এ পর্বটা আগের পর্বেরই কিছু উদিত হওয়া প্রশ্নের উত্তর দেবে। তবে আজকের কাহিনী, গল্প আলাদা এবং আমার জীবনকে দেখার ধরন আরো একবার পাল্টে যাবে তাদের প্রভাবে।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১০) সমকামিতা ১৮++
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১১) - কিশোরিবেলায় কানাডার প্রথম ভালোলাগা - এক গ্রিক দেবতারূপী সুদর্শন কানাডিয়ান ছেলে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১২) - বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে এবং আমার স্কুল জীবনে তার প্রভাব
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৩) - কানাডায় বিয়ে, লিভ টুগেদার, ডিভোর্স এবং কিশোরি আমি (১৮+)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৪) - বাংলাদেশীদের বিয়ে ভাবনা নিয়ে বিদেশীদের দৃষ্টিকোন এবং আমার নারী জীবন
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৫) - মায়ের বয়ফ্রেন্ড ও অত্যাচারিত মেয়েটি এবং অবাক, অসহায় আমি (কঠিনভাবে ১৮++)
আমি কখনো স্কুল লাইব্রেরির গল্প করিনি যদিও আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে প্রিয়, নিরাপদ জায়গা ছিল। আমার তো প্রথমদিকে কোন বন্ধু ছিলনা তাই একা একা লাইব্রেরিতে ফ্রি টাইমে বসে থাকতাম। এসাইনমেন্ট করতাম অথবা কম্পিউটারে বাংলা ব্লগ, বাংলাদেশি পেপার পড়তাম। পিছন থেকে কারও স্ক্রিনে চোখ পড়লে বলে যেত, "কি সুন্দর, কম্প্লেক্স লুকিং ভাষা! তুমি সব পড়তে পার? সত্যিই পড়তে পার?" আমি হেসে ফেলতাম আমার ভাষা আমি পড়তে পারি কিনা জিগ্যেস করে হাহা।
লাইব্রেরিটা যে কি ভীষন বড় ছিল! লাল দরজা, রংগিন কাঁচের খুব ঝলমলে ইন্টেরিয়ারে সাজানো। সুন্দর কাঠের গোলটেবিল, দামি সোফা সুদৃশ্য করে জায়গায় জায়গায় বসানো। সারি সারি কম্পিউটার দেয়াল ঘেষে। বিভিন্ন র্যাকে কত ধরনের বই! ফিল্মি ম্যাগাজিনের তাকও ছিল। বাংলাদেশে স্কুলে ম্যাগাজিন লুকিয়ে আনত অনেকে আর এখানে সাজিয়ে রেখে দেয় স্টুডেন্টদের জন্যে! লাইব্রেরিতে সপ্তাহে তিনদিন বোর্ড গেম খেলার অনুমতি থাকত। বিভিন্ন ধরনের লটারি, কুইজ, গেম হত; জিতলে বই গিফ্ট। একটা বড় পাজল রেখে দেওয়া হত রুমের এক কোনে। ফ্রি টাইমে যে কেউ মেলানোর চেষ্টা করতে পারে। যেকোন বিশেষ অকেশন যেমন ক্রিসমাস, হ্যালিউনে পুরো লাইব্রেরি সাজানো হত। বড় বড় ক্রিসমাস ট্রি, লাইটিং, ডেকোরেশন, চকোলেট ছড়িয়ে থাকত জায়গায় জায়গায়। কেউ একটু পরে পরে "সাইলেন্স!" বলত না। এমনকি পৃথিবীর সব লাইব্রেরির প্রচলিত সাইনবোর্ড "সাইলেন্স প্লিজ" ছিলনা কোথাও। থেকেই বা কি লাভ?
