তো এবার আরেক পর্ব নিয়ে হাজির। আগের পর্বগুলোতে অনেকে কালচারাল ডিফারেন্সগুলো কিভাবে ট্যাকল করতাম সেটা জানতে চেয়েছেন। এ পর্বে সে প্রশ্নের উত্তর দেব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
ওখানে সবচেয়ে বেশি যে ক্লাসে কালচারাল ডিফারেন্স অনুভব করেছি সেটা হচ্ছে P.E. Physical Education ক্লাসে। আমাদের দেশে ড্রিল সপ্তাহে একদিন হতো এবং হালকা খেলাধুলার মধ্যে আধ ঘন্টা কখন পার হয়ে যেত তা বুঝতে পারতাম না। আমাদের দেশে এটা খুবই আনইম্পর্ট্যান্ট একটা ক্লাস। কিন্তু ওখানে বাকায়দা ৭৫ মিনিটস (অন্যান্য ক্লাসের সমান টাইম) প্রতিদিন হতো। এটা ওখানে গ্রেড ১০ পর্যন্ত কমপালসারি।
তো ইয়া বড় জীম, নিচের তলায় বাস্কেটবল, হকি (আমাদের দেশে যেমন ক্রিকেট, ওদের দেশে তেমন হকি), ব্যাডমিন্টন, সকার (ফুটবল), ভলিবল খেলা হত। উপরে তলায় Exercise Machines, পিং পংও হতো। আর বাইরে বিশাল মাঠে আরও অনেক ধরণের খেলা হত। তো প্রথমদিন টিচাররা বলে দিলেন কেডস, শর্টস, টিশার্ট পরতে হবে, এবং ক্লাসের শুরুতে চেংজিন রুমে পোশাক চেন্জ করতে হবে। আর যাওয়ার সময় আবার রেগুলার ড্রেস পরে নিতে হবে।
কেডস নাহয় পরলাম, কিন্তু শর্টস, টিশার্ট ? ওসব পরতে পারবনা বাবা। টিচারকে ভাংগা ভাংগা ইংলিশে বুঝালাম, শুনেই টিচার আমাকে চেংজিন রুমে নিয়ে গেলেন। আমি ভাবলাম আড়ালে ডেকে নিয়ে মারবে নাকি!! হায় কই পালাই। তারপরে তিনি আমাকে চেংজিন রুম দেখিয়ে দিয়ে বললেন এখানে কাপড় বদলাতে পারব। আসলে আমার ইংলিশ না বুঝে ভেবেছিলেন চেংজিন রুমের ব্যাপারে জানতে চেয়েছি। তো আরো ১৫ মিনিট ধরে বুঝালাম, তারপরে বুঝল। আমি বললাম অন্য সালোয়ার কামিজ নিয়ে আসব। তবে ওদের শর্টস, টিশার্ট পরতে পারবনা। তখন উনি বললেল "ও সরি আমি বুঝতে পারিনি, কোন প্রবলেম নেই"।
তো দেশের ইউনিফর্মে ওড়নাটা সুন্দর করে আটসাট অবস্থায় থাকে। কিন্তু ওখানে নরমাল, কালারফুল কামিজ পরতাম। ওটুক সময়ের মধ্যে পিন টিন দেওয়া সম্ভব ছিল না। তো আমাদের দেশে বিকালে খেলতে গেলে ওড়না যেমন করে বুক থেকে জড়িয়ে কোমরে বাধে সেভাবে বাধতাম। কেউ অবাক দৃষ্টিতে তাকাতো না। যেন এটাই নরমাল। ওরা রেসিস্ট ছিল না, তবে আমার সাথে বন্ধুত্যও করত না। আমার সাথে ভাল খারাপ কোন কথাই বলত না। Like I didn't exist in their world. শুধু আমার লম্বা চুলের দিকে অবাক হয়ে তাকাত অবাক হয়ে আর বলত তোমাদের দেশে কি সবারই লম্বা চুল? ব্যাস এইটুকুই।
