আরেকটা পর্ব নিয়ে হাজির। আগের পর্বগুলোতে প্রচন্ড উৎসাহ পেয়েছি। অনেক ধন্যবাদ। এবারের পর্বে কিভাবে কানাডিয়ানদের সাথে বন্ধুত্ব করলাম, এবং কানাডিয়ান ছেলেরা কিভাবে আমাকে জ্বালাত তা নিয়ে লিখব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
তো কানাডিয়ান বাচ্চারা কেউ রেসিস্ট ছিল না, তবে ভাষা সমস্যার কারণে আমার কাছে তেমন একটা ঘেষত না। আমাকে আমার পোশাক, গায়ের রং নিয়ে কখনো কিছু শুনতে হয়নি। তবে আমার সাথে কথাও বলত না। আমি প্রতি ক্লাসে বেন্চের মাঝে বসতাম যাতে কাউকে না কাউকে কোন এক পাশে বসতে হয়। কিন্তু তখন পুরো বেন্চ খালি থাকত শুধু আমি ছাড়া। অন্যান্য এশিয়ান (জাপানিজ, কোরিয়ানদেরও) একই অবস্থা। আর এদিকে E.S.L ক্লাসে টিচাররা তাগাদা দিচ্ছে ইংলিশ ইমপ্রুভ করতে কানাডিয়ান কিডদের সাথে মেশো। তোমরা বিদেশীরা সারাক্ষণ আলাদা থাক এটা ঠিক না। ওনাদের কে বোঝাবে আমরা মিশতে চাই, কিন্তু আমাদের কালচার, ইংলিশ না বুঝতে পারায় ওরাই আর আগ্রহ দেখায় না। আর এমনিতেও নতুন কোন কানাডিয়ান স্টুডেন্ট আসলেও খুব যে মেশে তা না। আমাদের দেশে নতুন স্কুলে গেলে টিচাররা পুরানোদের বলতেন ও নতুন, মানিয়ে নিতে সাহায্য করো। আসলে আমাদের দেশের আতিথেয়তা বা সরল মনে আপন করে নেওয়ার ব্যাপারটা কানাডায় নেই। এখানে নিজেরটা নিজেই করে নিতে হয়। এরা না কারও ক্ষতি করবে, না কারও লাভ করবে। Your life, your headache.
তো অনেক চেষ্টা করলাম টুকটাক কথা বলার ওদের সাথে। কিন্তু এক হাতে তালি বাজল না, আর আমারও কানাডিয়ান বন্ধু হলো না। কয়েকটা E.S.L এর ছেলেমেয়েদের সাথেই মিশতে থাকলাম। কিন্তু ওদেরও নিজের দেশের বন্ধু থাকায় খুব একটা পাত্তা পেলাম না। খালি মনে হত কয়েকজন বাংলাদেশি যদি এখানে থাকত! তো হাল ছেড়ে দিলাম। একাকিত্বকেই বন্ধু বানিয়ে নিলাম। একা একা ঘুরতাম, পড়তাম। খারাপও লাগত না আর। যেন এটাই নরমাল। তবে এতে আমার খুব লাভ হয়েছিল। খুব self dependent হয়ে গিয়েছি। এখনো যদি বন্ধু ছাড়া চলতে হয় চলতে পারব।
তো প্রথম সেমিস্টার প্রায় শেষের পথে। একদিন সাইন্স ক্লাস থেকে আমাদের জীমে নিয়ে যাওয়া হল। গিয়ে দেখি পুরো স্কুল এক হয়েছে। ওখানে নাকি ভালো স্টুডেন্টদের আওয়ার্ড দেওয়া হবে। তো বিশাল জীমের সারি সারি সিড়িতে স্টুডেন্টরা বসা। আর সামনে টিচাররা ভাষন দিলেন, সিনিয়াররা মজার মজার খেলা খেলল ফান্ড রেইজিং এর জন্যে। এরা ফান্ড রেইজিংটা খুব করে। এরপরে সামনে থাকা বড় স্ক্রিনে যারা বিভিন্ন সাবজেক্টে ভালো করেছে তাদের নাম উঠছে। তখন শুধু নাম দেখায় পরে অফিস থেকে পুরষ্কার হিসেবে দেওয়া সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হয়। হঠাৎ করে দেখি স্ক্রিনে বেশ কয়েকজনের সাথে আমার নাম!!! সাচ এ সারপ্রাইজ। ভাষাই পারিনা আবার ভালো করলাম কখন? একটু পরে পরে দেখি বিভিন্ন সাবজেক্টে একসিলেন্স আওয়ার্ড লিস্টে আরও পাচ ছজনের সাথে আমার নাম। কি যে ভালো লেগেছিল! পরের বছরগুলোতেও নিয়মিত পেয়েছি কিন্তু প্রথম বছরে আনএক্সপেকটেডলি এতগুলো আওয়ার্ডে যারপরনাই খুশি ছিলাম।
