কানাডায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবতাম বিয়ে কম্পালসারি একটা বিষয়। সব ছেলে চাকরি পেয়ে আর সব মেয়ে পড়াশোনা শেষে বিয়ে করেই করে। বিয়ে এমন একটা জিনিস যা জীবনে একবারই হয়। বিয়ে না হলে ছেলে মেয়ে একসাথে থাকতে পারেনা। পার্কে ঘুরতে পারে তবে লুকিয়ে লুকিয়ে। এটা ইউনিভার্সাল কালচার, এবং পৃথিবীর সব দেশ এ প্রথাগুলো মেনে চলে! হায়রে মফস্বলের দুই বেনী করা কিশোরি মেয়েটি দুনিয়া তখনও দেখেনি, কানাডায় এসে দেখল। কি দেখলো তাই আপনাদের বলবো।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১০) সমকামিতা ১৮++
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১১) - কিশোরিবেলায় কানাডার প্রথম ভালোলাগা - এক গ্রিক দেবতারূপী সুদর্শন কানাডিয়ান ছেলে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ১২) - বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বাংলাদেশকে কিভাবে দেখে এবং আমার স্কুল জীবনে তার প্রভাব
লিভ টুগেদার: এই জিনিসটা কানাডায় যাওয়ার আগেও জানতাম কোন এক মুভিতে দেখে। ভাবতাম নায়ক নায়িকা তো কত কিছুই করে! কিন্তু এটা যে কোন দেশের নরমাল প্র্যাকটিসিং কালচার হতে পারে তা জানতাম না।
আমি তখন বেশ নতুনই, জিম ক্লাসের ঘটনা। জিম ক্লাসে অন্য লম্বা চওড়া কানাডিয়ানদের পাশে ভয়েই থাকতাম। হয়তো সেজন্যেই জিম টিচার যেচে আমার সাথে কথা বলতেন ফ্রি করার জন্যে। সেদিন আমাকে এবং আরো দুই কানাডিয়ান মেয়েকে ডেকে আনলেন। তারপরে গল্প শুরু করে দিলেন। আমাকে জিগ্যেস করলেন কোন দেশের? বললাম। প্রথমবারের মতো ঐ কানাডিয়ান মেয়েটাও কথা বলল। বাংলাদেশ কোথায় জিগ্যেস করল। কথায় কথা বাড়ল। এক সময় টিচার বললেন, "আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ড একসাথে মুভ করছি। কি যে হ্যাসল! খুব বিজি সময় যাচ্ছে।" ঐ মেয়েরাও না চমকে বলে যাচ্ছে ওয়াও গ্রেট কোথায় মুভ করছেন? আর আমার তো কোন কথা আর মাথায় ঢুকছে না। কানের আশেপাশে শো শো শব্দ শুরু হয়ে গিয়েছে। টিচার অবলীলায় স্টুডেন্টদের লিভ টুগেদারের কথা বলছেন! কি ভীষন অবাক হয়েছিলাম! এটা এতো নরমাল এখানে?
