একজন সুখী রাজপুত্তুরের গল্প (The Happy Prince)
মূল: অস্কার ওয়াইল্ড
অনুবাদ: সামিও শীশ
(অস্কার ওয়াইল্ডে ইচ্ছা ছিল শিশু-কিশোরেরা যেন এ গল্পটি পড়ে)
শহরটির মাঝে উঁচু যে মূর্তিটি দেখা যাচ্ছে সে মূর্তিটি হচ্ছে একজন সুখী রাজপুত্তুরের। মূর্তিটি সোনার হালকা প্রলেপ দিয়ে ঢাকা। সুখী রাজপুত্তুরের মূর্তির চোখ দুটিতে নীলাকান্ত মণি বসানো, সেই চোখ দু’টি জ্বলজ্বল করছে। তার এক হাতে তলোয়ার ধরা, তলোয়ার ধরা মুষ্টি থেকে লাল রুবি রতেœর দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
মূর্তিটি সুন্দর নিঃসন্দেহে। শহরের কাউন্সিলররা চান যে নগরবাসীরা তাদের রুচি আর শিল্পবোধের প্রশংসা করুক। তারা বলেন যে মূর্তিটি বায়ু ঘড়ির মতো সুন্দর যদিও বায়ুঘড়ির মতো এর ব্যবহারিক দিকটি নেই। কাউন্সিলররা খুব সচেতন যেন তাদের রুচি নিয়ে কোন সন্দেহ না করেন।
রাতে যখন কোনো বাচ্চা আকাশের চাঁদ ধরার জন্য জেদ করে তখন তার মা একটু ধমকে বলেন, “তুই সুখী রাজপুত্তুরের মতো হতে পারিস না? লক্ষ্মী রাজপুত্তুরতো কখনও কোনো কিছুর জন্য কাঁদে না। তুই কেন খালি কান্নাকাটি করিস?”
জীবনের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত কোনো লোকও মূর্তিটির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,“ যাক অন্ততঃ দুনিয়াতে একজন মানুষ আছে যে পুরা সুখী।”
চার্চ বেরুনো পরিষ্কার ঝক্ঝক্ েপোশাক পরা শিশু-কিশোরেরা মূর্তিটিকে দেখে বলে, “আহা! মনে হয় যেন সত্যিকারের এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে আছে।”
একথা শুনে রসকষহীন গণিতের শিক বলেন,“তোমরা কি কখনও ফেরেশতা দেখেছো? না দেখে কী করে এমন কথা বলো?”
শিশুরাও চটপটে উত্তর দেয়,“দেখেছি তো। স্বপ্নে দেখেছি।”
অতি যুক্তিবাদী গণিতের শিক ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করে। তিনি স্বপ্নের বিষয়টি মানতে পারেন না।
একরাতে একটি ছোট পাখিছানা এ শহরে উড়ে আসে। তার বন্ধুরা ছয় সপ্তাহ আগে মিশরে চলে গেলেও সে যায় নি। থেকে যাবার কারণ গত বসন্তে সে যখন উড়ে এসে নদীর ধারে বসে তখন হালকা পাতলা গড়নের চিকন কোমরের একটি নলখাগড়াটিকে দেখে। প্রথম দেখাতেই প্রেম।
পাখিছানার প্রেমের প্রস্তাবে নলখাগড়াটি ঈষৎ ঝুঁকে সম্মতি দেয়। পাখিছানাটি নলখাগড়ার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, পানিতে ডানা ঝাপটায়, নদীতে রূপালি মৃদু তরঙ্গ ওঠে। এই ছিল পাখিটির প্রেমের পূর্বরাগ, পুরো গরমকাল জুড়েই এই চলেছে।
