-সাকি বিল্লাহ্
ভুতের ব্যাপারে আমার বরাবরই একটা সন্দেহ ছিল “ভুত আছে বা নেই” । বিশেষ কৌতুহলের কারণে তাই বার বার ভুত বিষয়ে লিখেছি । আসলে ভুত নেই বিষয়ে যেমন হাজারটা প্রমান দেয়া যায় একইভাবে ভুত আছে এ ব্যাপারেও হাজারটা প্রমান দেয়া যাবে । আমার দাদার বাড়ী গাজীপুরের পূর্বাচলে যা এখন ঢাকার পূর্বাচল টাউন নামে পরিচিত । বছরে দুই একবারের বেশি যাওয়া হয় না । যারা পূর্বাচল টাউনে কখনও গিয়েছেন তারা জানেন সবাই যেভাবে বলে সেরকম উন্নত নয় এ এলাকা । এখানে এখনও অনেক গ্রাম আছে যেখানে অনেক ভুত বা জ্বিন বাস করে । এখনও অনেক প্রেতসাধক আছে যারা চোখের নিমিষে আপনাকে কোনও অবিশ্বাস্য কিছু করে দেখাতে সক্ষম । এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল আমার সাথে গতবছর গ্রীষ্মের সময় ।
প্রচন্ড গরমে উঠোনের এক পাশে সবাইকে নিয়ে গাছের নীচে বসে গল্প করছিলাম, চাচা চাচী, চাচাতো ভাই-বোন ও আমি । দাদা-দাদী মারা গেছেন প্রায় ১৫ বছর এর উপর হয়েছে । হঠাৎ গ্রামের এক মধ্যবয়েসী লোক উঠোনের এক পাশে দাড়িয়ে চাচাকে সালাম দেয় । উনার নাম সুশীলবাবু । পেশায় একজন মাছ ব্যাবসায়ী । চাচা ওনার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন । সুশীলবাবু মাছের ব্যাবসা করেন কিন্তু নিরামিষভোজী, ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যজনক । গ্রামে ওনার আরেকটা পরিচয় আছে “প্রেতসাধক”, তবে ভয়ে কেউ সামনাসামনি এ কথা বলে না । লোকটার সাথে অনেক বিষয়ে কথা হল, এক পর্যায়ে আমি ভুত বিষয়ে জানতে চাইলে সে উত্তর না দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে উঠে পড়ে, বলে “যাই অনেক কাজ ফেলে এসেছি” । তার এরকম আচড়ন আমার কৌতুহল আরো বাড়িয়ে দিল । বললাম “আজকে চলে যাচ্ছেন ঠিক আছে কিন্তু কালকে আবার আসবেন, আপনার সাথে আমার কথা আছে” । তার মুখে কোনো উত্তর শোনা গেলনা । শুধু মৃদু হাসলেন । তার হাসির অর্থ বুঝতে পারলাম না, তিনি আসবেন নাকি আসবেন না ।
পরদিন সুশীলবাবুকে আর দেখা গেল না, আমি বেশিদিন থাকবো না তাই কৌতুহল মেটানোর জন্য আমি নিজেই তার বাসায় হাজির হলাম । সুশীল বাবু প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে বুঝতে পারলাম তিনি খুশি হয়েছেন আমি আসাতে । ওনাকে ভুত বিষয়ে আবারও একই প্রশ্ন করলাম “আপনি কি আমাকে ভুতের সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারবেন?” সুশীলবাবু আবারও হাসলেন, তার হাসির রহস্য আমি বুঝতে পারলাম না । তাই বিরক্ত হয়ে বললাম, “দেখুন, না পারলে তো লজ্জার কিছু নাই, হাসির মানে কি?” সুশীলবাবু বললেন “আপনার কথা শুনে হাসলাম, কারণ, মনে হচ্ছে গাছে পাকা আম ঝুলে আছে আর আপনি বলছেন আমটা পেরে দিতে । যদি সত্যি আপনার আগ্রহ থাকে তাহলে আমাকে ২ ঘন্টা সময় দিতে হবে আর মিষ্টি, দই, পান-সুপারি, জ্যান্ত মুরগী একটা অথবা মুরগীর পরিবর্তে দুইটা জ্যান্ত কবুতর বলি দিতে হবে ভুতবাবার সামনে”
