ঈদের ছুটি শেষ। বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরছি। উপজেলা কানেক্টিং রোড। একটাই মাত্র মুড়ির টিন বাস সার্ভিস ভরসা। উঠলাম সেই বাসেই। বাসটা একটু এগিয়ে এক মোড়ে থামল। লোকজন বাসে উঠছে। এক ভদ্রলোক রাগতস্বরে কিছু বলতে বলতে বাসে উঠলেন। বসলেন আমার সামনের সীটে। বসেই তিনি বাসের বাইরে থাকা এক লোকের দিকে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এই যে মুরুব্বি, আমনের ঘরে ভাতের পাতিলা কয়টা? মুরুব্বি, মুরুব্বির মত থাকেন, নাইলে কিন্তু খারাপ হইব। আমি একটু আগ্রহ বোধ করলাম, ভাবলাম, ঘটনা কি, ভাতের পাতিল নিয়ে কি আবার ঘটল? ওদিকে ওই ভদ্রলোকের রেডিও ততোক্ষনে চালু হয়ে গেছে। আমি একটু মনোযোগ দিলাম। তিনি তখন পাশে বসা আরেক ভদ্রলোককে বলছেন, “দেখেছেন ভাই, যেই না আমার সিনজি(সিএনজি অটোরিক্সা), ছিড়া সিট, স্কুরুপ (স্ক্রু) এর উপর বইতে হইব, কয় ভাড়া ৪০ টাকা, আমি যামু না, আমারে কয় ঘরে ভাতের পাতিলা নাই, হের ঘরে কয়ডা ভাতের পাতিলা আছে? ধাক্কা দিয়া সিনজি উল্টাইয়া দিলে কি করব?”
যাক, বাস ভালই চলছিল, লোকজনের বাড়ি থেকে ডেকে এনে গাড়িতে তোলা, ঈদ উপলক্ষ্যে হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়া ভাড়া নিয়ে বচসা, ইত্যাদি। গন্তব্যের আর পাঁচ কিলোমিটার বাকি। একটা স্টপেজ এল। কিছু যাত্রী নামার জন্য বাসের দরজার সামনে লাইন দিয়েছে। হেলপার নিয়মমত বাসের গায়ে চাপড় দিয়ে গাড়ি থামানোর সংকেত দিল। কিন্তু বাস তো আর থামে না, হেলপার একটু অবাক হয়ে বাসের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “ওস্তাদ, গাড়ির ব্রেক কি ফেল করছে?” আমি এতক্ষন একটু চোখ খুলেই ঝিমাচ্ছিলাম। হেলপারের বক্তব্যে সচকিত হয়ে সোজা হয়ে বসলাম। কাছেই ছিল কন্ডাক্টর, তার দিকে চোখ বড় বড় করে ভয় আর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে মুখের উপর হাসি টেনে বলল, “হারা রাস্তা ভালা আইলাম, এখন আবার কি হইল? সমস্যা নাই, কোন সমস্যা নাই”। বাস একসময় থামল, গতি বেশী না থাকাতে কোন সমস্যা হল না, বাস আপনা আপনি থেমে গেল। মজার ব্যাপার হল, গাড়ীর ব্রেক নষ্ট হয়ে গেছে, এতে গাড়ীর যাত্রী আর ড্রাইভার হেলপারদের কোন বিকার দেখা গেল না, বাস আবার চলতে শুরু করল। বুঝলাম, এই রাস্তায় এটা একটা নিয়মিত ঘটনা। আমিও মজা পেয়ে গেলাম, দেখা যাক কি হয়?। তো, মুড়ির টিন আবার চলতে শুরু করল, তবে এইবার একেবারে গরুর গাড়ির গতিতে। আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, ব্রেক ছাড়া গাড়ি কি করে থামাবে? হঠাৎ থামাতে হলে কি করবে? দেখলাম তার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। হেলপার কোথা থেকে যেন একটা ইট আকৃতির কাঠের টুকরা বের করল। বাস থামানোর দরকার হলেই সে দৌড়ে গিয়ে কাঠের টুকরাটা বাসের চাকার সামনে নিয়ে রাখছে, চাকাটা কাঠের উপর দিয়ে যাচ্ছে, বাসে একটা জোরছে ঝাকুনি লাগছে আর বাস থেমে যাচ্ছে। এইভাবে কাঠের টুকরা প্রয়োগ করে আরও ৮-১০ বার থেমে যাত্রী উঠানামা করিয়ে প্রথম গন্তব্যে পৌছুলাম।