সবচেয়ে বেশি গল্প/নয়েজ তো হত লাইব্রেরিয়ান মিসেস টির ডেস্কের সামনে দাড়িয়ে তারই সাথে! মিসেস টি; এক মধ্যবয়স্কা, হাসিখুশি, সাদামাটা চেহারার কানাডিয়ান নারী। জ্বী এত সব মজা যে একটা স্কুল লাইব্রেরিতে হচ্ছে তার কারন এই না যে ওটা কানাডার একটা স্কুল। বরং একটা বড় কারন ছিলেন লাইব্রেরিয়ান মিসেস টি! ওনাকে আমি খুব পছন্দ করতাম কেননা প্রথমদিকে যে হাতে গোনা কজন আমার ভাংগা ভাংগা ইংলিশ সহজে বুঝতেন তার মধ্যে উনি একজন ছিলেন। সবসময় লাইব্রেরিতে পা পরতেই, "তোমার পোশাক কি ভীষন সুন্দর! কি সুন্দর লাগছে তোমাকে!" বলবেনই। আমিত একটু আদর পেলেই গলে পরা মানুষ আর ইনিতো সবসময় আমাকে মমতা দেখাতেন। আমার বেশ কাছের মানুষ ছিলেন যার কাছে মন খুলে কথা বলতে পারতাম।
একদিন সকালে লাইব্রেরি খোলার অপেক্ষা করছি। খুললেই ঢুকব। লাইব্রেরির বাইরে পায়চারি করতে করতে দরজার ওপরে থাকা একটা পোস্টার চোখে পরল। একজন কানাডিয়ান মেয়ের চোখের নীচে মারের কালশীটে দাগ এবং নিচে লেখা "তোমার স্বামী তো কালকেও বলেছিল তোমাকে আর মারবেনা!" মানে বোঝানো হচ্ছে মেয়েটা বারবার স্বামীর মিথ্যা আশ্বাস পেয়ে অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে! আমি হা হয়ে গেলাম। কানাডায়েও এসব হয়? অনেকক্ষন তাকিয়ে ছিলাম কনফিউসড হয়ে, পিঠে হাত অনুভব করলাম কারও। দেখি মিসেস টি চাবির গোছা হাতে নিয়ে পেছনে দাড়িয়ে। উনি দরজা খুলে দিলেন।
আমি আস্তে আস্তে অন্যমনস্ক হয়ে ঢুকলাম ওনার পিছু পিছু। ওনার ডেস্কটা পেরিয়ে কোন এক কম্পিউটারে বসতে যাচ্ছিলাম এমন সময় উনি ডাকলেন আমাকে। বললেন, "কোন সমস্যা?" আমি বললাম ঐ পোস্টারটার মানে কি? পোস্টারটা তিনিই লাগিয়েছিলেন বলে আমাকে কথাটার মানে বিশ্লেষন করলেন এটা ভেবে যে আমি ইংলিশটা হয়ত বুঝিনি। আসলে আমি ইংরেজী বুঝেছিলাম কিন্তু একটা কানাডিয়ান মেয়ে কেন স্বামীর মার সহ্য করবে সেটা ভাবছিলাম। যাই হোক, উনি বলতে থাকলেন, "ছবির মেয়েটি এক মডেল। কিন্তু অনেক মেয়েই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স সহ্য করে যায়। আমার ভাগ্নিই এখন এরকমই কিছুর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ওরা হাইস্কুল সুইটহার্ট ছিল। একই ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে জাকজমকপূর্ণ ভাবে বিয়ে করে। বাচ্চাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত সুখেই ছিল। বাচ্চা হওয়ার পরে ও অনেক ওয়েট গেইন করল। ওকে খুব খোটা দিত ওর বডি নিয়ে। একটা সময় ছোট একটা বিষয় নিয়ে চড় পর্যন্ত মারে। এভাবে দিনদিন মারধোর বেড়েই যাচ্ছে।"
আরো কিছু বলতে যাবেন আমি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলাম ডিভোর্স দেয় না কেন? তখনো পর্যন্ত আমি ভাবতাম কানাডায় নাক ডাকার কারনেই মেয়েরা ছেড়ে চলে যায়। উনি বললেন, "ও অনেক ভালবাসে হাসবেন্ডকে। যেভাবে হোক সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে চায়। আমি এই উইকেন্ডেও বুঝিয়ে এসেছি আত্মমর্যাদা রেখে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু ও শুনছে না। বাচ্চাকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করতে চায়না, ভেরি স্যাড ইয়াং লেডি!" এটুকু শোনার সাথে সাথে শরীরে ঢেউ খেলানো ইলেকট্রিক শক অনুভব করলাম। এতদিন শক খেতাম বাংলাদেশের চেয়ে আলাদা কালচার হওয়ায়। সেদিন প্রথম শক খেলাম অনেক অসহায় বাংগালী নারীর মতো পরিস্থিতি দেখে। মনে হল কোন বাংলাদেশীর সাথেই কথা বলছি। বাচ্চা, সংসার টিকিয়ে রাখার জন্যে স্বামীর মার সহ্য করছে? খুব এফেক্টেড হয়েছিলাম কথাটায় যে পৃথিবীর সব দেশেই এমন মেয়ে আছে?
