২রা জুলাই ১৭৫৭ সালে সিরাজ উদ্দোলা শহীদ হন ।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের একটা দোষ আছে; যেমন ধরুন, রাজনীতি করে কি হবে, আমি বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘৃনা করি । অথবা দেখা যাবে কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে আর বেশিরভাগ মানুষই মজা দেখছে আর বলছে অহেতুক আন্দোলন করে লাভ কি ? কিন্তু এ দেশের রাজনীতির পটভূমি পরিবর্তনে যে সে নিজেও জড়িত তা হয়ত বুঝতে দেরী হয় যখন উদোরপিন্ডি বুদোর ঘাড়ে এসে চাপে তখন ।
উপরে শহীদ নবাবের মৃত্যু তারিখ স্মরন করার কারন হল গত ২৩শে জুন ও এ মাসের ১৯শে জুলাই আমাদের সিরাজ পরিষদের দুটো প্রোগ্রাম হয় । এ ধরনের প্রোগ্রাম আগেও করেছি আমরা কিন্তু কিছু ফেবু ইউজার ও বন্ধুবান্ধব (বিশেষত মীর জাফর ভক্ত) নবাবের ব্যাপারে কটু মন্তব্য করেন যা একান্ত কাম্য নয় ।
১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন যে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাতে আমাদের নবাব কিছুতেই পরাজিতত হত না যদি না তার প্রধান তিনজন সেনাপতি বিশ্বাসঘাতকতা না করত ।
যদি ছোট একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরি তাহলে বিষয়টা পাঠকদের কাছে আরো পরিস্কার হবে বলে আশা রাখি ।
ইংরেজদের প্রধান ছিলেন লর্ড ক্লাইভ ও তার অনুগত সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে, মেজর কিলপেট্রিক, মেজর গ্রান্ট, মেজর আইরে কোট, ক্যাপ্টেন গপ ।
অন্যদিকে আমাদের পক্ষে প্রধান ছিলেন নবাব সিরাজ উদ দোলা ও তার সেনাপতিগণ যথাক্রমে, মোহনলাল, মীর মদন, মীর জাফর আলী খান(বিশ্বাসঘাতক), ইয়ার লতিফ খান(বিশ্বাসঘাতক), রায় র্দুলভ(বিশ্বাসঘাতক) এবং ফরাসী সেনাপতি মসিযেঁর সিনফ্রে বা মসিয়েঁর ডি সেন্ট ফ্রেইজ(সত্যিকারের সাহসী বিদেশী বন্ধু) ।
এবার আসুন পদাতিক, অম্বারোহী ও ভারী অস্ত্র এর পরিসংখ্যান দেখা যাকঃ
ইংরেজদের পক্ষে, ৭৫০ জন ইংরেজ সৈন্য ও ২১০০ জন্ ভারতীয় (বিশেষত নেপালি গোরখা)সৈন্য মোট ২৮৫০ জন পদাতিক সৈন্য ছিল । ১০০ জন গোলন্দাজ ও ১০০জন ভারতীয় পর্তুগীজ বা টোপাজ(টোপাজঃ যাদের পূর্বপুরুষ পর্তগাল থেকে এসেছিল) । আর মোট কামান ছিল ১০টি ।
এবার আসুন বাংলা বিহার উড়িষ্যার তথা আমাদের পক্ষে কি ছিল, আমাদের শহীদ নবাব সিরাজ উদ দোলার পক্ষে যারা যারা সেনাপতি ছিলেন তাদের সবারই স্বাধীন সৈন্যবাহিনী ছিল । তন্মধ্যে, নবাবের ছিল ৭ হাজার পদাতিক, ৫ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, মীর জাফরের ছিল ৩৫ হাজার পদাতিক ও ১৫ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য । ফরাসী সিনফ্রের ছিল ৫০টি ভারী কামান ও সেগুলো নিয়ন্ত্রনের জন্য সৈন্য । আমাদের পক্ষে মোট কামান বা তোপ ছিল ১০৩টি(৫৩টি নবাবের ও ৫০টি ফরাসীদের)। মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ৬২ হাজারের বেশি ।
