সবুজ কাঁধে একটা বাঁশ নিয়ে দৌড়াচ্ছে, "বাঁশটাতে যেন পুরো বাংলাদেশ..!"
বাংলাদেশের ছোট বড় পতাকা, পতাকা আঁকা মাথায় লাগানো ব্যান্ড, পতাকা আঁকা হাতে বাঁধার ব্যান্ড।
সামনেই বিজয় দিবস, তাই সবুজ এসব বিক্রি করছে। এমনিতে সে ইট ভেঙে সুরখি বানায়, কাজটা খুব কষ্টের। হাতে ফোস্কা পড়ে, কিন্তু টাকাটা ভালো পায়। তবে বিশেষ মাসগুলোতে পতাকা বিক্রি করতে তার খুব ভালো লাগে।
সবুজের বয়স কত হবে চৌদ্দ পনেরো বৎসর। এই বয়সী ছেলেরা স্কুলে পড়ে, অথচ সে এই বয়সে সংসার চালায়।
বাবা তার সাত বছর বয়সী বোনটা মায়ের পেটে থাকতেই অসুস্থতায় মারা যান।
মা মানুষের বাসায় কাজ করে, আর সবুজ এটা সেটা করে। মা ছেলের রোজগারে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে তিনজনের সংসারটা চলে।
ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সবুজের কাছ থেকে পতাকা, ব্যান্ড, স্টিকার কিনে।
যুদ্ধের কথা মানুষের মুখে শুনেছে, তার দাদু বেঁচে থাকতে, দাদুর কাছেও যুদ্ধের গল্প শুনেছে। দেশেকে স্বাধীন করতে মুক্তি সেনারা পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ করেছে।
এই যুদ্ধে কত বাঙালী মারা গেছে, কত মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে ঐ পাকিস্তানি হায়েনারা। মুক্তিসেনারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে নিজের দেশ, নিজের মা সমতুল্য মাতৃভূমির জন্য স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আসলে চতুর্দিকের সাজ সাজ রব, সবুজের খুব আনন্দ লাগে। স্কুলের ছেলে মেয়েরা লাল সবুজ কাপড় পড়ে, হাতে পতকা নিয়ে ঘুরে ।
সবুজেরও মন চায়, কিন্তু সে তো স্কুলে পড়ে না। তাই সে পতাকা বিক্রি করে মনের শখ পূরণ করে।
বিজয় দিবসের দিন, উপজেলার মাঠে অনেক সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান হয়। সব স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রী আসে, সেদিন অনেক পতাকা বিক্রি হয়।
আজকের বিক্রির টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনবে, ছেড়া শাড়ী পরে মা মানুষের বাসায় কাজে যায়, তার দেখে খারাপ লাগে।
আহা, "আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো, মাকে ছেড়া শাড়ী পরতে হতো না, কারো বাসায় কাজ করতে হতো না। দু'ভাই বোন স্কুলে যেতো, সবুজের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো...!"
সবুজের মা মোটামুটি সুন্দরী, স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক বিয়ে এসেছে। কিন্তু সন্তান দুইটার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে, আর বিয়ে করেনি। তবে গ্রামের মাতাব্বর ফজলু মিয়ার চোখ তার মায়ের দিকে। কয়েকবার সবুজের মাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে, অথচ ঘরে তার বউ আছে।
প্রায়ই ফজলু মিয়া তাদের ঘরে এসে বসে থাকে, বুঝায় সবার খোঁজ খবর নিতে এসেছে। কিন্তু চোখ থাকে অন্য দিকে, লোকটাকে সবুজের মোটেও পছন্দ না, দেখলেই ওর রাগ উঠে।
উপজেলার মাঠে আজ সব পতাকা বিক্রি হয়ে গেছে। পতাকা বিক্রির টাকা দিয়ে, সবুজ মায়ের জন্য সবুজ জমিনে লাল পেড়ে একটা শাড়ী কিনলো।
তার চোখে ভাসছে লাল পেড়ে শাড়ী পড়া, মায়ের হাঁসি মুখটা।
সবুজ এক হাতে মায়ের জন্য কেনা শাড়িটা, অন্য হাতে পতাকা বিক্রির বাঁশটা নিয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরছে।
একটা পাট ক্ষেতের পাশ দিয়ে সবুজকে বাড়ি ফিরতে হয়, ওর মা মাঝে মাঝে পাট শাক নিতে আসে। প্রায়ই ওদের পাট শাক ভাঁজি দিয়ে ভাত খেতে হয়। ছোট বোনটা পাটশাক ভাঁজি দেখলে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে বলে, "ভাত খামু না, এই শাক তিতা লাগে...!"
সবুজ মাঝে মাঝে বোনের জন্য একটা ডিম নিয়ে যায়। সব দিন নিতে পারে না, টাকায় কুলায় না।
বোনটা ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ করে। বোনের ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়া হাসি মুখটা দেখে, সবুজ সারাদিনের করা পরিশ্রম ভুলে যায়।
ঐ যে মায়ের শাক তোলার ঝাকিটা দেখা যাচ্ছে। ঝাকিটার কাছে যেতেই সবুজ ক্ষেতের ভিতর থেকে ধস্তাধস্তি ও চাপা গোঙানির শব্দ শোনতে পায়।
কৌতুহল নিয়ে সবুজ ভিতরে উঁকি দেয়, হাত থেকে মায়ের শাড়িটা পড়ে যায়।
ফজলু মিয়া নামের হায়েনা তার মায়ের মুখ চেঁপে ধরে সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করছে।
দাদুর বলা কথাগুলো মনে পড়লো, একাত্তরের যুদ্ধে ফজলু মিয়া রুপি হায়েনারা অনেক মা বোনের ইজ্জতের উপর হামলা করে। আর তাদের ইজ্জত বাঁচাতে মুক্তিসেনারা হায়েনাদের উপর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশ রক্ষার্থে, মা বোনের ইজ্জত রক্ষার্থে, নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে।
বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা, অর্জন করে আজকের এই পতাকা, এই বিজয় দিবস...!"
সবুজ পতাকা বিক্রির বাঁশ দিয়ে সজোরে ফজলু মিয়ার মাথায় বাড়ি মারে।
মাকে জড়িয়ে সবুজ বিজয়ের হাঁসি হাসে, " মায়ের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে আজ যেনো, আবার সে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে..!"
ফজলু মিয়ার মৃত্যুর জন্য সবুজকে বাকি জীবন হয়তো কারাগারে কাটাতে হবে।
কিন্তু তার কোন দুঃখ নেই, "সে যেন একাত্তরের মুক্তিসেনা, মায়ের সম্ভ্রম রক্ষা করে আবার আজ বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছে....!"
"আমি গাইবো, গাইবো বিজয়ের ই গান,
যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রান। "
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৮