প্রথম মুড়ির টিন থেকে নেমে নতুন আরেক রুটের মুড়ির টিনে উঠেছি। এটি আসল জাতের মুড়ির টিন। সীটে বসার সাথে টের পেলাম, আমার মত ছোটখাট লোকেরও দুই পা আটকে গেছে। দুই সীটের মাঝখানে জায়গা এত কম যে, “নট নড়ন চড়ন অবস্থা”। ঈদ পরবর্তী সময়, কেউ কর্মস্থলে ফিরছে, কেউবা বেড়াতে যাচ্ছে, পিলপিল করে লোক উঠে বাস ভরে গেল, আমার পক্ষে আর সীট পরিবর্তন করা সম্ভব হল না, “অগত্যা মধুসূধন” হয়ে বসে রইলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম সামনের দিকের এক লোক দুই সীটের মাঝখানের কম যায়গা নিয়ে কন্ডাক্টরের কাছে অনুযোগ করছে। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে আসলে আমি বললাম, “সীটের সামনে আসলেই তো যায়গা কম, লোকজন কি আর এমনি এমনি অভিযোগ করে”? জবাবে সে বলল, “সীটের মাঝখানে এত ফাঁকা যায়গা এই রুটের অন্য কোন বাসে নাই”। আমি আর কোন ভাষা খুজে না পেয়ে চুপ করে থাকলাম।
পাশে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক বসেছেন। বয়স হলেও তেল কমেনি, বোঝা গেল তখন, যখন বাসে একজন অন্ধ ভিক্ষুক উঠল। বাসে উঠেই সে দ্রুতলয়ে জপতে লাগল, “ভাইয়া গো, আমারে সাহায্য করেন ভাইয়া, আমি অন্ধ মানুষ, আমারে সাহায্য করেন ভাইয়া”, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার পাশের ভদ্রলোক তৎক্ষনাৎ চালু হয়ে গেলেন, “এই, তোগোরে সাহায্য করলে পরে বদনাম করস, তোরা খুব খারাপ, হ্যা, ভাই, এগোরে সাহায্য করছিলাম, পিছনে গিয়া বদনাম করে, একেকটা হাড়ে হারামজাদা, কি ভাই ঠিক কি না?” (আমার দিকে তাকিয়ে)। আমি হাসি চেপে সম্মতিসুচক মাথা ঝাকিয়ে নিস্তার পেলাম।
তো, বাস চলছে। আমার পাশের ভদ্রলোকের ঘুম চেপেছে। তিনি সীটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। কিছুক্ষন পর শুরু হল নতুন আপদ। ভদ্রলোকের মাথাটা পিছলে এসে পড়ছে আমার কাঁধে। দেখে মনে হচ্ছে তিনি আমার কাধেই স্বাচ্ছন্দ পাচ্ছেন (!)। কি করি? চাপা সীট, সরারও যায়গা নেই। কায়দা করে বাম হাতে ভদ্রলোকের মাথাটা ধরলাম। বেশিক্ষন ধরতে হল না। একটা স্পীড ব্রেকারে ঝাকুনি লেগে ভদ্রলোকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি তার মাথা ধরে রেখেছি দেখে ভদ্রলোক মনে হয় একটু লজ্জাই পেলেন। একটা আধা লাজুক মার্কা হাসি দিয়ে তিনি সোজা হয়ে হেলান দিলেন।