচ্ছি তাদেরকে হোমিং পায়রা বলা হয়ে থাকে। এমন নামের কারন তাদেরকে যেকোন অচেনা, অজানা জায়গায় ছেড়ে দিলেও তারা ঠিকই খুঁজে খুঁজে নিজ গৃহে ফিরতে পারে! কিভাবে তা সম্ভব? এই রহস্য সমাধানে ১৯৬০ সালে একদল রিসার্চার নেমে পরেন। তারা নিউ ওয়ার্ক স্টেইটের বিভিন্ন জায়গায় হোমিং পায়রাদের ছেড়ে দেন। যেকোন জায়গা থেকে তারা আবারো নিজ গৃহে ফিরে আসতে পেরেছিল। শুধু জার্সি হিলে যে পাখিদের ছাড়া হয়েছিল তারা বারবার হারিয়ে যেত! অবাক, দিশেহারা, ছত্রভংগ হয়ে উড়ে বেড়াত! তবে ১৯৬৯ সালের ১৩ আগস্ট তারা আবার খোঁজ পায় নিজ আবাসস্থলের। এর কারন কি? কেন তারা নিউ ওয়ার্ক স্টেইটের সেই জায়গাটিতেই হারাত, আর কেনইবা শুধু ১৩ ই আগস্ট বাড়ি ফিরতে পারল?
ব্যাখ্যা: ড: জোনাথন হ্যাগস্ট্রাম ব্যাখ্যা দেন এ রহস্যের। পাখিরা কম্পাস এবং ম্যাপ ব্যবহার করে থাকে নীড়ে ফেরার জন্যে। সূর্যের অবস্থান তাদেরকে কম্পাস সেট করতে সহায়তা করে। তবে এই হোমিং পায়রারা অন্যরকম। তারা ম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করে শব্দকে! এই শব্দ মানুষের শোনার সাধ্যের বাইরে। তবে পায়রারা পৃথিবী পৃষ্ঠে সমুদ্র ঢেউয়ে হওয়া সূক্ষ্ণ কম্পনের শব্দকে ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান বুঝে ঘরে ফিরতে পারে। জায়গা পরিচিত হোক না হোক, এ শব্দ তাদের অতি পরিচিত!
তাহলে জার্সি হিলের রহস্যটা কি? কেন সেখানে তারা হারিয়ে যেত? যেসব সময়ে তারা হারিয়েছে সেসব সময়ে জার্সি হিলে প্রবল বাতাসের আনাগোনা ছিল। যা সেই শব্দ বা সিগন্যালটিকে শোনা মুশকিল করে দিয়েছিল পায়রাদের জন্যে। কিন্তু ১৩ আগস্ট জার্সি হিলে বাতাস চলাচল স্বাভাবিক ছিল এবং তারা খুঁজে পেয়েছিল নিজ ঘর। এই হচ্ছে হোমিং পায়রাদের রহস্য!
৩) সাগরে অতিমানবীয় শব্দ!
রহস্য: ১৯৯৭ সালে প্যাসিফিক জুড়ে খুব জোরে, লো ফ্রিকোয়েন্সির একটি শব্দ শোনা যায়। পানির নিচের লিসেনিং স্টেশনগুলো ৫০০০ কিলোমিটার দূরত্বে শুনেছিল অদ্ভুত রহস্যময় শব্দটি। গা ছমছমে ভয় জাগিয়ে দেওয়া। যেন কোন হিংস্র প্রানীর আর্তচিৎকার! এ কারনে অনেকেই সাজেস্ট করেছিল কোন অজানা পশুর শব্দ ছিল সেটি। সেই পশুটির আগমন অন্যকোন গ্রহ থেকে হতে পারে এমন জল্পনাও তৈরি হয়েছিল। আসলেই কি তাই?
ব্যাখ্যা: আসল কারনটি খুবই সরল। ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড এটমোসফেয়ারিক এডমিনিস্ট্রেশনের গবেষকেরা সেটিকে কোন পশুর শব্দ মানতে নারাজ ছিল বরাবরই। একপর্যায় তারা আবিষ্কারও করে ফেলেন যে এন্টার্টিকার কাছে আইসবার্গ ভাংঙার কারনে শব্দটি তৈরি হয়েছিল। ফ্যান্টাসি পছন্দ করেন যারা তারা এমন সহজ ব্যাখ্যায় যারপরনাই হতাশ হয়েছিলেন!
৪) কোন অলৌকিক শক্তিতে পিরামিড তৈরি হয়েছিল?