অন্যান্য পাখিরা অবাক হয়, নিজেদের মাঝে কিচির মিচির করে বলে,“এটা একটা বিদঘুটে সম্পর্ক। নলখাগড়াটির তো কোনো টাকা পয়সা নাই, আর কতজনের সাথে যে তার সম্পর্ক আছে কে জনো?” একথা সত্যিই যে নদীতে অসংখ্য নলখাগড়া আছে। পরে, যখন শরৎকাল আসে তখন পাখিরা সবাই উড়ে যায়।
আর সব পাখিরা চলে যাবার পর পাখিছানা একা বোধ করে, সেই সাথে তার প্রেমেও কান্তি আসে। পাখিছানা ভাবে,“ সে এখন আর আমার সাথে কথা বলে না। সে কি ছলনাময়ী? সে এখন বাতাসের সাথে ছলাকলা খেলছে। যখন বায়ু বয়, তখন তার নাচানাচি বেড়ে যায়। ” আরও ভাবে,“ সে তো গৃহী আর আমি উড়ে উড়ে বেড়াই। আমার বউকেও তো আমার সাথে উড়ে বেড়াতে হবে।”
শেষ পর্যন্ত পাখিছানা নলখাগড়াটিকে বলেই ফেলে, “তুমি আমার সাথে যাবে কিনা বল?” কিন্তু নলখাগড়া মাথা নেড়ে না জানিয়ে দেয়, তার জীবন তার ঘরের সাথে নিবিড়ভাবে বাঁধা।
পাখিছানা রেগে বলে,“ আমার কাছে তোমার আর কোনো দামই সেই। আমি পিরামিডের দেশে চললাম। বিদায়।” সে উড়ে যায়।
সারাদিন সে উড়ে, রাতে শহরটিতে পৌঁছে। নিজে নিজে বলে,“আমি কোথায় থাকব? শহরে নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা আছে।”
পাখিছানাটি লম্বা মূর্তিটা দেখে। দেখে যে থাকার জন্যে এটি উত্তম জায়গা। জায়গাটি দিয়ে তাজা বাতাস বয়ে যায়। সে সুখী রাজপুত্তুরের পায়ের কাছে বসে পড়ে।
পাখিছানাটি বলে, “আমার আছে সোনার পালঙ্ক।” সে ঘুমুবার প্রস্তুতি নেয়। যেই সে ঘুমানোর জন্যে মাথা রেখেছে ওমনি এক ফোটা পানি তার মুখে পড়ে। সে অবাক হয়ে বলে, “আজব। এক ফোটা মেঘও নাই আকাশে, তারাগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এর মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। উত্তর ইউরোপের আবহাওয়া আসলেই বিদঘুটে। নলখাড়গাটি বৃষ্টি পছন্দ করত, কিন্তু সেটা নিছকই নিজের স্বার্থে।”
আরেকটি ফোটা পড়ল।
“বৃষ্টিতেই যদি ভিজতেই হয় তাহলে আর এই বিশাল মূর্তির নিচে বসে থাকা কেন? বরং খুঁজে দেখি কোথাও একটা চিমনি পাওয়া যায় কি না?” সে উড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পাখিছানাটি যেই ডানা মেলতে যাবে ওমনি আরেকটি ফোটা পানি পড়ল। পাখিছানা উপরের দিকে তাকায়। তাকিয়ে যা দেখল তা বিশ্বাস করা শক্ত। দেখে যে সুখী রাজপুত্তুরের চোখ দু’টি অশ্র“ভরা, তার সোনালি গাল বেয়ে পানি পড়ছে। জ্যোৎস্নার আলোতে মূর্তিটিকে খুব সুন্দর আর স্নিগ্ধ লাগে। পাখিছানার মায়া লাগছে।
“তুমি কে?” পাখিছানা জিজ্ঞেস করে.