তবে ক্লাসটা অনেক কঠিন মনে হত। ওরা আমার চেয়ে বেশি লম্বা, শক্ত সামর্থ্য ছিল। ওদের দৈহিক গঠন আমাদের চেয়ে কেন বেটার হয় এই ক্লাস করতে যেয়ে বুঝি। ভলীবল খেলতে গিয়ে হাত লাল হয়ে যেত, বেশি জোরে দৌড়াতে গিয়ে (লেগ পুল) সহ বিভিন্ন ইনজুরিতে পরতাম। যাই হোক সবচেয়ে কষ্ট ছিল কোন বন্ধু না থাকা। কোন গেমে পার্টনার লাগলে টিচারকে গিয়ে বলতে হত I don't have any partner. তখন টিচার কাউকে ঠিক করে দিতেন। কিশোরী একটা মেয়ে যে এমনিতেই নিজের শারিরীক, মানসিক পরিবর্তন নিয়ে কনফিউসড তার কোন বান্ধবী না থাকাটা কিযে ভয়াবহ একটা ব্যাপার। খালি দেশে ফিরে আসতে ইচ্ছে হত, আর দলা পাকিয়ে কান্না আসত।
তো একদিন এক বড় সমস্যায় পরলাম সেমেস্টারের শেষের দিকে। আজকে নাকি Socializing Skills শেখাবে। মানে কাপল ড্যান্স কেননা ওদের ওখানে পার্টিতে এসব নাচ জানতে হয়। তো ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে দাড়িয়ে, একজনের সাথে নেচে আরেকজনের দিকে ঘুরে যাবে। এভাবে সবাই সবার সাথে নাচবে। উরে মা, বাংলাদেশে জীবনে কোন ছেলের হাত ধরিনি, কোন ছেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ওড়না ঠিক করতে করতে চোখ রান্গিয়েছি (মফস্বলে এটা করলে ছেলেরা বোঝে মেয়েটি বিরক্ত হচ্ছে, আর তাকানো যাবেনা)।
আর এখন কোমরে হাত, হাতে হাত impossible.
তো টিচাররের কাছে গেলাম দুরু দুরু বুকে কেননা নাচে (২০% মার্ক) আছে। টিচারের তো মানার কথা না। ভাবছিলাম জোর করলে পালিয়ে যাব আর এই স্কুল না। কিন্তু টিচারকে বলায় তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে শুধু আমার জন্যে ৮/১০ জন মেয়েদের গ্রুপ করে দিলেন। বললেন ছেলেদের সাথে নাচা সমস্যা, নাচা তো সমস্যা না। আলাদা গ্রুপের বেশিরভাগই জাপানিজ, কোরিয়ান আর কয়েকজন কানাডিয়ান ছিল। নাচ করতে করতে একটা কোরিয়ান, আর কানাডিয়ান মেয়ের সাথে মোটামুটি সখ্যতা হল।
যে প্রশ্ন দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেই প্রশ্নে ফিরে আসি। আমি কিভাবে কালচারাল ডিফারেন্সগুলো ট্যাকল করতাম? সত্যি বলতে আমি করতাম না, ওরাই করত। আমাকে কানাডার সাথে এডজাস্ট করতে হয়নি, কানাডাই আমার সাথে এডজাস্ট করে নিয়েছে। কি যে স্পেশাল ফিল করেছিলাম সেদিন!! কানাডা নিয়ে আর কোন ভয় মনে ছিলনা। আর ওরা আমাকে সেভাবে মেনে নেওয়ায় আমিও যখন ওদের ছোট কাপড়ে দেখতাম, সবার সামনে লিপকিস করতে দেখতাম মনে হতো এটাইতো নরমাল। ওরা ওদের মতো নরমাল আর আমি আমার মতো। আল্লাহ যেন উদার মনের মানুষের উদার দেশটাকে সবসময় ভালো রাখে।
পরের পর্বে আরও কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। আরো অনেক সমস্যা তখনো ছিল।