শিরোনামে যা লেখা তাই বর্ণনা করব। বেশ কিছু পাঠক এ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন প্রথম থেকেই। আমি লিখেই ফেললাম আজ। প্রচন্ড হাই ভোল্টেজের কিছু কালচার শক পেয়েছিলাম এ বিষয়ে। সেসব নিয়েই গল্প করে যাব এবং এ পর্বে বাংলাদেশের গল্প ঘুরেফিরে অনেকবার আসবে।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১০) সমকামিতা ১৮++
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১১) - কিশোরিবেলায় কানাডার প্রথম ভালোলাগা - এক গ্রিক দেবতারূপী সুদর্শন কানাডিয়ান ছেলে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১২) - বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে এবং আমার স্কুল জীবনে তার প্রভাব
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৩) - কানাডায় বিয়ে, লিভ টুগেদার, ডিভোর্স এবং কিশোরি আমি (১৮+)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৪) - বাংলাদেশীদের বিয়ে ভাবনা নিয়ে বিদেশীদের দৃষ্টিকোন এবং আমার নারী জীবন
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৫) - মায়ের বয়ফ্রেন্ড ও অত্যাচারিত মেয়েটি এবং অবাক, অসহায় আমি (কঠিনভাবে ১৮++)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৬) - পশ্চিমি অনেক নারীর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নীরবে সহ্য করার কারন এবং বোকা আমি
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৭) : কানাডায় আমার প্রথম হ্যালুইন, ভ্যালেন্টাইন্স ডে vs এক আবেগী জাতির পাগলামি
কাহিনী অনেক পিছে নিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের একটা ছিমছাম বাড়ির সাজানো ড্রয়িংরুমে। কাঠের কারুকাজ করা সোফাসেট, একটা সিংগেল খাট, চারকোনা টেবিল ঠিক ঠিক জায়গায় সাজানো। সোফায় বড়রা গম্ভীর মুখে আলোচনা করছেন এবং ছোটরা কার্পেটের ওপরে বসে বোর্ডগেম খেলতে খেলতে ফিসফিস করে গল্প করছে। আমিও একজন সেই ছোটদের মধ্যে। বড়দের আলোচনা কানে আসছে। বাবা বলছেন, "সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ফ্লাইট। এর আগে সব রিলেটিভদের একত্রিত করে চাইনিজে নিয়ে যাই। একটা গেট টুগেদার, আবার কবে আসা হবে তার তো ঠিক নেই!" ফুপি মানা করে উঠলেন, "না না ভাইয়া আপনি সবসময় খরচ করবেন কেন? আমার বাড়িতে সবাই আসবে, দেশীয় রান্না খাবেন। কবে আবার ঘরের খাবার পাবেন কে জানে?" অনেক আলোচনার পরে শেষ ডিসিশান কয়েকদিন পরেই আমার কাজিনদের বাড়িতে সব আত্মীয়দের ঘরোয়া গেট টুগেদার। আমাদের বিদায়ী দাওয়াত বলতে পারেন।