“আমি সুখী রাজপুত্তুর।”
“সুখী রাজপুত্তুর হলে আবার কাঁদ কেন? কাঁদতে কাঁদতে তো আমাকে একেবারে ভাসিয়ে দিয়েছ।”
মূর্তিটি বলে ওঠে,“ যখন আমি জীবিত ছিলাম তখন কান্না কাকে বলে আমি জানতাম না। আমি রাজপ্রাসাদে থাকতাম, রাজপ্রাসাদের ভিতর কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই। সারাটা দিন আমার বন্ধুদের সাথে খেলে কাটাতাম। সন্ধ্যার পর হতো নাচের আসর। আমাদের প্রাসাদের বাগান ঘিরে ছিল উঁচু দেয়াল। দেয়ালের আরেকপাশে কী আছে তা দেখার কথা কখনও মাথায় আসে নি। আমার চারপাশটা ছিল সুন্দর, গোছালো, ছিমছাম, টিপটপ।
সবাই আমাকে বলত সুখী রাজপুত্র। হ্যাঁ, সুখীইতো ছিলাম। বিলাস করাকে যদি সুখ বলা যায়, তবে হ্যাঁ,আমি সুখীই ছিলাম। এই সুখেই দিন কাটালাম। সুখ নিয়েই মারা গেলাম।
মরার পর এখন যখন এই উঁচু খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই শহরের মানুষের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন দেখি তখন আমার মনটা কষ্টে ভরে যায়। আমি কাঁদতে থাকি।”
পাখিছানা ঠিক ভেবে পায় না একেবারে খাঁটি সোনা দিয়ে তৈরী হওয়ার পরও কী করে কারও কোনো দুঃখ থাকতে পারে। যদিও কথাটি মুখ ফুটে বলতে পারে না।
মূর্তিটি মৃদু স্বরে, ধীরে ধীরে বলে যায়,“ঐ দূরে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরের একটি জানালা খোলা। আমি দেখতে পাচ্ছি ঘরের ভিতরে একজন রোগা কান্ত মহিলা বসে আছে। তার হাতে সুঁই-সুতা, সে সেলাইয়ের কাজ করছে। সে পোশাকে নকশা করছে, এই পোশাক পরে কেউ রাজবাড়িতে নাচের আসরে যাবে। আর তার ঘরের কোণাতে এক ছোট্ট বাচ্চা শুয়ে আছে, বাচ্চাটা অসুস্থ। বাচ্চাটা কমলা খাবার আবদার করছে। কিন্তু তার মা তাকে নদীর পানি ছাড়া কিছু খেতে দিতে পারছে না। বাচ্চাটা কেঁদে যাচ্ছে। আর আমি এখানে আটকে আছি, কোনো চলা ফেরা করতে পারি না। বাচ্চাটার কাছে যেতে পারছি না।
পাখিছানা শোন, আমার একটা কাজ করে দাও। আমার তলোয়ারের মুষ্টিতে যে রুবি পাথরটা আছে তা নিয়ে ওদের কাছে দিয়ে এস।”
“কিন্তু আমাকে তো মিশরে যেতে হবে। সেখানে আমার বন্ধুরা যাবে, নীল নদের ধারে বসবে, ফুলের সাথে কথা বলবে। তারপর রাজার কবরে গিয়ে ঘুমাবে। মমি রাজা হলুদ চাদরে ঢাকা। তার গলায় সবুজ গয়না। হাতগুলো ঝরা শুকনো পাতার মতো ।”
“পাখিছানা, পাখিছানা, তুমি কি আজ রাতটা আমার সাথে থাকতে পারবে না? তুমি আমার দূত হয়ে বাচ্চা আর বাচ্চার মায়ের কাছে যাবে। জানো, বাচ্চাটি খুবই ুধার্ত আর তার মা কেমন মন খারাপ করে বসে আছে।”
“ছোট বাচ্চাদের আমি পছন্দ করি না। জানো, গত গরমের সময় আমি নদীর ধারে বসেছি ওমনি দুইটা দুষ্টু বাচ্চা দৌঁড়ে এসে আমার দিকে পাথর ছুঁড়ে মারে। আমাকে লাগাতে পারে নাই অবশ্য, আমরা পাখিরা ঠিকই উড়ে নিজেদের বাঁচাতে পারি। কিন্তু আমি এখনও বাচ্চাদের ওপর রেগে আছি।”
