আগের পর্বে বলেছিলাম ওদের বিয়ে ভাবনা আমাকে কিভাবে এফেক্ট করেছিল। আজকে একটু টেবিলটা ঘুরিয়ে দিচ্ছি। বলছি আমাদের বিয়ে ভাবনা ওদেরকে কিভাবে এফেক্ট করে? আমার স্কুল জীবনে তার কী প্রভাব ছিল? বেশ কিছু টুকরো গল্প দিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১০) সমকামিতা ১৮++
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১১) - কিশোরিবেলায় কানাডার প্রথম ভালোলাগা - এক গ্রিক দেবতারূপী সুদর্শন কানাডিয়ান ছেলে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১২) - বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে এবং আমার স্কুল জীবনে তার প্রভাব
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১৩) - কানাডায় বিয়ে, লিভ টুগেদার, ডিভোর্স এবং কিশোরি আমি (১৮+)
গ্র্যাডুএটিং ইয়ারের ঘটনা বলব আজকে। ঐ ইয়ারের মার্ক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে ম্যাটার করার কারনে পড়াশোনা নিয়ে কিছুটা প্রেশারে থাকতাম। তবে ততদিনে আমি পুরোপুরি ওয়েল এডজাস্টেড। স্কুলে স্মার্ট কিড হিসেবে বেশ পরিচিত। টিচাররাতো সবসময় প্রশংসা করতেন। সব ক্লাসই ভাল ছিল তবে ইংলিশ ক্লাসটা আমার বেশি ভালো লাগত। আমি ওই ক্লাসে আমার প্রানের ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী জে এবং জাপানিজ মেয়ে শের সাথে বসতাম। ওদের সাথে অনেক মজায় ক্লাসটা হত। জে আর আমি অনেক বকবক করতাম যদিও শে চুপচাপ থাকত। শেষের দিকে আমাদের প্রভাবে শেও মনখুলে মিশত।
একদিন ক্লাসে একটা গল্প পড়ানো হচ্ছে এক কানাডিয়ান পাহাড়ি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের। সেখানে এরেন্জ ম্যারেজ হয় এবং ছেলেটাকে ইমপ্রেস করতে হয় মেয়ে এবং মেয়ের মাকে। ছেলে মেয়ের মা একে অপরের সাথে কথা বলে নেন। তারপরে প্রতিদিন শিকার করে মেয়ের বাড়ির সামনে কিছু রেখে আসতে হয় ছেলেটাকে। মেয়ের পরিবারের সবাই জানালা থেকে ছেলেটাকে নজরে রাখে সে সময়। এরকম অনেকদিন যাওয়ার পরে একদিন দরজা খুলে যায় এবং ছেলে দাওয়াত পায় খাওয়ার। ছেলে দাওয়াতে সেজেগুজে যায় মুখ হাসি করে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। সেখানেও ইমপ্রেস করতে পারলে তবেই বিয়ে। ছেলের মা হাজারটা টিপস দেয় এভাবে কথা বলবে ওভাবে বলবে না। কাহিনী আরো অনেক কিছু ছিল কিন্তু আমাদের টপিকের জন্যে এটুকুই রিলেভেন্ট।