-এত কিছু কেন” আমি জিজ্বেস করলাম ।
-ওনারা মেহমান । আমার বাসায় আসলে ওনাদের সমাদর না করলে পরের বার ডাকলেও আর আসবে না, তাই ।
যাই হোক আমাকে আজ ভুতের সাথে সাক্ষাৎ নিতেই হবে । বাজার থেকে সব কিছু কিনে দিলাম সুশীলবাবুকে । যথারীতি ৩ ঘন্টা পর সন্ধ্যায় সুশীলবাবুর বাসায় আমি ও আমার এক চাচাতো ভাইকে সাথে নিয়ে হাজির হলাম । সাথে কলম ও ডায়েরী, ভুত বাবার সাক্ষাৎ নেয়ার জন্য । সুশীলবাবু ধ্যানে বসে অনেক মন্ত্র পড়লেন, প্রায় ১ ঘন্টা মত হবে । ১ ঘন্টা পর ঘরের সব আলো নিভে গেল । ঘরের বাতাস ভারী হয়ে এল । সুশীলবাবু একটা মোমবাতিতে আগুন ধরিয়ে আমাদের সামনে রাখলেন । এক পাশে আমি, আমার চাচাতো ভাই অন্য পাশে সুশীলবাবু ও জনৈক ভুতবাবা । ভুতবাবাকে অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । তবে সুঠাম দেহের লম্বা বাবরি চুলের একজন ঠিক বোঝা যাচ্ছে । লম্বা লম্বা হাত পা, ভরাট কন্ঠে ভুতবাবা জিজ্বেস করলেন “আমাকে ডেকেছিস কেন?” আমি বললাম, “জ্বি আপনার একটা ছোট সাক্ষাতকার নেয়ার জন্যে, যদি বেয়াদবি না হয়, খুব বেশিক্ষণ লাগবে না । ভুতবাবা মনে হল ফিসফিস করে সুশীলবাবুর কানে কানে কি যেন বলছেন । সুশীলবাবু বললেন “ঠিক আছে বাবাজী বেশিক্ষণ সময় দিতে পারবেন না , উনার একটা প্রোগ্রাম আছে” । আমি বললাম “না বেশিক্ষণ লাগবে না এই ধরেন ২০ কি ২৫ মিনিট, আমি আগে থেকেই প্রশ্ন লিখে এনেছি” ।
আমি আমার সাক্ষাতকার নেয়া শুরু করলাম । পাঠকের সুবিধার্তে সাক্ষাতকারটি হুবুহু তুলে ধরা হলঃ
জনৈক ভুতবাবার সাক্ষাতকার
সাক্ষাৎ গ্রহনকারী: সাকি বিল্লাহ্
সার্বিক সহযোগীতা ও ভুতবাবার সাথে সাক্ষাতের জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ: সুশীলবাবুকে ।
-আপনাকে আমরা কি বলে ডাকবো?
-আমাকে তোমরা ভুতবাবা বলে বা বাবাজী বলে ডাকতে পারো ।
-আমরা কি আপনাকে সালাম দিব নাকি নমষ্কার দিব?
-ভুতদের আসলে কোন ধর্ম নাই, দুনিয়ার সব ভুত পরস্পর ভাই ভাই । তবে মানুষের যেহেতু ধর্ম আছে তাই যার যে ধর্ম সেই অনুযায়ী ডাকতে পারো । যেমন হিন্দু হলে নমস্কার, মুসলমান হলে সালাম দিতে পারো ।
-আসসালামু ওয়া আলাইকুম
-ওয়া আলাইকুম আসসালাম
-আপনার সম্পূর্ণ নাম কি ?