তারপরও সুখী রাজপুত্তুরের দুঃখী মুখ দেখে পাখিছানা চলে যেতে পারল না। পাখিছানা বলে,“ যদিও এখানে ঠাণ্ডা, তারপরও আজকে রাতটা আমি তোমার সাথে থাকব, তোমার দূতের কাজ করে দেব।
“আমি খুবই খুশী হলাম,” রাজপুত্তুর পাখিছানাকে বলে।
পাখিছানা লাল রুবি পাথরটা নিয়ে শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। পাখিছানা শুভ্র মূর্তি দিয়ে ঘেরা চার্চের ওপর দিয়ে উড়ে রাজপ্রাসাদ পেরুবার সময় শুনতে পায় রাজপ্রাসাদের ভিতর থেকে নাচ গানের সুমধুর সুর ভেসে আসছে। সেখানে একজন প্রেমিক তার সুন্দরী প্রেয়সীকে বলছে, “আকাশের তারাগুলো কী সুন্দর, ঠিক আমাদের ভালবাসার মতো।” জবাবে সুন্দরী মেয়েটি বলে, “আমি চিন্তায় আছি সময় মতো কালকের নাচের পোশাকটি পাব কি না? যাকে নকশা করতে দিয়েছি সে খুব অলস।”
পাখিছানা উড়ে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে নদী পেরুবার সময় জাহাজের মাস্তুলে ঝুলানো আলো দেখতে পায়। শহরের ইহুদিদের পাড়ার উপর দিয়ে যাবার সময় দেখে কয়েকজন ইহুদি টাকা-পয়সার লেনদেন নিয়ে দরাদরি করছে। এসব পেরিয়ে সে গরীব মহিলাটির কুটিরে পৌঁছে। বাচ্চাটি জ্বরে কাতরাচ্ছে, মা কান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাখিছানা মহিলাটির হাতের কাছে রুবিটি রেখে চুপিচুপি উড়ে ঘর থেকে বের হয়। বেরুবার আগে পাখা দিয়ে বাচ্চাটির কপালে বুলিয়ে দেয়। বাচ্চটি বলে ওঠে, ‘‘আহা! কী আরাম লাগছে। জ্বর চলে যাচ্ছে।” বাচ্চাটি আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ে।
পাখিছানা সুখী রাজপুত্তুরের কাছে ফিরে আসে। কাজ হয়ে গেছে সে খরব দেয়। তারপর বলে, “এটা আজব ব্যাপার। এখন এত ঠাণ্ডা, কিন্তু আমার বেশ গরম লাগছে।”
“কারণ তুমি একটা ভাল কাজ করেছে” বলে সুখী রাজপুত্তুর। পাখিছানাও কারণটা ভাবতে শুরু করে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে। কোন কিছু চিন্তা করতে গেলেই তার ঘুম আসে।
ভোরের আলো ফুটবার পর সে নদীতে গোসল করতে যায়। পাখিটি যখন নদীর পানিতে গোসল করছিল, তখন ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন একজন অধ্যাপক। ঠাণ্ডার মধ্যে ভোরে গোসল এমন অদ্ভূত দৃশ্য দেখে তিনি বলেন,“এটি প্রকৃতির এক অদ্ভূত খেয়াল।” পরে তিনি ‘শীতল জলতরঙ্গ আর একটি পাখি’ শীর্ষক একটি লম্বা রচনা স্থানীয় পত্রিকায় লেখেন। তার মনের মাধুরী আর সমৃদ্ধ শব্দ সম্ভার দিয়ে রচিত এ রচনা থেকে অনেকে উদ্ধৃতি দেন, তবে প্রায় কেউই এ রচনার মর্মার্থ বুঝতে পারেন না।
সারা সকাল পাখিছানা শহরের সবগুলো স্তম্ভ, ভাস্কর্যগুলো ঘুরে দেখে। গির্জার ছাদে সে দেখে দু’টি চড়ুই ছানা পাখিছানাকে দেখিয়ে নিজেদের মাঝে বলছে,“এটা কী এক আজব চিড়িয়া।” পাখিছানা খুব মজা পায়।
“কিন্তু এখন আমার যাবার সময় হল,” পাখিছানা সুখী রাজপুত্তুরকে বলে,“মিশরে কি তোমার জন্য কোন কিছু করতে হবে, হলে বল। আমি এখন রওনা হচ্ছি।”
“পাখিছানা, ও পাখিছানা, তুমি কি আর একটা রাত আমার সাথে থাকবে না?”
