কানাডায় আসার পরে অনেক কিছু নতুন দেখেছি। প্রতিমুহূর্তে হাজারটা কালচার শক। আজ এক বিশেষ কালচার শক নিয়ে কথা বলব যা আমার অস্তিত্বকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। আজকের গল্পগুলো মনের খুব কাছের, কেননা তারা কিশোরি আমার বয়স এক লাফে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল!
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১০) সমকামিতা ১৮++
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১১) - কিশোরিবেলায় কানাডার প্রথম ভালোলাগা - এক গ্রিক দেবতারূপী সুদর্শন কানাডিয়ান ছেলে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১২) - বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে এবং আমার স্কুল জীবনে তার প্রভাব
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৩) - কানাডায় বিয়ে, লিভ টুগেদার, ডিভোর্স এবং কিশোরি আমি (১৮+)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৪) - বাংলাদেশীদের বিয়ে ভাবনা নিয়ে বিদেশীদের দৃষ্টিকোন এবং আমার নারী জীবন
তখন মোটামুটি নতুনই। প্রথম সেমিস্টার শেষ করে পরেরটা শুরু করেছি। আমি কানাডিয়ানদের ইংলিশ বুঝি কিন্তু ওরা আমারটা সহজে বোঝেনা, রিপিট করতে হয়। আগের সেমিস্টারে যে দুএকজনের সাথে কষ্টেসৃষ্টে ভাব জমিয়েছিলাম নতুন সেমিস্টারে তারা অন্য শাখায় পরল। আমি আরো অসহায় হয়ে গেলাম। যেসব টিচার আগলে রাখতেন তারা বদলে নতুন টিচার আসলেন। যা জমিয়েছিলাম সব হারিয়ে আবারো আমি নি:স্ব। ইংলিশ ক্লাস ছিল সেই সেমিস্টারে। কি যে কঠিন লাগত! মার্ক খুব লো আসত ইংলিশে। সারাক্ষন পড়েও ভাষা সমস্যা, আলাদা পড়ানোর ধরনে কোন কুলকিনারা করতে পারছিলাম না।
সাইন্স ক্লাসেও একই অবস্থা। ল্যাব করতে হত প্রায় প্রতি সপ্তাহে। সিরিয়াস লেভেলের ফর্মাল ল্যাব এবং রাইটআপ এখানে অনেক ছোট থাকতেই করায়। কানাডায় ল্যাব করতে গেলে শুধু দেশের ল্যাব ক্লাস কল্পনায় ভেসে উঠত। আমাদের মফস্বলের ক্লাসে ল্যাব সরন্জাম কত কম আর অনাধুনিক ছিল! অনেককিছুই ভাংগাচুরা কিন্তু আমরা শেয়ার করে চালিয়ে নিতাম। দলবেঁধে বান্ধবীরা ল্যাবরুমে যেতাম আর ল্যাবে টাংগানো কংকাল দেখে তোর বর বলে ক্ষেপাতাম একে অপরকে। সবার সাথে মজায় মজায় ল্যাব শেষ হত। আর কানাডায় রুমের মধ্যেই ল্যাবের সব ব্যবস্থা থাকে। প্রতি টেবিলের সাথে এটাচড সিংক! রুমের সাথে লাগোয়া বড় স্টোররুমে সব জিনিসপত্র থাকে। ল্যাবের দিনে টিচার প্রয়োজনীয় সরন্জাম বের করে এনে ক্লাসরুমে রাখেন। কি সব দামী অাধুনিক ভয়াল দর্শন সব জিনিসপত্র, নামই জানতাম না বেশিরভাগের! মাত্র