যেখানে ইংরেজদের মাত্র ২৮৫০ জন সৈন্য সেখানে আমাদের ছিল ৬২, ০০০(বাষট্টি হাজার) সৈন্য [ যা কিনা প্রায় ২১ গুন বেশি ছিল ইংরেজদের থেকে ], তাহলে আমাদের প্রিয় নবাবের পরাজয়ের কারন কি ছিল । খুব কমন এবং সহজ একটি প্রশ্ন; কমবেশি সবাই আমরা এর উত্তরটা জানি । তিনজন বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি, মীর জাফর, রায় দুর্লভ ও ইয়ার লতিফের বেঈমানীর কারনে আমাদের পরাজয় বরন করতে হয় ।
মীর জাফর শুধু বিশাল বাহিনী নিয়ে চুপচাপ দাড়িয়েই থাকেনি বরং সে ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল । বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে যা জানা যায় মীর জাফর নবাবের বহু সংখ্যাক সৈন্যকে হত্যা করেছিল সেই পলাশীর যুদ্ধের সময় । একটা মানুষ কতটা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে তা মীর জাফরকে না দেখলে আসলে ধারনা করা যায় না । বৃস্টি শুরু হলে মীর জাফর কামান ও কামানের গোলাকে ইচ্ছাকৃতভাবেই বৃস্টির পানি হতে রক্ষা করেনি যার কারনে নবাবের বেশিরভাগ কামানই কাজ করেনি ।
অন্যদিকে ফরাসী সেনাপতি সিনফ্রে নবাবের পক্ষে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন ।
মীর জাফর, ইয়ার লতিফ কোরান শরীফ ছুয়েঁ শপথ করেও বেইমানী করেন আর রায় র্দুলভও হিন্দু ধর্মীয় পবিত্র গ্রন্থ ছুয়েঁ শপথ করে বিশ্বাসঘাতকা করেন ।
যুদ্ধের পরাজয়ের পর অনেক মানুষ নির্বীকার ছিল । এখনকার মত তারাও বলেছিল নবাব হেরেছে তো আমাদের কি হয়েছে ! আমরা রাজনীতি বুঝি না বুঝতে চাইও না । ভাগ্যের কি নিমর্ম পরিহাস, আমাদের মত সেই সাধারন মানুষ গুলোই কিন্তু সবচেয়ে বেশি নির্যাতন ভোগ করেছে ইংরেজ আমলে । মীর জাফরের মত লোকেরা ছিল শান্তিতে । তবে পাপের জন্মদাতাকে তার নিজের পাপ এর শাস্তিভোগ করেই মরতে হয় । মীর জাফরের সে শান্তি বেশিদিন টিকেনি ।
ইংরেজদের সে সময় অনেকে ভগবান হিসেবে দেখেছিল, বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গণ । তাদের ধারনা ছিল ইংরেজরা তাদের ত্রানকর্তা ঠিক এখনও কিছু মানুষ আছে যারা ইংরেজদের ত্রানর্তাভাবে ।
ইংরেজদের ভগবান ভাবতে যাদের দ্বিধা হয় না তাদের কাছ থেকে যেমন স্বদেশপ্রেম আশা করা যায় না ঠিক তেমনি তাদের পরিণতিও হয় খুবই মর্মান্তিক । ঘসেটি বেগম যে কিনা নবাবের খালা ছিল এবং পলাশী যুদ্ধ ও ইংরেজদের ১৯০ বছর এ দেশকে উপঢোকন দেয়ার অন্যতম খলনায়িকা, তার পরিনতি ছিল মীর জাফরের ছেলে মীর মীরনের নির্দেশে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবিয়ে হত্যা করা ।