এবার অন্যকাহিনীতে চলে যাচ্ছি। সিনিয়ার ইয়ারের সময়কার কথা। আমার এক জার্মান মেয়ের সাথে মোটামুটি ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মেয়েটার নাম অলিভিয়া। মেয়েটার কোকড়া ব্রাউন চুল, হালকা নীল চোখ, লম্বা, সবমিলিয়ে সুন্দরী। আমি খুবই ঘরকুনো মানুষ, বন্ধুদের বাড়িতে পারতপক্ষে যাইনা। ওর বাড়িতেও যাওয়ার কথা না। কিন্তু সেই মেয়ের মা আবার আমার মায়ের বান্ধবী ছিলেন। আমার হাউসওয়াইফ মা বাড়িতে বসেই ভাংগা ভাংগা ইংলিশে এত বিদেশী বান্ধবী কিভাবে জোটাতেন এখনো ভেবে আশ্চর্য হই। আমি স্কুলে যেয়েও এত বন্ধু করতে পারতাম না। যাই হোক, একদিন দাওয়াতটা দুদিক থেকেই আসল। মা মেয়ে দুজনেই খুব করে ধরলেন যে ওনাদের বাড়িতে যেতে হবে। শুধু আমাকে বললে তো বাহানা দিতাম। কিন্তু মা সহ বলার পরে যেতেই হল। গেলাম, যেয়ে দেখি ড্রয়িং রুমটা খুব ছিমছাম দামী জিনিসে সাজানো। রুচিশীল পরিবার দেখলেই বোঝা যায়। কানাডায় আবার বেশিরভাগ বাড়িতে কিচেনের সাথেই ডাইনিং যাতে হোস্ট রান্না করতে করতে গেস্টের সাথে গল্প করতে পারেন। আমার মায়ের এ বিষয়ে দর্শন হল, "পিত্তি জ্বলে যায় এসব দেখলে, ঘেমে নেয়ে রান্না করতে করতে মেহমানের সাথে কথা বলতে হবে কেন? ওভেনে রান্না করেত বোঝনা। আমাদের মতো বেটে, কাটাকাটি করে তেল মশলার কঠিন রান্না হলে বুঝত।" হাহা।
তারা রান্নাঘরে গল্প করছেন। আমি আর অলিভিয়া ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছি। আমি স্কুলে খুব বকবক করলেও প্রথম ওদের বাড়িতে যেয়ে মা দের সামনে বেশ আনকমফর্টেবল ও লাজুক হয়ে বসে আছি (শান্ত মেয়ের ট্যাগ তো আর এমনি পাইনা )। অলিভিয়া কিছুক্ষন কথা বলে একটু বোরই হয়ে গেল শান্ত আমাতে। কার্পেটে বসে থাকা নিজের ছোট ভাইয়ের সাথে খেলতে লাগল। আমিও সেদিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলাম। একসময় একটু একা একা খাপছাড়া অবস্থায় হাটতে হাটতে ডাইনিং রুম সংলগ্ন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে স্নোফল দেখতে লাগলাম। এসময় মা দের কথা কানে আসল। জার্মান আন্টি বললেন মাকে, "ও একটা এনিম্যাল ছিল! এনিম্যাল! পাঁচ বছরে একদিনও এবিউজ/মার/গালি ছাড়া ছিলাম না। অনেকদিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলাম ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু শেষমেষ না পেরে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। এখনো আমার আগের পক্ষের ছেলেটা জার্মানিতে পরে আছে। আইনি ঝামেলা ফাঁসিয়ে জানোয়ারটা আসতে দিচ্ছে না।" শরীর শিরশির করে উঠল এবং আবারো আমি লাইব্রেরির সে দিনের মতো অবাক হলাম।