তো পরের সেমিস্টার শুরু হল। আর social studies ক্লাসে আমার নাইটমেয়ারও শুরু হল। ওই ক্লাসে স্কুলের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেগুলো কিভাবে যেন একসাথে পরে গেল। আর ক্লাসে বাকি ৭/৮ টা মেয়ের মধ্যে আমাকেই বেছে নিল ফ্লার্ট করার জন্যে। অশ্লীল কিছু করত না কিন্তু খুব পিছে লাগত। যেমন আমার পুরো নাম আরবিতে হওয়ায় আরবি টোনে নাম নিয়ে গান বাধত, লম্বা বেনীতে টান দিত, অন্যভাবে তাকাত এইসব। আগের সেমিস্টারেও তাকাত কিন্তু আমি নতুন হওয়ায় হয়ত অস্বস্তি বোধ করত। আর আওয়ার্ড পাওয়ার পরে আরও নজরে পরে গেলাম। আমি ভাই আমার মফস্বল শহরে এত ওপেন ফ্লার্টিং দেখিনি। খুব বেশি হলে চোখাচুখি। হাসবেন্ড ওয়াইফও জনসম্মুখে হাত ধরতে লজ্জ্বা পেত আমার ছোট শহরে। আর এখানে? নিজে থেকে ঝাড়িও দিতে পারছিনা। মা আমাকে বলেছিল, "যদি দেশে খারাপ কিছু কর ফ্যামিলির বদনাম, আর যদি এখানে খারাপ কিছু কর দেশের বদনাম।" সেই কথা মনে করে কিছু বলতাম না, ভাবতাম যদি ছড়িয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষ রুড। কিছু না বলায় ওরা আরও আগ্রহ পেয়ে যায়। এখন আল্লাহর ফেরেশতা হয়ে কে বাচাবে আমাকে? হ্যা পেয়েছি যারা সবসময় বাচিয়ে এসেছে, টিচার!
তো একজন জার্মান কানাডিয়ান ভদ্রমহিলা আমার টিচার ছিলেন। ওনার সাথে অনেক ফ্রি ছিলাম। কারণ social studies এর টিচারদের অন্য দেশের প্রতি আগ্রহ থাকে। তো ক্লাস শেষ হওয়ার পরে প্রতিদিন অন্তত বিশ মিনিট দুজনে মনখুলে দেশের গল্প করতাম। তো আমি একদিন একটু আগে ক্লাসে যাই কনফিডেন্টলি ওই পাচ/ছয়টা ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ দিতে। যাওয়া মাত্র টিচার আমাকে বললেন তুমি দেখেছ? আমি বললাম কি? উনি বললেন ও (ওদের মধ্যে একজন) ইউটিউব ভিডিওটার (ক্লাসে ভিডিওটা দেখানো হয়েছিল পড়ানোর জন্যে) নিচে কমেন্ট বক্সে i love you (আমার ডাক নাম) লিখে রেখেছে। টিচার বললেন তুমি নিশ্চয় খুশি ক্লাসের সব ছেলে তোমার সাথে ফ্লার্ট করে। It means you are hot stuff." আমার ওপরে তো বজ্রপাত হল। টিচার এসব কি বলে? কোথায় রাগ করবে, ছেলেদের স্কুল থেকে বের করে দেবে (বাংলাদেশে তাই হত) তা না। পরে বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের দেশে ছেলেরা ডিস্টার্ব করলে সেটা খারাপ কেননা মেয়েটার ক্যারেক্টারে দাগ পড়তে পারে। আর এখানে ছেলেদের নজরে আসাটাই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট!!