এদেশের অনেক ব্যাবসায়ীরা ব্যাবসায় লাভবান হবে আশা করে তখন মীর জাফর আর ঘসেটি বেগমকে সাহায্য করেছিল যাতে ইংরেজরা জয়ী হয় । তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল, জগত শেঠ ও উমিচাঁদ ।
এখনও অনেক ব্যাবসায়ী আছেন যারা এমনটাই ভাবেন কিন্তু তাদের অনেককেই ব্যাবসা বন্ধ করে দিতে হয়েছে মীর জাফর এর মত সরকারের কারনে ।
অনেকেই বিদেশী পন্য ভালবাসে । মোবাইল কিনতে গেলে স্যামসাংই কিনব কারন সিম্ফনি বা ওয়ালটন তো বিদেশ থেকে পার্টস কিনে নিয়ে আসে শুধু এখানে একসাথে জুড়ে দেয় মাত্র । অথচ পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের অনেক পন্যও প্রথম দিকে এরকমই ছিল, বাহির থেকে এনে নিজেদের বলে চালিয়ে দিত; কিন্তু ভারতীয়দের দেশপ্রেম আছে তাই তারা আজ এত উন্নত ।
আমার এলাকার এক বড় ভাই ভারত থেকে তৈরী পোষাক এনে বাংলাদেশে সাপ্লাই দেন বিভিন্ন শোরুমে । একবার তিনি ভাবলেন এভাবে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খোয়া যাচ্ছে তাই তিনি পরের বার কিছু বাংলাদেশী টিশার্ট নিয়ে গেলেন । যাদের কাছ থেকে তিনি কেনাকাটা করেন (কোলকাতা ও বোম্বের পোষাক ব্যাবসায়ী) তাদের এ টিশার্টগুলো দেখালেন আর বললেন যে কিনবে কিনা । উক্ত ব্যাবসায়ীর সবাই আমাদের দেশী পন্যটি হাতে নিয়ে পরখ করে দেখল, হ্যাঁ খুবই ভাল উন্নত মানের, ভারতীয় যে কোন টিশার্টের চাইতে উন্নতমানের কিন্তু উত্তর শুনে বড় ভাই চমকে গেলেন । ব্যাবসায়ীর উত্তরঃ “ভাই আপনাদের কাপড়, টিশার্ট অনেক টেকসই আর উন্নতমানের কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে এগুলো আমাদের আছে । মানে আমাদের তো টি শার্ট আছে, হোক সেটা নিম্নমানের কিন্তু আছে তো । যে জিনিসটা আমাদের আছে সেটা কেন আমি বিদেশীটা কিনব?”
আমার এলাকার বড় ভাই উত্তর শুনে ‘থ’ হয়ে গেলেন । তিনি এখন ভারতীয় পন্য আনা কমিয়ে দিয়েছেন । বিশেষত কিছু পন্য যেগুলো বাংলাদেশে নেই সেই পন্য গুলো মাঝে মাঝে আনেন । তিনি আশাবাদী অদূর ভবিষ্যতে হয়ত ৯০ ভাগ পন্যই আর আমাদের বিদেশ থেকে আনতে হবে না ।
আমিও সেই আশাই করি । আমরা এখন খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ, বস্ত্র আর শিক্ষাকেও স্বয়ংসম্পূর্ন বলা যায় । আরো অনেক সেক্টর আছে যেগুলোতে আমরা বিদেশী সাহায্য না নিলেও চলে যাবে । এখন শুধু দরকার তাবেদারী আর দালালী বেহায়া পনা মন থেকে মুছে ফেলা তবেই তো নবাব এর স্বপ্ন সফল হবে আর শান্তি পাবে আমাদের পূর্বপুরুষ দেশপ্রেমিকদের আত্মা । আর যদি হাফপ্যান্ট পড়া ভদ্রলোক হয়ে থাকতে পছন্দ করেন তাহলে তো আর বলার কিছু নাই । শুধু বলব, কবে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?