কানাডায় টিচাররা চায় স্টুডেন্টরা প্রতিটি গল্পের সাথে রিলেট করে নিজে বিশ্লেষন করে তারপরে Essay লিখুক। আমাদের দেশে যেমন বই থেকে পড়ে সবাই একই জিনিস লেখে তেমন না। ওখানে নিজের ভাবনা থেকে সবাই নিজের মতো করে লেখে। টিচার রিডিং পড়া শেষে প্রশ্ন শুরু করলেন। একটা প্রশ্ন ছিল আমরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করি তো এধরনের সমাজ কেমন লাগল? একটা কোকড়া চুলের কানাডিয়ান ছেলে বলল "রিয়ালি? আমি ভেবেছিলাম কানাডা মিউচাল সমাজ।" সবাই আমরা হেসে ফেললাম, মিউচাল সমাজ আবার কি? টিচার বোঝালেন আমাদের সমাজে মেয়েরা বিয়ের আগে বাবার ও বিয়ের পরে স্বামীর পদবী নেয় এবং আরো অনেক উদাহরন দিলেন। ছেলেটা মাথা নাড়ল যদিও চেহারা দেখে বুঝেছিলাম কিছুই বোঝেনি।
এরপরে প্রশ্ন করলেন তোমাদের মধ্যে কে কে মা বাবার পছন্দে বিয়ে করতে চাইবে? তিরিশ জনের ক্লাসে তিনটি কানাডিয়ান মেয়ে এবং আমি হাত তুললাম। হাত তুলেই মনে হল এখন তো কারন জিগ্যেস করবে, কি বলব? অন্যরা হাইপোথেটিকালি উত্তর দেবে কিন্তু আমার জীবনে রিয়ালি হতেও পারে। অন্য মেয়েটা বলল আমার মা আমার বেস্ট বাডি, বন্ধু ডেট সেট আপ করার মতো হবে আমার জন্যে বিষয়টা। আরো সব সুন্দর কারন বলছে অন্যরা। কিন্তু আমার তো সুন্দর কোন কারন নেই। আমার কালচারে একটা সময় পর্যন্ত কাউকে পছন্দ না করতে পারলে বাবা মা প্রেশার দিয়ে বিয়ে করিয়ে দেন। কাউকে পছন্দ করলেও অনেক পরিবার জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেয়! কিন্তু এসব কথা বললেতো আমার কালচারের রেপুটেশনের বারোটা বেজে যাবে। বাকি তিনটা মেয়েকে জিগ্যেস করে আমার কাছে আসলেন। আমি বললাম আমার মা বাবা আমার খুব ভালো বন্ধু, আমার পছন্দ জানে। তাদের পছন্দ অবশ্যই আমার পছন্দ হবে। আপনারা খেয়াল করেছেন যে ঐ কানাডিয়ান মেয়েটার মতো উত্তর দিয়েছি? আসলেই ওরটাই অন্য ভাষায় বলেছিলাম।
তারপরে সবাইকে নিজেদের টেবিলের মধ্যে আলোচনা করতে দিলেন। জে অবশ্যই লাভ ম্যারেজের জন্যে হাত তুলেছিল। আলোচনায় বলল, "Marriage is all about looove!" লাভ শব্দটা টেনে টেনে সুন্দর করে বলেছিল। এখনো কানে বাজে। বললাম লাভ ম্যারেজেও ডিভোর্স হয়। ও বলল সেটা সমস্যা না আবার নতুন করে ভালবাসা খুজতে হবে। আমি বললাম এটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস? একটার পরে একটা আসতেই থাকবে? ও খুব অভিয়াস যেন এটাই নরমাল এমনভাবে বলল "হ্যা"। আমিও বললাম মা বাবাও ভালো ডিসিশন নিতে পারে। বিয়ের পরে ভালো লাগতে পারে। ও বলল কিন্তু ভালো না লাগলে বিয়ে করার মানে কি? আমি খুব ভালো তার্কিক তাই ওর সাথে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে পেরেছিলাম টিচার সবাইকে থামানোর আগে। শেষে ও মাথা নেড়ে আমার লজিক মানছে বলেছিল। কিন্তু মনে মনে কথাগুলো বাজত ঠিকই। এটা যেন মনে মনে হেরেও হার স্বীকার না করা!
