এক-
...আমি আর দাউদ কামরায় বসে রইলাম। রাষ্ট্রপতি টেলিফোনে তথ্যমন্ত্রীকে চাইলেন। সংযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, 'হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান এ্যাবাউট মিঃ মূসা' উত্তরে কী জানলেন আমি জানিনা, তবে মুখ খানি কঠোর করে কিছুক্ষণ শুনলেন, তারপর 'আচ্ছা' বলে টেলিফোন রেখে দিলেন। আমাকে বল্লেন, 'একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে, ঠিক করে দেব।' আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিলেন, দাউদকে থেকে যেতে বল্লেন।
সমস্যাটি কি পরে দাউদের মুখে শুনেছিলাম। সমাধানটি রাষ্ট্রপতি কীভাবে করেছিলেন তাও জেনেছি। আমার প্রেস ইনস্টিটিউটে নিয়োগের ব্যাপারে সামরিক ও বেসমরিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আপত্তি এসেছিল। আমাকে বিদায় দিয়েই টেলিফোন করলেন ডিএফআই প্রধান জেনারেল মহব্বত জান চৌধুরীকে। জেনারেল চৌধুরী রাষ্ট্রপতিকে জানালেন, 'মূসা সাহেব আওয়ামীপন্থী, সুতরাং তাঁকে সরকারি কোন পদে নিয়োগ দেয়া যাবেনা।' রাষ্ট্রপতি গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, ' তা আমি জানি। তিনি প্রেস ইনস্টিটিউটের ডিজি হওয়ার উপযুক্ত কিনা, সাংবাদিকদের শেখানোর বিদ্যা আছে কিনা, সেটা বলুন।' তারপর নাকি বলেছেন, 'তাকে রাষ্ট্রপতি ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার পরে আপনাদের রিপোর্ট ইজ ইউজলেস'। এই কথাবার্তার বিষয়বস্তু পরবর্তীতে মহব্বত জান চৌধুরীর ছোটভাই সরওয়ার জান চৌধুরীও আমাকে জানিয়েছিলেন। দু'দিন পরে হুদা ভাইয়ের ফোন পেলাম, 'মূসা, তুই কোথায়? এদিকে বঙ্গভবনের টেলিফোনে আমার প্রাণ অতিষ্ঠ।' যথা সময়ে ডিজি পিআইবি পদে যোগ দিলাম।
অতঃপর জিয়া চরিত্রের কোন বিশেষ দিক নিয়ে বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে আমার ব্যক্তিগত কাহিনীটি থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনায় যে প্রশাসনিক দক্ষতার কথা বলা হয় তার ভিত্তি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে বোঝা গেছে তাঁর প্রশাসনে দলীয়করণ, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ এবং রাজনৈতিক সংকীর্নতার কোন স্থান ছিল না। প্রশাসনিক বা নীতিটি অনুসরন না করার কারণেই পরবর্তীতে কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন॥"
- এ বি এম মূসা, জিয়ার দর্শন ও বাংলাদেশ(প্রবন্ধ সংগ্রহ), পৃঃ ২৫
দুই-
...পরদিন বিকেলবেলা অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। চট্রগ্রাম রেডিও স্টেশন থেকে মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন বলল, বঙ্গবন্ধু ভাল আছেন। তাকে নেতা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করা হয়েছে। শোনামাত্র সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মেজর জিয়াউর রহমান নামের মানুষটার জন্য গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠলো।
- মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল, আমার বন্ধু রাশেদ, পৃঃ ১৭২
তিন-
...২৭ মার্চ শনিবার রাত ৮ টায় রেডিওর নব ঘুরাতে ঘুরাতে এই দেশের বেশ কিছু মানুষ অদ্ভুত একটা ঘোষণা শুনতে পায়। মেজর জিয়া নামের কেউ একজন নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা দিয়ে বলেন , 'আমি বাংলেদেশর স্বাধীনতা ঘোষণা করছি' । তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধের ডাক দেন। দেশের মানুষের ভেতর দিয়ে তীব্র ভোল্টেজের বিদ্যুতের শক প্রবাহিত হয়। তাদের নেতিয়ে পড়া মেরুদণ্ড একটি ঘোষণায় ঋজু হয়ে যায়। একটা অচেনা অজানা কণ্ঠস্বর এতটা উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারে ভাবাই যায় না"।
- হুমায়ূন আহমেদ, জোছনা ও জননীর গল্প, পৃঃ ১৮৩
চার-
"...প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্পর্কে মাওলানা ভাসানী কে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ হুজুর, আপনাকে তো সব সময়ই সরকার বিরোধী ভূমিকায় দেখা যায়, এমনকি যখন আপনার নিজের দল মন্ত্রী সভা গঠন করেছেন তখনও আপনি একই জনসভায় দাঁড়িয়ে আপনার পাশে বসা মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বক্তব্য দিয়েছেন, অথচ দেখা যায় আপনি জিয়াউর রহমানের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল । জিয়াউর রহমানের প্রতি আপনার এই দুর্বলতার কারণ কি ?
