হারিয়ে যাওয়া এই শহরগুলো ছিল একসময় ধনসম্পদ ও প্রাচুর্যে ভরা। কিন্তু কিভাবে এই ধনসম্পদে ভরা শহর গুলো সৃষ্টি হয়েছিল ও কিভাবেই বা এগুলো ধ্বংশ হয়েছিল তা এখন স্পষ্ট নয়।চলুন আজ সেই রকম কিছু শহর সম্পর্কে জেনে আসি।
১) মাচ্চুপিচ্চঃ-
মাচ্চুপিচ্চু সম্পর্কে কিছু বলার কিছু নেই।এ নিয়ে ব্লগে অনেক তথ্য আছে, শুধু বলা যায় মাচ্চুপিচ্চু হল ইঙ্কা দের ১টি শহর যা সৃষ্টি হয়েছিল সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৪৩০ মিটার উঁচুতে এবং সৃষ্টি করেছিল ইনকা শাসক পাচাকুতেক । পেরুর কুজকোর 70 কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে উরুবামবা (Urubamba) নদীর কাছে 15 শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি শহরটি তৈরি করিয়েছিলেন।স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ীরা যখন ইনকা সাম্রাজ্ঞ ধ্বংশ করেছিল তারাও এই শহরের আস্তিত্ব খুজে পায়নি।ত যা হবার তাই হল আস্তে আস্তে শহর টি জংগলে হারিয়ে গেল।এবং হারিয়ে গেল মানুষের মন থেকেও। এমনকি ইনকারাও ভুলে গেল শহরটির আস্তিত্ব।১৯১১সালে ঐতিহাসিক হেরাম বিংহাম পৃথিবীর মানুষের কাছে নতুন করে নিয়ে এল এই ঐতিহাসিক শহরটিকে। ১৯৮৩সালে এই শহর টিকে বিশ্বঐতিহ্যের আওতাভুক্ত করা হল। যেখানে বলা হল ``An absolute masterpiece of architecture and a unique testimony to the INKA civilization”
আরো যানতে ঘুরে আসুন http://en.wikipedia.org/wiki/Machu_Picchu
২)এংকর।(কম্বোডীয়া):- কম্বোডিয়ার দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত আনিন্দসুন্দর এই শহরটির পরিচিতি এখনও অনেকের অজানা। ধারনা করাহয় এই শহরটি নবম থেকে পনের শতকের দিকে বিস্তার লাভ করেছিল।এই শহরটির গোড়া পত্তন করেছিল খামার সাম্রাজ্যের রাজা দ্বীতিয় জয়াভর্মন।রাজা দ্বীতিয় জয়াভর্মন নিজেকে (universal monarch) ও(king of God) বলে ঘোষনা করেছিলেন।২০০৭ সালে ১দল গবেষক উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে বের করে যে Angkor হল শিল্পযুগের পুর্বে স্থাপিত সবচেয়ে বড় শহর যার আয়তন ছিল ১১৫০ বর্গ কিলোমিটার । যাইহোক আংকরিয়ানরা ছিল পাথর খোদাইয়ে শ্রেষ্ঠ।তার প্রমান হল কম্বডিয়ায় অবস্থিত বিশাল বিশাল মন্দির ও কবর।তাদের মদ্ধে শ্রেষ্ঠ হল Angkor Wat. মজার ব্যাপার হল ১টি খোদাইকৃত পাথরে তৎকালীন সময়ের গবাদীপশুর বর্ননা পাওয়া যায় ।যেখানে গরু মহিষের পাশাপাশি ১টি ডাইনোসরের ছবিও আছে। মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাবার পর ১৮৬১ সালে ফ্রাঞ্চের আবিষ্কারক Henri Mouhot এই শহরকে পুনরায় আবষ্কার করেন। Angkor এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত।
আরো আছে Click This Link