তারপরে সাইন্স ক্লাসে ল্যাবের চক্করে এসব আলোচনা ভুলে গিয়েছি। গগলস নিতে যাব তখন একটা কানাডিয়ান মেয়ে যে আগে কখনো আমার সাথে কথা বলেনি শুধু হাসত চোখে পরলে জিগ্যেস করল, "তোমাদের দেশে কি বাবা মা জোর করে বিয়ে দেয়?" আমি অবাক হয়ে বললাম না না তা কেন হবে? তোমাকে কে বলল? ও বলল, "না এমনি।" মেয়েটা সিটে যাওয়ার পরে ওর বান্ধবী ওকে জিগ্যেস করল আমাকে এটা কেন বলল? মেয়েটা বলল ইংলিশ ক্লাসের ঘটনা। তারপরে দুজনে ইশারায় হাসতে লাগল। ঐ একই ক্লাসে বাকী তিনটা কানাডিয়ান মেয়ের মধ্যে দুইজন ছিল যারা এরেন্জ ম্যারেজ করতে পারে বলেছিল। তো আমার কথায় কেন প্রশ্ন শুরু হল? আমিতো এমন কিছু বলিও নি। কেননা ওরা জানে যে আমাদের দেশে বা এশিয়ানদের মধ্যে না দেখেও অনেক বিয়ে করে এবং এটা হাসির খোরাক ওদের কাছে। এসব নিয়ে অনেক প্রশ্ন করত আমাকে। মাঝেমাঝে ওদের মুখ বিকৃত হয়ে যেত শুনলে যে মানুষ না চিনেই একে অপরকে বিয়ে করে ফেলে? কিন্তু সাথে সাথে মুখে ভদ্র হাসিটা ফিরিয়ে আনত যাতে আমি মাইন্ড না করি। কিন্তু প্রথম এক্সপ্রেশনেই আমার খারাপ লেগে যেত!
একদিন মি: এম এর সাথে কথা হচ্ছে। আগের পর্বের সেই বউপাগল টিচার। তার বউ ফিলিপিনো ছিলেন। বলছিলেন প্রথমবার ওনার মা বাবা দেখে একটু চমকে গিয়েছিলেন যে মেয়ে ফিলিপিনো, কিন্তু কোন বড় সমস্যা হয়নি, তারা সহজেই মেনে নিয়েছেন। আমাকে জিগ্যেস করলেন, "তোমাদের কালচারে কি অন্য জাতি বিয়ে করে? যেমন তুমিই যদি বিদেশী খুব ভালো ছেলেকে পছন্দ কর তোমার মা বাবা কি মেনে নেবে?" আমি বললাম এমন অনেক বাংলাদেশী আছে যারা ভিনদেশী বিয়ে করে খুশি। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশী ছেলে না হলে বিয়ে করব না। অন্যকেউ জিগ্যেস করলে আমি এভাবে বলতাম না হয়তো কিন্তু মি: এম আমার চোখ পড়তে পারতেন। তাকে মিথ্যা বলার মানে হয়না। যুক্তি দিলাম তাই। বললাম এক দেশে যে ভালো ছেলে অন্য দেশে সেই খারাপ। যেমন এক দেশে মদ খেয়েও মানুষ ভালো হতে পারে কিন্তু আমি এলকোহলিকের সাথে সংসার করতে পারবনা। আমি চাই যাকে বিয়ে করি সে যেন বাংলাদেশী কালচার বোঝে, কেননা যে বাংলাদেশী কালচার বোঝেনা সে আমাকে কিছুই বুঝবে না। বাচ্চারা কনফ্লিকটেড হয়ে যাবে দুটো কালচারে। আরো অনেক কিছু বলে গেলাম। উনি সব শুনলেন।