“মিশরে সবাই আমার জন্য অপো করছে, কাল আমার বন্ধুরা আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্যে যাবে। নদীর ধরে তৃণলতা দিয়ে আমাদের আসন তৈরী করব। তারপর মেমন দেবতার ( মেমন ছিলেন একজন ইথিওপিয়ান রাজা, গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী মেমন রাজা ট্রয় যুদ্ধে ট্রোজানদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন এবং একিলিসের হাতে নিহত হন) সমাধিতে গিয়ে বসব। জানো দেবতা মেমন সারারাত আকাশের তারা দেখে, যখন ভোরের তারাটি জ্বলজ্বল করে ওঠে তখন সে আনন্দে কেঁদে ওঠে, তারপর আবার চুপ হয়ে যায়। রাতে হলুদ রঙের সিংহ নদীতে পানি খেতে আসে। সিংহের চোখ দু’টি সবুজ চকচকে পাথরের মতো,তাদের গর্জন জলপ্রপাতের আওয়াজকেও ছাপিয়ে যায়।”
‘‘পাখিছানা, লী পাখিছানা, শহরের ঐ দূরের বাড়ির চিলেকোঠায় আমি একজন তরুণকে দেখতে পাচ্ছি। তার ঘরে কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কয়েকটা ফুল শুকিয়ে পড়ে আছে। তার মাথায় কী সুন্দর বাদামি চুল, ঠোঁটগুলো ডালিমের মতো টকটকে লাল, তার চোখ স্বপ্নে ভরা। সে একটি নাটক লেখা শেষ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এই কনকনে ঠাণ্ডার কারণে সে লেখা শেষ করতে পারছে না। তার ঘর গরম করার জন্যে উনুনে একটুও আগুন নাই। শীত আর তার সাথে খিদাতে তারতো প্রায় মরমর অবস্থা।”
পাখিছানার মনটা খুব নরম। সে বলে “আমি আজ রাতও তোমার সাথে থাকব। তোমার কাছ থেকে কি আরেকটা রুবি নিয়ে যাব?”
‘‘আমার কাছে তো আর কোনো রুবি নাই। কিন্তু আমার চোখ দুইটা দামী নীলা পাথরের। প্রায় হাজার বছর আগে ভারত থেকে আনা হয়েছিল। সেখান থেকে একটা পাথর তুলে ছেলেটাকে দিয়ে আস। সে এটা বিক্রি করে খাবার আর কাঠ কিনুক। আমি চাই সে তার নাটকটা লেখা শেষ করুক।”
‘‘রাজপুত্র ভাই, আমি এই কাজটা করতে পারব না”, ছলছল চোখ করে পাখিছানা কথাগুলো বলে।
“পাখিছানা, শোন আমি যা বলছি তাই কর,” রাজপুত্র বলল।
পাখিছানা রাজপুত্তুরের এক চোখ থেকে নীলাপাথরটি তুলে দেয় এবং ছেলেটার কাছে নিয়ে যায়। ছেলেটার ঘরের ছাদে বড় একটা গর্ত আছে। তার ফাঁক দিয়ে নীলাটা ছেলেটার ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। ছেলেটা কানমাথা মুড়িয়ে ছিল তাই সে পাখির ডানা ঝাপটার শব্দ শুনতে পায় না। সে শুধু দেখে তার ঘরের শুকনো ফুলগুলোর মাঝে একটা নীলা পড়ে আছে।
“যাক শেষ পর্যন্ত আমার লেখা লোকে বুঝতে পারছে। নিশ্চয়ই আমার কোনো ভক্ত পাঠক আমাকে উপহার পাঠিয়েছে।” খুব পরিতৃপ্ত মন নিয়ে ছেলেটি মনে মনে কথাগুলো বলল।