আরেক ঘটনা, আমাদের বাড়িওয়ালা এক কানাডিয়ান মহিলা ছিলেন বয়স ৫০ এর কাছাকাছি হবে। তার স্বামী অতি সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। বউয়ের সব কথা হাসিমুখে মেনে নিতেন এবং বউ কথা বললে চুপ হয়ে যেতেন। ১৯/২০ বছরের ছেলে ছিল ওনাদের। সবমিলিয়ে সুখী পরিবার। বেশ ভালোই লাগত ওনাদের। আমার এক সহপাঠী ওনারদেরই কোন এক এপার্টমেন্টে থাকত। আমি একদিন বলছিলাম ওনার হাসবেন্ডটা কি ভীষন ভাল! ও থামিয়ে দিল। বলল, "হাসবেন্ড? ওরাতো বিয়ে করেনি কখনো!" একসাথে এতদিন থেকেও বিয়ে করেনি! হায় আল্লাহ! বিয়ে ছাড়া ছেলেটা! ছি ছি কি দেশে এসে পরলাম আমি! ও আরও শকিং নিউজ দিল। ওনারা ২৫ বছর একসাথে থাকছেন, কখনো বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ওর কথাগুলো! পরে আরো সোর্স থেকে জেনেছিলাম আসলেই তাই।
লিভ টুগেদার সবাই করে এখানে। বেশ কবছর লিভ টুগেদার করে ভাল লাগলে তবে বিয়ে। এর পেছনের কারন হচ্ছে বিয়ের আগে এক ছাদের নিচে থেকে বোঝা যে বিয়ের পরেও থাকা সম্ভব কিনা। আবার সেই বাড়িওয়ালার মতো অনেকেই বিয়ে কখনোই করেন না। তারা কোন সামাজিকতায় বিশ্বাস করেন না। এর মানে এই নয় যে এখানে কাপলদের মধ্যে ভালবাসা নেই। আছে, একে অপরকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যে যে কিসব পাগলামি করে! কিন্তু পাগলামি চলে যেতেও বেশি সময় নেয় না। অন্যকাউকে ভাল লাগলে খোলা মনে এমব্রেস করে। খুব বেশি নীতি নৈতিকতা নেই। মনের ওপরে জোর খাটেনা, I gotta do what my heart tells me বলে অবলীলায় এক সম্পর্ক থেকে অন্য সম্পর্কে বানরের মতো ঝুলতে থাকে।
বিয়ে: বিয়ে সাধারনত মধ্যবয়সে হচ্ছে আজকাল। বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার পরে অনেকে বিয়ে করে। মা বাবার বিয়ে বাচ্চা দেখবে এটা অতি স্বাভাবিক এবং সুইট একটা ব্যাপার! এখানে বিয়ের জন্যে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে I gotta find the right one! My soulmate! দেশ/জাত/পেশা/ধর্ম/বর্ণ/শিক্ষা/বয়স কোনকিছুর পরোয়া নেই। শুধু মন মিললেই হল। হার্টের মিসিং পাজলটা হলেই হলো। এরা প্রচন্ডভাবে বিশ্বাস করে যে সবার জন্যে কেউ না কেউ থাকে এবং কখনো জীবনে আসেই। এখানে বিয়েটা শুধু মেয়েটার ভরনপোষন বা ছেলেটার জৈবিক চাহিদা পূরন নয়। বিয়েটা রাইট পার্টনারের সংগ এনজয় করার জন্যে। ব্যাপারটা শুনলে অনেক সুইট মনে হয়। কিন্তু এই রাইট মানুষটাকে খুজতে গিয়ে কোথায় যেন বেড়াছেড়া লেগে যাচ্ছে। বারবার সম্পর্কে জড়ানো, ভাংগা, বিয়ের পরেও মনে করা এই কি সে? সেই মনে করা থেকে এত বছর লিভ টুগেদার করেও ডিভোর্সের মতো করুন পরিনতি! বেটার কিছু পাওয়ার লোভে আরো খারাপের দিকে ধাবিত হওয়া। কিন্তু পসিটিভিলি, এখানে যারা ম্যারিড এবং একসাথে আছেন প্রচন্ড সুখে আছেন। লোভ হওয়ার মতো সুখে! সেরকম এক সুখের গল্প বলব।