গেট রুগেদারে আমি শান্ত হয়ে বসে আছি। আমার সব রিলেটিভ ঢাকার হলেও আমি মফস্বলেই বেড়ে উঠেছি বাবার চাকরির সুবাদে। বেশ সরল, শান্ত, দুনিয়া না দেখা মানুষ। আমার ঢাকার কাজিনরা আবার নামী স্কুলে পড়া ইংলিশ জানা ছেলেমেয়ে। আমি যখন বাংলা/ভারতীয় ছবিতেই পরে ছিলাম ওরা হলিউডের নামিদামী মুভিগুলো নখদর্পনে রাখত। আমি বিটিভির মীনার কার্টুন, আলিফলায়লা পাগলের মতো দেখতাম আর ওরা ডিসনীর বিখ্যাত ইংলিশ কার্টুনগুলো দেখত। আমিতো সাবটাইটেল দেখেও অনেক শব্দ বুঝতাম না। পুল যে পুকুর হওয়ার সাথে সাথে একটা খেলাও সেটা ওদের কাছেই জেনেছিলাম। মফস্বলে টিচারদের কাছে শান্ত হলেও বান্ধবীদের সাথে কথার ফোয়ারা ছোটাতাম। কিন্তু "স্মার্ট" কাজিনদের সামনে একদম চুপ সেই প্রজাপতির পেছনে ছুটে চলা চঞ্চল আমি। ওরা যে আমাকে মফস্বলের আনকালচার্ড, ক্ষ্যাত মনে করে বুঝতাম হাভেভাবে। তাই একটু আড়াল করে এককোনে নীরবে বসে ছিলাম ওদের মজলিসে।
এমনসময় আমার দুষ্টু কাজিন ব্রাদার ও সিস্টার আমাকে ডেকে নিয়ে গেল নিজেদের রুমে। আমাকে বলল, "কানাডায় যাচ্ছিস, কিছু জানিস দেশটার সম্পর্কে?" আমি পতাকা, নায়াগ্রাফলস আরো কিসব বললাম। ওরা বলল, "হায় হায় তুই তো আসল জিনিসই জানিস না।" আমি জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। আমার বোন ড্রেসিংটেবিল থেকে তুলে একটা বিদেশী পাউডার হাতে ধরিয়ে বলল, "মোড়কটায় কিসের ছবি বলত?" আমি দেখি দুজন বিদেশী নর নারী অন্তরঙ্গভাবে ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে আছে। আমি খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম ওরা কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে। ওরা বলল, "কানাডায় স্কুলে এসব ওপেনলি হবে, বুঝলি? তোকেও করতে হতে পারে!"ওদের সিরিয়াস টোনে বলা কথাটা শুনে কিছুটা ভয় লেগে গেল আমার। কখনো কোন ছেলের হাতও ধরিনি, তাকালেই ওড়না ঠিক করতে শুরু করে দিতাম বিব্রত হয়ে। আমি এসব? ছি ছি! ওরা মজা পেয়ে বলল, "ভর্তি হতে এসব জানা লাগে কিন্তু ওখানে।" সেটুকু শুনে বুঝে গেলাম মজা নিচ্ছে দুজনে মিলে। এত বোকা ছিলাম না যে ভর্তি হতে এসব লাগতে পারেনা সেটা বুঝব না। বিরক্তিভরা চেহারা নিয়ে চলে গেলাম ফুপির কাছে গল্প করতে। ওরা নালিশ করব কিনা ভয় পেয়ে গেল, ইশারায় সরি বলল। আমি এমনিতেও নালিশ করতাম না, এসব বলতেও লজ্জা লাগত।
আমি সেদিন ক্ষনিক চমকালেও মনে মনে ওতটা ভয় পাইনি ওদের কথা শুনে। ভাবতাম রাস্তাঘাটে ওপেনলি হলেও পৃথিবীর সব দেশের স্কুলই কিছু ডিসিপ্লিন মেনে চলে। আমার এসব নিয়ে স্কুলে অন্তত কোন সমস্যা হবেনা। কিন্তু কানাডায় এসে বুঝলাম কাজিনদের কথা আংশিক সত্যি ছিল, স্কুলে সত্যিই এসব ওপেনলি হয়!