পরের দিন পাখিছানা ঘাটে যায়। নাবিকেরা জাহাজের মাস্তুল তুলছে, দল বেঁধে বলছে, “হেঁইয়ো, হেঁইয়ো।” পাখিছানা একটু আবদারের সুরে বলে,“আমি তোমাদের সাথে মিশরে যাব।” নাবিকেরা কেউই আপত্তি করল না। আকাশে যখন চাঁদ উঠল, সেই স্নিগ্ধ আলোতে রাজপুত্তুরকে পাখিছানা বলে, “আমি বিদায় জানাতে এসেছি।”
রাজপুত্তুর বলে, “পাখিছানা আর একটি রাত থেকে যাও না?” পাখিছানা তখন বলে, “শীতকাল এসে গেছে। কদিন পর এখানে কনকনে ঠাণ্ডা পড়বে, তুষার পড়বে। মিশরে এখন গরম পড়ছে, কুমিররা নদীর ধারে কাদাতে আয়াস করে শুয়ে আছে শুয়ে শুয়ে সবুজ তাল গাছ দেখে। আমার বন্ধুরা বালবেক (বালবেককে বলা হয় সূর্যের শহর, প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় সূর্য পূজার কেন্দ্র ছিল) মন্দিরে বাসা বানাচ্ছে। ওখানের গোলাপি আর সাদা কবুতরগুলোকে দেখছে আর কিচির মিচির করছে। প্রিয় রাজপুত্তুর, তোমাকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু সত্যি বলছি তোমাকে কখনও ভুলব না। পরের বসন্তে যখন আসব তখন তোমার জন্য এই লাল রুবির চেয়েও বেশি গাঢ় লাল রুবি নিয়ে আসব, নীলা নিয়ে আসব সমুদ্রের পনির মতো নীল রঙের। তোমাকে দেব সবগুলো।”
রাজপুত্তুর পাখিছানাকে বলে, “ঐ ময়দানটা দেখ। ওখারে দিয়াশিলাইয়ের বাক্স নিয়ে একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিয়াশিলাইয়ের কাঠিগুলো নর্দমায় পড়ে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। সে ভয়ের চোটে কাঁদছে। সে দিয়াশিলাইগুলো বিক্রি করে বাসায় টাকা নিয়ে যেতে না পারলে তার বাবা তাকে অনেক মারবে। এই ঠাণ্ডার মধ্যেও মেয়েটার পায়ে কোনো জুতা নাই, মাথায় কোন টুপি নাই। তুমি আমার আরেক চোখ থেকে নীলাপাথরটা নাও আর মেয়েটাকে দিয়ে আস। তাহলে তাকে আর মার খেতে হবে না। ”
“ঠিক আছে, আমি তোমার সাথে আরও একরাত থাকব কিন্তু তোমার চোখ থেকে পাথর তুলতে পারব না। এই পাথরটা তুললে তো তুমি পুরোপুরি কানা হয়ে যাবে।” পাখিছানা বলে।
“পাখিছানা শোন, আমি যা বলছি তাই কর।” রাজপুত্তুর একটু হুকুমের সুরে বলে। পাখিছানা রাজপুত্তুরের আরেকটা চোখ থেকে নীলাটা তুলে নেয়।
পাখিছানা রাজপুত্তুরের আরেকটি চোখের পাথরটি নিয়ে উড়ে যায়। উড়ে গিয়ে মেয়েটির হাতের কাছে ফেলে দেয়। মেয়েটি তার হাতের মুঠোতে পাথরটি তুলে বলে,“ কী সুন্দর রঙিন কাঁচের টুকরা।” মেয়েটি উৎফুল্ল হয়ে দৌড়ে দৌড়ে বাড়ির দিকে যায়।
পাখিছানা রাজপুত্তুরের কাছে ফিরে আসে। রাজপুত্তুরকে বলে, “এখন তুমি পুরোপুরি কানা। আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। আমি তোমার সাথেই থাকব।”
“না না পাখিছানা, তুমি মিশরে চলে যাও।” রাজপুত্তুর বলে।
“আমি তোমার সাথেই থাকব” বলে পাখিছানা রাজপুত্তুরের পায়ের কাছে শুয়ে পড়ে।