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে মায়ের জীবনকাহিনী মেয়ের সাথে রিপিটেড হল। অলিভিয়ার সৎ বাবা সব দায়িত্ব করতেন তবে গম্ভীর মুখে খোটা দিয়ে দয়া দেখানোর ভাব করতেন। প্রতিটিদিন মেয়েটাকে নিজের বাড়িতেই আশ্রিতের মতো ট্রিট করা হত। কিশোরি অভিমানি অলিভিয়ার অবশ্যই তা ভাল লাগত না। হাই স্কুলে থাকতে থাকতেই বয়ফ্রেন্ডের সাথে মুভ করল। ভেবেছিল এখন ভালোবাসা/স্বাধীনতা পাবে। বেশিদিন না কয়দিন পেরোতেই একদিন শুনলাম প্রেগন্যান্ট। সেটা শুনে আমার কত কাঁপাকাঁপি হয়েছিল সে গল্প বাদ দিই। প্রেগন্যান্ট হওয়ার সাথে সাথে "সুইটহার্ট" বয়ফ্রেন্ডের এবিউজ শুরু।
কতভাবে বয়ফ্রেন্ড শারীরিক, মানসিক কষ্টে রেখেছিল তা আমাকে অলিভিয়া বলত না। আসলে খুব ক্লোজ বান্ধবী আমরা ছিলাম না। মোটামুটি ধরনের একটা বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু আন্টি মায়ের কাছে এসে সব বলতেন কেঁদে কেঁদে। বলতেন মেয়েকে নিজের কাছে আনতে চান কিন্তু মেয়ে সৎ বাবার ওপরে অভিমান করে কিছুতেই আসবেনা। মাকে বলতেন, "তুমি কি লাকি! তোমার মেয়ে পড়াশোনায় ভাল, ভার্সিটিতে পড়বে। আমার মেয়েটাকে নিয়েও আশা করেছিলাম, কিন্তু...।" মা স্বান্তনা দিতেন, কিইবা আর করার ছিল তার?
কিন্তু আমি কিছু করতে চাইলাম। কোনভাবে ওকে বাঁচাতে হবে। অনেক ভেবে বন্ধুর মতো টিচার মি: এম যার আন্ডারে টিএ ছিলাম তাকে সব বললাম। বললাম আমি এসব বিষয় কিভাবে বোঝাতে হয় জানি না, আপনি বলুন। একটা মেয়ের এসব সহ্য করা উচিৎ না। উনি চিন্তিত মুখে বললেন, "আসলে কি জানো? আমি বলে কোন লাভ হবেনা।" আমি হতাশ হয়ে ইশারা করলাম বলতেই হবে আপনাকে, উনি বললেন, "ঠিক আছে, বলব।" আমি ১০০% শিউর ছিলাম এত সুন্দর করে কথা বলেন/বোঝান উনি, তারপরে আবার টিচার, অলিভিয়া অবশ্যই শুনবে ওনার কথা। একদিন আমি মি: এমের ডেস্কের একটু দূরে রুমের মাঝখানে দাড়িয়ে আছি, স্টুডেন্টরা পড়ছে কিনা তদারকি করছি। মি: এম অলিভিয়াকে ওনার ডেস্কে ডাকলেন।
আমি অনেক খুশী হলাম, বুঝলাম আজই বলবেন। কান ফেলিয়ে শুনলাম ওনাদের কথাবার্তা। অনেককিছুই পরিষ্কারভাবে শুনতে পারিনি কেননা মি: এম স্বাভাবিকভাবেই নিচুস্বরে কথাগুলো বলছিলেন। আমি খাপছাড়া যা শুনেছিলাম তা আর কিছু অনুমানের ওপরে কথাগুলো ছিল, "শুনলাম তুমি প্রেগন্যান্ট, কনগ্র্যাটস। এই অবস্থায় কিন্তু নিজের অনেক খেয়াল রাখতে হয়। কোন ধরনের মানসিক, শারীরিক কষ্ট নেওয়া যাবেনা। জানত এসব?" ও বলল, "হুম।" মি: এম বললেন, "এখন তোমার অনেক দায়িত্ব, বাচ্চাটাই প্রথম এবং শেষ প্রায়োরিটি হওয়া উচিৎ। বাচ্চাটা যেহেতু তোমার মধ্যে তাই তুমি নিজে টপমোস্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিৎ, তাই না?" ও হঠাৎ এসব কথায় কনফিউসড হয়ে বলল, "হ্যা।" উনি কিছুটা গম্ভীর গলায় গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, "তুমি কি নিজেকে প্রায়োরিটি দিচ্ছো?" এই কথাটা পরিষ্কার শুনেছিলাম। মি: এম কোনদিকে যাচ্ছেন বুঝে অলিভিয়া কঠোর মুখে বলল, "Mr. M. this is my life. I am not your daughter. Worry about your own kids!" বলে নির্লিপ্তভাবে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পরল।