E.S.L. টিচার মি: এম সুদর্শন, ভদ্রস্থ, মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ছিলেন। উনি ওনার লাভ স্টোরি যে আমাকে কতবার শুনিয়েছেন! ওনার বউয়ের সাথে কমন ফ্রেন্ডদের মাধ্যমে পরিচয়। তখন ওনার এবং ওনার বউয়েরও লম্বা সময়ের সম্পর্ক ভেংগে টুকরা টুকরা। তারা বন্ধু হলেন, ডিসাইড করলেন আর প্রেম না, এবং যথারীতি একে অপরেরই প্রেমে পরলেন। তারপরে বিয়ে, এবং দুটো টিনএজ বাচ্চার পিতামাতা। উনি মাস্টার্স ছিলেন, এবং ওনার বউ P.H.D করছিলেন। উনি সেই সময়টায় সারাদিনের স্কুল শেষ করে বাড়ির সব কাজ করতেন! রান্নাবান্না, ক্লিনিং, বাচ্চাদের স্কুল থেকে শুরু করে ক্যারাটে ক্লাস! আমি বলতাম আপনি টায়ার্ড হন না? উনি বলতেন, "নিজের কষ্ট কিছু না কিন্তু ও কষ্ট করলে আমার জন্যে অনেক কিছু।" আমি বলতাম আপনার বউ আপনার ওপরে কখনো রাগ করেন না? উনি বলতেন, "সবসময় রেগে থাকে! কিন্তু ও রাগ না করলে আমি লাইনে থাকতাম না। Women keeps men in line." এক্সাক্ট এই কথাটাই বললেন। শুনে চমকে গেলাম, বাংলাদেশেও তো বলে বউ এসে ছেলেটাকে লাইনে রাখবে। আমার ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী "J" বলল ওদের কালচারেও কথাটা বলে! আসলে এটা ওয়ার্ল্ডওয়াইড একটা ব্যাপার বলে সবাই হাসতে শুরু করলাম। ওনাকে আমি ক্ষেপাতাম আপনার বউ ডিগ্রিতে আপনার চেয়ে এগিয়ে গেল, এখন আরোই বকা খাবেন! উনি বলতেন, "না সেরকম কিছু হবে না। আমিতো গর্বিত, ও আমার চেয়ে বেশি যোগ্য হওয়া মানে I am the winner."
এসব কথা শুনে কি যে ভালো লাগত! একদিন মি: এম ক্লাসরুমে নেই, একটু বাইরে গেছেন। আমরা বান্ধবীরা বসে কে কেমন হাসবেন্ড চায় সেটা নিয়ে গল্প করছি। দুইজন ব্রাজিলিয়ান এবং এক কানাডিয়ান। এখানে বলে রাখা ভাল কানাডিয়ান স্টুডেন্টরা E.S.L. ক্লাসে এলাউড না। ইংরেজী যাদের দ্বিতীয় ভাষা তারাই থাকতে পারে সেই ক্লাসে। কিন্তু ও আমার মা জার্মান এসব বলে কোনভাবে এনরোল হয়েছিল যাতে আমাদের সাথে থাকতে পারে হাহা। যাই হোক, ভালো হাসবেন্ডের কথা উঠলে মি: এম এর কথা উঠবেই। সবাই বলছে ওনার মতো হাসবেন্ড থাকলে লাইফে আর কি লাগে! আমিও বলে ফেললেম, "I hope I get a husband like Mr. M." বলে হাসতে হাতে দেখি পেছনে মি: এম।
ইস!! সবাই বলল আর শুনল শুধু আমারটা। এখন কি করি কোথায় লুকাই! কি লজ্জার ব্যাপার! উনি হাসতে হাসতে বললেন "হাসবেন্ড (আমার নাম)"? চিন্তা করোনা আমার চেয়ে বেটারই হবে!" যদিও আমি আজও বিশ্বাস করি ওনার চেয়ে বেটার হাসবেন্ড সম্ভব না!
ডিভোর্স: একবার মি:এমকে জিগ্যেস করেই ফেললাম কানাডায় মানুষ বিয়ে করে না কেন? উনি হো হো করে হেসে ফেললেন। বললেন, "কই করেনা, আমিতো হ্যাপিলি ম্যারিড!" আমি বললাম বলেন না কেন অনেকে বিয়ে করেনা? উনি বললেন, "আমার এক কাজিন অনেক বড়লোক। ও একটা মেয়ের সাথে এক বছর বন্ধুত্ব, দুই বছর সম্পর্ক, পাচ বছর লিভ টুগেদার করেছিল এবং বাচ্চাটার যখন চার বছর বয়স তখন বিয়ে করে। যদিও আমি পারসোনালি বিয়ের আগে বাচ্চা নেওয়া পছন্দ করি না। "আমার নাম" বিশ্বাস করতে পার যে আট বছরের সম্পর্ক বিয়ের দুই সপ্তাহ পরেই ছারাছারি? ও এখন ডিভোর্সের ঝামেলায় পরে গিয়েছে, বলছে আমার অর্ধেকের বেশি সম্পত্তি নিয়ে নেও, তাও ছাড়ো। তবে মেয়েটি অনেক লোভী, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরো টাকা চাচ্ছে।" আমি বললাম অর্ধেকের বেশি সম্পত্তি?