এবার কানাডায় ফেরত আসি। মনে পরে সেই প্রথমদিনের স্কুলের পর্বটা? সেখান থেকেই প্রায় শুরু করি। কয়েকদিনই হয়েছে স্কুলে। আমি অথৈ সাগরে পরে গিয়েছি। কোন ক্লাস কোনদিকে তাই ভুলে যাই, কাউকে জিগ্যেস করলে ইংলিশ বোঝেনা। কি করি আর না করি। এত আলাদা বর্ণ, দৈহিক গঠন, পোশাকের মানুষদের দেখে অবাক হয়ে যেতাম। যে আমি আড়ং এ ঢুকে কয়েকটা বিদেশী চোখে পরলেই হা হয়ে তাকিয়ে ভাবতাম এত সাদা! পাশে দাড়িয়ে থাকা মানুষটাকে ইশারা করে দেখাতাম, "ঔ যে বিদেশী!! কোন দেশের? বাংলাদেশ কি কাজে এসেছে?" কি কৌতুহল আর উত্তেজনা দু একটা বিদেশীতেই! সেই আমি যেদিকেই তাকাই কতধরনের মানুষ দেখি আর হকচকিয়ে যাই! এরকমই এক অসহায়ত্বে ভরা মনখারাপের সময়ে একদিন লবি দিয়ে আনমনে হেটে যাচ্ছি ব্রেকে। হঠাৎ চোখে পরল লকারের সাথে ঠেসে দুজন স্টুডেন্ট মগ্ন হয়ে লিপ কিস করছে! আমি দেখেই চোখ সরিয়ে নিলাম, আবার তাকালাম। না তাকানো যায়, না চোখ সরানো যায়! কি বিব্রতকর অবস্থা! হায় আল্লাহ! স্কুলে টিচারের রুমের কাছেই এসব! আমি কি দেখলাম, কেন দেখলাম?
কোনভাবে নিজেকে সামলে ছুটে সবচেয়ে কাছের দরজা দিয়ে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে গেলাম কিছুক্ষনের জন্যে। বারবার ভাবছিলাম এসব ওপেনলি হয় স্কুলে? স্কুলে? প্রথম সামনাসামনি এমন কিছু দেখে কেমন জানি শরীর ঝিনঝিন করে উঠেছিল। একটা অস্বস্তি ভরা লজ্জায় মিশে গিয়েছিলাম!
তখন মাসখানেক হয়েছে স্কুলে। কোন ক্লাস কোথায় এটা জানি, কয়েকজন টিচারের সাথে ভাংগা ভাংগা ইংলিশেও ভাব জমিয়ে ফেলেছি। স্কুলে আপন বলতে কাউন্সিলার, আর দুজন টিচার। তাছাড়া আমি ভীষন একা। বন্ধু দূরের কথা কেউ পাশেও বসে না। পড়াশোনায় মার্ক তেমন ভালো না কিন্তু আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। স্কুলের লম্বা ৭/৮ ঘন্টা প্রায় চুপ করে কারও সাথে কথা না বলে থাকতে হত। কেউ কথা বলতে গেলে আমি কিছু বুঝতাম না। মনে হত ট্রেইন চালিয়ে শব্দগুলো বলছে! কি দ্রুত, খটমটে একসেন্ট! ওরা কয়েকবার রিপিট করে আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। আর তেমন মিশত না। সবমিলিয়ে খারাপ পরিস্থিতি।
এমনসময় একদিন ব্রেকে আনমনে হাটছি। ছন্নছাড়া গন্তব্যহীন ভাবে হাটতে হাটতে স্কুলের পেছনের মাঠটায় পৌঁছে গেলাম প্রথমবারের মতো। কি ভীষন বড় এক মাঠ! ছোট করে ছাটা সতেজ ঘাসবিশিষ্ট সবুজ চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে মাঠটি শুয়ে আছে ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে। মাথা উঁচু করে সামনে তাকিয়ে বুকে ধক করে লাগল প্রডন্ড সৌন্দর্য! সারি সারি পাহাড় আকাশ ছুঁয়ে! এ যেন আকাশ আর পাহাড়ের সৌন্দর্য প্রতিযোগীতা! এত সুন্দর আমি কি আগে দেখেছি? আমার একাকীত্ব প্রকৃতির বিশালত্বে মিলিয়ে গেল। কিছু বেঞ্চ ছিল সারি করে বসার। প্রথমদিন বসে ছিলাম বেঞ্চে। আস্তে আস্তে জায়গাটা আপন হয়ে যাওয়ায় ঘাসেই একা একা বসে থাকতাম। ঢালুমতো জায়গায় হেলান দিয়ে পাহাড় দেখতাম, সেটুকু সময় মনে কোন একাকীত্ব থাকতনা। এই আকাশ, পাহাড়ই আমার বন্ধু, এরা আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে। ইংলিশ জানতে/বুঝতে হয়না আমাকে। কি ভীষন অভিমানের সাথে এসব কথা ভাবতাম আমি!
