গত কয়েক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতাধিক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। এগুলোর নির্মাণব্যয় কিলোমিটারপ্রতি ৮০-৯০ কোটি টাকা। কোনো কোনোটির ক্ষেত্রে ব্যয় আরো কম। অথচ গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী (মেয়র হানিফ) ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় কিলোমিটারপ্রতি প্রায় ২১১ কোটি টাকা। এতে ফ্লাইওভার নির্মাণব্যয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করেছে বাংলাদেশ।
চলতি বছরের ১৪ জুন মুম্বাইয়ে উদ্বোধন করা হয় ১৬ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ইস্টার্ন ফ্রিওয়ে। এর নির্মাণব্যয় ১৯ কোটি ডলার বা ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ৮৮ কোটি ২১ লাখ টাকা। ভারতীয় কোম্পানি সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করে; যারা গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণে বাংলাদেশী ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারকে সহযোগিতা করছে।
আবার কলকাতায় নির্মাণাধীন ৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ পরমা-পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ৩১৭ কোটি ২০ লাখ রুপি বা ৩৯২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিম কলকাতার বাটানগরে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি ফ্লাইওভারও নির্মাণ করা হচ্ছে; যার কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণব্যয় ৪৪ কোটি টাকা।
এদিকে গত ২৪ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার উদ্বোধন করা হয়। এগুলোর কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণব্যয় ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। গত বছর উদ্বোধন করা চীনের প্রায় ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি এলিভেটেড রোড নির্মাণেও কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ৪৮ কোটি টাকা।
শ্রমিকের গড় মজুরির হিসাবেও চীন, মালয়েশিয়া ও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণব্যয় কম হওয়ার কথা। ২০১২ সালের ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন সার্ভের তথ্যমতে, মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিকদের গড় মজুরি প্রতি ঘণ্টায় ৫ ডলার, চীনে ৩ ও ভারতে ১ ডলার। আর বাংলাদেশে তা ৫০ সেন্টেরও কম। অথচ ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় কয়েক দফা বৃদ্ধির পর দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ ব্যয় আরো ৩০০ কোটি টাকা বাড়তে পারে বলে জানান প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। এতে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ২৪১ কোটি টাকা।
এ প্রকল্পের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ স্থানে রয়েছে— এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফ্লাইওভার নির্মাণে গড়ব্যয় ৮০-৯০ কোটি টাকার মধ্যেই থাকে। মজুরি কম হওয়ায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ব্যয় আরো কম। ঢাকা শহরে মাটির নিচে অপরিকল্পিতভাবে পরিষেবা সংযোগ লাইন ছড়িয়ে থাকায় এক্ষেত্রে ব্যয় কিছুটা বেশি হয়। তবে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় কোনোভাবেই ১০০ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় অস্বাভাবিক হয়ে গেছে।
বিল্ড ওন অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে নির্মিত গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের ব্যয় অনেক বেশি হলেও সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত অন্যান্য ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। এক্ষেত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ কুড়িল ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০৬ কোটি টাকা। গত ৩ আগস্ট উদ্বোধন করা ফ্লাইওভারটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৯০ কোটি টাকা।
আবার প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ ছয় লেনবিশিষ্ট বনানী ওভারপাস, ৫৬১ মিটার সংযোগ ব্রিজ ও ১ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার দীর্ঘ চার লেনের মিরপুর-বিমানবন্দর সড়ক ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত এ ফ্লাইওভারের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ১০৫ কোটি টাকা। আর রাজধানীতে চলমান ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) অধীনে নির্মিত ফ্লাইওভারটির কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৯৪ কোটি টাকা। এছাড়া ২০০৭-০৮ সালে নির্মিত প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ তেজগাঁও ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় ১০০ কোটি আর ২০০৫ সালে নির্মিত ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও ফ্লাইওভারের গড় ব্যয় ৭৬ কোটি টাকা।
অস্বাভাবিক নির্মাণব্যয় প্রসঙ্গে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আশিকুর রহমান বলেন, ‘কুড়িল ফ্লাইওভার বা মিরপুর-বিমানবন্দর সড়ক ফ্লাইওভারের চেয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার আকারে অনেক বড়। এক্ষেত্রে গড় ব্যয় দিয়ে সব বিষয় মূল্যায়ন করা যায় না। এটি একটি ভিন্নধর্মী প্রকল্প। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।’
প্রসঙ্গত. ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করছে ওরিয়ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড; যার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ডিএসসিসি। গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১০ সালের জুনে। আড়াই বছরের মধ্যে এটি শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও তিন দফা পিছিয়ে এখনো প্রকল্পটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়নি। এক্ষেত্রে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ফ্লাইওভারটির একটি অংশের উদ্বোধন করা হবে। পুরো নির্মাণকাজ শেষ করতে আরো নয় মাস সময় লাগবে।
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৫১