আর মি: এমও এমনই হবে এরকম একটা মুখ করলেন, সরি বললেন অলিভিয়াকে! কোন শক/রাগ ছিলনা ওনার স্টুডেন্টের কাছে এরকম বাজে ব্যবহার পেয়ে! একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন হাত দুইদিকে ঝাঁকিয়ে। সেই ইশারার মানে ছিল তোমাকে তো বলেছিলামই। সেটাও মুচকি হেসেই! আমার ওপরেও কোন রাগ ছিলনা তার!
আমি সেদিন কি ভীষন লজ্জ্বা পেয়েছিলাম তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। এখনো সেদিনটার কথা মনে পরলে রাগে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করে নিজের। সেই অপরাধবোধ এতদিনেও আমার যায়নি। লিখতে গিয়েও নিজের প্রতি মন অভক্তিতে ভরে উঠল! আমার কারনে এত প্রিয়, ভালবাসার মানুষ আমার মি: এম অপমানিত হলেন! সেদিন বিব্রত আমি কিছু বলতে পারিনি, পরে ক্ষমা চেয়েছিলাম। অলিভিয়ার প্রতি কি যে রাগ লাগছিল! ও প্রেগন্যান্ট না হয়ে যদি মি: এমের সাথে এভাবে কথা বলত তবে তখনই কিছু একটা করে বসতাম ওকে। কিন্তু প্রেগন্যান্ট বান্ধবীকে কি আর বলব?
যদিও রাগ/ক্ষোভ পুরোপুরি সামলাতে পারিনি। ওকে স্কুলের পরে ধরব ভাবলাম। যা হওয়ার তাই হবে আমি ওকে বোঝাবই। কিন্তু আমার কিছু আগেই স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। আমি কোনমতে লকার থেকে জ্যাকেট নিয়ে দৌড় ওর পিছনে। বিদেশীরা লম্বা হওয়ায় এবং অভ্যাসগত কারনে আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত হাটে। আর তখন বরফের সিজন চলছে। অন্যসবাই বুট পায়ে দিয়ে এমনভাবে বরফে হাটে যেন পরিষ্কার রাস্তা! আমি এতদিন কানাডায় থেকেও পিছলে পরার ভয়ে বরফে পা টিপে টিপে হাটার অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। সবমিলিয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পরে ও হাটলেও আমি সাবধানে দৌড়াচ্ছিলামই ওকে ধরার জন্যে। ওকে ধরতে পেরে বললাম, "তুমি আন্টির কাছে মুভ করো, বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে দেও।" আমি হাই হ্যালো কিছুনা একদম এই কথাটাই প্রথম বললাম। ও আশ্চর্য হলো না, নরমালি আবার মি: এমের মতো কঠোরভাবে আমাকেও প্রায় একই কথা বলল। আমার রাগ আরো একধাপ বেড়ে গেল। বললাম, "তোমার মাও এসব সহ্য করে ভুল করেছিল জানো নিশ্চই?" ওর মুখ ভীষন কঠোর হয়ে গেল। আমাকে বলল, "আমার মা বাবার সংসার টিকলে আমি এই অবস্থায় থাকতাম না, আর আজকে আমার সম্পর্ক ভাংলে আমার বাচ্চাও তোমার মতো স্টুপিডের কাছে উপদেশ শুনবে একদিন! সেদিন যেন না আসে সেজন্যে আমি সব সহ্য করব। তারপরে আমার বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলল, "I know what's right for my baby, stay out of it." বলে হনহন করে বাস ধরতে চলে গেল।