বললেন তা ঠিক আছে কিন্তু জানো, "আমার নাম" হয়ত তোমার ভাবনা একদিন চেন্জ হবে! কানাডায় থাকতে থাকতে একদিন হয়ত এতটা বাংলাদেশী থাকবে না, তখন কি করবে?" এই প্রশ্নটা যে কেমন করে দিল বুকের ভেতরে! এ আবার কি কথা! এতদিনে কিছু চেন্জ হলাম না, আর এখন সিনিয়ার ইয়ারে এসব কি প্রশ্ন? আমি বললাম, "যখন নতুন ছিলাম অনেকে বলত জলদি চেন্জ হয়ে যাব, হইনি। আপনার কথার পরেও হবনা।" উনি হো হো করে হেসে বললেন, "Sassy, ha? Good for you." আমিও ওনার সাথে হেসে ফেললাম।
আসলে প্রথম প্রথম আমাদের এদিককার অনেক মানুষ (প্রবাসি, ভারতীয়, পাকিস্তানি ) বিদ্রুপপূর্ণ গলায় আমাকে বলতেন একদিন ডাল ভাত না মাফিন(কেক), সাবওয়ে স্যান্ডউইচের জন্যে পাগল হয়ে যাব, জিন্স, প্যান্ট পরতে শুরু করব এসব। আমি এসব কথা কখনো পছন্দ করিনি কেননা আমাকে খুব বেশি না জেনে এত আত্মবিশ্বাসের সাথে ভবিষ্যৎবানি করাটা অপমানজনক। আমার বিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব এতো ঠুংকো না যে অন্যের প্রভাবে ঢেকে যাবে। যেসব সাউথ এশিয়ান কানাডায় নিজ কালচারকে আর ফলো করেন না তারা মনে করেন সবাই তাদের মতো হয় বা হয়ে যায়।
তাই তাদের কথা অতটা মাথায় তুলিনি কিন্তু মি: এম তো এই টোনে এরকম কথা বলার মানুষ না! এতটা বাংলাদেশী থাকবে না মানে বোঝানো যে এটা ভাল ভাবনা না। কিন্তু উনিই তো সব দেশের স্টুডেন্টের শেখাতেন কানাডিয়ান একসেন্ট কপি না করে নিজের একসেন্টে কথা বলতে। ইংলিশ অনেকভাবে বলা যায় তবে গ্রামার যেন ঠিক থাকে। তিনিই তো আমাকে সবসময় সাহস দিয়েছেন বি ইওরসেল্ফ বলে। তিনি আবার একরম বলেন কি করে? কি করে জানেন? আমার ভিনদেশী বিয়ে করতে না চাওয়ার ব্যাপারটা ওনার ভালো লাগেনি তাই। এর আগে বাংলাদেশী কালচারের যা কিছু শেয়ার করেছি যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,স্পাইসি খাবার, কালারফুল পোশাক, ফ্যামিলি ভ্যালুস, ক্রিকেট ইত্যাদি মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। ওগুলো তো কানাডিয়ান কালচার বিরুদ্ধ না। কিন্তু ভিনদেশী বিয়ে না করার ব্যাপারটা ওরা ভাল চোখে দেখেনা। কানাডিয়ানরা প্রবলভাবে বিশ্বাস করে যে ভালোবাসা জাতের ওপরে না, মন মিললেই হয়। আমিও মানছি ভালোবাসা হলে ভিনদেশী বিয়ে করো আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাংলাদেশী কোন ছেলে আমার অতি আবেগী মন, ভাবনাচিন্তা বেশি বুঝবে তাতে কার কি?
