ঘটনা এমন ভয়ংকর রূপ নিতে পারে সেটা কল্পণাতেও ছিল না কাদির আলী মেম্বারের। জীবনের অনেক সময় যার অপরাধ করেই কেটেছে তার জন্য পাবলিকের রোষানল নতুন কিছু না। শেষবার এমন ঘটেছিল ৩০ বছর আগে শান্তিগঞ্জ বাজারে, প্রতিপক্ষ ফাঁসীয়ে দিয়ে হাটের লোক দিয়ে পিটিয়ে মারার ফন্দি করে কুখ্যাত কাদু ডাকাতকে, কোনমতে বাজারের পাশের নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে জানটা বাঁচায়।
কিন্তু বুদ্ধিমান কাদু’র এভাবে খুব বেশীদিন পুলিশ আর মানুষের তাড়া খেয়ে বেঁচে থাকাটা খুব পছন্দের ছিল না আর ততদিনে পাপের কামাইও ভালোই জমিয়ে ফেলেছে গোপনে। অনেক কৌশল খাটিয়ে শেষে এই পথ থেকে বের হতে পারে একদিন। পরবর্তী ২০ বছর ধরে সে অনেক চেষ্টা চালিয়েছে তার নামের কুখ্যাতি মোচন করতে। প্রথমে সে হয়েছে গ্রামের উপকারী মানুষ কাদির আলী ভাই, এজন্য অল্প-বিস্তর পয়সা কড়িও খরচ করতে হয়েছিল মানুষের মন পেতে।
সৌভাগ্যক্রমে গ্রামের মানুষকে খুব অল্পতেই তুষ্ট করা যায়, একবার সাহায্য করলে তখন আর অতীতের সাত খুনের কথা কেউ মনে রাখে না। আর কাদিরের পৈশাচিকতার কথা গ্রামের খুব বেশী মানুষও জানতো না, এখনের নামাজী, টুপি-দাঁড়িওলা কাদির আলীকে কেউ কাদু ডাকাত হিসেবে চিন্তা করলেও মনে মনে অনুশোচনায় ভুগতে হবে।
এদিকে কাদির আলীর এই বাড়তি খরচ তুলে আনতেও খুব একটা বেগ পেতে হয়নি, গত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে বিরামপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের জনপ্রিয় নির্বাচিত মেম্বারের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মেম্বার হওয়ার আগে যা সহায় সম্পত্তি ছিল এখন সেটা দ্বিগুন হয়ে গেছে, দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে মেয়েরাও ঢাকাতে থেকে পড়াশোনা করছে। জীবনের হিসেব মিলিয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তার উপর খুবই তৃপ্ত কাদির মেম্বর; আর কেউ না জানলেও সে জানে আসলে তার কোন মুক্তি নেই, সব পাপের মুক্তি মেলে না। নামাজ পড়লেও আর নিজের জন্য মাফ চায় না সে, অনেক চেয়েছে কিন্তু লাভ হয়নি, তারা জানিয়ে দিয়েছে মাফ আর সে পাবে না। তাই দুনিয়ার সুখ দেখেই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করে!!
সমস্যার শুরু আছরের ওয়াক্তের পর। জয়নাল আর হাশেম গাজী একসাথে এসেই খবরটা দিল তাকে; গাঁয়ের সবার মাঝে এরা দুজনই মেম্বারের নিজস্ব লোক বলে পরিচিত। মানুষ পিছনে এদের খারাপ কথাই বলে, তবে নানা কাজের কাজী এই দুজনই মেম্বারের সব ঝামেলার কাজগুলো সামাল দেয়। বয়সে জয়নালের তুলনায় হাশেম গাজী বেশ বড়, অভিজ্ঞতায়ও বেশী। ঘটনাটা হচ্ছে বদর মাঝির বিধবা বৌ ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে দুই সন্তানসহ গলায় ফাঁস নিয়েছে। গৃহকর্তা রোগে ভোগে মারা যাবার পর দুই সন্তানকে নিয়ে পথেই বসতে হয় মহিলাকে। একবার কাদির মেম্বার শুনেছিল এদের কথা, যতোদূর মনে পড়ছে তার, জয়নালকে বলেও দিয়েছিলেন কিছু চাল দিতে। দিয়েছিল কি না কে জানে! জয়নালের পক্ষে কবর থেকে লাশ তুলেও ত্রাণের খাতায় টিপসই আনা সম্ভব, আর এই লাশ তো ঝুলছে এখনো।
