somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নির্মম শিকার একজন কল্পনা চাকমা

৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৮:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বুর্জোয়ারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুড়ঁছে। সেদিন আর বেশী দূরে নয় যেদিন পূঁজিবাদকে হটিয়ে দিয়ে সমাজতন্ত্র আবার বিজয় গাথা রচিত করবে। শ্রেনী বৈষম্য দূর করে সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই সোনালী দিনের প্রত্যাশায়......

ফেলে যাওয়া বাড়ি আর জোতগুলো দখল হয়ে যায়।দলে দলে আসে নতুন মানুষ।নতুন ধরনের মানুষ।ওরা একেবারে অন্যরকম।পাহাড়-জংগলের দেশে এসেছে কিন্তু পাহাড়-জংগলকে ভালোবাসে না।বন কেটে উজাড় করে ফেলে, জুমের ক্ষেতগুলো পুড়িয়ে ফেলে, উপত্যকা বিষিয়ে তোলে হানাহানির বিষবাষ্পে।পাহাড়িদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি দখল তো করেই, তার ওপর মাঝে মাঝেই হামলা করে চাকমা বসতিতে, মারমাদের ক্ষেতে।কেটে নিয়ে যায় ক্ষেতের ফসল, কেড়ে নিয়ে যায় ঘরের জিনিসপত্র।তাদের সাহায্য করে জলপাই পোষাকের রাজার সেপাই।কিছু বলতে গেলেই হাতিয়ার তুলে তেড়ে আসে।বিচার চাইতে গেলে জোটে আরো নির্যাতন।

সন্ধ্যার পর প্রায়ই দেখা যায়, পূবে-পশ্চিমে-দক্ষিণে-উত্তরে আকাশে সর্বনাশের লালচে রং।আগুনে পুড়ছে বন-টিলার ওপাশের কোন বস্তি।কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমা, দুই ভাই কালিন্দীকুমার চাকমা আর ক্ষুদিরাম চাকমা শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আগুনের সর্বনাশা আভার দিকে- ভগবান, কতদিন যে আমরা টিকতে পারব! বোধহয় চলেই যেতে হবে।

কল্পনা সক্রোধে চেঁচিয়ে উঠে- কক্ষণো না।এই মাটি আমাদের।এই মাটি ছেড়ে আমি একধাপও নড়ব না।জীবন থাকতে নড়ব না।

কিন্তু দিনের পর দিন শুধু অত্যাচার সহ্য করা! পড়ে পড়ে মার খাওয়া!

.......................................................................................................

১৯৯২ সালে ১৩ই অক্টোবর ৭০ বছরের বৃদ্ধা ভরদাসমনি, ৯৩ সালের মার্চে সাহসী তরুন নীতিশ চাকমা, ৩১শে অক্টোবর ১২ বছরে কিশোরী মিস স্বপ্না চাকমা, ৯৯ সালের ১৭ই অক্টোবর জ্ঞান আলো চাকমা, ২৬শে অক্টোবর লাল রিজফ বমসহ লংগদু, মাল্যা, লোগাং, ননিয়াচরের গণ হত্যায় হাজার হাজার নিরীহ জুম্ম নর-নারীর নামের তালিকায় ভরে ওঠে তার ডায়েরি।

কল্পনা জানতে পারে কাপ্তাই বাধের কারণে পাহাড়ীরা হারিয়েছে চুয়ান্ন হাজার একর চাষের জমি, উদ্বাস্তু হয়েছে চল্লিশ হাজার পরিবার।জানতে পারে, ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খান সরকারি সফরে চীন গেলে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্ব পান স্পীকার ফজলুল কাদের চৌধুরী।তিনি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের 'বহির্ভূত এলাকা'-র মর্যাদা তুলে দেন।এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য প্রতিবেশি জেলাগুলি থেকে সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে কয়েকহাজার অনুপজাতি পরিবার পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে লুটপাট করে উপজাতিদের জমি দখল নিয়ে উপজাতিদেরই ঘর ছাড়া করে।