উনি বললেন, "কানাডায় ডিভোর্স নিলে হাসবেন্ডকে অর্ধেক সম্পত্তি দিতেই হয় ওয়াইফকে সিকিউরিটি হিসেবে, ওয়াইফ যদি বাচ্চাদের কথা বলে আরো দাবী করে তবে কোর্টের ডিসিশনে অনেক সময় তাও মেনে নিতে হয়। আর জানো, "আমার নাম" কানাডায় ৫০% এর বেশি বিয়ে ভেংগে যায়।" আমি বললাম তার মানে ডিভোর্স রেট হাই, আর ডিভোর্স নেওয়া অনেক যন্ত্রনাকর এক প্রসেস এজন্যে অনেকে বিয়ে করেনা? উনি বললেন, "For most part, yes, that's the main reason according to me!"
এখন প্রশ্ন হলো যারা লিভ টুগেদার করে মা বাবা পর্যন্তু সাকসেসফুলী হতে পারলেন তারা কেন স্বামী স্ত্রী হতে পারলেন না? আসলে বিয়ের আগে কোন বন্ধন ছিলনা, আশা ছিল না, দায়িত্ব ছিলনা। সবকিছুই দুজনে করেছেন মনের আনন্দে। বিয়ের পরে দায়িত্ব, অধিকারের চাপ লাগতে শুরু করল যা সম্পর্কের ফান টুকু নষ্ট করে দিল। কানাডিয়ানদের জীবনে "ফান" একটি জাতীয় শব্দ। ওরা যেকোন মূল্যে জীবনকে এনজয় করতে চায়। মুক্ত পাখির মতো ওড়া খুব জরুরি ওদের জন্যে এবং বিয়ের শেকলে অনেকের দমবন্ধ লাগে। এখানে বিয়ে না টেকার আরো একটা বড় কারন জীবনে ছোট খাট কমপ্রোমাইজ না করতে পারা। বিদেশীদের নিয়ে একটা জোক আছে যে নাক ডাকলেই ছাড়াছাড়ি। বাস্তবিকভাবে এতটা না হলেও যান্ত্রিক ব্যাস্ত জীবনে কেউ কাউকে সহজে ছাড় দিতে চায় না।
আর পরকীয়া তো ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। আজকাল এখানে "open marriage" পলিসি শুরু হয়েছে। যার মানে স্বামী স্ত্রী জানবেন যে একে অপরের আরো গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড আছে এবং কোন কমপ্লেইন করতে পারবেন না! বাড়িতে এসে গল্প করবেন গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ডের সাথে কেমন সময় কাটল! বাচ্চা কাচ্চারাও এভাবেই বড় হবে সব জেনে শুনে। তবে হ্যা বাচ্চা কাচ্চা শুধু স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই হতে পারবে এ পলিসিতে। এর পেছনের লজিক হচ্ছে বিয়ের পরেও মানুষ অপসিট সেক্সের প্রতি এট্রাকশন ফিল করে, এবং ভয়ে সেটা এভয়েড করেন। কিন্তু মনের অনূভুতিকে পাত্তা না দেওয়া তো ভীষন অন্যায়! যাই হোক, এটা এখনো অনেকে পছন্দ করেনা, কিন্তু একটু একটু করে কমন হচ্ছে। কয়েক যুগ পরে যে মহামারি আকার ধারন করবে বুঝতে পারছি!
