বছর হয়ে গেলো তুলতুলির বিয়ে হয়েছে। বয়স আর কত হবে আঠারো ঊনিশ। জামাই ইতালি থাকে শুনে তুলতুলির বাবা মা তিনদিনের ভেতরেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। ছেলের নাম রুয়েল। নামের মতোন ছেলে দেখতে সুন্দর। তুলতুলি তাই না করেনি। বাবা মায়ের অভাবের সংসারে বড় হতে হতে ক্লান্ত লাগছিলো তার। বিদেশী জামাই পেয়ে চোখ বুজে বিয়ে করে ফেলেছে। বিয়ের ২ মাস ঘুরতেই রুয়েল আবার ইতালি চলে যায়। এরপর থেকেই চোখ ছোট করে তুলতুলি দূরে তাকিয়ে থাকে স্বামীর অপেক্ষায়।
কবে আসবে স্বামী? ধান দুব্বা দিয়া ঘরের দরজায় তাকে বরণ করে নিবে। রাত অন্ধকার হলে বুকের ছায়ায় তার স্বামীকে ঘুম পাড়াবে। তুলির বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে উঠলো। স্তনের ভেতরেও কেমন যেন যন্ত্রনা। দুই হাতে স্তন চেপে ধরলো তুলতুলি। তার শরীর ভেঙে আসে, ইতালি থেকে স্বামী ফিরে আসে না।
মোবাইলে কথা বলার সাথে এখন ছবিও দেখা যায়। সকাল বিকাল ভিডিও কল দেয় রুয়েল। তুলতুলির শ্বাশুড়ি মানে রুয়েলের মায়ের কাছেই মোবাইলটা সবসময় থাকে। তুলতুলির সাথে সেদিন সন্ধ্যায় মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলতে পারলো রুয়েল। দুই মাসের স্বামীকে ছোট মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে কান্না চলে আসে। মোবাইলটা ব্লাউজের কাছে চেপে ধরে রাখে সে।
রাত বেশি হয়নি। না খেয়েই বিছানায় শরীর ছেড়ে দেয় তুলতুলি। দুম করে একটা স্বপ্নও চলে আসে। চারদিকে লাশ আর লাশ। কোন যুদ্ধ নেই, কেউ কাউকে হত্যা করেনি তবুও মৃতদেহ পড়ে আছে এখানে সেখানে। যুদ্ধ ছাড়া এতো মানুষ একসাথে কখনো কি মারা যায়? ঘাম দিয়ে ঘুম ভাঙে তুলতুলির। উঠোনেই একটি কুকুর ডেকে উঠলো। কুকুরের ডাক যেন মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ। বসার ঘর থেকে টিভির শব্দ কানে আসছে। পা টিপে টিপে উঠোন পেড়িয়ে বসার ঘরে যায় তুলতুলি। রুয়েলের কলেজ পড়ুয়া ছোটভাই সুহেল। টিভি ছেড়ে বসে আছে সে, কিন্তু টিভি দেখছে না। শ্বাশুড়ির মোবাইলটা দেবরের হাতে। সমান তালে টিপে যাচ্ছে সুহেল। কুকুরটা আবার ডেকে উঠলো। ভাবিকে দরজায় দেখে চমকে উঠে সে।
-কি হয়েছে ভাবি?
-মোবাইল একটু দেও তো। তোমার ভাই এর লগে কথা কমু।
-দেওরের লগে আগে একটু কথা কন্ আগে, তারপর মোবাইল দিতাছি।
সুহেলের হালকা রসিকতায় পরিবেশটা তখনো হালকা হয়নি। টিভিতে খবর পাঠিকা মুখস্ত পড়ে যাচ্ছেন, “চিনের প্রাণঘাতি ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে ১০জন আক্রান্ত হবার খবর মিলেছে..........”
দমকা বাতাসের মতো দৌঁড়ে বসার ঘর থেকে নিজের ঘরে চলে যায় তুলতুলি। দরজা জানালা লাগিয়ে দিলো বটে কিন্তু পাশের দাস পাড়া থেকে হরিধ্বনী এসে কানে লাগলো। বল হরি, হরি বল। বল হরি, হরি বল। গায়ে কাঁটা দিলো তুলতুলির। পৃথিবীর কিছু একটা হয়েছে। বাঁশপাতার হাত ধরে কিছু একটা এলোমেলো ফিশফিশানি কানে এসে ঢুকছে তার। দম বন্ধ লাগছে, জানালা খুলে দিলো। খানিক বাদে গ্রামের শ্মশানের লাল অগ্নিশিখার আলোতে কালো আকাশ ভরে উঠলো।
জ্বর নিয়ে ইতালি থেকে গ্রামে ফিরেছে রুয়েল। তুলতুলির হাসি দেখে কে? ভেতরে ভেতরে একটা সুখের সমুদ্র। স্বামীর জ্বর নিয়ে তার মাথাব্যাথা নাই। জলপট্টি দিলেই জ্বর বাপবাপ করে পালাবে। তবে এবার স্বামীকে আর পালাতে দেবে না। রুয়েল ঘরে ঢুকলো। তাকে এক পলক দেখে শরমে চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ করে রান্না ঘরে দৌড়ে পালালো তুলতুলি। এক বছর পরেও তার নতুন বউ ভাবটা কাটেনি। শ্বাশুড়ির ডাক পড়লো।
-কি গো বউ। আমার পুলাডা সাত সমুদ্দুর পার কইরা আইছে। চোখ মুখ লাল অই গ্যাছে দেখো। অ বউ কই গ্যালা? এক গেলাশ গরম দুদ লইয়া আহো। অ বউ!
