ভীষন ইমপর্ট্যান্ট একটা টপিক নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি আজ। ব্রেস্ট ক্যান্সার ও এর ভয়াবহতা নিয়ে আমি কানাডায় স্কুলে থাকাকালীন সময়েই জেনেছিলাম। আজকে তা শেয়ার করব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১০) সমকামিতা ১৮++
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১১) - কিশোরিবেলায় কানাডার প্রথম ভালোলাগা - এক গ্রিক দেবতারূপী সুদর্শন কানাডিয়ান ছেলে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১২) - বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে এবং আমার স্কুল জীবনে তার প্রভাব
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৩) - কানাডায় বিয়ে, লিভ টুগেদার, ডিভোর্স এবং কিশোরি আমি (১৮+)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৪) - বাংলাদেশীদের বিয়ে ভাবনা নিয়ে বিদেশীদের দৃষ্টিকোন এবং আমার নারী জীবন
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৫) - মায়ের বয়ফ্রেন্ড ও অত্যাচারিত মেয়েটি এবং অবাক, অসহায় আমি (কঠিনভাবে ১৮++)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৬) - পশ্চিমি অনেক নারীর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নীরবে সহ্য করার কারন এবং বোকা আমি
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৭) : কানাডায় আমার প্রথম হ্যালুইন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে vs এক আবেগী জাতির পাগলামি
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৮) : পশ্চিমের গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড কালচার vs মফস্বলের প্রেম এবং চমকে যাওয়া আমি!
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৯) : কানাডিয়ান কৈশোর জীবনের কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা এবং মফস্বলের বোকা মেয়েটি
কানাডার স্কুলে একদিন (পর্ব ২০) - জানি না আজকের পর্বের নাম কি হওয়া উচিৎ? অনেক ভেবেও কোন নাম খুঁজে পাইনি!
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ২১) : পশ্চিমি কালচারে নারী পুরুষের অবাধ ইনটিমেসি এবং রক্ষনশীল সমাজের স্তব্ধ আমি! (১৮++)
আমার স্কুল বাসা থেকে পনেরো মিনিটের পায়ে হাঁটার পথ ছিল। আমাদের বেশ লম্বা একটা লাঞ্চ ব্রেক হতো। আমি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আবার স্কুলে চলে যেতাম শেষের ক্লাসগুলোর জন্যে। ভীষন রেগুলার ছাত্রী ছিলাম, কখনো লেইট করতাম না। একবার নরমালি লাঞ্চ করতে গিয়েছি। খেয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছি, আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। ক্লাস শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে বেড়িয়ে গেলেই হবে। ঘড়িতে দেখছি ১১:৩৫ বাজে, ভাবলাম বেড়িয়ে পরি। ১২ টায় ক্লাস। যেতে যেতে নিজের হাতঘড়িতে হঠাৎ চোখে পড়ল, দেখি প্রায় বারটা বাজে! মাকে বললাম, মাআআ একি? দেয়াল ঘড়ি আর আমার ঘড়ির সময় আলাদা! মা বলল, "ওহো! এই ঘড়িটা তো স্লো হয়ে গিয়েছে অনেক, তোকে বলতে ভুলে গিয়েছি। তুই দৌড়া, নাহলে লেইট হয়ে যাবি।"
