আমাদের চারপাশে শব্দের একটা জগত আছে। একান্ত নিরবতা বলে আসলে কিছু নেই। সবসময়ই নানাধরনের শব্দ আমরা শুনে থাকি। পায়ের আওয়াজ, পেয়ালা-পিরিচের টুংটাং, পাখির ডাক, হয়ত কোন বাচ্চা “মা” বলে ডেকে উঠল, টিকটিকির টিকটিক ডাক, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের চারপাশের অসংখ্য শব্দ থেকে বিচিত্র উপায়ে আমাদের মস্তিষ্ক প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আমাদের জন্য বাছাই করে। প্রয়োজনীয় শব্দগুলোর দিকে মনোযোগকে সন্নিবেশ করে। কিছু শব্দকে আমাদের বোধগম্য ভাষায় অনুবাদ করে। যেমন ধরা যাক, একটা বাচ্চা যখন ‘মা” বলে ডেকে উঠে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের বুঝিয়ে দেয়, ছেলেটি তার মাকে ডাকছে। কিন্তু একটি পাখি কিচিরমিচির করে ডেকে উঠলে আমাদের মস্তিষ্ক সেটার মানে বুঝতে পারেনা। বিষয়টি এমন যে, যে ব্যক্তি মোর্স কোড জানে না, তার কাছে টেলিগ্রামের টরেটক্কা কোন মানে বহন করেনা। অবোধ্য শব্দটিকে আমাদের মস্তিষ্ক মনোযোগের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেয়। মানুষের কথায় আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিই বলেই সেটা শুনতে বা বুঝতে পারি। কিন্তু কোনদিন যদি এমন হয়, মানুষের কথার চেয়ে অন্যান্য শব্দের দিকে আমাদের মনোযোগ নিবিষ্ট হয়ে যায়, মানুষের কথা কি আমাদের কাছে পাখির কিচিরমিচিরের মত অপ্রয়োজনীয় আর দুর্বোধ্য মনে হবে?
এমনই এক বিচিত্র বিষয় নিয়ে “শব্দ” সিনেমার বিস্তার। “শব্দ” সিনেমার প্রধান চরিত্র তারক দত্ত সাউন্ড স্টুডিও তে কাজ করে। ফলি আর্টিষ্ট। কাজ সিনেমার শব্দ পূনঃনির্মান করা। পায়ের শব্দ, পাখির ডানা ঝাপটানো, থালাবাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ ইত্যাদি। একান্তে কানে হেডফোন লাগিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে তার নিজস্ব শব্দের একটা জগত তৈরী হয়ে গেছে। মানুষের কথায় তার মনোযোগ থাকে না। কেউ হয়ত তাকে কিছু বলছে, কিন্তু সে তখন রাস্তার গাড়ীর শব্দ শুনতে ব্যস্ত। সংসারে টানাপড়েন। বউয়ের অভিযোগ, তারক তার কোন কথায় মন দেয় না। বউ তাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার দেখতে পান, তারকের শুনতে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু সে তার স্বনির্মিত এক শব্দের জগতে আটকা পড়ছে, সেই জগত একসময় মানুষের কথার জগতকে তার কাছে দুর্বোধ্য করে তুলবে। তারকের মনোজগতের সাথে বাস্তব জগতের ঘাত-প্রতিঘাত জমে ওঠে। মনোরোগের ডাক্তার কি পারলেন তারককে তার শব্দের জগত থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে? কি ঘটল তারকের ভাগ্যে?
কলকাতায় নির্মিত বাংলা সিনেমা “শব্দ”। পরিচালনা করেছেন কৌশিক গাঙ্গুলী। সিনেমাটোগ্রাফী- শীর্ষ রায়। তারকের চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী, তারকের স্ত্রীর চরিত্রে রাইমা সেন, মনোরোগের ডাক্তারের চরিত্রে চুনি গাঙ্গুলী অভিনয় করেছেন।
২০১২ সালে মুক্তির পর সিনেমাটি ব্যপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সিনেমাটিকে “নিরব বিপ্লব” নামে অভিহিত করেছে এবং ১০ এর মধ্যে ৯.৫ রেটিং দিয়েছে যা আনন্দবাজার পত্রিকার সর্বকালের সেরা রেটিং। সিনেমাটি ভারতের ৬০তম চলচিত্র পুরস্কারে “সেরা বাংলা ফিচার ফিল্ম” হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে।
ভাবনার উদ্রেককারী অসাধারণ বিষয়বস্তু, অসাধারণ নির্মান, চমৎকার অভিনয়, সব মিলিয়ে সিমেমাটি সব সিমেমাপ্রেমীর অবশ্যই দেখা উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:২৭