আরেকদিনের ঘটনা মি: এম বলছেন, "আমার ফিলিপিনো শ্বশুড় শ্বাশুড়ি আমাকে অনেক খাওয়ায়! প্লেট ভরা কিন্তু আরো দেয়।" আমার তখন বাংলাদেশের জামাই আদরের কথা মনে পরে গেল। আরো বললেন, "অনেক বিরক্তি লাগে। আসলে অনুন্নত অনেক দেশ যেখানে খাবারের অভাব সেখানে হয়ত বেশি করে খাবার দিয়ে সম্মান দেখানো হয়।" আমি চমকে গেলাম। আতিথিয়তার একি বিশ্লেষন! আমার গায়ে লাগল যদিও উনি ফিলিপাইনের কথা বলছিলেন আমি রিলেট করতে পারছিলাম। আরো বললেন, "আমার বাচ্চারা ওনাদের ফিলিপিনো একসেন্ট কপি করে হাসাহাসি করে। আমাকে শ্বশুড় শুধু একটাই কথা বলেন, "গুড, গুড।" হাহা।" আমি ওনাকে বললাম আপনি কি তাদেরকে বুঝতে পারেন, অনেক গল্প করতে পারেন? উনি বললেন, "না, তবে মাঝেমাঝে যাই, বউ খুশি হয়।"
আমি বললাম একদম এটাই আমি আপনাকে সেদিন বলেছিলাম। আপনার বউ পাঁচ বছর বয়স থেকে কানাডায় তাই আপনার এডজাস্ট করতে অসুবিধা হয়নি। তিনি যদি রিয়াল ফিলিপিনো হতেন আপনি এডজাস্ট করতে পারতেন না যেমন ওনার মা বাবার সাথে মানাতে পারেননি। আমি চাইনা আমার হাসবেন্ড এবং বাবা মায়ের মধ্যে দূরত্ব থাকুক, বাচ্চারা হাসাহাসি করুক। আর সে নিজেও তো আমাকে বুঝতে পারবেনা। উনি বললেন, "সেদিন যে কথা বলেছিলাম সেটা..." বলে আরো কিছু বলতে যাবেন তখন এক স্টুডেন্ট প্রশ্ন নিয়ে আসল। তাই আর সে বিষয়ে কোন কথা হয়নি পরে। এখনো খুব জানতে ইচ্ছে হয় ওনার লজিক কি হত?
একদিন মি: এমের ক্লাসে ওনার চেয়ারে অন্য একজন বসে আছেন। অনেক লম্বা, ব্রাউন, চশমা পরা প্রচন্ড হাশিখুশি। ঢুকে প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকালে উনি বললেন, "Hi, I am Mr. K. I am your sub today." কানাডায় রেগুলার টিচার ছুটি নিলে সাব আসেন সেদিনের ক্লাসটা করিয়ে দিতে। এই টিচাররা জানেন না কালকে সকালে কোথায় পড়াতে হতে পারে? ফোন আসে যে এই স্কুলে এই টিচারের জায়গায় বসতে হবে। উনি এক পান্জাবি ইন্ডিয়ান কানাডিয়ান ছিলেন যিনি কখনো ইন্ডিয়া যাননি তবে মা বাবা পিউর ইন্ডিয়ান। উনি ভীষন মজার, মিশুকে মানুষ ছিলেন তাই সবাই ওয়েট করে থাকতাম ওনার জন্যে। এভাবে কয়েকবার মি:কে ফাকেফুকে ক্লাস নিয়েছেন এবং অনেক ভালো সম্পর্ক হয়েছে সবার সাথে। বিশেষ করে টিএ হিসেবে আমার সাথে বেশি কথা বলতেন। সাব আসলে টিএর দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। যেমন এটেন্ডেন্স সেদিন আমি নিতাম কেননা উনি একদিনেই সবার নাম নিশ্চই জানতে পারতেন না। আমি চেহারা দেখেই ২০/২৫ জন স্টুডেন্ট আছে কি নেই টিক দিয়ে দিতাম, নাম ডাকতে হতো না যেভাবে রেগুলার টিচার করেন। এছাড়া আরো অনেক টুকিটাকি হেল্প তো আছেই।