জায়গাটা এত সুন্দর হবার পরেও নির্জন থাকত বেশিরভাগ সময়। স্কুলের ভেতরে বা সামনের মাঠটাতেই সবাই হ্যাং আউট করত বেশি। আমাদের স্কুলের আশেপাশে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ছিল। স্টুডেন্টরা দলবেঁধে সেখানে লাঞ্চ করতে যেত। আমি তো বাড়ি থেকেই দেশী নাস্তা আনতাম তাই কোথাও যাওয়া লাগত না। জীম ক্লাসের পেছনের দরজা দিয়ে সহজেই মাঠটা পরত এবং স্লো না থাকলে ক্লাস বাইরে হত। মাঠটা তাই বেশিরভাগ সময় ক্লাস অথবা টুর্নামেন্ট পার্পসে ব্যবহৃত হত। সবমিলিয়ে আমার পছন্দের জায়গা যার মালিকিন শুধু আমি! প্রতিদিনের রুটিন ছিল আমার সময় পেলেই নির্জন জায়গাটায় বসে বসে পাহাড়/আকাশে মিলেমিশে একাকীত্ব, বাংলাদেশকে ছাড়ার তীব্র ব্যাথা ভোলার। গাল বেয়ে কত ফোঁটা নিঃসংগ অশ্রু যে সেই ঘাসে পরেছে তার হিসেব নেই!
এরকমই একদিন রুটিন অনুযায়ী ব্রেকে গিয়েছি, দেখি অন্য অনেকদিনের মতো নির্জন না। বেশ কিছু স্টুডেন্ট আছে, খেলাধূলা করছে। কোন টুর্নামেন্টের অনুশীলন করছে মনে হয়। মন একটু খারাপ হয়ে গেল, একা থাকলে মনে হত এই পুরো পাহাড়, আকাশ আমার। যাই হোক তাও হাটতে হাটতে ঢালু মতো জায়গায় বসতে যাব দেখি কি আমাদের স্কুলের দুটো ছেলেমেয়ে ঘাসের ওপরে একে অপরের ওপরে শুয়ে মেক আউট করছে। আমার তো চোখে বড় বড়, মুখ হা হয়ে গেল! তখনো মেক আউট শব্দটা জানতাম না, একে "লজ্জা লজ্জা" বলতাম মনে মনে। তো ওদের লজ্জা লজ্জা করতে লজ্জা না লাগলেও আমি লজ্জা পেয়ে জোরে কদম চালিয়ে স্কুলের ভেতরে। কি ভীষন অস্বস্তি হয়েছিল সেদিন! কোন ছেলে মেয়েকে প্রথমবার অতটা অন্তরঙ্গ ভাবে দেখেছিলাম, তাও আবার আমারই সহপাঠি! ছেলেটা অনেক লম্বা, সোনালী চুল, নীল চোখবিশিষ্ট হওয়ায় আগেও অনেকবার চোখে পরেছে স্কুলে। আমার ক্লাসের না কিন্তু লাইব্রেরীতে মাঝেমাঝেই দেখতাম। মেয়েটাকে চিনতাম না। ওরা কি অবলীলায় একে অপরের ওপরে মেতে ছিল! আশেপাশের বাকি ছেলেমেয়েরাও অবাক চোখে তাকাচ্ছিল না, নিজের মতো খেলে যাচ্ছিল! এটাই যে স্বাভাবিক এখানে!