-হা---হা----, ভুতদের কোনো নাম থাকে না, আমাদের বিভিন্ন জাত রয়েছে, যেমন মেছো ভুত, সরষে ভুত, কানা ভুত, মাথাকাটা ভুত, শাকচুন্নী ভুত, পেত্নী ভুত । তবে আমরা নামের জন্য ভুত প্রোটোকল ব্যাবহার করি, যেমন ধরো, ছোটভুত, মাঝারিভুত, বড়ভুত, আবার নীলভুত, লালভুত, কালো বা সাদাভুত, সব কিছু হিসেব করে আমাদের একটা ইউনিক আইডি দেয়া হয় । যেমন ধরো আমার আইডিঃ ভুতভুতং-সাদা-মাঝারি-গ-০১৭০ এটা আমাদের ভুত কল্যাণ সংস্থা থেকে দিয়ে দেয় ।
-খুবই সুন্দর নিয়ম । নামেই সব কিছু বোঝা যাচ্ছে ।
-হ্যাঁ । আমাদের বিশ্বকবি “ভুতকবিং-বড়-সাদা-র-০১৯০” তাই বলেছেন, “বৃক্ষ তোমার ফল কি নামে পরিচয়”
-কথাটা মনে হচ্ছে রবি ঠাকুরের কিন্তু কেমন একটু উল্টো পাল্টা লাগছে ।
-কথাতো উল্টোপাল্টা লাগবেই কারন এটা ওনারই লেখা বানী । কিন্তু উনি মরে ভুত হওয়ার পর ওনার নাম দেয়া হয়েছে “ভুতকবিং-বড়-সাদা-র-০১৯০” আর উনি ভুত হওয়ার পর থেকে কবিতা ও বাণীতে কিছু পরিবর্তন এনেছেন ।
-হুম্ । যাই হোক আপনার মাতাপিতার পরিচয়?
-মাতা ভুত হয়েছেন গত বছর কিন্তু পিতা এখনও জীবিত তাই ভুত হওয়ার ১নং শর্ত উনি এখনও পূরণ করতে পারেননি । তাছাড়া ভুত হওয়ার বেশ কিছু শর্ত আছে । এগুলো মানতে পারলে ভুত হওয়া যায় ।
-শর্তগুলো কি ব্যাখ্যা করা যাবে, দেশ ও জাতির ভবিষ্যত ভুতদের কথা চিন্তা করে ?
-আলবৎ যায় । আমাদের সংখ্যা বাড়াতে আমি যেকোন কাজ করত আগ্রহী । প্রধান প্রধান শর্তগুলো হচ্ছে একজন ভুত হতে হলেঃ
১/ যেকোনো মারাত্বক দুর্ঘটনায় মৃত হতে হবে মানে স্পট ডেথ ।
২/ হত্যা, গুমখুন হলে তার ১ বছর পর প্রাথমিক ভুত হিসেবে আবেদন করতে পারবে ।
৩/ নিবন্ধিত ভর্তি ফরম পূরণ করে ভুত সংগঠনের সদস্য হতে হবে ।
৪/ কমপক্ষে ১৫-২০ জন মানুষকে ভয় দেখাইয়া প্যান্টে বা কাপড়ে ইয়ে সারাইতে পারিলে ।
৫/ সামু ব্লগের নিয়মিত পাঠক হিসেবে পুরস্কৃত হইলে ।
ইত্যাদি..ইত্যাদি.....
-শর্তগুলো মানা খুবই কঠিন ব্যাপার । যাই হোক আপনার প্রিয় ফল?
-মাকালফল ।
-প্রিয় ফুল?
-সরষেফুল
-প্রিয় খাবার?
-চাঁদের আলোর সাথে কাঁচা ইলিশ মাছ ।
-প্রিয় রং?
-কালো, নিকষ কলো [হে...হে....]
-হাসলেন যে, কারন কি?