জীবনে বিশেষ করে কানাডায় প্রথম কেউ সামনাসামনি আমাকে তীব্রভাবে অপমান করল। কিন্তু আমার সেটা না মনে হয়ে প্রবল তুষারপাতের মধ্যে দাড়িয়ে খুব বড় একটা উপলব্ধি হল জীবনে। আমি জানিনা সেদিন বরফ বেশি শীতল ছিল না আমার মন। আমি শুভ্র বরফের মধ্যে মূর্তির মতো দাড়িয়ে নিজের পুরো জীবনকে চোখের সামনে নামালাম। আসলেই সারা জীবন মফস্বলের সরল পরিবেশে সবার আদরে মানুষ হয়ে আমি একটা স্টুপিডই তো ছিলাম। পড়াশোনার বাইরের জীবন কি কঠিন আমি কিছুই বুঝতাম না। আগের পর্বে একজন কমেন্ট করেছিলেন আমি কিশোরি বয়সে একটু বেশিই সরল সোজা ছিলাম। উনি ভদ্রভাবে বলেছেন কিন্তু আমি একদমই পরিষ্কার বাংলায় বলি বোকা, ভীষন বোকা ছিলাম আমি।
আমি ভাবছিলাম বয়ফ্রেন্ডকে ছেড়ে দিলেই সব সমস্যা শেষ, ও আর মার খাবে না। এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবার যোগ্যতা আমার কৈ ছিল? কিন্তু ওর ভাবনায় বাচ্চাটা ছিল শুধু! মারুক ধরুক কাটুক ওর বাচ্চার বাবা মানুষটা! বয়ফ্রেন্ড বাড়ি ভাড়া দিয়ে রাখছে, ভরনপোষনের অর্ধেক খরচ দিচ্ছে, অত্যাচার/মারধোর করলেও পাশে তো আছে। খারাপ হোক কিন্তু নিজের বলার ঐ একটাই তো মানুষ ওর জীবনে! ওর মতো অসহায় অবস্থায় সেটুকুই কি ভীষন প্রাপ্তি ছিল! বেচারি চায়নি ওর নিজের বাচ্চা এমনকরে খুব অল্প প্রাপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকুক। দাঁতে দাঁত চেপে আমারই বয়সী একটা মেয়ে কি ভীষন কম্প্রোমাইজ করে যাচ্ছে! একা একা লড়ে যাচ্ছে পরিবার, বন্ধুবিহীন, অন্ত:সত্ত্বা মেয়েটা একটা অমানুষের আশ্রয়ে!
আর আমার দুনিয়া কি ছিল? ভাল মার্ক পেয়ে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া এবং ব্যাচেলর শোতে শেষ পর্যন্ত কে জেতে সেটা দেখা। যখন ও কাজ খুঁজে বেড়াত আমি মাকে বলতাম কালকে পরীক্ষা, খাইয়ে দেও, সময় নেই। যখন ও পরম মমতায় নিজের পেটে হাত দিয়ে বাচ্চাটার কথা ভেবে মারের ব্যাথা ভুলত আমি বাবার সাথে মজা করে পান্জা লড়তাম। আমি ছিলামই কে ওকে জাজ করার? ওকে দূর্বল ভাবার? আমি এক বোকা মেয়ে যে দুনিয়া দেখেনি, নিষ্ঠুরতা দেখেনি, নিজেও নিষ্ঠুর হতে শেখেনি। আমি তো বুঝতামইনা একটা মেয়ে কতটা অসহায় হলে এত অপমান সহ্য করতে পারে! আমি ছিলামই বা কে ওকে উপদেশ দেবার?
আমাদের মতো সাধারন মানুষের জীবনে ফিল্মি সিন কমই হয়। তবে সেই প্রবল শুভ্র তুষারপাতে পাথরের মতো দাড়িয়ে থাকা আমার মুখে বিস্ময়, রাগ, অনুতাপ, দুঃখ, সংঘাত সহ বিভিন্ন আবেগ মূহুর্তে রংধনুর মতো খেলে যাওয়ার দৃশ্য নাটকের সিন হিসেবে টিভিতে প্রকাশ করা যেত! জীবন পাতার সে ভীষন আবেগী দিনটা আজকে সত্যিই অনেক নাটকীয় মনে হচ্ছে!