একদিন উনি গল্পে গল্পে বললেন, "আমার বউও ইন্ডিয়ান কানাডিয়ান, তিন বছর বয়সে কানাডায় এসেছিল। না না প্ল্যানড ছিলনা। আমি চাইনিজ ডেট করেছি, কানাডিয়ান ডেট করেছি (এভাবে অনেক দেশের মানুষের কথা বলে যাচ্ছিলেন!)। কখনো মাথায় ছিলনা ইন্ডিয়ানই বিয়ে করব। আমার পান্জাবী বন্ধুরা বলতো অন্য দেশের মানুষকে ডেট করা খারাপ। খুব হাসি পেত কথাগুলো শুনে।" তারপরে আমাকে জিগ্যেস করলেন, "আমাদের এদিকে এখনো এসব বিশ্বাস করে। তোমার ফ্যামিলি কি কখনো বিদেশী বিয়ে করতে আপত্তি জানাবে?" আমি মি: এমকে যা বলেছিলাম ওনাকেও তাই বললাম। ফ্যামিলি না আমার নিজেরই ই্চ্ছে করবেনা। উনি বললেন, "ধর তুমি ভার্সিটিতে গেলে, তুমি এত স্মার্ট তুমিত যাবেই।" একটু বলে রাখি আমাদের দেশে অর্থসমস্যা না থাকলে যেমন সবাই ভার্সিটি যাবেই এরকম আশা করা হয় কানাডা তেমন নয়। টিচাররা জানেন অনেক খারাপ/এভারেজ স্টুডেন্টই ভার্সিটি না গিয়ে অন্যকিছু করবে। হাই স্কুল গ্র্যাডুয়েশন অনেকের পড়াশোনার শেষ স্টপ, তাই ওভাবে বলা। যাই হোক উনি বলছিলেন, "ওখানে ফর সে একটা জার্মান ছেলেকে ভালবেসে ফেললে, কি করবে?" আমি বললাম ওরকম কিছু হবে না। উনি বললেন, "তুমি ভার্সিটি যাবেনা?" আমি বললাম মি:কেএএএ সেটা না। বলে দুজনেই হেসে ফেললাম। তারপরে ভার্সিটির এপ্লিকেশন, প্ল্যান এসব নিয়ে কথা উঠে গেল।
বিশ্লেষন: কানাডিয়ানরা আমাদের না জেনে বিয়ে করার ব্যাপারটা স্বাভাবিক নিতে পারেনা সেটা অনেক নরমাল একটা ব্যাপার। আমরাও সাধারনত ওদের লিভ টুগেদারের কালচারকে ভালভাবে দেখিনা। ওরা ভাবে আমরা শুধু ট্র্যাডিশন রক্ষার জন্যে বিয়ে করি, ভালবাসাটা মুখ্য না। ওরা এশিয়ান বাবা মাদের ডোমিনেটিং মনে করে এবং ভাবে তারা সন্তানের ওপরে সবকিছু চাপিয়ে দেয়। আমরা জাতি, ধর্ম এসবকে জরুরি মনে করি বিয়ের ক্ষেত্রে যেটা ওদের কাছে একধরনের রেসিজম। ভালবাসা ব্যাতিত অন্যকোন কারনে হওয়া বিয়ে ওরা মেনে নিতে পারেনা। যাই হোক, এসব অপছন্দ করার পরেও আমার সামনে কখনো খারাপ কিছু বলেনি শুধু হাভেভাবে বুঝতাম। বিষয়টা ভাল না লাগলেও ওরা বিনয়ীভাবে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখে। কিছু বলেনা অথবা বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করে। এটাই শিক্ষনীয়।
যারা লাভ/এরেন্জ/কমবাইন্ড যেকোন ধরনের বিয়েতে সুখে আছেন তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করলাম। কিন্তু যারা সুখে নেই তাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই। আমাদের দেশে মেয়ে প্রেম করলে অন্য ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়ার একটা রীতি আছে। কি ভয়াবহ অমানবিকতায় তিনটা জীবন নষ্ট হয়ে যায়! মা বাবা সন্তানের