কাহিনী প্রথম কয় মাস থেকে এক টানে লাস্ট ইয়ারে নিয়ে আসছি। পায়ের মাটি পুরোপুরি শক্ত। সব টিচারদের পছন্দের পাত্রী এবং ভীষন সুমধুর সম্পর্ক তাদের সাথে। কানাডিয়ান সহ বিভিন্ন দেশের ইংলিশ একসেন্ট ভালমতো বুঝতে পারি এবং নিজেও বলতে পারি। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব। নিজে তো এডজাস্ট করেই নিয়েছি, টিএ হয়ে নতুন, ইংরেজী না জানা স্টুডেন্টদের সাহায্য করার সৌভাগ্যও হয়েছিল।
আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু সময় কেটেছে মি: এম এবং প্রানের ব্রাজিলিয়ান বান্ধবীর জের সাথে। একটা E.S.L. ক্লাসে দুজনকেই একসাথে পেয়েছিলাম। আমাদের তিনজনের বন্ডিংটা কি ছিল সেটা বলে বোঝানো যাবেনা।
আমি আর জে অনেক গল্প করতাম। কিশোরি বয়স, মনে অনেক রং থাকে। বান্ধবীদের সাথে বেশিরভাগ গল্পই ছেলেসংক্রান্ত হতে থাকে। পছন্দের মেইল সেলিব্রেটিদের ছবি দেখতে দেখতে কল্পনায় ভাসতাম, ওর দিকে তাকিয়ো না ও শুধুই আমার বা এটা আমার ওটা তোমার এভাবে ভাগ বাটোয়ারা করে হেসে লুটপাট হতাম (এখনো লিখতে হাসি পাচ্ছে), স্কুলের কোন ছেলে ফ্লার্ট করছে, হাসব্যান্ড কেমন হবে, বাচ্চা কয়টা হবে সবকিছু নিয়ে গল্প করতাম। ও বলত আমি বড়লোক হলে অনেকগুলো বাচ্চা নিতাম, আমি বলতাম দুটোর বেশি কখনোই না এবং অবশ্যই মেয়ে। হাহা, এসব পাগলামি কথা ছিল। জীবনের কোন এক সময় এসব ধারনা পাল্টাবে কিনা সেটা নিয়ে আমরা বেপরোয়া ছিলাম। মি: এম এই সরল সুন্দর গল্পগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনতেন এবং আমরা ওনার সাথেও এসব কথা বলে যেতাম অবলীলায়!
জের বয়ফ্রেন্ড ছিলো এজন্যে আমার চেয়ে ওর গল্পগুলো আরো বেশি ইন্টারেস্টিং হতো। বয়ফ্রেন্ডের সাথে যা যা হতো সব আমাকে আর মি: এমকে বলত। এমনই একদিন জে মন খারাপ করে বসে আছে। জিগ্যেস করতে জানলাম ও ফেসবুকের চ্যাট হিস্ট্রিতে দেখে ফেলেছে যে বয়ফ্রেন্ড তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলেছে এবং ওকে জানায়নি। আমি জিগ্যেস করলাম চিট করছে? ও বলল, "না মেয়েটাকে বলে দিয়েছে ওর গার্লফ্রেন্ড আছে।" আমি বললাম সমস্যা কি তবে? ও বলল, "এই কথাগুলো আমাকে বলেনি কেন? ঐ মেয়ের সাথে কেন কথা বলতে হবে? আমিতো ওকে সব বলি, স্কুলে কোন ছেলে তাকালেও বলি।" আমি ওর মাথায়, পিঠে হাত বোলাচ্ছি, বোঝাচ্ছি। মি: এম আমাকে ইশারায় ডেস্কে ডাকলেন, ফিসফিস করে কি হয়েছে জানতে চাইলেন। আমি বললাম সব। উনি মাথা ঝাঁকিয়ে যার মানে (তোমরা বাচ্চারা!), জের