আমি তো পরিমরি করে দৌড়। আমার পারফেক্ট এটেনডেন্স রেকর্ডে লাল কালি পরতে দেওয়া যাবেনা কোনভাবেই।
১১:৫৭ - আমি চওড়া রাস্তার একধার দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে নেবারহুডের সারিবদ্ধ এপার্টমেন্টগুলোকে পেরিয়ে মেইন রাস্তায় আসলাম। সেখান থেকে ডানে টার্ন করে ছবির মতো সুন্দর উঠানওয়ালা কিছু বাড়ি পেরিয়ে একটা মাঠে আসলাম।
১১: ৫৮- সেই বিশাল মাঠের প্রকান্ড আকাশছোঁয়া গাছগুলো পেরিয়ে মাঠসংলগ্ন ছোটখাট ঢালুমতো পাহাড়টায় আসলাম। ঢালুর দুপাশে সুন্দর বুনো হলুদ ফুল ফুটে থাকত। অন্যদিন পা টিপে টিপে ঢালুটা পার করলেও সেদিন লাফিয়ে দৌড়ে পার করছিলাম বলে পা হড়কে পরার মতো অবস্থা হলো বেশ কবার। পার করে মনে হলো আজ প্রিয় হলুদ ফুলগুলোর গায়ে হাত বোলানো হয়নি। আবার পিছে হড়বড়িয়ে গিয়ে নিয়মিত কাজটা করে ছুটতে ছুটতে ঘড়ি দেখলাম।
১১: ৫৯ - স্কুলটাকে দেখতে পাচ্ছি। দুপাশে সুন্দর করে ছাঁটা ঘাসময় মাঠ আর মাঝখানে সরু পথ। স্কুলের চারিপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের বেড়াজাল। প্রকৃতি মায়ের অপরূপ এক ভিটা যার ভূমি, ও দেয়াল সবুজ আর ছাদটি নীল, ঝকঝকে মুক্ত আকাশ! আরেকটু ছুটলেই পৌঁছে যাব স্কুলে। ছুটতে ছুটতে কানে আসল আমার নাম নিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে কিছু ছেলের কন্ঠ, "গো গো! ইয়ে! উই আর উইথ ইউ!" আমি পিছে তাকিয়ে দেখি থমাস ও তার বন্ধুরা বেশ দূরে। গত পর্বে ছোট একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে থমাসের সাথে আমার শত্রুতা বেঁধে যাবার কাহিনী বলা হয়েছে। ওরা সবসময়েই লেইট হয়, হেলেদুলে হেঁটে আসছে। কোন ব্যাপারই না। আমার তো তা না। আমার দৌড় দেখে ওরা একে অপরের গায়ে পরে হেসে যাচ্ছে। আমি লজ্জা পেয়ে দৌড় থামিয়ে জোড়ে হাঁটা শুরু করলাম।
১২:০০ - ক্লাসের দোড়গোড়ায় পা পরল আমার। আমি হাঁফ ছেড়ে চেয়ারে বসে পরলাম। যাক লেইট হয়নি! জাস্ট অন টাইম! প্রায় ছুটে যাওয়া একটা ট্রেইন লাফিয়ে ধরার মতো একটা আনন্দ মনের মধ্যে হচ্ছিল আমার।
হঠাৎ করে মনে হলো। এইরে! ব্যাগ তো লকারে রাখা! লাঞ্চ করতে যাবার সময় ব্যাগ লকারে রেখে যেতাম। দৌড়ে ব্যাগ আনতে গেলাম, ব্যাগ এনে ক্লাসে ঢুকতে যাব তখন টিচার বললেন, লেইট স্লিপ নিয়ে এসো। প্রথমবার জীবনে লেইট হলাম! ইশ! ঘড়ি! আমি হতাশ, অসহায়ের মতো অফিসে ছুটলাম।
কানাডায় কোন স্টুডেন্ট লেইট হলে মেইন অফিসে রিসিপশনিস্টের কাছে যেতে হয়। তাকে বলতে হয় কেন লেইট হয়েছে? এরপরে লেইট শিটে সাইন করতে হয়, এভাবে ওদের রেকর্ড থাকে কে কতবার লেইট করল। আর রিসিপশনিস্ট একটা লেইট স্লিপে এক্সিউজড লিখে দিলে সেটা এনে টিচারকে দেখাতে হয়। ব্যাস এই। কোন বকাবকির ব্যাপার নেই। তবে বেশি লেইট হতে থাকলে বাড়িতে ফোন যায় স্কুল অফিস থেকে। এক দুবারে কিছু হয়না।