মাওলানা ভাসানী জবাবে বলেছিলেন: দেখ তোমরা তো রাজনীতি দেখছো বহুদিন ধরে, আমার রাজনৈতিক জীবন ও অনেক দিনের। আমার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এদেশে এমন একটা লোক তো কখনো ও দেখলাম না যে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে নিজেকে দূর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে রাখতে পেরেছে । আমাকে একটা উদাহরণ দেখাও"।
-অধ্যাপক আবদুল গফুর (ভাষা সৈনিক), প্রবন্ধ
পাঁচ-
...তিনি ছিলেন জনগণের হৃদয়ের মানুষ। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ। সামরিক শৃঙ্খলাকে, সামরিক আবেগকে তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়ে আসেন। তার দূরদৃষ্টিমূলক, রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রথম পা রাখে; বাংলাদেশ পৃথিবীর জাতিগুলোর মিলনমেলায় নিজের নাম উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত করে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলো, তাৎক্ষণিক প্রতিবেশী অমুসলমান দেশগুলো এবং বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানকারী পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সাথে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। উভয় পক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ওই যুদ্ধ নিরসনের লক্ষ্যে যেই তিন সদস্যের তথা তিনজন রাষ্ট্রপ্রধানের কমিটি করা হয়েছিল, সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সর্বোপরি উদীয়মান সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমান।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক বিরোধীরা তার সমালোচনা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বিনাদ্বিধায় বলবেন, জিয়াউর রহমান সমন্বয়ের রাজনীতি, সহনশীলতার রাজনীতি, সমঝোতার রাজনীতি ও বহুদলীয় রাজনৈতিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। গবেষকেরা স্বীকার করেন, তিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তৃণমূল মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বাস করতেন, কঠোর শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করতেন এবং নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধে রাখায় বিশ্বাস করতেন। তিনি তরুণ ও মেধাবীদের রাজনীতিতে আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সব কিছু মিলিয়ে তিনি সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছিলেন। তিনি বন্দুকের যোদ্ধা থেকে কোদালের কর্মী হয়ে দেশ গড়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন।
-মেজর জেনারেল অবঃ সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম (বীর প্রতীক) ৩০ মে ২০১৮, দৈনিক নয়া দিগন্ত
ছয়-
১৯৭৭ সালে কিং খালেদ বিন আব্দুল আজীজের আমন্ত্রণে সৌদি আরব যান জিয়াউর রহমান এবং উপহার হিসেবে সাথে নিয়ে যান দশ হাজার নিম গাছের চারা। বাদশাহকে উপহার দেয়ার সময় বলেন- “ গরিব মানুষের দেশের গরিব রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে আপনার জন্য এই সামান্য উপহার।”
বাদশাহ্ বহু দেশ থেকে বহু মূল্যবান উপহার পেয়েছেন; কিন্তু এই অদ্ভুত উপহার আগে তিনি পাননি। এই গাছ উষর মরুতে ছায়া দেবে শুনে তিনি বলেন অবাক হয়ে যান এবং বলেন, আজ থেকে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ পরস্পর অকৃতিম বন্ধু। তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে চান। এ সময় জিয়াউর রহমান বলেন, আমাদের দেশের মানুষ গরিব, কিন্তু তারা পরিশ্রম করতে জানে। আপনার দেশের উন্নয়ন কাজের জন্য হাজার হাজার শ্রমিক দরকার। একটি নব্য স্বাধীন মুসলিম দেশের জন্য যদি আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চান, তবে আমার দেশের বেকার মানুষদের কাজ দিন। বাদশাহ তক্ষনাৎ রাজি হলেন। শুরু হল আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি। তখন থেকে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ সৌদি আরব গিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদল সহ স্বাবলম্বী হয়ে ফিরেছেন বাংলাদেশে