৩) মেম্ফিস (মিশর):- মেম্ফিস হল প্রাচীন মিশরের ১টি বিখ্যাত শহর।নীল নদের ব-দ্বীপে অবস্থিত এই শহরটি ছিল পুরাতন রাজ্যের(Old Kingdoom c.3100–c.2258 B.C.) রাজধানী।এটার গোড়াপত্তন করেছিলেন সংযুক্ত মিশরের ১ম রাজা মেনিস Menes। এটার প্রাচীন মিসরীয় নাম হল ইনেব হেজ(Ineb Hedj ) যার অর্থ “সাদা দেয়াল”(Tha White Wall). মেনিস তার এই শহরে বসে মিসরের উচ্চ ও নিম্ন ভুমির নদীপথ ওস্থল পথ নিয়ন্ত্রন করতেন।যাই হোক, ধারনা করা হয় মেনিস এই শহরটিকে তৈরি করেছিলেন নীলনদের বন্যা থেকে মিসরকে রক্ষা করতে। পরবর্তিতে এটি ধর্মীয় আচার ও প্রসাসনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। এবং আস্তে আস্তে প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহরে পরিনত হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন প্রাচীন এই শহরটিকে আস্তে আস্তে উত্তরে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল তারপর আবার সরিয়ে দক্ষিন দিকে ফিরিয়ে আনা হয়।একসময় এই শহরটি জুরে অনেক মন্দির, রাজপ্রাসাদ ও বাগান ছিল, এখন তার সামান্যই অবশিষ্ঠ আছে। আমরা অনেকে হয়ত Percy Bysshe Shelley এর ozymandias কবিতাটি পরেছি। ozymandias এর বিখ্যাত মূর্তিটি মেম্ফিসে অবস্থিত।আমাদের অতি পরিচিত পিরামিড গুলিও এখানে অবস্থিত।
আরও জানতেঃ- http://www.ancient-egypt.org/index.html
৪. পিতরা (petra) জর্ডান :-
পাথরের গায়ে খোদাই করা এই শহরটি জর্ডানে অবস্থিত ।পিতরা এর অর্থ পাথর।১৮১২ সালে সুইস আবিষ্কারক Johann Ludwig Burckhardt করার পুর্বে এই শহর সম্পর্কে কেউই তেমন জানতনা।এটি অবস্থিত জর্ডানের হর(hor) পর্বতের ঢালুতে। যাইহোক ধারনা করা হয় পিতরা তে জনবসতি সুরু হয় (1550-1292 BC) তে।পাত্থরে ঘিরে থাকার কারনে এই শহর যে শুধু নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত হত তাই নয় এটা এমনকি তথকালীন সময়ের বানিজ্যিক পথগুলও নিয়ন্ত্রন করত।এটা ছিল একটি গুরুত্বপুর্ন শহর কারন এর পশ্চীমে ছিল গাজা উত্তরে দামেস্ক এবং আস্তে আস্তে এটা রাজধানী শহর ও উট বিক্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে।এটার ধংস হয়ে যাওয়ার কারন সম্পর্কে অনেক মতবাদ রয়েছে । তাদের মদ্ধে উল্লেখযোগ্য হল ৩৩৬ এর ভুমিকম্প।এই ভুমিকম্পে পিতরার পথরে খোদাই করা অনেক উচু ভবন ধংশ হয়ে যায়।মধ্যযুগ থেকে এখন পর্জন্ত পিতরার এই ভঙ্গুর সৌন্দর্য মানুষকে রহস্যে ডুবিয়ে রেখেছে।১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো পিতরা কে বিশ্বঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। যেখানে বলা হয় "one of the most precious cultural properties of man's cultural heritage.")