কাছে এসে বোঝালেন, "একটা সম্পর্কে কিছু কিছু জিনিস পার্টনারকে বলা না বলা দুটোই রিস্কের। সে যদি তোমাকে বলত তুমি জিগ্যেস করতে কেন ও তোমাকে নক করেছে? সে বোঝাত এটা তার দোষ না। তুমি বলতে তারই দোষ, সে রেগে যেত। তুমিও। তোমার বয়ফ্রেন্ড এসব এভয়েড করতে চেয়েছে। ওর উচিৎ হয়নি তবে ও ভাবনা ঠিক ছিল। আর মেয়েটাকে তো বলেই দিয়েছে তুমি আছ ওর জীবনে। আমার মনে হয় তুমি ওকে ক্ষমা করে দাও পরেরবার কোন কথা না লুকানোর শর্তে।" জে একটু ভেবে মাথা নেড়ে সাথে সাথে ফোন নিয়ে ক্লাসের বাইরে গেল মি: এমের অনুমতি নিয়ে এবং কিছুক্ষন পরে হাসতে হাসতে ফিরে আসল।
ততদিনে এসবে আমার অবাক লাগেনা। কিন্তু মুচকি হাসতে লাগলাম বাংলাদেশের এক বাংলা টিচারের কথা মনে করে। গার্লস স্কুলে ছিলাম তখন। গ্রেড সেভেনের ক্লাসেই সম্ভবত, ঝড়ের গতিতে এসেই লেকচার শুরু করে দিলেন, "তোমরা কি হিন্দি সিনেমা দেখে এসব শিখতেছ?'' বেতটা উপর থেকে নিচে হাত বুলিয়ে বললেন, "কিছু মেয়ের সম্পর্কে খারাপ কথা কানে আসতেছে আমার। যদি হাতেনাতে ধরতে পাই তবে বেত না বাঁশ ভাঙ্গব পিঠের ওপরে। পরিবারের সাথে সাথে স্কুলেরও নাম খারাপ করতেছে। এইটুকু বয়সে তো আমরা প্রেম শব্দটার মানেই জানতাম না আর তোমরা?" আরো অনেককিছু গজগজ করতে করতে বলে গেলেন। ক্লাসে সবাই মাথা নিচু করে লজ্জায় মুখ ঢেকে হেসে যাচ্ছে। আমার বান্ধবী ইশারা করল একটা মেয়ের দিকে, "ইনিই তিনি" বলে। আমি একটু চমকে উঠলাম, আমার বয়সী মেয়ে প্রেম করে? এটাতো ভার্সিটির বড় আপুরা করে শুধু। সেদিন প্রথম জেনেছিলাম স্কুলপড়ুয়ারাও প্রেম করে। আর করাটা বিরাট আকারের পাকামি, পাপ এবং টিচার জানলে বেত না বাঁশ! পরিবারের সম্মান নষ্ট, সমাজে মুখ দেখানো যাবে না জানাজানি হলে। মোরাল অফ দা স্টোরি, পরীক্ষায় ফেইল এবং প্রেম এ দুটো জিনিস জান বাঁচাতে হলে কোনভাবেই করা যাবেনা।
আর কানাডায় টিচারই রিলেশনশিপ এক্সপার্ট হয়ে সাহায্য করছেন! ভাবতেই শব্দ করে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। জে আর মি:এম জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকালে বললাম, "একটা মজার স্মৃতি মনে পরে গেল!"
সারকথা: ভালোবাসাকে কোন বয়সের গন্ডিতে ফেলতে নারাজ কানাডিয়ানরা। প্রেমটা এখানে যেকোন বয়সেই পাকামি মনে করা হয়না। বরং সাত বছরের বাচ্চাও যদি মাকে বলে স্কুলে একটা মেয়েকে সুইট মনে হয় তবে মা বলবেন, "ওও হাউ কিউট! আমার বেবির প্রথম ক্রাশ, ইয়ে! ওকে কোনদিন বাড়িতে প্লে ডেটে ডাকো!"