তিরিশটা স্টুডেন্টের জন্যে অতো জিনিস! অন্য স্টুডেন্টরা আরো ছোট বয়স থেকে ওসব ব্যবহার করে ল্যাব করত কিন্তু আমার হাত কাঁপত। কিভাবে কোন যন্ত্র ব্যবহার করতে হয় জানতাম না। পাশের জনের হেল্প চাইতাম বারবার অসহায় হয়ে। ল্যাবের ওপরে কোর্সের ২৫% মার্ক ছিল। বন্ধু না থাকায় প্রতি ল্যাবে টিচারকে বলতে হত আমার কোন ল্যাব পার্টনার নেই ঠিক করে দিন। পাগল পাগল লাগত মাঝেমাঝে। সবকিছু যখন কঠিন হতে থাকে কোন এক আলোর দরজা খুলে যায়। আমারো খুলল।
কয়েক সপ্তাহ ক্লাস হয়েছে নতুন সেমিস্টারে। আমি একা একা সামনের রোয়ে বসি ক্লাসে। এক পাকিস্তানি মেয়ে ঢুকল ক্লাসে; মাথায় হুড পরা, লং স্কার্ট এবং টিশার্ট। গোলগাল বড় চোখের চেহারায় আপাদমস্তক ভালোমানুষি। মেয়েটা টিচারকে বলল সেমিস্টার ব্রেকে দেশে যাওয়ায় ক্লাসগুলো মিস হয়েছে। টিচার মেয়েটাকে আগের পড়ার সব ওয়ার্কশিটগুলো দিয়ে দিল। মেয়েটা আমার পাশের চেয়ার খালি দেখে অনুমুতি নিয়ে বসে পরল। আমার দিকে খুব মিষ্টি করে হাসল। সেদিন কথায় কথায় মোটামুটি একটা ক্লোসনেস তৈরি হল। মেয়েটার নাম আসমা; ক্লাস ফাইভ থেকে কানাডায়। কিন্তু ভীষন ধার্মিক, এবং নিজ কালচারকে এখনো মানে। এসব শুনে একধরনের কানেকশন বোধ করলাম। আসমাও আমাকে সালোয়ার কামিজে দেখে বুঝে গিয়েছিল ওর মতো করেই ভাবি আমি। ও স্কুলের পুরনো ছাত্রী, আমার মতো অসহায় অবস্থা না। কিন্তু দুজনের ধর্মীয় ভাবনা এক হওয়ার কারনে বেশ কাছে এসে গিয়েছিলাম প্রথমদিনেই।
পরেরদিন সেই ক্লাসেরই দুটো কানাডিয়ান মেয়ে আমাদের টেবিলে এসে বলল, "এসমা, এখানে কেন? আমাদের কাছে বসো।" আমার মন খারাপ হয়ে গেল। একটা মনের মতো বন্ধু হচ্ছিল, সেও গেল। কিন্তু আসমা ওদের টেবিলে মুভ করার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে গেল। ঐ কানাডিয়ান মেয়েদের জিগ্যেস করল আমি ওদের জয়েন করতে পারি কিনা? ওরা বলল, "অফ কোর্স!" একক্লাসে তিন বন্ধু হয়ে গেল আমার। আস্তে আস্তে খেয়াল করলাম তিনজনই ভীষন ভালো মেয়ে এবং পড়াশোনায় মোটামুটি খারাপ। আমি মাসখানেক পরে ভালো মার্ক পেতে শুরু করলাম এবং ওদেরকে হেল্প করতাম। এভাবে বন্ধুত্ব গাড় হলো। এদের মধ্যে একটা কানাডিয়ান মেয়ের নাম শেন, হালকা মোটা, খুব জলী একটা চেহারা এবং চুল খুব লম্বা। আমার নিজেরও লম্বা চুল। তাই আমরা কমপেয়ার করতাম আমাদের মধ্যে কার চুল বেশি লম্বা? আসমা বিচারক থাকত। কখনো আমাকে জেতাত, কখনো ওকে। এভাবে সুখের, ভীষন সুখের ৭০ মিনিটের সাইন্স ক্লাস কেটে যেত। টিচারকে তখন জিগ্যেস করতাম তিনজনের গ্রুপে ল্যাব করলে সমস্যা নেই তো? কেননা ল্যাব সাধারনত দুজনে করে। টিচার আমাদের কিছু বলতেন না। আমরা তিনজনেই পাগলামিপূর্ন সব কথাবার্তা, আড্ডায় মেতে থাকতাম সারাক্ষন। আমি গড়গড় করে ইংলিশ বলে যেতাম ওরা পাশে থাকলে। অন্যক্লাসে তেমন বন্ধু না থাকলেও আমি সেই প্রচন্ড পাওয়াতেই অনেক সুখী ছিলাম।