পছন্দের মানুষটি খারাপ হলে বিয়ে করা থেকে আটকাতে পারেন সন্তানের মংগল চেয়ে। কিন্তু জোর করে বিয়ে দেওয়া একটা মধ্যযুগীয় বর্বরতা। আমি জন্ম দিয়েছি, মানুষ করেছি এসব বলে জোর করে বিয়ে দেওয়াটা অন্যায়। মা বাবার জন্যে সন্তান দরকার লাগলে প্রানও দিতে পারে কিন্তু জোর করে কাউকে ভালবাসতে পারেনা। এটা যেন বাবা মা বোঝেন। আর সন্তানেরও বোঝা উচিৎ মা বাবা দুনিয়া দেখেছেন, নিজের পছন্দের সংগীটিকে খারাপ বললে আবেগী তর্ক না করে আরেকটু পূনর্বিবেচনা করা উচিৎ।
পসিটিভলি, এখন সেটেলড ম্যারেজে অনেক পরিবার ছেলে মেয়েকে সমানভাবে মতামত দেওয়ার অধিকার দিচ্ছে। আবার পরিবারও ছেলে মেয়ের পছন্দ ভাল হলে লাভ ম্যারেজে সহজেই হ্যা করে দিচ্ছেন। সিচুয়েশন আগের চেয়ে বহুগুন বেটার কিন্তু এখনো অনেক জায়গায় সঠিক কালচারটা পৌছুতে হবে। সকল সংকীর্নমতা দূর করে বাংলাদেশী সমাজ এগিয়ে যাবে সে আশা রাখি। তখন বিদেশীদের ভাবনা আমার গায়ে লাগবে না। কেননা আমি জানব আমার দেশের মানুষ পরিপূর্ন সুন্দর চিন্তাভাবনায় সুখে আছে এবং সেটাই আমার কাছে জরুরি। বিশ্বের ভাবনা গায়ে মাখিনা।
আমার জীবন: জে একদিন বলছিল ও কিরকম ছেলে পছন্দ করে। হ্যান্ডসাম, রোমান্টিক, সৎ, গুড হিউমার, গিটার বাজাবে এরকম আরো অনেককিছু। আমাকে জিগ্যেস করলে অদ্ধুতভাবে আমি কিছু বলতে পারলাম না! আমি যে একটা মানুষ এবং আমারো চাওয়া থাকতে পারে সেটা তখনো জানতাম না। চোখের এক ঝলকে বাংলাদেশে থাকার সময়কার কথা মনে পরে গেল। পাশের বাড়ির সুন্দরী সীমা আপু খুব রোমান্টিক হাসবেন্ড চাইত। কিন্তু মোটা বেতনের গম্ভীর ছেলের সাথে মা বাবা বিয়ে দিয়ে দিল। বিয়ের কতোদিন পর্যন্ত হাসি দেখিনি আপুর মুখে! ছেলেটা সুন্দরী বউ পেয়েছিল মনমতো কিন্তু আপু তো টাকা চায়নি। পরিবার/সমাজকে খুশি করতে আপুকেই কম্প্রোমাইজ করতে হলো সারাজীবনের জন্যে! লাভ ম্যারেজেও বিয়ের পরে অনেক ছেলে পাল্টে যায় এবং মেয়েটা অসহায় হয়ে মা বাবাকে কিছু বলতেও পারেনা। শ্বশুরবাড়িতে অনেক কষ্ট মুখবুজে সহ্য করে বাবা মায়ের সম্মান রক্ষার্থে। সেসব মেয়েদের করুন পরিস্থিতিও কাছ থেকে দেখেছি।
আমাদের মতো মফস্বলের মেয়েরা ভালো হাসবেন্ডের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে পারেনা। একটু বড় হতেই দাদী, নানী, মা, খালা বলতে শুরু করে রান্না শেখ, ঘরের কাজ শেখ নাহলে বিয়ের পরে শ্বাশুড়ীর বকা খেতে খেতে জীবন চলে যাবে। বাইরে রোদে যেওনা, চেহারা খারাপ হলে আরোই স্বামীর কথা শুনতে হবে। টিভিতে কোন রোমান্টিক দৃশ্য স্বপ্নীল চোখে দেখলে খালা বলতেন, "নিজের জন্যে আবার অতো আশা কইরো না। বাস্তব ওইরকম না। অনেক কম্প্রোমাইজ করা লাগে।" আশেপাশের অনেক