লেইট স্লিপ নিতে গেলাম। আমার বিমর্ষ চেহারা দেখে সুইট, বৃদ্ধা রিসিপশনিস্ট বললেন, "ডার্লিং ইটস ওকে! তুমি কখনো লেইট হওনা!" পানসে হাসিতে মাথা নাড়াতে নাড়াতে পাশে চোখ পরল। এরিক দাড়িয়ে! ও স্কুলের ভয়াবহ সুদর্শন, পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে। ও নিজেও আমারই মতো কখনো লেইট করেনা। ওর মুখের এক্সপ্রেশনে যেন আয়না দেখতে পেলাম। বিমর্ষ! রিপোর্ট কার্ডে লেইটের ঘরে ১ লেখা থাকবে, এর চেয়ে বড় মন খারাপ করা বিষয় তখন আমাদের দুজনের জীবনে হতে পারত বলে মনে হয়না। পাঠক, এখন হাসি পেলেও তখন আসলেই এটা বিরাট ব্যাপার মনে হচ্ছিল। কি ভীষন এক কাকতাল! দুটো মানুষ যারা কখনো লেইট করেনা, একই দিনে, একই সময়ে লেইট করল! ও আমার নাম নিয়ে হাই বলল মনমরা সুরে, আমিও বললাম। সাইন করে যে যার ক্লাসে।
সেই ইংলিশ ক্লাসের টিচার স্কুলে নতুন জয়েন করেছিলেন। তিনি একজন কানাডিয়ান ইয়াং নারী ছিলেন। বেশ হাসিখুশি, তবে একটা ভাবগাম্ভীর্যতাও ছিল। অন্যকোন টিচার হলে আমাকে এক দু মিনিটের কারনে কখনোই লেইট স্লিপ আনতে বলতেন না। আমি টিচারদের পছন্দের পাত্রী ছিলাম। আর অন্যকোন টিচার অবাক হতেন আমার লেইট দেখে, ইনি তাও হননি। আমাকে সেভাবে জানতেনই না যে!
আমার লেইট স্লিপটা হাসিমুখে নিলেন। আমি নিজের সিটে এসে বসে পরলাম। থমাস ও ওর বন্ধুরাও হাজির ততক্ষনে। ওদের বললেন, "গাইস, তোমার প্লিজ একটু টাইমে আসার চেষ্টা করো। অনেকবার লেইট করে ফেলেছ। আর কবার হলে প্যারেন্ট কল যাবে!" থমাস আমার দিকে ইশারা করে বলল, "হোয়াই শি গেটস অল দ্যা স্মাইল, এন্ড উই গেট অল দ্যা লেকচার? শি ওয়াজ অলসো লেইট!" টিচার বললেন, ও তোমাদের মতো এতবার লেইট করেনি। থমাস বলল, "ও প্রতিদিন কোন না কোন ক্লাসে লেইট করেই করে!" আমি হা হয়ে গেলাম, কেউ এত বড় মিথ্যে কি করে বলতে পারে? তখন একটা কানাডিয়ান মেয়ে বলে উঠল, "থমাস ইজ লায়িং!" বাকি সবাইও সাপোর্ট করল আমাকে।
থমাস আমার বিরক্তিভরা চেহারা দেখে শয়তানিপূর্ণ হাসি দিল। আমাকে বিরক্ত করতে পেরেছে, ব্যাস এতেই ওর শান্তি। ও নিজের সিটে যাবার সময় আমাকে পাস করতে করতে মেকি হাসি দিয়ে ন্যাকা গলায় বলল, "আর ইউ ম্যাড এট মি? ডোন্ট বি, আই এম আ নাইস গাই!" ও আমাকে রাগানোর মতো করে বলেছিল। কিন্তু আমি হেসে ফেললাম জোড়ে। ও নাকি নাইস গাই! এটা শুনে আমার হাসি থামেই না। কোথায় রাগ রাগ মুখ করে রাখব! আমি হাসি থামানোর চেষ্টাও করছি, এমন একটা খারাপ ছেলের কথায় হাসা ঠিক হচ্ছেনা। একদমই ওকে পাত্তা না দেওয়া ভাবলেশহীন মুখ রাখতে হতো। কিন্তু কান্না ও হাসির নিয়ম হচ্ছে থামানোর চেষ্টা করলে আরো বাড়ে! আমারও তাই হলো। আমার হাসি অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হলো। আরেকবার কোন প্ল্যান ছাড়াই ওকে সবার সামনে অপদস্থ করে ফেললাম! এন্ড দ্যা ব্যাটেল কন্টিনিউড...
