১৯৬৯ সালের আজকের দিনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে মিথ্যা এবং প্রতিহিংসা আখ্যা দিয়ে এই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আয়োজিত সহিংস মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যায় আসাদ। সেই মামলার আদ্যোপান্ত-
...এক:
ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা (রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তার বিশ্বাস ছিল শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি সে সময়ে গেপনে গঠিত বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সম্মতি দিয়েছিলেন। বিপ্লবী পরিষদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডাে স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাদের বন্দি করবে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবে। পরিকল্পনাটির ব্যাপারে একবার শেখ মুজিব ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় গিয়েছিলেন। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই তা ফাঁস হয়ে যায়। এরপর পাকিস্তান সরকার ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা( রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য) দায়ের করে। শাসকগােষ্ঠী এটিকে ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে আখ্যায়িত করে। এ মামলায় রাজনীতিবিদ, বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা, সামরিক ও প্রাক্তন সামরিক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য বেসামরিক ব্যক্তিবর্ণসহ মােট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় এক নম্বর আসামি। তাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দন্ডবিধির ১২১ ও ১৩১ ধারায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে সশস্ত্র পন্থায় স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করার অভিযােগ আনা হয়। বিচারের উদ্দেশ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ১৯৬৮ সালের ১৯শে জুন এ মামলার শুনানি শুরু হয়।
মামলা শুরু হওয়ার পর তা প্রত্যাহারের জন্য আন্দোলন শুরু হয়। ছাত্র সমাজের ১১ দফার ভিত্তিতে কৃষক-শ্রমিক- ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে। ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনের ফলে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়, তারই ধরাবাহিকতায় ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা' বাঙালিদের স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করতে অনুপ্রেণা জোগায়।
— বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, নবম-দশম শ্রেণী, পৃঃ- ১০
দুই-
...জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যাঁরা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, “ষড়যন্ত্র” শব্দটি তাঁদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাদের বন্দী করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করব।’
— কর্নেল শওকত আলী, সত্য মামলা আগরতলা, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন। ২০১১। পৃঃ ভূমিকা অংশ
তিনঃ
....‘আগরতলা মামলা ষড়যন্ত্র ছিল না, এটা ছিল সত্য। মামলাটি ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য। এই অন্যান্যদের মধ্যে আমরা ৩৪ জন ছিলাম। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন আমাদের ট্রাইব্যুনালের সামনে হাজির করা হয়। সে সময় পাকিস্তানের ওই বিশেষ আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। অভিযোগে বলা হয়, আপনারা পাকিস্তানের পূর্বভাগ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথক করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এই অভিযোগটি সত্য ছিল। ‘
এ সময় অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যরা স্পিকারের এই বক্তব্য টেবিল চাপড়িয়ে স্বাগত জানান।
— ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী, জাতীয় সংসদের বক্তব্য। বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১১।
শেখ মুজিবুর রহমান উনার ডায়েরিতে লিখেছেন,
-------------------------------------------------
একঃ
...ভাবতে লাগলাম রাজনীতি এত জঘন্য হতে পারে। ক্ষমতার জন্য মানুষ যে কোনাে কাজ করতে পারে। আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে কারাে বিবেকে দংশন করল না। আমি তাে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি। যাহা ভাল বুঝেছি তাই বলেছি । বক্তৃতা করে বেড়াইয়াছি, গােপন কিছুই করি না বা জানি না। সত্য কথা সােজাভাবে বলেছি তাই সােজাসুজি জেলে চলে গিয়াছি । কাহাকে ভয় করে মনের কথা চাপা রাখি নাই। যে পথে দেশের মঙ্গল হবে, যে পথে মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহাই করেছি ও বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যাতে তার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে তার জন্য আন্দোলন করেছি। বার বার জেলে যেতে হয়েছে আর মামলার আসামী হতে হয়েছে। কিন্তু মনের কথা চাপা রাখি নাই । জেলে যেতে হবে জেনেও ছয় দফা জনগণের কাছে পেশ করেছিলাম। যদিও জানা ছিল শাসক ও শােষকগােষ্ঠীর আঁতে ঘা লাগে। ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ও আমার সহকর্মীদের উপর। অত্যাচার চরম হবে, তবুও গােপন করি নাই। আজ দুঃখের সাথে ভাবছি আমাকে গােপন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে শাসকদের একটু বাঁধলাে না? এরা তা আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভাল করে জানে। ভাবা ও চিন্তা করা ছাড়া কোনাে কাজই যখন নাই যখন মনকে বললাম, 'ডাবাে যত পারাে, কিন্তু পাগল করাে না। জীবনের বহু কথা মনে পড়তে লাগলো। খাতা কাগজ নাই যে কিছু লেখব। কলম আছে। কাগজ ও খাতা পাওয়ার কোনাে উপায়ও নাই, আর অনুমতিও নাই।
— শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি। মার্চ, ২০১৭। পৃঃ ২৫৮-৯
দুই-
...পরের দিন সকাল ১০ টায় মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর মেসে বসে ডিউটি অফিসার লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফরকে খবর দিলেন আমাকে মেসে নিয়ে যেতে। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। সূর্যের আলাে তাে গায়ে লাগে নাই এই কয়দিন, তাই বের হয়ে গেলাম। এক মিনিটের বেশি সময় লাগলাে না পৌছতে। রিজভী সাহেবের নাম আমি শুনেছি, কিন্তু আলাপ ছিল না। যথারীতি আলাপ পরিচয় হওয়ার পরে আমাকে নিয়ে রৌদ্রে বসলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে? আপনারা তো আমার সম্বন্ধে জানেন। আমি তাে গােপন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। যাহা ভাল বুঝেছি তাহাই করেছি। স্বায়ত্তশাসনের দাবী তা ১৯৪৯ সাল থেকে আমি করতে শুরু করেছি। পার্লামেন্টে প্রাদেশিক আইন সভার বাইরে ও ভিতরে আমি প্রচার করি । তারপর ছয়দফা প্রােগ্রাম দিয়েছি ১৯৬৬ সালে। বই ছাপাইয়াছি, বক্তৃতা করেছি। আপনারা আমাকে ও আমার সহকর্মীদের দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে রেখে কতকগুলি মামলাও দায়ের করেছেন। আমি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করি নাই । দুই অঞ্চলকে আলাদা করতেও চাই নাই। কারণ সংখ্যাগুরু অঞ্চল সংখ্যালঘুদের ভয়ে আলাদা হতে পারে না। আর এমন কোনো নজির ইতিহাসে নাই।
আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে আপনারা রাজনীতি করতে দিবেন না। ঠিক আছে আপনারা আমার একটা চিঠি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবের কাছে পৌছাইয়া দিতে রাজি আছেন কিনা? কারণ যতদূর আমার জানা আছে তিনি অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতী নন। তাহারা বললেন, আমরা কি করব যদি অন্যান্য আসামিরা আপনার নাম বলে। আপনাকে এই মামলায় জড়িত আমরা করি নাই। অনেকেই আপনার নাম বলেছে। আপনি তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন এবং অন্যকে দিতে বলেছেন। আমি বললাম, যা হবার হবে, তবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে আমার পত্রটা পৌছাইয়া দেন। কারণ পাকিস্তান দুই ভাগ হয়ে যাক আমি চাই নাই । যদি চাইতাম তবে প্রকাশ্যে বলতাম। তিনি ইচ্ছা করলে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, কারণ আজ ২১ মাস আমি জেলে বন্দি। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছাড়া কারও সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না। তাহারা বললেন, চিঠি আমরা নিতে পারব না। তবে যদি টেপরেকর্ডে আপনি কিছু বলতে চান বলে দিবেন-আমার কাছে শুনাবাে।
রিজভী সাহেবকে আমার বাড়িতে খবর দিতে অনুরােধ করলাম যে আমি ভাল আছি এবং এখনও বেঁচে আছি। ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বই দিতে অনুরোধ করলে তিনি ডিউটি অফিসারকে আমাকে বই পড়তে দিতে অনুমতি দিলেন, আর সন্ধ্যার পরে এক ঘণ্টা বাইরে বেড়াবার হুকুম দিলেন। রিজভী সাহেব বললেন, "আপনার বাড়িতে আমি নিজেই যাবো এবং আপনার স্ত্রীকে বলে আসবাে যে, আপনি ভাল আছেন। অসুবিধা নাই।” বললাম, “মেহেরবানি করে এই কাজটা করলে বাধিত হব।" খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হবে না, কারণ আইনে নাই। তাহারা চলে গেলেন, আমিও কামরায় এসে ভাবতে বসলাম মানুষ স্বার্থের জন্য কিই না করতে পারে! শুনেছিলাম ভালবাসা ও রাজনীতিতে ভাল মন্দ বলে কোনাে জিনিস নাই। আমি বিগ্রেডিয়ার আকবরকে বলেছিলাম, মনে রাখবেন এদেশের লােক বিশ্বাস করবে না আর করতে পারে না যে আমি ষড়ন্ত্র করতে পারি। আমার চরিত্র সম্বন্ধে তাদের ধারণা আছে। আমাকে জড়িত করে দেশের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই করলেন। দরজা বন্ধ। ঘরের মধ্যে বসে মনে মনে ভাবলাম, রাজনীতি জঘন্য রূপ ধরেছে। এর আর শেষ নাই। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে যে কোনাে পন্থায় শেষ করার পথ অবলম্বন করেছে। লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদকে হুকুম দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার আকবর আমাকে বই দিতে। তিনি আমাকে একটা বই এনে দিলেন।
— শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি। মার্চ, ২০১৭। পৃঃ ২৬০-৬১
তিনঃ
...আমাকে মিথ্যা মামলায় আসামী করে দেশের মঙ্গল হবে না। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের কেহ বিশ্বাস করবে না। জনগণ বলবে, আমাকে অত্যাচার করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে । ৬দফা প্রস্তাব জনগণের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। ১২টা মামলাও দায়ের করেছে। আমার সহকর্মী খােন্দকার মােশতাক, তাজউদ্দীন, আব্দুল মােমিন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম, আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
— শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি। মার্চ, ২০১৭। পৃঃ ২৬৩
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ২:১৮