একদিন শেন ক্লাসে আসল না। এভাবে এক সপ্তাহ চলে যাওয়ার পরে আসল। ওকে না আসার কারন জিগ্যেস করলে বলল, "আমার মা আমাকে বাবার কাছে পাঠিয়েছিল অন্য শহরে। এজন্যে আসতে পারিনি।" আমি তো তখনও কানাডিয়ান কালচার তেমন বুঝি না, বাংলাদেশি কালচার ছাড়া কিছুই বুঝিনা আসলে। আমি বললাম, "তোমার বাবা দূরে কাজ করে? অনেক মজা করলে তার সাথে? তোমার মা কেন গেল না?" ও বলল, "মা কেন যাবে? আমার মা বাবা ডিভোর্সড।" আমি ওর দিকে কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে থাকলাম। আমি আগে শুনেছিলাম ডিভোর্স হলে মা বাবা আলাদা হয়ে বাচ্চাটা অনেক কষ্ট পায়। মুভিতে অনেক ড্রামা/কেসও দেখেছি এসব নিয়ে। কিন্তু সামনাসামনি একটা ব্রোকেন ফ্যামিলি কিড প্রথম দেখলাম। আমি মুভির জিনিস বাস্তবে দেখে উত্তেজনা বোধ করলাম। ওকে জিগ্যেস করলাম, "তুমি মাঝেমাঝেই এভাবে বাবার কাছে যাও?" ও বলল, "না যখন আমার মা কোন ছেলেকে ডেট করে বাড়িতে আনে তখন পাঠিয়ে দেয়। মায়ের বয়ফ্রেন্ড বাড়িতে কিছুদিন বেড়াতে আসলে আমাকে রাখা হয়না। ওরা আনকমফর্টেবল ফিল করে।" এটা খুবই স্বাভাবিক, হাশিখুশি টোনে বলল। আর আমিতো এদিকে শেষ। কাঁপছি রীতিমতো। মনকে বলছি ইংলিশ বুঝিসনি তুই। ও অন্যকিছু বলেছে, তুই ইংলিশ বুঝিসনি। এরকমও হয়? মা বাড়িতে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে এসে মেয়েকে বের করে দেয়? আর সে মেয়ে কোন মুভি ক্যারেক্টার না আমার কাছের বান্ধবী?
আমি কিভাবে সেদিন ঠান্ডা মাথায় ক্লাসটা শেষ করেছিলাম আল্লাহই জানেন। সেদিনের শেষ ক্লাস ছিল বলে রক্ষা। বাড়িতে আসার পথে কিছুক্ষনের জন্যে ভুলে গিয়েছিলাম। তারপরে টিপটা খুলে আয়নায় রাখতে রাখতে হুট করে আবার মনে হল। আমি মা মা বলে চিল্লানো শুরু করে মা আসতে পুরো কাহিনী বললাম মাকে। মা বলল, "ছি ছি কি অসভ্য এরা, এইযে শুনছ?" বলে আমার বাবাকে কাহিনী শোনাতে চলে গেলেন। তারা বিরক্তির মধ্যেও একধরনের বিনোদন খুজে পেয়েছিলেন বলে মনে করি। মজার টপিক পেয়েছিলেন গল্প করার। কিন্তু আমি আসলেই প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম আমার বান্ধবীর এমন অসহায়ত্বে। ও যতোই হাসুক না কেন এক ভীষন তীব্র ব্যাথা ওর চোখে আমি পড়তে পারতাম। মফস্বলের মেয়ে আমি, সরল আবেগী মনে যদি মানুষের আবেগই না বুঝতে পারি তবে আর কি শিখলাম?