রহস্য: অনেকদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করা হত শুধু মানব শক্তিতে পিরামিড তৈরি সম্ভব নয়! নিশ্চই কোন এলিয়েনের সাথে সম্পর্ক ছিল মিশরীয়দের। কেননা কোন আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া এত ভারী ভারী মূর্তি ও পাথর যার ওজন প্রায় ২.৫ টন তা মরুভূমিতে টানা বা সরানো সম্ভব না কেবল বাহুর জোরে। আসলেই সেভাবে পিরামিড তৈরি করতে হলে যে পরিমান লোকবল বা সময় লাগত তাতে পিরামিড শেষ পর্যন্ত তৈরি হতো কিনা সন্দেহ। তো এলিয়েন কিছু সাহায্য করেছে নিশ্চিত! তাই কি?
ব্যাখ্যা: আসল ব্যাখ্যাটি আসলে পানির মতো সহজ। পানিই যে ব্যবহৃত হয়েছিল! বিশাল বিশাল স্লেজগাড়ীতে পাথরগুলোকে টেনে নেবার সময়ে বালুতে পানি ঢালা হতো যা স্লাইডিং ফ্রিকশন কমিয়ে টানার কাজটি খুবই সহজ করে দিত। এই ট্রিকটি ব্যবহার করে মিশরীয়রা শ্রমিক সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিল!
২০১৪ সালে আমস্টারডাম ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা এই রহস্যজট খোলেন। একটি প্রাচীন মিশরীয় সমাধিতে একটি ছবি পাওয়া যায় যা ১৯০০ বি.সি.র ধারনা করা হয়ে থাকে। সেই ছবিতে দেখা যায় মিশরীয় শ্রমিকেরা স্লেজে করে একটি ভারী মূর্তি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং স্লেজের সামনে একজন মানুষ পানি ঢেলে যাচ্ছে বালুতে। এই পানির মতো সহজ কারনটি জানতে কত যুগ অপেক্ষা করতে হলো! এটি সেই প্রশ্নটিকে আবার দাড় করিয়ে দেয়, প্রাচীনকালে মানুষেরাই কি বেশি আধুনিক ছিলেন?
৫) মৃত্যু উপত্যকার চলমান পাথর!
রহস্য: পূর্ব রহস্যে ২.৫ টন পাথর মানুষ কিভাবে টানত তা ভাবা হচ্ছিল। এই রহস্য আরোই জটিল! ৭০০ পাউন্ড পাথর নিজে নিজেই সরে যাবার রহস্য! ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার একটি মরুভূমি যা পৃথিবীর অন্যতম উষ্ণ স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ১৯৪০ সাল থেকে মানুষ ভেবেই যাচ্ছিল কিভাবে এই মরুভূমির ভারী ভারী পাথরগুলো নিজে নিজে সরে যায় এবং পিছে লম্বা চিহ্ন রেখে যায় বালুর মধ্যে! বালুতে কেবলই পাথর সরার লম্বা চিহ্ন। কোন মানুষ বা প্রানীর পদচিহ্ন কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। নিশ্চই পাথরগুলোর ওপরে ভূতের কোন আছর হয়। নয়তো কিভাবে এমন মিরাকেল সম্ভব?
ব্যাখ্যা: ২০১১ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকেরা অবশেষে এই রহস্যজট খুলেছিলেন। ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিস তাদেরকে সেই পাথরগুলোতে কোন কাঁটাছেড়া করতে দিতেন না। সেজন্যে তারা একই সাইজের ১৫ টি পাথর এনে সেই মরুভূমিতে রেখেছিলেন জিপিএস সিস্টেম সংযুক্ত করে। দু বছর গবেষনা করার পরে তারা ইউরেকা বলে উঠলেন। শীতকালে খুব পাতলা বরফ জমে যেত মরুভূমি তলে। আর সূর্যে সে বরফ গলে ছোটখাট পুকুরের মতো হয়ে যেত। বাতাস প্রবল ধাক্কায় গলে যাওয়া বরফ বা পানির প্রবাহ সরিয়ে নিয়ে যেত এবং স্রোতময় পানির ধাক্কা পাথরগুলোকে টেনে নিয়ে যেত। অল্প পানি ও হালকা বাতাসই হচ্ছে ভূতের আছরের পিছের আসল রহস্য! তবে এ পাথরগুলো খুবই ধীরে ধীরে সরে, খালি চোখে দেখা যায় না এমনভাবে। একটা লম্বা সময় পরে পরে পর্যবেক্ষন করলে বোঝা যায় কি ভীষন পরিবর্তন হয়েছে অবস্থানে। আবারো সেই সরল পানির যুক্তিতে জটিল রহস্যে মুক্তি!
বাকি পাঁচটি বৃহৎ রহস্য পরের কিস্তিতে দেওয়া হবে। এ পর্ব ভালো লেগেছে আশা করি।
সূত্র: অন্তর্জালের নানা অলিগলি!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৭