পরদিন সারাটা সময় পাখিছানা রাজপুত্তুরের কাঁধে বসে থাকে। তাকে আজব আজব দেশের গল্পের শোনায়। সে তাকে নীল নদের তীরে সারি সারি করে দাঁড়িয়ে থাকা লাল আইবিস পাখিরা কী করে গোল্ডফিস ধরে সে কথা বলে। বলে পৃথিবীর সমান বুড়ো সবজান্তা স্ফিংসের কথা। আরও শোনায় আরব বণিকদের কথা- তারা উট নিয়ে চলে আর পাথরের তসবিহ বিক্রি করে। আবার বলে, আবলুস কাঠের মতো কালো চাঁদের পাহাড়ের রাজার গল্প যে রাজা একটা বড় ক্রিস্টাল বলকে পূজা করে। আরও শোনায় তাল গাছে শুয়ে থাকা সবুজ রঙের বিকট শাপের কথা, এই শাপকে বিশজন পূজারি মিষ্টি, মধু খাওয়ায়। বলে বড় বড় পাতার ভেলায় করে ভাসা পিগমিরা (বিষুবীয় আফ্রিকার খর্বাকৃতি জনগোষ্ঠী) সারাণ খালি প্রজাপতিদের সাথে যুদ্ধ করে।
সব শুনে রাজপুত্তুর বলে, “প্রিয় পাখিছানা তুমি দারুণ দারুণ গল্প বললে। কিন্তু জান, সবচেয়ে দারুণ গল্প হচ্ছে এই পৃথিবীর মানুষের দুঃখ কষ্টের গল্প। এর চেয়ে রহস্যময় গল্প আর নেই। তুমি উড়ে উড়ে শহরটাকে দেখ আর আমাকে বল তুমি কী দেখলে?”
রাজপুত্তুরের কথা মতো পাখিছানা শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। দেখে যে নয়নাভিরাম অট্টালিকা আর তার ছায়াতেই খোলা আকাশের নিচে আছে গৃহহীন নরনারী। শহরের অন্ধকার গলির ভিতরে শোনে ুধাতুর শিশুদের আর্তনাদ। ব্রিজের নিচে দেখে দুইটা ুধার্ত বাচ্চা গায়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে শরীরের শীত কমানো চেষ্টা করছে। হঠাৎ দারোগা ধমকিয়ে বলে, “এখান থেকে ভাগ।” শীত আর তার ওপর উপরি ঠাণ্ডা বৃষ্টির মধ্যে বাচ্চা দুইটা হাঁটা আরম্ভ করে।
পাখিছানা এসব দেখে। সে যা যা দেখল সব রাজপুত্তুরকে এসে বলে।
“তুমি আমার শরীরের প্রতিটি জায়গা থেকে সমস্ত সোনা খুলে নাও, সোনাগুলো ওদেরকে দাও। দেখি ওরা খুশি হয় কিনা?” রাজপ্ত্তুুর পাখিছানাকে বলে।
রাজপ্ত্তুুরের শরীরের প্রতিটি স্বর্ণকণা পাখি খুট খুট করে তুলে নেয়। রাজপ্ত্তুুর হয়ে যায় একেবারে নিরাভরণ,জৌলুসশূন্য। সোনাগুলো নিয়ে সে ওই গরীব মানুষগুলোর মাঝে বিলিয়ে দেয়। শিশুদের মুখে হাসি ফুটে, রাস্তার ধারে খেলতে খেলতে তারা উল্লসিত হয়ে বলে,“আজ আমরা পেট ভরে খেতে পারব।”
কদিন পরেই তুষার পড়া শুরু হয়ে যায়, তারপর বরফ পড়ে। দেখে মনে হয় পুরো শহরটা রূপার চাদরে ঢেকে গেছে, ঝলঝল করছে; ঘরের ছাদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে বরফ গলা পানির ফোটা জমে আছে। সবার কাছে গরম কাপড় আছে, বাচ্চারা গায়ে গরম কাপড় চড়িয়ে বরফে খেলছে।
পাখিছানার এই ঠাণ্ডাতে কষ্ট হয়, তবু সে রাজপুত্তুরকে ছেড়ে যাবে না। সে রাজপুত্তুরকে খুব বেশি ভালবেসে ফেলেছে। সে মাঝে মাঝে রুটিওয়ালাকে লুকিয়ে এক টুকরো রুটি নিয়ে এসে কুটকুট করে খায়, সেইসাথে ডানা ঝাপটিযে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করে।
ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। সে তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে রাজপুত্তুরের কাঁধে এসে বলে। সে বলে, ‘‘বিদায় বন্ধু। চলে যাবার আগে তোমার হাতে একটি চুমু দিয়ে যাই।”
চলে যাবার অর্থটা ঠিক বুঝতে না পেরে রাজপুত্তুর বলে,“আমি খুবই খুশি হয়েছি যে তুমি মিশরে যাচ্ছ। এখানে তোমার অনেকদিন হল। তোমাকে আমি খুবই ভালবাসি।”
পাখিছানা মিষ্টি হেসে বলে,“আমি মিশরে না আরও দূর দেশে যাচ্ছি। চিরঘুমের দেশে।” তারপর সে রাজপুত্তুরকে চুমু দেয় এবং তার পায়ে ঢলে পড়ে।
এমন সময় মূর্তির ভিতর থেকে একটা ফাটলের শব্দ হয়। সীসার তৈরী হৃদয়টি দুই টুকরা হয়ে যায়। শীতের প্রকোপ আরও বাড়তে থাকে।
পরদিন সকারে নগরের মেয়র আর তার কাউন্সিলারা নগর ময়দানে হাঁটতে বের হয়। মূর্তিটির কাছে এসে থমকে যায়, চমকে গিয়ে মেয়র বলে, “আমাদের রাজপুত্রের এইটা কী হালত হয়েছে?”তার সাথে কাউন্সিলাররা সুর মিলিয়ে বলে,“একেবারে ফকিররা অবস্থা।”
“তলোয়ারে রুবি নাই, চোখ কানা, গায়ে সোনার কাপড় নাই, এতো একেবারে রাস্তার ফকির অবস্থা,”মেয়র বলতে থাকে। কাউন্সিলাররা যোগ করে,“পুরা রাস্তার ফকির।”
মেয়র বলে যায়, “এইটার পায়ের কাছে একটা মরা পাখি পড়ে আছে। এখানে পাখিদের মরা নিষেধ করে একটা পরিপত্র জারি করতে হবে।” মেয়রের সেক্রেটারি কথাটি নোট করে নেয়।
এরপর তারা সুখী রাজপুত্তুরের মূর্তিটি সরিয়ে নেয়। “এর সৌন্দর্য যখন শেষ তখন একে এখানে রাখার কোনো মানে হয় না,” নন্দনতত্ত্বের অধ্যাপক মন্তব্য করেন।
মূর্তিটিকে হাপরে দিয়ে গলিয়ে ফেলা হল। মেয়র বলে, ‘‘এই গলানো সীসা দিয়ে আরেকটা মূর্তি করা হোক, এইবার আমার মূর্তি বসালে কেমন হয়? যে কাউন্সিলাররা আগে সবসময় জ্বি জ্বি করত তারাও এ প্রস্তাব মানতে পারল না, তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল।
অন্যদিকে লোহার কারখানার কামার বলে,“এটাতো আজব ব্যাপার। ভাঙ্গা হৃদয়ের সীসাগুলো তো গলছে না।” এই বলে সে রাজপুত্তুরের হৃদয়টা বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। রাজপুত্তুরের হৃদয়টা মৃত পাখিছানার পাশে গিয়ে পড়ে।
শহরে যখন মূর্তি বসানো নিয়ে তর্ক চলছিল, কামার যখন সীসা না গলার কারনে বিরক্ত হচ্ছিল, ঠিক তখন ঈশ্বর তার এক ফেরেশতাকে বলছিলেন,“তুমি আমার জন্যে ঐ শহরের সবচেয়ে মূল্যবান দুইটি সম্পদ নিয়ে আস।” ফেরেশতা রাজপুত্তুরের সীসার হৃদয় আর পাখিছানার মৃতদেহটি নিয়ে আসে।
অত্যন্ত সন্তুষ্টির সাথে ঈশ্বর বলেন,“তুমি একেবারে ঠিক সম্পদটি নিয়ে এসেছ, পাখিছানা স্বর্গের বাগানের গাতক পাখি হবে, আর সুখী রাজপুত্তুর হবে এর মধ্যমনি।”