আর কানাডিয়ান কালচারে পার্টনারের সাথে ঘনিষ্ঠতা যেকোন বয়সেই লুকানোর মতো কিছুনা। ওরা ভাবতেই পারেনা এসব ব্যাপার রেখেঢেকে করার জিনিস। আমার ভালবাসার মানুষটার হাত ধরি, চুমু খাই তাতে কার কি? স্কুলেও কিশোর কিশোরিরা হাত ধরে, খুব অন্তরঙ্গভাবে টিচারের সামনে দিয়েই ঘুরে বেড়ায়। বলাই বাহুল্য টিচারও ভুরু কুচকে তাকায় না। অনেক টিচার তো আবার রিলেশনশিপ এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করেন তাদের ফ্যাভারিট কাপলদের জন্যে। ঝগড়া হলে মেটান! এসব কাপলকে এখানে মিষ্টি করে "হাই স্কুল সুইটহার্ট" বলা হয়।
সবাই জানে এরা স্কুল শেষ হবার পরে আলাদা হয়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি, বিয়ে হওয়ার চান্স খুবই কম। কিন্তু সিংগেল থাকাটা যেকোন বয়সেই কানাডায় নরমাল না। ডেটিং চলতেই থাকবে, অনেককে ডেট করতে করতে স্পেশাল মানুষটা ঠিকই একসময় এসে যাবে! সেই বহু আরাধ্যের সৌলমেইট! এভাবেই কানাডিয়ানদের মেজোরিটি জীবনধারন করেন।
চমকে যাওয়া আমি: কানাডায় প্রথম প্রথম এসব অন্তরঙ্গতা দেখে চোখের সামনে নিজের মফস্বলের জীবনটা ফিল্ম রিলের মতো ভেসে উঠত। প্রেম কি ভীষণ সরল ছিল সেখানে! ব্যালকনিতে আপুটা, রাস্তায় ভাইয়াটা, ভীষন দূরত্ব কিন্তু কি ভীষন কাছে! মফস্বলের প্রেমগুলো কার সাথে কার হচ্ছে সেটা সবচেয়ে আগে বোধহয় আমরা কিশোর/কিশোরিরাই জানতাম। অনেক আপু পেটে কিছু লুকোতে পারতেন না, মুচকি হেসে কাউকে কিছু না বলার শর্তে সব বলতেন। আসলে সবার কাছে লুকিয়ে রাখা জিনিসগুলো সেইফ কোন জায়গায় বলতে না পারলে অস্থির লাগে। তাদের মিষ্টি গল্পগুলো আমরা ছোটরা স্বপ্নীল চোখে শুনতাম! আমি বাবার বদলির চাকরি হওয়ার কারনে এতটাও জানতে পারতাম না প্রথম প্রথম যেয়ে। কোন এক শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট খবরী বান্ধবী আল্লাহ আমাকে জুটিয়েই দিতেন যে ফিসফিসিয়ে কার সাথে কার "ইটিশপিটিশ" চলছে তা জানিয়ে দিত। অনেক লুকানোর পরেও প্রেম লুকিয়ে থাকত না, কারও চোখে পরেই যেত। সেই একজন থেকে পুরো মহল্লা, শহরে ওপেন সিক্রেট যে অমুক বাড়ির ছেলের তমুক বাড়ির মেয়ের সাথে চলিতেছে লটর পটর। মজার বিষয় হচ্ছে, শুধু প্রেমিক প্রেমিকাদের বাবা মাই সবকিছু একদম শেষে জানতেন। জানার পরে আসল ড্রামা শুরু হত। কারও ভালোবাসার জয় হত হাজারটা ঝড় ঝাপ্টা পার হয়ে, আর কিছুর করুন পরিনতি দেখা লাগত! করুন পরিনতিগুলো দেখে প্রেম এক ভয়াবহ জিনিস ছিল আমার কাছে। চোখাচোখির প্রেমও যে কালচার মেনে নিতে পারত না সহজে সেই কালচার থেকে এমন ওপেনলি সবার সামনে আমারই বয়সী ছেলেমেয়েদের অন্তরঙ্গতা বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিত ভীষনভাবে। চমকে চমকে যেতাম প্রতি কদমে!
কি ভীষন এক অস্বস্তি! মনে ভয় ধরে থাকত কখন কি দেখে চমকে যেতে হয়! কতদিন পর্যন্ত আমি সারি করে থাকা লকারগুলোর দিকে ভয়ে তাকাতাম না! মাথা নিচু করে হাটতাম। সেই মাঠেও সপ্তাহ দুয়েক পর্যন্ত ভয়ে যাইনি। লাইব্রেরিতে বসে থাকতাম। আবার যেন দেখতে না হয় ওসব! সত্যি বলতে এসব চোখে পরাটাও আমার কাছে অবৈধ, পাপ মনে হত। কানাডায় প্রথম প্রথম এসব দেখে অনেকবার মনে হত কোন দেশে আসলাম? কেন আসলাম?