বিশ্লেষন: অদ্ভুত হলেও সত্য শুধু বাংলাদেশই না পৃথিবীর সব দেশেই সংসার আকড়ে ধরা কিছু মেয়ে থাকে যারা ভাবে, "সে একদিন ঠিক হবেই। আমি আরেকটু সহ্য করি।" এরকম অনেক নির্যাতিত মেয়েকে বলতে শুনেছি I looove him! আসলে মায়ের জাত তো শুধু বাংলাদেশী মেয়েরাই না সব দেশেই মেয়েরা মা এবং মায়ার জাত হয়। আমি যেটা এখন লিখলাম শুধু প্রবাসে আসলেই কেউ এগ্রি করবে বলে মনে হয়। কেননা পশ্চিমি নারীদের নিয়ে আমাদের ভাবনাটা এতই আলাদা। কিন্তু নারী সেতো নারী!
পরিবারে ডিভোর্স কালচারের খারাপ জিনিগুলো সহ্য করে অনেক মেয়ে ছোট বয়সেই এক প্রকার প্রতিজ্ঞা করে ফেলে যে যখনই বিয়ে করবে ডিভোর্স নেবে না। যাই হোক আর তাই হোক! নিজের বাচ্চাদের মা বাবা দুজনের ভালবাসা দেবে যা নিজে জীবনে পায়নি।
সবচেয়ে বড় কারন কোন আশ্রয় না থাকা। আমাদের দেশে যেমন একটা মেয়ে জানে স্বামী ছাড়লে বাপে নেবে না। মার খেয়ে রক্তাত্ব হয়েও কোনভাবে স্বামীকে তিন তালাক বলা থেকে আটকে পরে থাকতে হবে তার পায়ের কাছে। ওখানেও আশ্রয়হীনতা আছে তবে অন্যভাবে। বাবা মা ডিভোর্সড, নিজেদের ডেটিং/ম্যারিড লাইফ এনজয় করতে চান। আগের পক্ষের বাচ্চা এই নতুন শুরু করা জীবনে বোঝা ছাড়া আর কিছুই না। তখন কাউকে তো লাগবে জীবনে। মা বাবা ডেটিং করে বিজি, আমিও তাই করব। সহজ হিসাব। এসব বয়ফ্রেন্ড একটা সময় পর্যন্ত প্রচন্ড ভালবাসে কিন্তু সব পাওয়া হয়ে গেলে বিশেষ করে বাচ্চার দায়িত্ব মাথায় পরলে মেয়েটাকে নিজের "ফান" লাইফের ভিলেন মনে করে অত্যাচার করতে শুরু করে। মেয়েটা সহ্য করে ভীষন সুখের সময়গুলো ফিরে আসবে সে আশায়। ভালবাসা যে একটা মানুষকে কি ভীষন অসহায় করে দেয়! মেয়েটা মার সহ্য করেও না ছেড়ে গেলে ছেলেটার পুরনো ভালবাসা ফিরে আসার বদলে আরো ঘৃনা তৈরি হয়। একটা অাত্মমর্যাদাহীন, অনুভূতিহীন সস্তা পুতুল মনে হতে থাকে মেয়েটাকে। মেয়েটা যদি অতি অত্যাচারে একসময় ঘৃনা করতে শুরু করেও দেয় কি লাভ? যাওয়ার তো জায়গা নেই। পরিবার থেকেও নেই, বন্ধুর বাড়িতে কতদিন এবং পার্ট টাইম জব করে সব খরচ মেটানো সম্ভব না, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তো নাই। আর মানসিকভাবেও কেউ পাশে থাকা চাই, মারলেও পাশে তো আছে। এসব ভেবেই অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে অনেক মেয়ে।
এডাল্ট, শিক্ষিত, ওয়ার্কিং ওম্যানরা এবিউজ ইমোশনাল হয়ে ভালবাসার দায়ে পরে সহ্য করেন। আর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এমন অনেক নারী আছেন যারা অনুভব করেন একটা পুরুষ খারাপ হোক ভাল হোক তার আশ্রয়ে আছি, নিরাপদ আছি। তবে বেশিদিন সহ্য করেন না কেননা নিজেকে সাপোর্ট করতে পারলে অন্যের সাপোর্টে সাধারনত মানুষ নির্ভরশীল হয় না। সমস্যা মেইনলি ইয়াং মেয়েদের নিয়ে যারা পড়াশোনা শেষ করেনি, শুধু পার্ট টাইম জব করার যোগ্যতাই অর্জন করেছে। ব্রোকেন হওয়ায় পরিবার থেকে ছাড়া ছাড়া এবং হয়ত স্কুলেও বয়সন্ধিকালিন খিটমিটে মেজাজের কারনে বন্ধু নেই। সম্বল সবেধন নীলমনি সেই বয়ফ্রেন্ড! তাদেরই বেশি মুখবুজে সব সহ্য করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রবনতা থাকে।