বিস্তারিত পাবেনঃ- http://no.wikipedia.org/wiki/Petra_(Jordan)
৫) পালমিরা(PALMYRA) সিরিয়াঃ- প্রাচীন কালের এই বিখ্যাত শহর টি সিরিয়া তে অবস্থিত যাকে “ The Bride of the Desert”. বলা হয়।মরুভুমিতে অবস্থিত এই শহর টি প্রাচীন কালএ মরুযাত্রী উটের কাফেলা গুলোর বিস্রামের জন্য জনপ্রিয় স্থান ছিল। প্রাচীন নথীপত্র থেকে যানাযায় পাল্মিরার প্রাচীন নাম ছিল “তাদমুর” (Tadmur)।যদিও এই শহরটি ১৬ শতকের দিকে বিলুপ্ত হয়ে যায় এটি এখনও আদিবাসীদের কাছে তাদমুর নামেই পরিচিত।
প্রথম সতাব্দীর মধ্যভাগে পালমীর ছিল প্রাচুর্যে ভরা ১টি শহর।হিব্রু বাইবেল অনুযায়ী এই শহরটির গোড়া পত্তন করেছিলেন রাজা সলোমন, তিনি ছিলেন রাজা ডেভিডের ছেলে। ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে এখানে ১ম মুসলমানদের আগমন ঘটে।৬৩৬ সালে আরব মুসালমান খালিদ ইবনে ওয়ালিদ এই শহরটি দখল করেন।এই শহরটির সবচেয়ে সুন্দর ও জনপ্রিয় স্থাপত্য নিদর্শন হল ফাকরুদ্দিন আল মান্নির দুর্গ যা পর্বতের চুরায় স্থাপিত।যাইহোক হারিয়ে যাবার ৮০০ অবছর পর আবার পালমীরে মানুষের আনাগুনা শুরু হয়।
আরও :- http://en.wikipedia.org/wiki/Palmyra
৬) পম্পেই (pompay) ইটালি ঃ- হাড়িয়ে যাওয়া এই শহরটি ইতালি তে অবস্থিত যা ভিসুভিয়াস নামক আগ্নেয়গীরির অগ্নুৎপাতের ফলে ধ্বংশ হয়ে যায়। বর্তমান কালের নেপলস শহরের পাশে অবস্থিত এই রোমান শহরটির সাথে হারকিউলিনিয়াম (Hurculanium) শহরটিও এই ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে ধ্বংশ হয়েযায়। টানা ২দিন অগ্নুৎপাতের ফলে শহর টি লাভা ওছাই এর অনেক গভীরে তলিয়ে যায়।তৎকালীন ঐতিহাসিকদের রেখে য়াওয়া নথীপত্র থেকে জানা যায় ৭৯ সালে ভিসুভিয়াসে সেই মরনপন অগ্নুৎপাত্টি সঙ্ঘটিত হয়েছিল ৭২ সালের ২৪ আগস্ট মাসে যার স্থায়িত্ব ছিল ২ দিন। এই দুই দিনের অগ্নুৎপাতেই ফলে প্রাচুর্যেভরা পম্পেই নগরী লাভার নিচে পরে ধংশ হয়ে যায়।
হারিয়ে যাবার পর আস্তে আস্তে শহরটি মানুষের মন থেকেও হারিয়ে যায়।১৫৯৯ সালের দিকে পম্পেই এর একটি অংশ মাটি থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর পুনঃখননের ফলে বেরিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস।তবে এটি সম্পুর্নরুপে আবিষ্কৃত হয় ১৭৪৮ সালে।
বিস্তারিত জানুনঃ- http://en.wikipedia.org/wiki/Pompeii
৭)পালাঙ্কি (palenque) Maxico:- আমরা সবাই মায়ানদের সম্পর্কে জানি আর পালাঙ্কি হল মায়ানদের স্থাপিত ১টা শহর।পালাঙ্কি শহরটির দেখা পাওয়া যাবে মাক্সিকোর চিয়াপাস রাজ্যের গহীন অরন্যে।এই শহর টি মায়ান দের স্থাপত্ববিদ্যার পরিচয় বহন করে।যার প্রমাণ অবস্থিত অনিন্দ সুন্দর পাথরে খোদাই করে নকশা করা মন্দির ও বহু স্থাপনা।যাই হোক এই শহর টির গোড়াপত্তন হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ১শতকে। এর বিস্তার ঘটেছিল ৬০০ থেকে ৭০০ad তে.।পালাঙ্কি শহর টি সবচেয়ে গুরত্ব লাভ করেছিল রাজা পাকালের (Pakal) আমলে. পাকাল ছিল club footed(যাদের পায়ের পাতা বাকাঁনো)।তার রাজত্ব কাল ছিল ৬১৫ad থেকে ৬৮৩ad পর্যন্ত।তার শাসনামলে পালাঙ্কিতে অনেক ভবন রাস্তাঘাট ও মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। তাদের মদ্ধে শ্রেষ্ঠ হল Templo de las Inscripciones।