সেদিন থেকে আরো মায়া জন্মে গেল ওর ওপরে। আমি আগে লাঞ্চে বাড়ি আসতাম কিন্তু তখন থেকে ওকে সময় দিয়ে স্কুলেই থাকতাম। প্রথমে ওর অন্য বন্ধুদের সাথে আমাকে নিয়ে হ্যাং আউট করত। কিন্তু একটা সময় পরে শুধু আমরা দুজনই স্কুলের আশেপাশে বনবন করে ঘুরেঘুরে গল্প করতাম। একদিন ও আমাকে বলল একটা সিক্রেট জানতে চাও? আমি বললাম কি সিক্রেট? ও বলল, "কালকে আমার মাকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেক্স করতে দেখে ফেলেছি। ওরা জানত না আমি থাকব বাড়িতে সে সময়।" আমার ১০৫ ডিগ্রি জ্বরের কাঁপুনি এসে গেল। কিন্তু ও এত সাবলীল ভাবে বলল যেন এটাই নরমাল। আর এর মধ্যে মজার কোন এলিমেন্ট আছে। আমি জিগ্যেস করলাম ধরা পরোনিতো? ও বলল, "না চুপ করে চলে এসেছিলাম, It was so gross yaak!" আমি কিছুক্ষন নিলাম ধাতস্ত হতে। নিজেকে সামলে কাঁদো কাঁদো মুখে ওকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে গেলাম। ও অবাক হয়ে বলল, "এতো ইমোশনাল হচ্ছো কেন? চিল ম্যান। নট আ বিগ ডিল!"
খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। মনে মনে ভাবছিলাম নট আ বিগ ডিল? রিয়ালি? সেদিন ওর প্রতি মায়া একটু কমে গিয়েছিল। আসলে ওকে আমি দুঃখী মনে করে মায়া করে বন্ধুত্ব বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু সান্ত্বনা তো ওর লাগত না। এসবে ওর অভ্যাস আছে। তাহলে আর কি ভেবে বন্ধুত্ব রাখব? আমি ওকে ভুল বুঝেছিলাম, ও কষ্ট পাচ্ছে এ উপলব্ধি ভুল ছিল জেনে নিজেকে বোকা মনে হল। ভাবলাম এ বাংলাদেশ না যে বান্ধবীদের চোখের দিকে তাকালেই মন পড়তে পারব। এখানে সবাই আলাদা, ওরা মুখে বলে দিলেও আমি কিছুই বুঝবনা। এই ভাবনাটা আমাকে অনেক কষ্টে রাখত। আমি যে কানাডায় কি ভীষন একা তা গভীর ভাবে উপলব্ধি করলাম। বুঝলাম আমি চাইলেই এরা আমার মনের মতো বন্ধু হবেনা বা আমিও ওদের মন বুঝতে পারবনা। সেদিন বাড়িতে এসে এসব মনে করে কেঁদেছিলামও অসহায় হয়ে।
আমি শেন এর সাথে লাঞ্চে মেলামেশা করতাম এবং ক্লাসেও নরমালি হাসি ঠাট্টা চলত। যদিও ও মাঝেমাঝে গ্যাপ দিয়ে স্কুলে আসত। সেদিন আবার বাড়িতে আসতাম লাঞ্চে। এভাবে চলতে চলতে প্রায় দুই মাসের মাথায় জানলাম শেন এই সাইন্স ক্লাসটা এখন থেকে অনলাইনে করবে। ওকে বারবার বাবা মায়ের শহরের মধ্যে মুভ করতে হচ্ছে। ক্লাস বেশি মিস হয়ে ফেল করছে। ও শুধু ফিজিক্যাল এডুকেশন ক্লাসটা করার জন্যে স্কুলে আসত। স্বভাবতই সেটাও মিস করত শহরে থাকতে না পারার কারনে। কিন্তু সেই ক্লাসে "মেকআপ ক্লাস" এর সুবিধা থাকত। মানে লাঞ্চ টাইম, স্কুলের আগে, পরে টিচারের সামনে সব গেমস খেলে, এক্সারসাইজ করে মিস করা দিনটা পুষিয়ে দেবার। স্টুডেন্ট একাই টিচারের সামনে সব করবে এবং টিচার মার্ক করবে। ও এভাবে করেই চালাত। স্বভাবতই সাইন্স ক্লাসে না আসার কারনে এবং ওভারঅল খুব ইরেগুলার হওয়ার কারনে ক্লোসনেস কমে গেল। প্রায় ভুলেই গিয়েছি ওর কথা।