কল্পমা জানতে পারে, ১৯৭২ সালে পাহাড়ী জনগনের নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং জাতির জনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে দেখা করেন।প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ত্বে ছিলেন জাতীয় সংসদের চাকমা সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।তাদের হাতে স্মারকলিপি।বংগবন্ধু জানতে চাইলেন ওতে কি লেখা আছে।স্মারকলিপিতে দাবী করা হয়েছিল নিজস্ব আইন পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্বশাসন, ১৯০০ সালের বিধিসমূহের সংরক্ষণ এবং অপাহাড়িদের অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করা।বংগবন্ধু সরাসরি দাবীগুলি প্রত্যাখান করে বলেছিলেন তাদের সবাইকে বাংগালী হয়ে যেতে।এই মিটিং স্থায়ী হয়েছিল তিন মিনিট।প্রতিনিধিদলকে বসতে বলা হয়নি।বংগবন্ধু স্মারকলিপি গ্রহন করেননি।তিনি সেটি ছুঁড়ে মেরেছিলেন মানবেন্দ্র লারমার মুখে।

১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটি গোপন বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। যে বৈঠকে হাজার হাজার গরীব বাঙ্গালীকে ব্যাপক হারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের জন্য পাঠানোর পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৯৭৯ এবং ১৯৮০ সালে একলক্ষ, ১৯৮১ সালে একলক্ষ এবং পরবর্তী বছরে আরো দুই লক্ষ বাঙ্গালীর অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়।

বৃদ্ধা বসে আছে মরা কড়ই গাছের নিচে।হাতে একটা পেতলের ঘটি।তাতে পানি।বিল থেকে ভরে এনেছে ঘটি।

কল্পনা তাকে যখন দেখতে পায়, বেলা ডোবা ডোবা।কল্পনা অবাক হয়।গুচ্ছগ্রাম ছেড়ে একাকী এই বিলের ধারে এই অসময়ে বসে আছে কেন বাংগালী বৃদ্ধা? নতুন নাকি এই এলাকায়?পরিস্থিতির কথা জানেনা? একাকী বাংগালী বৃদ্ধা যদি এখন শান্তিবাহিনীর কারো চোখে পড়ে যায়!কিংবা প্রতিশোধপরায়ন চাকমা যুবক যদি তাকে দেখতে পায়!তাহলে কি ঘটবে ভাবতে গিয়ে শিউরে ওঠে সে।দ্রুত ছুটে যায় বৃদ্ধার কাছে।ডাকে- বুড়ি মা! ও বুড়ি মা!

বৃদ্ধা নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অস্তগামী সূর্যের দিকে।ধ্যানমগ্ন সন্যাসিনী যেন।কল্পনার উপস্থিতি খেয়ালই করেনি।কল্পনার কন্ঠ তার কানে পৌঁছেছে বলে মনেই হয়না।

কল্পনা আরো এগিয়ে যায়।বৃদ্ধার একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।হাত রাখে বৃদ্ধার কাঁধে।

বৃদ্ধা একটুও চমকায় না।আস্তে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে।দৃষ্টিতে একরাশ শূন্যতা।

কল্পনার বুকটা আরো নরম হয়ে উঠে বৃদ্ধার শূন্যদৃষ্টি দেখে।মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে- একা একা এখানে বসে আছো কেন বুড়িমা? এই সময় এখানে থাকা ঠিক না।বিপদ হতে পারে।

বৃদ্ধা কথাগুলো শুনেছে কিনা বোঝা যায় না।কেননা তার কোন ভাবান্তর ঘটে না।কল্পনার সন্দেহ হয়, বৃদ্ধা বোধহয় কানে খাটো।কিংবা হয়তো পাগল।সে আবার বলে- তুমি কোথায় থাকো বুড়ি মা? এখানে একা বসে আছো কেন?

এতক্ষনে বৃ্দ্ধার চটক ভাংগে যেন।তার দৃষ্টিতে ভাষা ফিরে আসে।মৃদু কন্ঠে বলে- এমনি এমনি বসি আছি রে মা।

কল্পনা বোঝাতে চায়- কিন্তু বিপদ...

আর বিপদ!
বুড়ির কন্ঠস্বরে যে কোন পরিণতি মেনে নেবার নিস্পৃহতা।

তুমি কোথায় থাকো?