মেয়েদের দেখে বুঝতাম তারা অতিরন্জিত করছেন না। সবসময় জেনেছি বা আমাকে জানানো হয়েছে লাভ হোক আর এরেন্জ বিয়ে নামক জিনিসটাতে বেশিরভাগ কম্প্রোমাইজ করতে হবে আমাকেই! আমি যেন নিজেকে তৈরি করি ভাল মেয়ে, রাঁধুনি, বউ হিসেবে এবং কোন আশা না রাখি তার কাছে! দায়িত্ব বোঝানোর সাথে সাথে অধিকারের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করতে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট বয়স থেকেই! বাংলাদেশের অনেক পরিবারে এভাবেই মেয়েদেরকে গড়ে তোলা হয়! তুমি মেয়ে তোমাকে বেশি মানিয়ে নিতে হবে, তুমি মেয়ে তোমাকে কম্প্রোমাইজ বেশি করতে হবে এমন আরো অনেককিছু ছোটবেলা থেকেই মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তাই বড় হয়ে সমাজ/কর্মক্ষেত্র/পরিবারে হাজারটা অন্যায়ের প্রতিবাদ অনেক মেয়ে করতে পারেনা। তারা ধরেই নেয় এটাই তো জীবন! নারী জীবন! এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে এবং খুব দ্রুতই।
আর দশটা সাধারন মেয়ের মতো হয়ত আমাকেও বিয়ের সময় এরকম বৈষম্যপূর্ন সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। নিজের জন্যে কোন আশা, স্বপ্ন রাখি না। কিন্তু স্বপ্ন দেখি আমার মেয়ে হলে তার বিয়ের সময় আসতে আসতে সবকিছু অনেক পাল্টে যাবে! তার দুচোখে সে সুন্দর স্বপ্ন সাজানোর অধিকার এবং সেগুলো বাস্তব হবার সুখ দেখবে! জের মতো ওর স্বপ্নের একটা রংগিন লিস্ট থাকবে, আমার মতো স্বপ্নহীন জগতের হাহাকারময় ব্ল্যাংক পেজ নয়!
বিশেষ কথা: আজকের পর্বে কানাডার কাহিনী বলেছি কিন্তু বাংলাদেশকে নিয়ে বেশি বিশ্লেষন করেছি। আমি বাংলাদেশী কালচারের সবকিছু নিয়ে নেগেটিভ না। নিজ কালচারকে নিয়ে অনেক গর্ব করি; বুকের মধ্যে ধারন করি। জানি কোন কালচারই পারফেক্ট না। কিন্তু আমরা চেষ্টা তো করতে পারি বেটার হবার। সেইজন্যে এই পোষ্টটা এত বাংলাদেশ কেন্দ্রিক। কানাডাতো বাহানা ছিল, আমার আসল চিন্তা বাংলাদেশকে নিয়ে। সেটাই শেয়ার করলাম।
আমি প্রথমদিকে এরেন্জ ম্যারেজে বিশ্বাস হারানোর হিন্ট দিয়েছি। জে আমাকে কিভাবে ইনফ্লুয়েন্স করত তা পর্ব ছয়ে আছে। আমি এখন এভাবে ভাবি না। বুঝি যে এমন অনেক এরেন্জ ম্যারেজ আছে যাতে কাপল প্রচন্ড সুখী, আবার লাভ ম্যারেজই হয়তো ভেংগে যাচ্ছে এন্ড ভাইস ভার্সা। সবকিছুরই ভালো খারাপ থাকে।
এ পর্বে মেয়েদের দুঃখের কথা অনেক বেশি উঠে এসেছে। এ কারনে নয় যে আমি ভাবি ছেলেদের কোন দুঃখ নেই। সমাজের অনেক ভুল ব্যবস্থার শিকার ছেলেরাও। কিন্তু এটা আমার জীবনের গল্প এবং মেয়ে হিসেবে আমার দুঃখগুলোই বেশি প্রকাশ পেয়েছে।
সবাইকে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২০