আরেকদিনের কথা, সেই ইংলিশ ক্লাসে বসে আছি। সেদিন সকালে হচ্ছিল ক্লাসটি। আমাদের স্কেডিউল রোটেট করত। একই ক্লাস একেকদিন একেক সময়ে হতো। কানাডায় স্কুলে মরনিং এনাউন্সমেন্ট হয়। মরনিং এনাউন্সমেন্ট যখন হয় সবাই চুপ করে মন দিয়ে স্ট্যাচু হয়ে শোনে। এটা মেইন অফিস থেকে মাইক নিয়ে রিসিপশনিস্ট করেন। ভীষন গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকে সাধারনত। কোন ক্লাব, স্পোর্ট এভেন্ট, স্কুল প্রোগ্রাম, এওয়ার্ড/একমপ্লিশমেন্টস সহ স্কুলের যাবতীয় জরুরি খবর । আমাদের স্কুল স্পোর্টস এ খুব ভালো ছিল। নিত্য খবর আসত যে এই গ্রেডের ছেলেরা বা মেয়েরা কোন খেলায় সেই স্কুলকে হারিয়েছে। আমরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠতাম প্রতিটি ক্লাসে। সেই ৫/১০ মিনিট এর মরনিং এনাউন্সমেন্ট সবার জন্যে বন্ডিং পিরিয়ড ছিল। স্কুলে কোথায় কি হচ্ছে জেনে একে অপরকে সাপোর্ট করা।
সেদিন এর এনাউন্সমেন্টে বলা হলো যে আগামি কাল ব্রেস্ট ক্যান্সার এওয়ারনেস মান্থ উপলক্ষ্যে স্কুলের সকল টিচার, স্টুডেন্টকে গোলাপি জামা পরে আসার অনুরোধ করা হচ্ছে স্কুল চ্যারিটি ক্লাব থেকে।
আমার ইংলিশ টিচার এনাউন্সমেন্ট শেষে বললেন, "ইউ অল ইয়াং লেডিস শুড বি এওয়ার অফ ব্রেস্ট ক্যান্সার। তোমাদের মধ্যে অনেকেই এর মধ্য দিয়ে যেতে পারে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বয়স হলে বাড়তে থাকে। আই হ্যাভ রিলেটিভস/ফ্রেন্ডস হু হ্যাভ গন থ্রু দিস। হ্যাভ এনি অফ ইউ?" অনেকেই দেখলাম হাত তুলল। বেশ অবাক হলাম। এর রেইট তো তাহলে বেশ হাই! উনি আরো বলতে লাগলেন, "ব্রেস্ট ক্যান্সার শুধু নারীদের না পুরুষেরও হতে পারে তবে বেশ রেয়ার। নারীরাই এই হুমকির সম্মুখীন হয় ফর মোস্ট পার্ট। গবেষনায় দেখা গিয়েছে কানাডায় প্রতি ১০ জনে একজন নারী ব্রেস্ট ক্যান্সারের শিকার হবে। মানে এই রুমে আমরা যতো মেয়ে আছি তার মধ্যে কারো না কারো যেতে হবে ব্যাধিটির মধ্য দিয়ে। এজন্যে সচেতনতা..." থমাস! বাক্য শেষ না করেই উনি থমাসের দিকে তাকালেন, বললেন, "আমি খুব জরুরি কথা বলছি। তুমি টেক্সটিং পরেও করতে পারো। থমাস বলল, "হেই ডিডন্ট ইউ জাস্ট সে মোস্টলি উইমেন গো থ্রু দিস? হোয়াই শুড আই কেয়ার? আমি শুনে কি করব?" আমি শিক্ষকের সাথে ওর অসংযত আচরনে হা হয়ে যেতাম। প্রতিদিনই এমন কিছু করত আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। টিচার মুচকি হেসে বললেন, "ইউ নো হোয়াট? আমি বিশ্বাস করি ব্রেস্ট ক্যান্সার নারীদের বেশি হলেও আসল সচেতনতা পুরুষের দরকার। হাওএভার, এনাফ এবাউট দ্যাট, তোমরা সবাই ম্যাকবেথ বের করো। আমরা চ্যাপ্টার ৭ এ ছিলাম।"