এভাবে প্রায় সেমিস্টারের শেষ শেষ। আমি সব ক্লাসে আবারো নিজেকে প্রমান করে ফেলেছি। প্রতি ক্লাসে একজন পাশে বসার মানুষ জুটিয়ে ফেলেছি। কেউ বন্ধু বলে পাশে বসত, আর কেউ পড়াশোনায় হেল্প পাবে বলে। কিন্তু আমি একা বসতে হচ্ছে না তাই ভেবেই খুশি ছিলাম। সবকিছু ভালোই চলছে। ফাইনালের পড়াশোনা কয়েকদিন পরেই শুরু করে দেব। আমি দেড় মাস আগে থেকে রুটিন করে রিভাইস দিতাম। যাই হোক, একদিন লবি দিয়ে হেটে লকার থেকে সোয়েটার আনতে যাচ্ছি। বাড়িতে যাব লাঞ্চে। লবির এক সাইডের বেঞ্চে একটা মেয়ে মাথা নিচু করে ফোপাচ্ছে। আমার খারাপ লাগল, মায়া করে ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে আহারে বলতে বলতে চলে যাচ্ছিলাম।
হঠাৎ করে পেছনের লম্বা চুল চোখে পরল। ফিগার খেয়াল করে বুঝলাম এতো শেন! আমি দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। ওর পিঠে হাত দিয়ে বললাম কি হয়েছে? ও মাথা উঠিয়ে চোখের পানি একনিমিষে মুছে ফেলল এবং মুখ হাসি করে উচ্ছাস নিয়ে বলল, "হেই গার্ল, লং টাইম নো সি! কেমন আছ? তোমাকে অনেক মিস করেছি।" আমি বললাম সেসব বাদ দেও, তুমি কাঁদছ কেন? ও হাত নাড়িয়ে বলল, "কিছু না এমনি, তোমার খবর বল। মার্ক কেমন পাচ্ছ? স্ট্রেইট A রাইট?।" আমি ওর কথা ঘোরানোতে বিরক্ত হয়ে খুব কড়া কন্ঠে দাঁত চিবিয়ে বললাম, "কাঁদছিলে কেন?" ও ভয় পেয়ে গেল। আসলে আমি বেশ নরম সরম মানুষ। কাউকে যদি হঠাৎ করে বকে উঠি আমার রুদ্রমূর্তি দেখে হকচকিয়ে যায়। ও অনেক অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। সেই স্কুলে বাইরে বের হওয়ার অনেক দরজা ছিল। প্রতিটা লবিতে দুটো করে দরজা থাকত। আমি ওর হাত ধরে ভীরের লবি থেকে নিকটস্থ দরজা দিয়ে মাঠে আনলাম বাইরে। হাত ধরে এনে বাইরে নির্জনে ঘাসের ওপরে বসালাম। বললাম কি হয়েছে? ও আর ধরে রাখতে পারল না। কেঁদে ফেলল ঝরঝরিয়ে। আমি ওর কোলের ওপরে রাখা হাতে হাত রেখে ইশারা করলাম বল সব আমাকে। ও বলল, "আমার বাবা আমেরিকা মুভ করেছে। মায়ের বয়ফ্রেন্ড বাড়িতে আসলেও থাকতে হচ্ছে একই বাড়িতে। রাতে পাশের রুম থেকে আসা শব্দে ঘুম ভেংগে যায় আমার। মায়ের এই বয়ফ্রেন্ডটা খুব রাফ। মাঝে মাঝে আমার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করে। আমার ব্রেস্টে হাত দিয়ে ঠেসে ধরেছিল কালকে। কোনভাবে ছাড়িয়ে বেঁচে এসেছি।"
ও আরো অনেককিছু তোতাপাখির মতো বলে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। কি ভীষন এক ঘৃনা লাগছিল পৃথিবীর প্রতি! আমি এসব পেপারে পড়তাম কিন্তু ওর মতো ইয়াং একটা মেয়ে আমারই বয়সি এসবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে! আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। ওকে কি সান্ত্বনা দেব? আমি নিজেই ভেংগে গেলাম। আমার বান্ধবী সেক্সুয়াল হ্যারেসমেন্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে নিজেরই বাড়িতে! এসব সত্যি হয়? আসলে মফস্বলের সরল পরিবেশে মানুষ হওয়া আমি অনেক অপরাধ কাছ থেকে দেখিনি। আমি পেপারে, মুভিতে অনেককিছুর কথা শুনতাম কিন্তু এত কাছে প্রথম! কি ভীষন এক হাহাকার জন্মেছিল আমার মধ্যে সেদিন! দুনিয়া আসলেই এত খারাপ? এত পাপের?