-হে.....হে... কালো ঘুট ঘুটে অন্ধকারেইতো মানুষদের বেশি ভয় দেখানো যায়, তাই ।
-হুম্--, প্রিয় ব্যক্তিত্ব?
-ঠাকুমা ।
-যদি কিছু মনে না করেন, ঠাকুমা আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব কেন?
-কারন উনিই প্রথম আমাদের নিয়ে গল্প লিখেছেন “ঠাকুমার ঝুলি” ।
-বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ভুতের সংখ্যা কত?
-এটা বলা খুবই কঠিন কারন প্রতিদিন যে হারে মানুষ গুমখন হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে তাতে সংখ্যা বেড়েই চলছে । তবে সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে, ....হুম....ভুতভুতং...ভুতভুতং....প্রায় ৫১৯৮১৮২০ জন ভুত রয়েছেন ।
-খুবই ভয়ের কথা । এভাবে ভুত বাড়তে থাকলে এক সময় বাংলাদেশে শুধু ভুতেরা বাস করবে আর মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
-তোমার আরো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো । আমার তাড়া আছে । ভুত কল্যাণ সমিতির একটা অনুষ্ঠান আছে “ভুতনৃত্য” বেলী ড্যান্স, শেওড়া গাছের মগডালে । আমাকে সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে ওরা ইনভাইট করেছে ।
-আমি আপনাকে আর বেশিক্ষণ ধরে রাখবো না । শেষ দু-তিনটে প্রশ্ন, আপনাদের মানে ভুতদের দিনের বেলায় দেখা যায় না কেন?
-দিনের বেলায় আমরা ঘুমাই আর রাতের বেলায় কাজ করি কারন আমরা নিশাচর প্রাণী, তবে কিছু কিছু ভুত আছে যারা ওভার টাইম মানে দিনের বেলাতেও কাজ করে ।
-বুঝতে পেরেছি । আচ্ছা মানুষদের ভয় দেখিয়ে আপনাদের কি লাভ? মানুষ ও ভুত কি বন্ধু হতে পারে না?
-(উত্তেজিত হয়ে) না-আলবত না, ভুত ও মানুষ কখনও বন্ধু হতে দেয়া যায় না । তবে ইদানিং কিছু বাজে ভুত, যারা ভুত নামের কলঙ্ক, মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করছে যা কিনা ভুত এর অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরুপ, এটা ঠিক না । ভেবে দেখো মানুষই আমাদের ভুত বানিয়েছে, তারপর আবার কিছু কিছু সন্নাসী ও কবিরাজগণ আমাদের বোতলে ভরে রাখতেও দিধা করে না । সেই মানুষ তো আমাদের বন্ধু হতে পারে না । আমি যাচ্ছি অন্য একদিন হয়ত দেখা হবে । বিদায় বৎস ।
মনে হল ভুতবাবা খুবই রাগ করেছেন এ ধরনের প্রশ্ন করাতে । তিনি তড়িঘড়ি করে চলে গেলেন, মোমবাতি নিভে গেল । সুশীলবাবু এবার হ্যারিকেন জ্বালালেন । বাইরে বৃষ্টি হবে হয়ত । চারদিকে নিঝুম অন্ধকার । বাড়ীতে চলে আসছি, রাস্তা এগিয়ে দিচ্ছেন সুশীলবাবু, তার হাতে হ্যারিকেন । বাড়ীর প্রায় কাছাকছি চলে এসেছি, সামনে পুকুরপাড়ের উল্টো দিকে একটা শেওড়া গাছ চোখে পড়ল । হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানিতে এক ঝলক আলোয় মনে হল শেওড়া গাছের মগডালে একঝাক ভুত নৃত্য করছে, বেলী ড্যান্স, চারদিকে অনেক ভুতেরা বসে তা দেখছে আর মধ্যিখানে বসে আছেন প্রধান অতিথি জনাব ভুতবাবা ।