ওনার "আমি বিশ্বাস করি ব্রেস্ট ক্যান্সার নারীদের বেশি হলেও আসল সচেতনতা পুরুষের দরকার" অনেক স্ট্রং একটা কমেন্ট ছিল। টিচারের ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে বলা কথাগুলোয় প্রভাবিত হয়ে আমি গোলাপি সালোয়ার কামিজ পরে গিয়েছিলাম স্কুলে পরের দিন। গিয়ে দেখি অনেকের টিশার্টে পিংক রিবন, ব্রেস্ট ক্যান্সার বিষয়ক স্লোগান লেখা। অনেকে নরমাল অন্য রংয়ের ড্রেসেই এসেছিল। জায়গায় জাগয়ায় ছোটখাট স্টল করে ভলান্টিয়ারি স্টুডেন্টদের রিবন, ব্রেসলেইট বিক্রি করতে দেখলাম। এসব অর্থ ব্রেস্ট ক্যান্সার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে যাবে! অনেক টিচারই ক্লাস শুরুর পরে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে কিছু কথা বললেন সেদিন। সবমিলিয়ে এলাহি আয়োজন। ওদের এই প্রত্যয়ী উদ্যোগ আমার খুবই ভালো লেগেছিল।
গল্প এবারে মি: এম এর ক্লাসে নিয়ে আসি। উনি E.S.L. টিচার ছিলেন, এবং আমি তার আন্ডারে টি.এ. ছিলাম। মধ্যবয়স্ক কানাডিয়ান, নিপাট ভদ্রলোক, দুটো টিনএজ ছেলে ও বউ নিয়ে সুখের সংসার। আমার অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল ওনার সাথে। সেই ক্লাসে আমার প্রানের বান্ধবী ব্রাজিলের জেও ছিল। তিনজনে মিলে অনেক আনন্দের সময় কাটিয়েছি একসাথে।
একদিন মি: এম ক্লাসে এসে আমাদের বললেন "তোমাদের জন্যে একটা গুড নিউজ আছে!" আমি এবং জে একসাথে দুটো আংগুল ওনার দিকে তাক করে বলে উঠলাম, "আপনি প্রেগন্যান্ট?" বলে সেকি খিলখিল হাসি আমাদের! অসাধারন সেন্স অফ হিউমারের অধিকারি মি: এম একটুও বিব্রত না হয়ে বললেন, "সেটাও, তবে আরেকটা আছে!" আমরা দুজন আবারো খিলখিল করে হেসে উঠলাম! উনি বললেন, "আমার ওয়াইফকে দেখার ইচ্ছে পোষন করেছিলে। হয়ত তা হবে জলদিই। ও স্কুলে আসছে। পি.এইচ.ডি র থিসিস লেখার কাজে ওকে নানা স্কুলের প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে হচ্ছে। কালকে আমাদের স্কুলে আসবে।" আমি আর জে একে অপরের দিকে এক্সাইটেড হয়ে তাকালাম। আমরা ভীষন ভাবে মিসেস এমকে দেখতে চাইতাম। এত ভালো একটা হাসব্যান্ড ওনার! জে তো বলত, আমি টিপস নেব ওনার কাছে দেখা হলে! আমি মাথা নাড়তাম উচ্ছাসে।