ঐ যে ছোট পাহাড়ডার ঐপারে- বুড়ি উত্তরের ছোট টিলা দেখায়- গুচ্ছিগ্রাম না কী জানি কয়।

তা এইখানে একা একা এসেছো কেন?

এই ছোট্ট এক ঘুপচি গিরামের মদ্যি থাকতি থাকতি পেরানডা হাঁপায় উঠিছিল রে মা।এইভাবে কি থাকা যায়! আত্মীয় নাই, পড়শি নাই, কুটুম নাই।মানুষি মানুষি চালাচালি নাই।আর কী একখ্যান দ্যাশ ইডা! আছে কী? না।খালি পাহাড় জংগল, মশা, মরণজ্বর।দ্যাশ আছিল আমাগের।

উম্মা প্রকাশ পায় কল্পনার কন্ঠে- এসেছো কেন তাহলে আমাদের দেশে?

কল্পনার উম্মা বুড়িকে স্পর্শই করেনা।সে আবার চলে গেছে ঘোরের মধ্যে-দ্যাশ আছিল আমাগের! ঘরে ঘরে সব মানুষ সবায়ের কুটুম। দিনমান কাম করি মরদরা যায় হাটে-বাজারে আড্ডা দিতি আর মাগি মানুষিরা বসে উঠোন জুরে গপ্পো করতি, উকুন বাছতি, চুলে ত্যাল লাগাতি।কত শাস্তর-বিস্তর, হাসি-আহ্লাদ।কী জীবনডা আছিল!

.......................................................................................................

আমি কি আসতে চাইছি? সোয়ামি মরিছে, ছাওয়াল আমাক খাওয়া-পড়ায়।সেই ছাওয়াল আসতি চাইলে আমি আর কোন ঠাঁয়ে যাবে?
কল্পনা একথার উত্তরে কী বলবে ভেবে পায়না।বুড়ি নিজের মনেই বকবক করে- ছাওয়াল কি আর এমনি এমনি আইছে।গবমেন্টের সেপাইরা বলিছিলি থাকার বাড়ি পাবা, দশ বিঘে জমি পাবা, হালের লাংগল-বলদ পাবা, দিনে বারো সের গম পাবা।তখনই না লোভে পড়লি ছাওয়াল আমার।

............... আমরা কারো জমি-ভিটে দখল করতে চাইনি।আমরা শুনিছি এই দ্যাশে জমি অঢেল।চাষ করার মানুষ নাই।নিজের দ্যাশে তো আমাদের আধপেটা খাওয়া।নিজেদের জমি নাই, কামলা-মজুর দিয়ি খাওয়া।তখন এতো লোভ দেখালি কে আর না আসে তুই ক দিনি! কিন্তু এসে দেখি সব ফক্কা।গুচ্ছিগিরাম তো না, জেলখানা।

তাহলে ফিরে যাওনা কেন নিজেদের দেশে।

সিখানে ফিরার তো কোন উপায় নাইরে মা।ভিটে-মাটি সব বিক্রি করে চলি আইছি।ছাওয়াল কয়, আর ফিরার উপায় নাই।মরতি হলিও এই জাগাত দাঁত কামড়ে পড়ি থাকতি হবি।

এই প্রথম অন্য এক বাস্তবতা উন্মোচিত হয় কল্পনার সামনে।এই মানুষগুলোও প্রতারিত।রাজার লোকেরা জঘন্য প্রতারণা করেছে এদের সাথেও।এদের ফেরারও পথ নাই।তাই এখানে টিকে থাকার জন্য এতটা হিংস্র হয়ে উঠেছে সবাই।
.......................................................................................................

বুড়ি মাথা নাড়ে- পাহাড়ের মানুষ আমাগের সাথে কথা বলতি চায়না।ঘিন্না করে আমাগের।কিন্তুক আমাদের দোষডা কী কও দিনি।আমাগের বললি যে ঘর পাওয়া যাবি, রোজ বারো সের গম, চষার জন্য অঢেল জমি পড়ি রইছে।................



===========================
বিঃদ্রঃ লেখাটি আমার নয়। ব্লগ থেকে সংগৃহীত। ভালো লাগছে বলে সংগ্রহে রেখেছিলাম।এখন শেয়ার করলাম। মূল লেখকের নাম মনে পড়ছেনা বলে ক্ষমাপ্রার্থী।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×