Pakal এর পুত্র Chan-Bahlum II পালাঙ্কির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রসার, স্থাপত্বকলা প্রভৃত্তির কাজ পরিচালনা করতেন। এত কিছুর পরেও পালাঙ্কি শহরটি ধ্বংশ হয়ে গিয়েছিল। বিশেসজ্ঞদের মতে ৭০২ সালের দিকে Chan-Bahlum IIএর মৃত্যুর পর আরেকটি মায়ান শহর তনিনাস (Toniná)এর শত্রুতার কারনেই পালাঙ্কি শহরটি বিলুপ্ত হয়েছিল।বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় Toniná ৭৩০ সালের দিকে পালাঙ্কিতে ভয়ঙ্কর আক্রমন চালায়।তারপর থেকে ১০ সতাব্দির পর থেকে পালাঙ্কি শহরটি পুরাপুরি পরিত্যাক্ত হয়ে যায়।১৮শতক পর্যন্ত শহরটি পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল। ত ২০ সতাব্দির শুরুর দিকে Frans Blom নামে ১জন আবিষ্কারক ম্যাক্সিকোর ১তি বৃষ্টিবিধৌত অরণ্যে পালাঙ্কির ধ্বংসাবশেষ পুনরায় খুজে পান। আরও কিছু জানতে মাসুদ রানা সিরিজের মায়ান ট্রেজার বইটি পড়ে দেখতে পারেন।
আরওজানুনঃ- http://en.wikipedia.org/wiki/Palenque
৮)(খলিফাতাবাদ) বাগেরহাট ঃ-
সময়টি ছিল ১৫ সতকের মাঝামাঝি ।ধারনা করা হয় ঠিক তখনি বৈরি শ্বাপদসঙ্কুল সুন্দরবনের মাঝে নতুন ১টি শহরের আবির্ভাব ঘটে যার নাম ছিল খলিফাতাবাদ আর এটাই হল বর্তমান বাগেরহাট।বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম জেলা বাগেরহাট। সুন্দরবন ও খুলনা শহর আর অসংখ্য নদী নালা রয়েছে এর চতুর্পাশে। বাগেরহাট নামকরণের ইতিহাসে রয়েছে নানা মত। কারও কারও মতে, বাগেরহাটে সুন্দরবনের একটা বড় অংশ থাকায় বাঘের উপদ্রব ছিল বেশ। এ জন্যই একে বাঘেরহাট বলা হতো। কালক্রমে বাঘেরহাট বাগেরহাটে পরিণত হয়।
যাইহোক, এই শহর টির গোরাপত্তন করেন দরবেশ হযরত খান জাহান আলী(রঃ)(১৪৩৩-১৪৫৯) তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম যিনি বৈড়ি সুন্দরবনে নিয়ে গিয়েছিলেন ইসলামের আলোকবর্তিকা এবং তৈরি করেছিলেন এই সমৃদ্ধ সশহরটিকে। এই শহরটির সুচনা হয়েছিল সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯) এর সাশনামলে।খান জাহান সাহেব তার এই শহর টিকে সাজিয়েছিলেন প্রচুর মসজিদ ভবন পুকুর ও রাস্তাঘাট দিয়ে। এইগুলোর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ষাটগম্বুজ মসজিদ ও তার পাশের খাঞ্জেলি দিঘি।খাঞ্জেলি দিঘি হল ১টি বিখ্যাত দিঘি যেখানে গেলে দেখা মিলবে এমন বিখ্যাত কালাপাহার ও ধলাপাহার কুমিরের বংশধরদের যারা মানুষের ক্ষতি করেনা। ষাটগম্বুজ মসজিদএর পাশাপাশি আর যেসকল বিখ্যাত স্থাপনা রয়েছে তাদের মদ্ধে উল্লেখযোগ্য হল-নয় গম্বুজ মসজিদ, সিঙ্গাঈর মসজিদ ,রনবিজয়পুর মসজিদ ও ছয় মসজিদ। আরও অনেক তথ্য পাবেন এই লিঙ্কে http://www.bagerhatnews.com/?p=93
হয়ত এখানেই শেষ, আবার হয়ত এখানেই শুরু। সব জির্নতা ধুয়ে মুছে যাক। আর ফেলেযাক মানুষের ভালবাসা।এই ত সভ্যতা।
সকল ব্লগারকে শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৩৪