দিনটি এসেই গেল। মি: এম একটু পরে পরে দরজা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছেন। ক্লাসে তার মন নেই। অপেক্ষা করছেন কখন মিসেস এম প্রিন্সিপালের সাথে মিটিং শেষ করে আসবেন! আমি আর জে ইশারা করে হাসছি ওনার আকুলতায়। জের সেদিন একটা এসাইনমেন্ট প্রিন্ট করতে হতো। তাই মি: এমের কাছে পারমিশন নিল, "আমি কি প্রিন্ট করাতে লাইব্রেরীতে যেতে পারি?" আমাদের স্কুলের বেশিরভাগ প্রিন্টিং লাইব্রেরীতেই হতো। আমি মি: এমকে বললাম, আমিও যাই ওর সাথে? উনি দুষ্টু হাসিতে জিগ্যেস করলেন, "তোমারও প্রিন্ট করাতে হবে?" আমি বললাম, না। কিন্তু টি.এ. হিসেবে দায়িত্ব আছে না? ওকে আমি একা প্রিন্ট করতে কিভাবে ছেড়ে দেই? যদি হারিয়ে যায়? বলে দুষ্টু করে হাসলাম। মি: এম বললেন, "হুমম যাও, দায়িত্ব পালন করো।" পারমিশন পেয়ে আমি আর জে হাত ধরাধরি করে লাইব্রেরীর দিকে যাচ্ছি। তখন মি: এম বললেন, "তোমরা যখন যাচ্ছই মেইন অফিসে প্রিন্সিপালের রুমে উঁকি দিয়ে আমার ওয়াইফকে দেখে আসতে পারো। ও ওখানেই আছে।"
আমরা প্রিন্ট করতে করতে মি: এম এবং তার ওয়াইফকে নিয়ে অনেক কথা বললাম। তারা মেইড ফর ইচ আদার, মি: এম কত ভালো হাসব্যান্ড এসব। প্রিন্ট শেষে মেইন অফিসে গেলাম, প্রিন্সিপালের রুমের দরজা ভেরানো, কিছুই দেখতে পেলাম না। হয়ত মিসেস এম মিটিং এ ছিলেন। আমরা ক্লাসে ফিরে এসে দেখি মি: এম দরজার কাছে আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে। ইভেন আমাদেরকে দেখে রুম থেকে কিছুটা বেরিয়েই আসলেন। বললেন, "দেখেছ ওকে?" আমি অবাক! এত ছটপটানি! বাপরে বাপ! আমি বললাম যে দেখা সম্ভব হয়নি। মি: এম হতাশ হলেন। আমি বললাম, আপনি ওনাকে কত ভালোবাসেন! মি: এম খুব গর্ব করে বললেন, "ক্যান ইউ বিলিভ? আফটার সিক্সটিন ইয়ারস অফ ম্যারেইজ!"
সেদিন মিসেস এম আর আমাদের ক্লাসে আসেননি। তিনি মি: এমকে ডিস্টার্ব করতে চাননি তার কাজে। নিজের কাজ শেষ করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। সেটা টেক্সট করে মি: এমকে জানিয়েছিলেন, এবং মি: এম আমাদের জানালেন। আমাদের আর দেখা হলোনা ওনাকে!
জে সেদিন মি: এমকে বলেছিল, "অনেক পুরুষ আছে যারা সংগীনি প্রেগন্যান্ট হয়ে ওয়েট গেইন করার পরেই এট্রাকশন হারাতে থাকে। আর আপনি এখনো কত ভালোবাসেন!" মি: এম বললেন, "আমার কাছে তো ওকে সবচেয়ে সুন্দর লাগত যখন ও জ্যাক (ওনার প্রথম সন্তান) এর মা হচ্ছিল। ভীষন কৃতজ্ঞ মনে হতো নিজেকে ওর কাছে। এত অমূল্য একটা উপহার কত কষ্ট করে দিচ্ছে ও আমাকে!" আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে শুনতাম। হি ওয়াজ এভরিথিং এনি ওম্যান কুড ওয়ান্ট ইন আ ম্যান! জাস্ট পারফেক্টলি পারফেক্ট!
