আগের পর্বগুলোতে অনেকবার বলেছি, আমি মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা মেয়ে। আমাদের মফস্বল শহরগুলোতে একটু বড় হতে হতে মেয়েদেরকে ওড়না, বোরখা পরিয়ে দেওয়া হয়। ফিসফিস করে মা, খালারা বলেন এখন বড় হয়েছ। রেখেঢেকে চলতে হবে, ছেলেদের সাথে খেলবেনা, তাকাবেনা। মোটামুটি বিয়ের আগে ছেলে মেয়ের মেলামেশা অবৈধই ধরা হয়। সেই আমি এমন এক দেশে এসে পড়লাম, যেখানে ছেলে মেয়ে তো কিছুই না, ছেলে ছেলে, মেয়ে মেয়ে প্রেম, বিয়ে সব করে ফেলে!! সমকামিতার সাথে আমার পরিচয় মূলত কানাডায় এসে। নিঃন্দেহে সবচেয় বড় কালচার শক এটাই ছিল। সেসব অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের পর্ব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৮) কিছু ভারতীয় যে কারণে বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৯): কেন প্রবাসি বাংলাদেশি বাচ্চারা কানাডিয়ান/ভারতীয় হয়ে যাচ্ছে
তখন আমি সদ্য কিশোরি, কানাডায় কয়েকমাসই হয়েছে। আমাদের স্কুল শেষ হত দুপুর ৩ টায়। সময়টা গরমকাল ছিল। কানাডার গরম ভয়ংকর সুন্দর। ঘাম হয়না, ধুলাবালি নেই। সোনালি রোদে ঝিকিমিকি আলোয় ভরে যায় চারিদিক। স্কুল থেকে আসার পথে একটা ঢালু মতো জায়গায় পায়ের কাছে কিছু হলুদ বুনো ফুল গজিয়ে থাকত। আমি স্কুলে যাওয়ার, এবং আসার সময় একটা তুলে খেলতে খেলতে যেতাম। আবার স্কুলে, এবং বাড়িতে ঢোকার সময় ফেলে দিতাম। সেদিনও নরমাল একটা দিন ছিল। আমি ফুল হাতে নিয়ে নিজের মনেই হাসতে হাসতে বাড়ি যাচ্ছি। বাড়ির কাছাকাছি জায়গায় এসে দেখলাম, একটা কাপল খুব অন্তরংগভাবে ঘাসের ওপরে শুয়ে আছে।
চোখ সরিয়ে নিলাম, কয়েক মাসে শিখে গেছি এখানে এসব ওপেনলি হয়, আর তাকিয়ে থাকাটা অভদ্রতা। কিন্তু চোখ সরাতে গিয়েই আবার চোখ চলে গেল। একি? এরাতো দুজনেই ছেলে!!! ও আল্লাহ এ আমি কি দেখলাম! তাকানো উচিৎ না জেনেও আবার তাকালাম, এবং অপলক কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম। ভালো করে খেয়াল করে বুঝলাম আসলেই দুজনেই ছেলে। আমার হাত থেকে ফুলটা ফসকে পরে গেল। ঘামতে লাগলাম ভেতরে ভেতরে। এসবও হয়? আগে অল্পবিস্তর মুভিতে এসব দেখেছি, এবং ভেবেছি মুভিতে তো কত কিছুই দেখায়! কমিক রিলিফের জন্যে দিচ্ছে বোধ হয়। কিন্তু আসলেই এসব হয়?
বাড়িতে কাপতে কাপতে আসলাম। মা জিগ্যেস করলেন কি হয়েছে? আমি বললাম মা আমাদের স্কুল থেকে ঐ ঢালু রাস্তাটা পার হয়ে বাড়ির কাছে এসে দেখলাম দুইটা ছেলে কেমন.... বলতে বলতে থেমে গেলাম। এসব কি বলা যায়? মা বলল কি? ডিস্টার্ব করছিল? আমি বললাম না, দুইটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছিল। মা বললেন এ আর এমন কি? এই দেখেই এরকম অবস্থা। এখানে আরও কত কিছু দেখতে হবে!
আমার মা জানতেন না আমি আসলেই অনেক কিছু দেখে এসেছি! তারপরে কোনরকমে হাত মুখ ধুয়ে, খাবার খেয়ে ল্যাপটপে ঝাপিয়ে পরলাম। দেখলাম এই গে, লেসবিয়ান কমুনিটি সত্যিই আছে, এবং পক্ষে বিপক্ষে অনেক তর্কও আছে। নিজেক মূর্খ মনে হল! কোন দুনিয়ায় থাকি আমি? দুনিয়া কোথায় চলে গেছে, আর আমি কোথায় পরে আছি। সারাজীবনই কি এত বোকা থাকব আমি?