কিন্তু আমাদের দেশে যে বিয়ে এত টেকে সেটাও কি ভালো? মেয়েরা স্বামী শাশুড়ির হাতে প্রচন্ড নির্যাতিত হয়ে/স্বামী কর্তৃক ধর্ষিত হয়েও কিছু করতে পারেনা সমাজের ভয়ে। মানছি আমাদের দেশে অনেক হ্যাপিলি ম্যারিড কাপল আছেন। কিন্তু এমন অনেক বিয়ে আছে যা মেয়েটার চোখের জ্বলে শিক্ত। আবার অনেক ছেলেও সমাজের ভয়ে বছরের পর বছর দজ্জাল বউকে সহ্য করে যান। ডিভোর্সি মানুষদের প্রতি বাংলাদেশি সমাজকে আরো ফ্লেক্সিবল হতে হবে। দুজন মানুষ একসাথে থাকতে না পারলেই তারা খারাপ হয়ে যান না। এটা ব্যক্তিগত চয়েস, সমাজের কানাঘুষার ব্যাপার না। আসলে সব কালচারেই ভাল খারাপ থাকে।
কিশোরি আমি: যখন নতুন নতুন ছিলাম গা গুলিয়ে যাওয়া ঘৃনা হত এসব দেখে। মনে হতো এরা এমন কেন? ক্লাসমেটরা অকপটে কোন ব্র্যান্ডের কনডম ভাল সেটা নিয়ে গল্প করত স্কুল লেভেলে! রাতে এসব ব্যাপার ঘুরতে থাকত মাথায়, ঘুম আসত না। আসলে কিশোরি বয়সে বাংলাদেশি কালচারকে ট্যাবলেটের মতো গিলে ফেলা আমি এসব মেনে নিতে পারতাম না। আমার ধর্মে, কালচারে তো এসব মহাপাপ। আর সবকিছু তো একবারে জানিনি। প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়িতে কোন না কোন নতুন "জ্ঞান" নিয়ে ফিরতাম। বুক ধক করে ওঠার মতো কোন কৃষ্টি, কাহিনী, পরিনতি।
কানাডিয়ানরা খারাপ এটাও মানতে পারতাম না। যে দেশ আমার মতো বাংলা মিডিয়াম পড়ুয়া, ইংরেজী না জানা, মফস্বলের, সালোয়ার কামিজ পরা, লম্বা বেনি ঝোলানো আনস্মার্ট/ক্ষ্যাত মেয়েকে যে ঢাকা শহরের হাই সোসাইটিতে পর্যন্ত বিলং করেনা তাকে আপন করে নিয়েছে তাদেরকে খারাপ বলি কি করি? যে দেশে অপরিচিতদের দিকেও মানুষ আন্তরিক ভাবে হাসে, বাস ড্রাইভারকে থ্যাংক ইউ বলে, ছোট ভুলেও হাজারবার সরি বলে তাদেরকে খারাপ ভাবি কিকরে? যে দেশ আমাকে নতুন ভাষা শিখিয়েছে ইংলিশও এবং জীবনেও, উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে, বিভিন্ন দেশের বন্ধু দিয়েছে তার প্রতি অবজ্ঞা রাখি কি করে?