তো আর কি করব? সহ্য করতে লাগলাম। ধীরে ধীরে ক্লাসের মেয়েরা খুব ভাব জমাতে চাইল। ছেলেদের পছন্দের যে আমি সেজন্যে! কিন্তু একটা সময় আমার টিচার ঠিকই খেয়াল করলেন বিষয়টা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যাচ্ছে। আমার অসহায় চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটাতে আমি বিব্রত। তো উনি ওই পাচটা ছেলে আর আমাকে ক্লাসের বাইরে নিয়ে গেলেন। বললেন, "কয়দিন আগে ইন্ডিয়াতে একটা মেয়ে পাবলিক বাসে রেপড হয়। তোমরা বোঝনা জীবণ কত কঠিন। ও তোমাদের কলিগ, ওকে এসবের মধ্য দিয়ে কেন যেতে হবে?" আমিও বললাম আমার বাবা যদি ইউটিউব ভিডিওর নিচের লেখাটা দেখেন কতোটা চিন্তায় পরে যাবেন। ওরা পুরোটা সময় মাথা নিচু করেছিল আর বারবার সরি বলছিল। পরে কয়েকদিন আমার দিকে আর তাকায়নি পর্যন্ত কিন্তু তারপরে আবার যা তাই। তবে আর কিছু মনে করতাম না কেননা সেদিন ওদের সরি বলার ধরন দেখে বুঝে গেছিলাম আসলে ওরা ভালো ছেলে। শুধু দুষ্টুমিটা বেশি করে। আর টিচারও কড়া নজর রাখতেন বলে বেশি কিছু করতে পারত না। শুধু পড়া বুঝে নেওয়ার বাহানা করে আমার কাছে আসত। এতে তো টিচার কিছু বলতে পারবেনা। টিচার সব বুঝে আমার দিকে মুচকি মুচকি হাসত, আর কাধ ঝাকাত। যেন বলছেন সরি এটুকু সহ্য করতে হবে।
তো এরপর থেকে কানাডিয়ান ছেলেমেয়েদের জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে গেলাম, যে আমি কোন একটিভিটিতে পার্টনার পেতাম না, এখন আমাকেই আগে থেকে বুক করে রাখে!! আমার পাশে কেউ বসত না, আর এখন আমার পাশে বসার জন্যে আগে থেকে ব্যাগ দিয়ে রাখে!! কারণ আামার গ্রুপে থাকলে ভাল মার্ক পাবে। কিন্তু এদের সাথে কাজ করলেও সিরিয়াস বন্ধুত্বে যাইনি। যে দুএকজন কানাডিয়ান আমার ভাংগা ভাংগা ইংলিশ সহ্য করেও প্রথমদিকে মোটামুটি মিশত শেষ পর্যন্ত তাদের সাথেই ছিলাম। ইংলিশ ইমপ্রুভ হওয়ার সাথে সাথে তাদের সাথে হওয়া টুকটাক কথাগুলো কনভার্সেশনে পরিণত হতে লাগল। বন্ধু ছিল তারাই যারা আমার কাছে হেল্প আশা করেনি, কিন্তু আমাকে হেল্প করেছে। আর ইংলিশে দ্রুত উন্নতি হওয়ায় E.S.L ক্লাসে সবার লাইফসেভার হয়ে গেলাম। সবাই অন্য সাবজেক্টের হেল্প নিতেও আমার কাছে আসত। ব্যাস এভাবেই দুতিনজন কানাডিয়ান বন্ধু আর অগনিত E.S.L বন্ধু পেয়ে গেলাম!
তো কিভাবে কানাডিয়ানদের সাথে ভাব জমালাম তার সহজ উত্তর হলো নিজের যোগ্যতা প্রমান করে, আর ইংলিশ ইমপ্রুভ করে। এটাই বাংলাদেশ আর কানাডার পার্থক্য। বাংলাদেশে বন্ধুত্ব করতে যোগ্যতা লাগেনা,অন্তত আমার ক্ষেত্রে লাগেনি। কিন্তু সত্যিই বলছি দেশের মতো পুরো স্কুল হাত হাত ধরে ঘুরে বেড়ানোর মতো, ক্লাস চলাকালিন লুকিয়ে কাটাকাটি খেলার মতো, রঙ সাধের পানি আইসক্রিম দুই ভাগ করে খাওয়ার মতো, মাতব্বরি করে ছোট একটা প্রবলেমের জ্ঞানী সমাধান দেওয়ার মতো বন্ধু খুব কমই পেয়েছি ....
এর পরের পর্ব পাঠক চাইলে লিখব। কষ্ট করে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ সকাল ১১:৫৪