ব্যাস আমার বিশ্লেষন শেষ। আপনাদের মতামত দেবেন জানি। আমার সাথে না মিললে বলব আমার জীবন কাহিনীর কারনগুলো এসবই ছিল। এক প্রশ্নের তো কত উত্তরই হয়, আপনাদের উত্তর জানার আগ্রহে রইলাম!
শেষ খবর: অলিভিয়ার লাস্ট খোঁজ যা জানতাম তা ছিল বয়ফ্রেন্ড বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে এবং ও কাজের জন্যে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার বেশ অনেকদিন পরে আন্টি ওর আর ওর বাচ্চার ছবি পাঠিয়েছিল। মা, ও বাচ্চা দুজনেই ভাল ছিল। আমি আশা করি সময়ের ফেরে জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছে সুন্দর করে।
আপনারা দয়া করে অলিভিয়াকে খারাপ, জেদি, বেয়াদব ভাববেন না। কিশোরি ওর বৈরী পরিস্থিতিটাকে মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখবেন সে আশা রাখি।
বিশেষ কথা: এ বিষয় নিয়ে পর্ব পরে লেখার ইচ্ছে ছিল। আমি ঠিক করেছিলাম স্কুলের মজার কিছু গল্প নিয়ে লিখব এ পর্বটা। আগের এত সিরিয়াস পর্বের পরে হালকা কিছু নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম আরকি! কিন্তু আগের পর্বে অনেকের কমেন্টে মনে হল একজন কানাডিয়ান বা পশ্চিমি নারী কেন প্রতিবাদ করেনা সে বিষয়ে লেখা উচিৎ। আগের পর্বে অনেককে কথা দিয়েছিলাম যে এটা বিশ্লেষন করব, আমি কথা রাখলাম। সেসব কমেন্টদাতাকে ধন্যবাদ যাদের সাথে কথা চলাকালে এটা নিয়ে লেখার ইচ্ছে জেগেছিল।
পাঠক দয়া করে এটা ভাববেন না এটাই পশ্চিমি কালচারের নিয়মনীতি। সব পরিবারে হয়। তা না। অনেক মেয়েই ছেড়ে দেয় এবিউজিভ সম্পর্ক। অনেকের মা বাবা পরিবারের সবাই মিশেমিশে ভালবাসার সুখের সংসার। আমি শুধু অত্যাচারিতদের কথাই লিখেছি বিশ্লেষনের জন্যে। আর আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি সব পুরুষ খারাপ না এবং অনেক পুরুষই খারাপের শিকার। এ লেখাটা অসহায় নারীদের নিয়ে মানবিকতা থেকে লিখেছি, নারীবাদীতা থেকে না।
কিছুদিন আগেই এ বিষয়ে নিয়ে বলা কানাডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডোর একটা সুন্দর কথা দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছিলেন, "কানাডায় অনেক মেয়ে নারী অধিকারের জন্যে, ইকুয়ালিটির জন্যে লড়ছে, সেটা অনেক ভাল বিষয়। কিন্তু আমি চাই আরো কানাডিয়ান পুরুষেরা নারী অধিকারের জন্যে লড়ুক।"
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৯