জিয়াউর রহমানের দেয়া সেই নিমের চারাগুলো আজ ছড়িয়ে পড়েছে সাড়া সৌদি জুড়ে। আরাফাতের ময়দানে সবুজ শীতল ছায়া দিয়ে চলেছে লক্ষ নিম গাছ। সউদি আরবের মানুষ প্রেসিডেন্ট জিয়াকে স্মরণ করে নিম গাছকে বলে "জিয়া সাজারাহ" বা জিয়া গাছ।
-দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ আগস্ট ২০১৭
সাত-
"রাষ্ট্রপতিকে কখন হত্যা করা হলো? ১৯৮০-তে নয়, ১৯৮১ সালের মে মাসে। যখন রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, যখন রাষ্ট্রপতি দৃঢ় প্রত্যয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেন, যখন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা বলতে চাইলেন, দক্ষিণ এশিয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গেলেন, সিরিয়ায় গেলেন যখন, আর সেই মুহূর্তে তার ওপর আঘাত এলো। সুতরাং আজকে নতুনভাবে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে, এই আক্রমণ কিসের আক্রমণ? কারা এই আক্রমণ করেছে? তাদের উদ্দেশ্য কী? তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক, দেশের কোনো মঙ্গল কামনা নয়, মানুষের মঙ্গল কামনা নয়, একটা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই এই হত্যা। হত্যা করা হয়েছিল একটা স্টাবলিশমেন্টকে নষ্ট করার জন্য, স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার জন্য। স্থিতিশীলতা নষ্ট করে কারা লাভবান হয় — লাভবান হয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, লাভবান হয় সাম্প্রদায়িক শক্তি, লাভবান হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলার জনগণ, দুঃখী মানুষরা, দেশের আপামর জনগণ।"
- সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ৩ জুন, ১৯৮১ তে সংসদে শোক প্রস্তাবের ভাষণে
আট-
...শুক্রবার ভোরে প্রেসিডেন্ট জিয়া নাস্তা খাচ্ছিলেন। আয়োজন সামান্য। চারটা লাল আটার রুটি। দুই পিস বেগুন ভাজি। একটা ডিম সিদ্ধ। জিয়ার সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসেছেন তার বন্ধু ও সহযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুর। জেনারেল মঞ্জুর বিস্মিত হয়ে বললেন, এই আপনার নাশতা ? প্রেসিডেন্ট বললেন, হতদরিদ্র একটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নাশতা কি যথেষ্ট না ?
...জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছরের শাসনে প্রতি মাঘের শেষে বর্ষন হয়েছিল কিনা তা কেউ হিসাব রাখেনি ,তবে এই পাঁচ বছরে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি । অতি বর্ষনের বন্যা না , খরা না , জলোচ্ছাস না । দেশে কাপড়ের অভাব কিছুটা দূর হলো । দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া হলো না। বাংলাদেশের নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়তে লাগলো। বাংলাদেশের মানুষ মনে করতে লাগলো অনেক দিন পর তারা এমন এক রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছে যিনি সৎ। নিজের জন্য বা নিজের আত্নীয়স্বজনের জন্য টাকা পয়সা লুটপাটের চিন্তা তার মাথায় নেই। বরং তার মাথায় আছে দেশের জন্য চিন্তা । তিনি খাল কেটে দেশ বদলাতে চান। জিয়া মানুষটা সৎ ছিলেন , এতে কোনো সন্দেহ নেই। লোক দেখানো সৎ না , আসলেই সৎ। তার মৃত্যুর পর দেখা গেল জিয়া পরিবারের কোনো সঞ্চয় নেই।
- হুমায়ূন আহমেদ, দেয়াল, পৃঃ ১৮৯, ১৯৩
আজ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জন্মদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ৮:২০