আমি শূন্য চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও আমার বাহু ঘষে কমফর্টেবল ফিল করানোর চেষ্টা করছিল। হায় আমারই সান্ত্বনা দেবার কথা ছিল কিন্তু কি হচ্ছে এসব? আমি সংবিত ফিরে পেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কাঁদলাম দুজনে মিলে। এভাবে পুরো লাঞ্চ টাইম চলে গেল। ঘন্টা পরলে আমাদের হুশ হল কাঁদতে কাঁদতে ঘন্টার বেশি কেটে গিয়েছে! মনে হল ক্লাস টেস্ট আছে আজ। ফাইনালের আগে ইংলিশের শেষ ক্লাস টেস্ট, ভালো করে মার্ক আরো বাড়াতে হবে। দৌড়ে বাই বলে ছুটলাম ক্লাসে।
সেদিন আমি ভেবেছিলাম ওকে নিজেদের বাড়িতে এনে রাখব। ব্যাপারটা শুধু ব্রেস্টে হাত দেওয়া পর্যন্ত থেমে থাকবেনা সেটা কিভাবে যেন বোকা কিশোরি আমি বুঝে গেলাম। হয়ত ওর কথায় বয়স অনেক বেড়ে গিয়েছিল! সেদিনই বলতে পারিনি কেননা মাকে জিগ্যেস করতে হত। বাড়িতে পুরো কাহিনী না বলে শুধু বান্ধবী কয়েকদিনের জন্যে থাকবে বললাম। মা খুশি হল যে আমার এরকম কাছের কানাডিয়ান বন্ধু হয়ে গিয়েছে। মানে আমি স্কুলে এডজাস্ট করে নিয়েছি। সহজেই হ্যা বলে দিলেন। পরেরদিন স্কুলে উত্তেজিত হয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছি ও হ্যা বলবে তো? ওরা তো এত স্পাইসি খাবার খায় না সেজন্যে মানা করতে পারে (এসব সিলি ভাবনা ভেবেও এখন হাসি পায়)। কিন্তু সেদিন ওকে পেলাম না। আসমার কাছে জিগ্যেস করলাম কোন খোঁজ নেই।
এভাবে এক সপ্তাহ যাওয়ার পরে ও একদিন আসল আমাদের জন্যে চকোলেট নিয়ে। জন্মদিন কিনা ভাবতেই বলল আজকে আমাদের লাস্টবারের মতো দেখছে। ও আমেরিকা শিফ্ট করছে বাবার কাছে। আমি যে কি ভীষন খুশি হয়েছিলাম ওর জন্যে! অন্যসবাই আমার চেহারার উজ্জ্বলতা দেখে অবাক হচ্ছিল। বন্ধু চলে যাচ্ছে আর আমি! কিন্তু ওরা যদি জানত কি প্রকান্ড বিপদ থেকে মুক্তি মিলছে ওর তবে আনন্দে নাচা শুরু করে দিত। সবাই অনেক মন খারাপ করছিল কিন্তু আমি আর শেন ইশারায় হেসে যাচ্ছিলাম। কে বলে আমি কানাডিয়ানদের বুঝতে পারব না? ওর অন্য কানাডিয়ান বন্ধুদের চেয়েও আমি বেশি বুঝেছিলাম ওকে। সেটাই শেষ দেখা ছিল।
অবাক/অসহায় আমি: আমার যে কি ভীষন ঘিন্না লাগত এসবে তা লিখে বয়ান করতে পারবনা। পাঠক ভাববেন না যে কানাডায় এসব ঘরে ঘরে হয়। তা না, অনেক ভালো পরিবারও আছে। মি: এমই (আগের পর্বের) যেমন কি সুন্দর বউ, দুই বাচ্চা নিয়ে পবিত্র ভালোবাসার সংসার। এরকম আরো হাজারটা আছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব একটা মেজর পার্সেন্টেজ। এক গবেষনা পড়েছিলাম যে নর্থ আমেরিকায় ৭০ ভাগের মতো ধর্ষন একটা মেয়ের বাড়িতে হয় কোন এক পরিচিতের কাছে! খবরটা পড়ে কি