এই কথার সূত্র ধরে ব্রেস্ট ক্যান্সার পর্যন্ত আলোচনা হলো। উনি বললেন, "তবে তোমার কথা ঠিক। এমন অনেক পুরুষ আছেন যাদের কাছে মেয়েদের লুকস অতিমাত্রায় ম্যাটার করে। আমি তখন অন্য শহরে চাকরি করতাম। সেখানে আমার এক কলিগ নিজের ওয়াইফকে ডিভোর্স দিয়েছিল শুধুমাত্র তার ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ায়।" আমি বললাম, হায় আল্লাহ! তখন তো ওনার আরো পাশে থাকার দরকার ছিল। উনি বললেন, "এক্সাক্টলি, আমিও তাই বিশ্বাস করি। কিন্তু..." কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, "জানো একটা এড দেখছিলাম। মিল্কের, একটা স্বল্পবসনা মেয়ে মিল্ক খাচ্ছে, সেই মিল্ক তার শরীর গড়িয়ে পরছে। আমি বুঝতে পারলাম না মিল্কের এডে এমন কন্সেপ্ট এর কি দরকার ছিল? মেয়েদেরকে এতটাই পন্যরূপে প্রেসেন্ট করা হয় যে পুরুষ তো দূরের নারীরাই ভুলে যায় দ্যাট ইটস দেয়ার ব্রেইন পাওয়ার নট ব্রেস্ট সাইজ দ্যাট ম্যাটারস!" আমি সজোরে মাথা নাড়লাম সহমত পোষন করে। আসলেই টিভি, ম্যাগাজিন, বিলবোর্ড সব জায়গায় মেয়েরা নিজেদের উন্নত বক্ষ প্রদর্শন করে দাড়িয়ে রয়েছে। যেন এটাই নারীত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক! আমরা এই বিষয়টি নিয়ে সেদিন অনেক আলোচনা করেছিলাম, আমি বেশ মনমরাই হয়ে গেলাম সবকিছু ভেবে। কেমন যেন অদ্ভুত শুন্যতা অনুভব হলো বুকের ভেতরে!
ব্রেস্ট ক্যান্সার - পশ্চিম ও বাংলাদেশ: আজকাল নারীদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সার রিস্ক ও রেইট অনেক বেড়ে গিয়েছে। ব্রেস্ট ক্যান্সারে আরলি ডিটেকশন খুবই জরুরি। দেরী করলে পেশেন্ট মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এজন্যে ঘটা করে বিশ্বব্যাপি ব্রেস্ট ক্যান্সার এওআরনেস মানথ উদযাপিত হয় অক্টোবার মাসে। এই মাস ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং এ গুরুত্ব আরোপ করে। স্ক্রিনিং এর মানে কোন ধরনের সিম্পটম ফিল না করলেও রেগুলার চেকআপ করাতে থাকা। এতে ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রিভেন্ট হয়না, তবে জলদি ডিটেক্ট করা যায়। আরলি ডিটেকশন ইজ দ্যা কি টু ট্রিট ব্রেস্ট অর এনি টাইপ অফ ক্যান্সার। পশ্চিমে যেখানে কোন সিম্পটম ছাড়াই সেইফ থাকার জন্যে চেকআপ করার সচেতনতা তৈরি হয়েছে নারীদের সেখানে আমাদের দেশে রোগের হাই স্টেজেও সুষ্ঠ চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছেনা অনেক ক্ষেত্রে। এখনো আমাদের দেশে শহর ভেদ করে দেশের কোনায় কোনায়, গ্রামাঞ্চলে নারীদের শিক্ষা ও সচেতনতার জায়গা তৈরি হয়নি। প্রত্যন্ত কোন গ্রাম, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান নিয়েই ভাবতে বেলা বয়ে যায়, সেখানে ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে আলোচনা হয়ত বিলাসিতা। কিন্তু এর ভীষন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অনেক নারীই পরিবার ও সমাজের লজ্জায় এসব রোগ লুগিয়ে যান। কাউকে বলা কি করে যায়! অসুখটা যে ব্রেস্টে! এটা নিয়ে তো কথা বলাও উচিৎ নয়। এমন সব কুসংস্কারের দরুন অনেক নারী লেইট ট্রিটমেন্টে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