অনেক রাত পর্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে জেগে রইলো রুয়েল। বসার ঘরে মানুষ গিজগিজ। কত প্রশ্ন কত আলোচনা। সবার চোখে মুখে উৎকন্ঠা। শুধু এক গাল হাসি নিয়ে নিজের ঘরে অপেক্ষা করছে তুলতুলি। স্বামী ইতালি থেকে ঘরে ফিরেছে। তুলতুলির কাছে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত। কাছে এসেই তুলতুলিকে জড়িয়ে ধরলো রুয়েল।
-ওমাগো। তোমার গাও যে পুইড়া গেলো। দেখি দেখি কপালডা দেখি।
রুয়েল তুলতুলির নরম হাতটা কপাল থেকে সড়িয়ে চোখ টিপে হেসে বলে,
-অ্যামনে জ্বর দেখে না।
-তাইলে ক্যামনে জ্বর দেখে?
-খাড়াও দেখাইতাছি।
চুমুতে চুমুতে তুলতুলির সারা শরীর ভরিয়ে দেয় রুয়েল। চুলে ধরে রুয়েলের মুখটা তুলতুলি তার বুকটার কাছে চেপে ধরে।
গত এগার দিন ধরে রুয়েলের জ্বর কমার লক্ষণ নেই। সাথে কাশি। কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে। রক্তের কথা তুলতুলি ছাড়া কেউ জানেনা। রক্তের কথা সবাইকে বলতে নিষেধ করেছে রুয়েল। ডাক্তার, কবিরাজ কেউ রুয়েলের জ্বর ভালো করতে পারে না। রুয়েল আসার পর বসার ঘর গিজগিজ করছিলো, আজ সেটি বিরান। প্রতিবেশিরা একবার খোঁজও নেয় না। তুলতুলির শ্বাশুড়িকে নিয়ে সুহেল তার বোনের বাড়ি গেছে। চারপাশে রব উঠেছে রুয়েলের মরণরোগ হয়েছে। রোগের নাম করোনা। সবাই ছেড়ে চলে গেলেও তাকে ছাড়েনি তুলতুলি।
রুয়েলের কপালে জলপট্টির পর জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে সে। গলায় একটু পরপর পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজ রাতে কাশি আরো বেড়েছে। বিছানার পাশেই জায়নামাজ বিছিয়েছে তুলতুলি। নামাজে দাঁড়িয়ে সুরা ভুলে যাচ্ছে, আয়াতে গন্ডগোল হচ্ছে। সোজা সেজদায় চলে গেলো তুলতুলি। হাওমাও করে কাঁদছে সে, “ও আল্লাগো আমার জামাইরে তুমি নিও না। ও আল্লা তুমি বাঁচাও।” কাঁদতে কাঁদতে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়লো তুলতুলি।
নিশুতি রাত। রুয়েলের ডাকে ঘুম ভাঙলো তুলতুলির।
-তুলি। ও তুলি। ওডো।
তুলতুলি ধরফরিয়ে উঠে। দু’দিন পর রুয়েলের গলা দিয়ে আওয়াজ বেড়ুলো। রুয়েলের মাথাটা তুলতুলি তার কোলে রাখলো। আগুন নেভানোর পর মাটির চুলার কয়লা ধিকিধিকি জ্বলে। রুয়েলের শরীরটাও তেমন জ্বলছে। ফজরের আজানের সময় সে আগুন নিভে গেলো। মুয়াজ্বিনের শেষ আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহের সাথে মারা গেলো রুয়েল। তুলতুলি রুয়েলের মরা মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মৃত্যুর আগে কিছু একটা চেয়েছিলো সে তুলির কাছে। ‘ও তুলি ওডো’ বলে কি চেয়েছিলো সে? একটি চুমু? রুয়েলের মরা মুখটা আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসে। ভোরের আলো ফোটার আগেই রুয়েলের লাশ ঘরে রেখে নিরুদ্দেশ হয় তুলতুলি।
আর কোনদিন ঘরে ফিরবে না সে।