ভীষন অবাক হয়েছিলাম আমি! এরকম হাজারটা হলিউড সেলিব্রেটির জীবনীতে আছে যে সৎ বাবার কাছে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছেন। তাদের ইন্টারভিউ দেখে অবাক হতাম। আসলে প্রতিটি কালচার, জীবনযাত্রার ভালো খারাপ থাকে। আমার ঘৃনাটা কানাডিয়ান, বা ওদের কালচারের ওপরে ছিলনা। এধরনের মানুষদের ওপরে ছিল! শেন অনেক লাকি যে ওর বাবা ওর দ্বায়িত্ব নিয়েছিল। অনেকসময় কোন প্যারেন্টই দ্বায়িত্ব নেয় না। একটা কিশোরি মেয়ে কোথায় থাকবে কি করবে কিছুই ভেবে পায়না! অনেকে বয়ফ্রেন্ডের সাথে লিভ টুগেদার করে। আবেগী বয়সে ভুল করে প্রেগন্যান্ট হয়! And it only gets worse from there.
আমার নিজের বান্ধবীর সাথে এসব হওয়াটা কিশোরি আমাকে অনেক বড় ট্রমার মধ্যে পাঠিয়েছিল। আমার মনে হত আমার সাথেও তো এসব হতে পারে, আমিও তো সেই বয়সেরই। তার আগে নিজেকে একদম বাচ্চাই মনে করতাম। স্কুলে পড়ি বাচ্চাইতো। কিন্তু সেদিন মনে হত বড় হচ্ছি আমি। মা ঠিকই বলে সামলে চলা উচিৎ। মায়ের অনেক কথার মানে বুঝতে শুরু করেছিলাম তারপর থেকে। এর আগে ভাবতাম ছেলেরা ক্লাসে অনেক দুষ্টুমি করে। এর চেয়ে বেশি পুরুষসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মনে কিছু হতো না। কিন্তু সে ঘটনার পরে মনে হতো কিছু পুরুষ জানোয়ারের চেয়েও খারাপ হতে পারে। মেয়ের বয়সী কারো সাথে কেউ কিভাবে ছিঃ। ক্লাসের মেইল টিচারদের কাছে ব্রেকে একা হেল্প চাইতে যেতে ভয় লাগত। আমার কোন টিচারই ওরকম ছিলেন না, তারা তো ফেরেশতার মতো মানুষ ছিলেন। কিন্তু সেই ভয়টা আমার ভাবনাকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছিল। যদিও আমার আশেপাশে অনেক ভালো পুরুষ বিশেষ করে টিচার থাকার কারনে খুব জলদি এসব নোংরা ভয় মন থেকে চলে গিয়েছিল।
কিন্তু আমি শুধু শুনেই বিশ্বাস হারিয়েছিলাম। আর যেসব মেয়েদের সাথে সত্যি সত্যি খারাপ কিছু হয় তাদের অবস্থা কি হয়? তারা কি জীবনে কখনো কাউকে বিশ্বাস করতে পারে? এসব আমাদের দেশসহ পৃথিবীর সব দেশেই হয়। অন্য অনেক পর্বে আমি সমস্যা বলে নিজের কিছু সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি। এক কালচার থেকে আরেক কালচারের ভালটা শিখে বা অন্য লজিক দিয়ে বলি এভাবে করে এ সমস্যা থেকে বের হওয়া যায়। কিন্তু সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের ক্ষেত্রে কি বলব? পৃথিবীর প্রতিটি দেশে যেকোন কালচারে এসব হয়েই যাচ্ছে, বেড়েই যাচ্ছে। কোন দেশে পরপুরুষের দ্বারা আবার কোন দেশে বাসর রাতে স্বামীর দ্বারা মেয়েরা কতবার কতভাবে যেকোন বয়সের রেন্জে ধর্ষিত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। আমি যা শুনেই কেঁপে উঠেছিলাম অনেক মেয়ে আমার চেয়েও কম বয়সে একদম ধর্ষিতই হচ্ছে। শেনের সাথে তো সেভাবে কিছুই হয়নি দেখতে গেলে।