এর সাথে আমি এডজাস্ট কিভাবে করেছি? হুম, কোন চেষ্টা করিনি। ব্যাস সময় যেতে যেতে চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারগুলো। ওদের যা করার করুক, আমার কি? আমিও তো সালোয়ার কামিজ, টিপ পরে সারা স্কুল ঘুরে বেড়াচ্ছি। কেউ তো কিছু বলছে না। এক কানাডিয়ান মেইল ক্লাসমেট গ্রুপ প্রজেক্টে হায়েস্ট পাওয়ার খুশিতে গ্রুপের সবাইকে হাগ করতে করতে আমার কাছে আসতে গেলে ভয়ে পা কয়েক কদম পিছে নিয়েছিলাম। কিচ্ছু বলিনি কিন্তু আমার পিছে সরে যাওয়া দেখে ওর প্রথম কথাই ছিল, "সরি! তোমার কালচারে সমস্যা?" আমি অস্বস্তিভরা চেহারায় মাথা ঝাঁকালে আবারো সরি বলেছিল অনেকবার। এরকম একটা দেশের মানুষের যেকোন কিছু মেনে নেওয়া যায় কেননা ওরা আমার সবকিছু মেনে নিয়েছিল। বিশ্বাস করুন মুখ ফুটে বলাও লাগেনি আমি এরকম, ওরা বুঝে নিয়েছিল, আমার চোখ পড়ে নিয়েছিল। আমার ঢাকার কাজিনরাও আমাকে ততটা বুঝতে পারেনি কখনো। আমাকে কিছুই করতে হয়নি। ওরা আমার বিপরীতধর্মী কালচারকে সহজে মেনে নিয়ে অজান্তে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল ওদের কৃষ্টি, কালচারকে কিভাবে মেনে নিতে হয়! মুক্ত, সরল, বিনয়ী চিন্তাধারায় প্রতিটি চমকে যাওয়া কদমে অদৃশ্যভাবে আমার পাশেই ছিল। ভীষনভাবে কৃতজ্ঞ আমি এই উদার মানুষগুলোর কাছে!
শেষ কথা: এই পর্বটার শেষের প্যারাটা অনেক আবেগী হয়ে লিখেছি কিন্তু বাকি স্মৃতিগুলো মজারই মনে হয়েছে। তখন বিদঘুটে লাগলেও এখনকার গা সওয়া বিষয়গুলোতে নিজের এক্সপ্রেশন মনে করে নিজেই নিজের ওপরে হেসে উঠেছি অনেকবার। কি ভীষন বোকা ছিলাম না আমি? না না ছিলাম কেন বলছি? এখনো আছিতো!
মফস্বলের প্রেম এ কবছরেই অনেক পাল্টে গেছে হয়ত। বৈশ্বিকতার ছোঁয়ায়, প্রযুক্তির বদৌলতে প্রেমেও আধুনিকতার পরশ লেগেছে দেশের কোনায় কোনায়। আমি শুধু নিজে দেশে থাকার সময়কার কথা বলেছি। এখন ভুল শোনালেও বেশ কবছর আগে তাই ঠিক ছিল। চোখের পলকেই যেন অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে! সেই পাল্টানোটা সবার জন্য হিতকর ফল আনবে কিনা জানিনা আমি, শুধু দোয়া করি আমার দেশের মানুষ যেকোন অবস্থাতেই ঠিক পথে থাকুক, সুখে থাকুক।
প্রতি পর্বে যে ভীষন অনুপ্রেরনা পাই তার জন্যে যেকোন কৃতজ্ঞতার ভাষা কম হয়ে যায়। তবুও বিনয়ের সাথে আবারো ধন্যবাদ জানাই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১০:১২