ব্রেস্ট ক্যান্সার যে শুধু শরীরকে ক্ষয় করে তা নয়। এই অসুখটা মনকেও ভেংঙে গুড়িয়ে দেয়। নারীদের ব্রেস্ট সাহিত্যে, কাব্য, চিত্রে নারীত্বের প্রতীক হিসেবেই ধরা হয়। আমি যখন সদ্য কিশোরি হয়েছিলাম ওড়না পরা শুরু করি। ওড়না সামলাতে কষ্ট হতো প্রথম প্রথম। একটু পিছলালেই মা চোখ কড়া করে তাকাতেন। ছোট আমিও নারীত্বের ইনস্টিংক্টে বুঝে গিয়েছিলাম ব্রেস্ট মেয়েদের বেশ গোপনীয়, আকর্ষনীয় অংগ। খারাপ ছেলেরা ওড়না ভেদ করেও গেলার চেষ্টা করে। ইহাকে সংরক্ষন করিতে হয়। এভাবেই মেয়েরা দেখতে শেখে পুরো বিষয়টাকে। কিন্তু কত ভয়ংকর সব রোগ বাসা বাঁধতে পারে এই অতি সামলে রাখা অংগে তার খবর অনেক মেয়েই রাখেনা। অনেক মেয়েই ভাবে পুরুষ সংগীটি হয়ত ছেড়েই দেবে। একটার পরে একটা কেমোথেরাপি, নারীত্বের সিম্বল মনে করা অংগটি হারানোর যন্ত্রনা, মৃত্যুর সম্ভাবনা এবং সব ছাপিয়ে দিনে দিনে ভালোবাসার মানুষটির কাছে গুরত্ব কমে যাবার ভয়! শরীর ও মন ভেংঙে পরে ব্রেস্ট ক্যন্সারে আক্রান্ত নারীটির। পুরুষ সংগীটির সাপোর্ট এ সময়ে মেয়েটির খুবই দরকার। আমার সেই টিচারের কথাটা আবার রিপিট করে বলি, ব্রেস্ট ক্যান্সার মেইনলি নারীদের হলেও, সচেতনতায় পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। নিজের সংগীনির পাশে প্রতিটি কদমে থাকতে হবে, তাকে বোঝাতে হবে ভালোবাসা একই আছে, থাকবে। ভালোবাসার বাস মনে, শরীরে নয়! ব্যাস এটুকুই! একজন নারীর জন্যে মনের জোর করে এই তীব্র মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রনা জয় করা সম্ভব শুধুমাত্র জীবনসংগীর একটু ভালোবাসা, ও যত্নে!
ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব পশ্চিমেও ভীষণভাবে ছিল। তবে ওদের সচেতনতা যেদিন থেকে বাড়া শুরু করেছে ব্রেস্ট ক্যান্সার সারভাইভাল রেইটও বাড়া শুরু করেছে ড্রাসটিক্যালি। কানাডায় আমার পরিচিত অনেকে রয়েছেন যারা ক্যান্সার সারভাইবার। ক্যান্সার যেন আর কোন মরনব্যাধি নয় এখানে! উন্নত রিসার্চ আবিষ্কার করছে নিত্য, নতুন চিকিৎসা এবং ভীষন রকমের সচেতনতায় ধীরে ধীরে ক্যান্সারকে জয় করছে পশ্চিমা বিশ্ব। দু চোখ ভরে একই স্বপ্ন আমি দেখি বাংলাদেশকে নিয়ে। সরকারী ও বেসরকারী নানা উদ্যোগে এদেশের সকল নারী প্রয়োজনীয় শিক্ষা, সচেতনতা, সুষ্ঠ চিকিৎসা ও আপনজনদের ভালোবাসায় ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সমর্থ হবে সে আশায় শেষ করছি আজকের পর্ব।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৩