আপনারা ওপরের প্যাড়া পরে ভাবছেন কানাডায় গে, লেসবিয়ান কোন ইস্যুই না? ডালভাত ব্যাপার? সব ওপেনলি হয়? আসলে অনেকটা তাই, তবে এটা একসময় অনেক বড় ইস্যু ছিল। অনেকেই মেনে নিতে পারত না। বলত এটা ইভ এবং আডামের পৃথিবী, স্টিভ এবং আডামের না। অনেকে স্কুলে খারাপভাবে বুলিড হত গে হওয়ার কারনে। একজন আমেরিকান বাচ্চাকে তার সহপাঠি খুন পর্যন্ত করেছিল গে হওয়ার দোষে। চার্চগুলো কোমড় বেধে নেমে পরেছিল এদের নির্মূল করতে। কেননা তাদের মতে বাইবেল এসব নোংরামি সাপোর্ট করেনা। তবে এসব সমস্যা এখন অনেকটাই কমে গেছে। মানুষজন সহজেই মেনে নিচ্ছে আজকাল।
একবার স্কুলে আমার কিছু সহপাঠি ঝগড়া করছিল। এমন সময়ে একজন আরেকজনকে গে হিসেবে সম্মোধন করল। টিচার সেটা খেয়াল করে বললেন এটা কখনো গালি হিসেবে ব্যবহার করবে না। এধরনের অনেক মানুষ আমাদের সমাজে আছে যারা আসলেই গে, এভাবে তাদেরকে অপমান করা হবে। ওরা মাথা ঝাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝল।
আমার এক ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী "J"র কথা বলেছি ৬ পর্বে। ওর ব্রাজিলে থাকা এক বান্ধবীর মা বাবা লেসবিয়ান বলে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। সে তখন থেকে নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে লিভ টুগেদার করছে! মা বাবার সাথে ৭ বছর ধরে কোন কনট্যাক্ট নেই। আমার কাছে আসল সমস্যা এসব না। আসল সমস্যা অনেক বড়!
গে/লেসবিয়ানরা নিজের সেক্সুয়ালিটি বুঝে অনেকের সাথে মিশে। তারপরে নিজের মধ্যে ডিফারেন্স অনুভব করে। কিন্তু এভাবে করে সবাই আজকাল কনফিউজড হয়ে যাচ্ছে। পার্টিতে কোন সেম জেনডারের মানুষের সংগ ভালো লাগছে? ব্যস নিজেকে প্রশ্ন আমি কি গে? কেউ যেন শিউর না কি চায়, কেন চায়। এখানে অনেকে যেকোন জেন্ডারের সাথে নির্দ্বিধায় সম্পর্ক করছে যাতে নিজের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে কোন দ্বিধা না থাকে! নিজেকে খোজার চেষ্টায় যেন হারিয়ে ফেলছে নিজেকে। নিজেকে জানতে না পারা, নিজের প্রায়োরিটিস না জানতে পারাটা যে কি এক দূর্বিষহ যন্ত্রনা! যারা এসবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারাই ভালো বলতে পারবে।
আমাদের দেশে মা বাবাদের সবচেয়ে বড় ভয় সন্তান পড়াশোনা করেনা, অথবা প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এখানে মা বাবাদের সবচেয়ে বড় ভয় কোন এক সকালে নাস্তার টেবিলে মেয়ে শান্ত গলায় বলবে, "আমার আবার ব্রেকআপ হয়েছে। আমি আসলে অন্যরকম। আমার ছেলেদের না মেয়েদের ভালো লাগে!" মা বাবা জানেন এসবের গ্রহণযোগ্যতা হলিউডে যতই থাকুক না কেন বাস্তব জীবনে কত কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এদেরকে। কিছু কিছু মা বাবা সাপোর্ট করেন, আর কেউ কেউ এসব করলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার, পকেটমানি কেটে নেওয়ার হুমকি দেন!