ধর্ষন এমন একটা জিনিস যা নিয়ে অনেক ছেলেও লজ্জাবোধ করে। অনেক পুরুষকে বলতে শুনেছি আমাদের মধ্যে থেকেই এরকম জানোয়ার বেরিয়ে আসে ভেবে নিজের ওপরে ঘৃনা আসে। সেসব পুরুষের প্রতি সম্মান তোলা রইল। আর যারা জানোয়ারের মতো মেয়েদের শরীর ছাড়া আর কিছু বোঝেনা তাদেরকে নিয়ে আমি অতি ঘৃনায় আর কিছুই লিখতে পারছিনা।
আমি শুধু আশা করছি দুনিয়াটা সুন্দর হবে। কিশোরি বয়সে আমি দুনিয়াটাকে ভীষন সরল, সভ্য, সুন্দর মনে করতাম। প্রজাপতির পেছনে দৌড়ে নাজেহাল করাটাকে সবচেয়ে বড় পাপ মনে করতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে বিভিন্ন ঘটনায় সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। আমি আবারো সাদা চোখে পাপবিহীন সরল দুনিয়া দেখতে চাই। কখনো সে দিন আসবে কিনা কে জানে?
শেষ খবর: শেনের সাথে তারপরে আর যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু আসমার সাথে এখনো যোগাযোগ আছে। ও ব্যাচেলরস অফ আর্টস করছে। আর আসমার অনেকদিন পর্যন্ত শেনের সাথে যোগাযোগ ছিল। ওর মুখে শোনা লাস্ট খবর পর্যন্ত ও আমেরিকায় ভালো আছে, কয়েকবছর পরে কানাডায় আবার মুভ করবে। এর বেশি কিছু জানিনা, অবশ্য ও ভালো আছে এ খবরই আমার কাছে যথেষ্ট।
বিশেষ কথা: আমি প্রতি পর্বেই ভাবতাম শেনের ঘটনা লিখব। কেননা সেটা আমার পুরো জীবনকে কিছু সময়ের জন্যে তছনছ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা এত কষ্টের স্মৃতি ছিল যে আমি আর পাতাটা ওল্টাতে চাইনি। ধুলা থেকে উঠিয়ে কষ্টগুলোকে ক্ষুরতে চাইনি। কিন্তু মনে হল সবই যখন বলছি, এত ক্ষুদ্র সব কাহিনী, তবে এত ভীষন বড় ব্যাপার কেন লিখব না? এ পর্ব লিখতে গিয়ে অসহায় কিশোরি বান্ধবীর চোখ কল্পনায় ভাসিয়ে কতবার চোখের পানি ফেলেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এতদিন ধরে মন খোচাচ্ছিল এটা লেখার জন্যে। এখন সেই ভয়ের মোকাবিলা করে মনের খোচানি বন্ধ করে শান্তি পেলাম।
পাঠকদের ভাল লেগেছে কিনা জানিনা কিন্তু এ পর্বটা লেখা আমার জন্যে খুব জরুরি ছিল। আমি অনেক দুঃখ শুধু নিজের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম অনেকদিন ধরে। এ পর্বগুলো লিখে সব আপনাদের সাথে শেয়ার করে হালকা লাগে নিজেকে। আজকেও ব্যতিক্রম হয়নি। আপনারা একেকজন মানুষ একেকবার করে পড়ে আমার অনেকগুলো দুঃখ নামিয়ে দেন। আমি অদেখা, অচেনা আপনাদের কাছে ভীষনভাবে কৃতজ্ঞ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৯