একদিকে প্রচন্ড সম্মান অন্যদিকে প্রচন্ড ঘৃনায় কি ভয়ংকর মানসিক যন্ত্রনার কিশোরিবেলা গিয়েছে তা লিখতেও এখন চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরে কিবোর্ড ভিজে যাচ্ছে! কিশোরি বয়সে এমনিতেই নিজেকে নিয়ে অনেক কনফিউশন থাকে, আমার তো নিজের সাথে সাথে নিজ কালচার নিয়েও কনফিউশন হতে থাকল। অস্তিত্ব কাপিয়ে দেওয়া এক বিক্ষিপ্ত, খাপছাড়া ভাব। রাতের পর রাত সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম যে কারা ভাল? আমাার দেশের মানুষ না ওরা? আমার কাদের মতো হওয়া উচিৎ? হাজারটা প্রশ্ন এবং উত্তর দেবার মতো কেউ নেই। বাড়িতে এসব "বড়দের বিষয়" নিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলা সম্ভব ছিলনা। স্কুলেও কোন কানাডিয়ান সহপাঠীকে মুখের ওপরে কিছু জিগ্যেস করতে পারতাম না ওদের কালচার নিয়ে। মি: এমসহ আরো কিছু টিচার ছিলেন শুধু যাদের সাথে সবকিছু অসহায়ের মতো শেয়ার করেছি। তারা যে কিভাবে ঠান্ডা মাথায় আমাকে সামলেছেন! আমার অসহায় চাহনী তারা পড়ে নিতেন এবং সিলি প্রশ্লগুলোরও বিশ্লেষনী উত্তর দিতেন।
তাদেরই সাহায্যে মানসিক দ্বন্দে পুড়তে পুড়তে একসময় সামলেছি আমি। আর আমার পারিবারিক শিক্ষা, মফস্বলের সরল মানুষের দেওয়া মূল্যবোধের ভীত অনেক শক্ত ছিল। প্রবল ঝড়ে তাই উড়ে যায়নি। মেনে নিয়েছি জীবন শুধু ভালো/খারাপ, পাপ/পূন্যই না, জীবন হয়তো অন্যের আলাদা ভাবনাগুলোকে সম্মান করাও। দেশে আমার অনেক হিন্দু/খৃষ্টান বন্ধু ছিল। তাদের ধর্মভাবনা ভীষন আলাদা হওয়ার পরেও কখনো ঘৃনা আসেনি। কেননা ছোটবেলা থেকে শিখেছি অন্য ধর্মালম্বী মানুষকে সম্মান করতে হয়। আমি ধর্মের থিয়োরি কালচারেও এপ্লাই করেছি। ভেবেছি ওরা ওদের ভাবনায় সুখে থাকুক এবং আমি আমার ভাবনায়।
তাই আমার ভাবনাচিন্তা এখনও প্রথম তিন লাইনের মতোই আছে। পরিবর্তন একটাই আগে দুই বেনী করতাম, এখন এক বেনী অথবা খোপা করি! এখনো মফস্বলের সেই ব্যাকডেটেড/আনস্মার্ট মেয়েটা আছি কিন্তু অনেক আত্মবিশ্বাসের সাথে আছি যা আছি। সারাজীবন এরকমই থাকব কেননা এই আমার আমিতেই যে আমার প্রকৃত সুখ!
শেষ কথা: ১৮+ দেবার পরেও অনেক ছোট ভাইবোনেরা জড়ো হবে। তাদেরকে বলছি যাও মন দিয়ে পড়ালেখা করো। ব্লগে/ফেসবুকে ১৮+ পোস্ট দেখে বেড়িয়ে নেপচুনকে নেপালের রাজধানী বানাতে হবেনা। যাও!
সব পাঠকদের বলছি, আমি নিজে এসব ১৮- বয়সেই জেনেছিলাম কানাডায় আসার কারনে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটুকু শালীন, সভ্য হতে পারে তা ভেবেই ট্যাগ দেওয়া। কোন অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করিনি, কিন্তু আইডিয়াগুলো এডাল্ট মনে হয়েছে। সব কানাডিয়ান কিন্তু এক না। এখানেও অনেক চার্চে যাওয়া ধার্মিক মানুষ থাকেন যারা এসব সাপোর্ট করেন না। তবে তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে দিনদিন। বিশ্বাস করতে যদি কারও কষ্ট হয় তবুও বলছি যা লিখেছি মেজোরিটির কথাই লিখেছি। সেই মেজোরিটির কালচারকে খারাপ ভালো বলে জাজ করার আমরাই বা কে? থাকুক ওরা ওদের মতো!
আমি প্রতি পর্বে অনেক অনুপ্রেরনা পাই। অনেকে কমেন্ট করেন, লাইক দেন। সবচেয়ে বড় কথা আনন্দ এবং আগ্রহ নিয়ে পড়েন অতি সাধারন আমার জীবন কাহিনী! তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। সত্যিই নেই!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২১