এতো গেল বাচ্চাদের কথা! আজকাল অনেক বয়স্ক মানুষ তাদের ২০/৩০ বছরের পুরোনো হাসবেন্ড/ওয়াইফকে ডিভোর্স দিয়ে সেম সেক্স ম্যারেজে ঢুকে পরছেন। আর বলছেন এতদিন সমাজের ভয়ে চুপ ছিলেন, কিন্তু এখনকার আধুনিক সমাজে নাটক করার দরকার নেই। We all finally have got the right to be ourselves. তা দেখে গে এক্টিভিস্টরা আরও জোর পায়। বলে বহুযুগ থেকে তাদের দাবিয়ে রাখা হয়েছে, আর না! আর চার্চগুলো বলে, এসব গে এক্টিভিস্টরা হাজারটা সুখের সংসার নষ্ট করছে। সময় থাকতেই এদের বের করে দিতে হবে। আর সরকার পরে যায় গেড়াকলে, কোন দিকে যায়? যদিও এসব গন্ডগোল কালের স্রোতে এখন অনেক কমে এসেছে, এবং কানাডার চেয়ে আমেরিকায় বেশি হয়।
একবার আমাদের E.S.L. ক্লাসে এক ফিলিপাইনের ছেলে নিজের জাপানিজ বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে বলছিল কানাডায় প্রায় সবাই গে। আমাদের ফিলিপাইনে এসব নেই। সেটা শুনতে পেয়ে কানাডিয়ান টিচার বিরক্ত হয়ে হেটে এসে বললেন, "তোমাদের দেশেও অনেক আছে, কিন্তু কানাডার মতো আইনত সুযোগ সুবিধা, সামাজিক বৈধতা না থাকায় তারা সবার সামনে ওপেনলি বলতে পারেনা। এবং এটা বেশিরভাগ এশীয়ান দেশের জন্যে সত্যি।" তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ব্যাংলাদেশেও তাই না?" আমি প্রশ্নটার জন্যে মেন্টালি প্রস্তুত ছিলাম না। কিছুটা থতমত খেয়ে আমি বললাম, "বাংলাদেশ স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশ, সেখানে সবাই নিজের মতো করে বাচতে পারে।" শুনে উনি হালকা হাসলেন।
আমার উত্তরটা জঘন্য একটা উত্তর ছিল। আমি কথা ঘুরিয়ে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং বলেছিলাম। কেননা আমাদের দেশে এই বিষয়ে ভালো খারাপ কোন আলোচনাই শুনিনি আমি। কি বলতাম আর? আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে এসব নিয়ে কথা শুরু হয়ে গেছে! ছোটবেলা থেকেই দেখছি কোন জিনিস ভালো হোক আর খারাপ হোক, প্রথমে আমেরিকায় শুরু হয়, তারপরে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতে, আর তারপর আমার দেশের মানুষ তা লুফে নেয়। কখনো তা ভালো ফল বয়ে আর কখনো খারাপ!
আজকাল ব্লগে মাঝেমধ্যে এসব নিয়ে পোস্ট আসে। আমি অনুভব করতে পারি ঝড় আসছে, জানি ব্লগের টুকরো আলোচনাগুলো একসময় চায়ের কাপের আড্ডায়, টিভিতে টকশোতে, মুভিতে রেগুলারলি হবে। বুঝি যে সমস্যা উন্নত বিশ্ব প্রায় সলভ করে এনেছে, তা আমাদের দেশে সবে মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে। অথবা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু বৃহৎআকারে প্রকাশ পাবে জলদি। আমি কামনা করি অন্য সব ঝড়ের মতো যেমন যুুদ্ধ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেও মাথে উচু করে বাচা এ জাতি যেন এ ঝড়টাও পার করে ফেলতে পারে গৌরবের সাথে। এবং বাংলাদেশকে নিয়ে বহুল প্রচলিত সেই কথাটা আবার যেন প্রমানিত হয়,
সারা বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়,
জ্বলে পুড়ে ছাড়খার তবুও মাথা নোয়াবার নয়।
বিশেষ কথা: ১৮++ ট্যাগ দিয়েও ১৮-- পাঠকদের আটকাতে পারব না জানি। তোমরা যারা পড়ছ তাদের বলছি, জেনেছ খারাপ কিছু হয়নি। না জানলে আমার মতো বোকা ভাবতে নিজেকে। কিন্তু খবরদার এডভেন্চারের লোভে এসব বাস্তবে এপ্লাই করবেনা। আমার লেখা পড়ে নিজের মাথা দয়া করে ঘুরিয়ে ফেলনা। অবশ্য আজকালকার দিনে ১৮- হয়েও তোমরা এ লেখার চেয়েও হাজারগুন ম্যাচিউর লেখা পড়ছ, দেখছ, শুনছ তা আমি জানি। তবুও লেখিকার কর্তব্য পালন করলাম আর কি!
আর সকল পাঠক, আমি এখানে কোন কিছুর পক্ষে বিপক্ষে বলছিনা। আমি শুধু নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছি।
আমি কিছুটা ভয়ে ভয়ে একরম একটা ইস্যু নিয়ে লিখেছি। ইন্নোসেন্ট কোন বিষয় নিয়ে লিখলেও দু একজন ব্লগবাড়িতে বয়ে এসে ঝাড়ি দিয়ে যান। আর এবারেতো সত্যিই বিতর্কিত ব্যাপার নিয়ে লিখেছি!
তবে আবারো বলব আমি শুধু তাদের জন্যই লিখি যারা প্রতি পর্বে বলেন "সাথে আছি, চালিয়ে যান।" আপনারা বলবেন পরের পর্বে কি কি জানতে চান, এবং এই পর্ব কেমন লাগল? ধন্যবাদ।
এ বিষয়ে একটা মজার ভিডিও দিয়ে শেষ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৩