জয়নালের কথা বার্তায় তেমন উৎকণ্ঠার ছাপ নেই, তার ভাষ্য মতে কাদির আলী মেম্বারকে দেখলেই মানুষ ঠান্ডা হয়ে যাবে। দাফনের খরচ মেম্বার দিবে বললেই এইসব ঘটনায় মানুষের রাগ শেষ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষ লাশ নিয়ে আন্দোলন করে না, তাদের তাড়াহুড়ো থাকে দাফন নিয়ে। পুলিশ, সাংবাদিক আসার আগেই তাদের আপোষে নিয়ে আসা ভালো হবে। হাশেম নীচু গলায় তার মত দিল পানি একটু বেশী গড়ালেও পুলিশ সাথে নিয়ে যাওয়াই উচিত হবে। নিজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় ক্ষুধার্ত মানুষের ক্রোধ সে অনেক দেখেছে এই দেশের মাটিতে, কিন্তু জয়নাল পরে খোঁচা দিবে চিন্তা করে সেটা আর বললো না। আর কি মনে করে কাদির মেম্বারেরও জয়নালের কথাটাই বেশী পছন্দ হলো! দুজনকে সাথে নিয়ে পতিত সীসাগড়ের ভিটার কাছে হাজির হলেন, এই নির্জন প্রান্তরের এক কোণেই থাকার জন্য একটা ঝুপড়ি তুলেছিল মহিলা। অবাক হয়ে দেখলেন ইতিমধ্যে শ’খানেক মানুষও চলে এসেছে।
এরপরের ঘটনা খুব দ্রুত কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘটে যায়। জয়নাল কাদির মেম্বারকে প্রায় বগলদাবা করে নদীর ধারের বন লক্ষ্য করে তীব্র ছুট লাগায়, কাদির মেম্বার যেন হাওয়ায় উড়ে পার হয়ে যায় মাইল খানেক। এদিকে হাশেম গাজীকে পুলিশ আসার আগেই চারপাশ থেকে ঘেরাও করে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী।
কাদির মেম্বার এখনো হাশেমের মৃত্যুর খবর পাননি, জানতে পারেননি তার বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।এই মুহূর্তে নিজ গ্রামের পাশেই জয়নালের শ্বশুরবাড়ির এলাকায় এক মাঝারি সাইজের, পুরানো বাঁশের বেড়ার ঘরে অন্ধকারের মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে বসে আছেন। বেড়া বাঁশের হলেও চালায় তিরপল দিয়ে বৃষ্টির পানি আটকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে; ঘরে রাখা শ’খানেক চালের বস্তা যেন ভিজে না যায় সেজন্যই এতো সতর্কতা। জয়নালকে এই চুরির সুযোগ তিনিই দিয়েছিলেন কিন্তু মাত্রাটা জানা ছিল না। ঘরে কোন চেয়ার নেই, এখন একটা চালের বস্তার উপরেই বসে আছেন স্থির হয়ে।
তাকে অন্ধকারে বসিয়ে জয়নাল গিয়েছে বাহিরের খবর আনতে। অসম্ভব সাহসী মানুষ কাদির আলীর অন্ধকারে কোন ভয় নেই, ভয়কে নিয়েই বাস করতে শিখেছেন বহু আগেই। তারপরেও যখন আজিজ মাঝিকে দেখতে পেলেন একটা অশুভ আতংক অনুভব না করে পারলেন না। সেই একই বিষ্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। কাদু ডাকাতের তৃতীয় ডাকাতির মাল লুকিয়ে রেখেছিল রসুই খালের পাড়ে, খুন না হলেও বেশ রক্ত ঝরাতে হয়েছিল এই ডাকাতি করতে গিয়ে। আজিজ মাছ ধরতে গিয়ে সেই মালের সন্ধান পেয়ে পুলিশকে জানিয়ে দেয়, ঘুণাক্ষরেও জানতো না এর পরিণাম। তাকে মাথায় বাড়ি মেরে যখন গলা টিপে ধরেছিল একটুও বাঁধা দেয়নি কাদিরকে; কোন যন্ত্রণা ছিল না, এক রাশ বিষ্ময় নিয়েই চোখ খোলা রেখে মারা যায় আজিজ। এরপর অনেক রাতেই আজিজকে আবিষ্কার করেছেন সেই দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে কিন্তু কোন ক্ষতি করেনি, তিনিও কাউকে বুঝতে দেননি আজিজের উপস্থিতি।
আজিজ যেহেতু এসেছে শান্তিগঞ্জ বাজারের সোহাগীও নিশ্চিত আসবে। তার অপরাধ কাদুকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিল সে, গোপনে কাদুর সন্তানও ধারণ করেছিল। দূর থেকে নূপুরের শব্দ ভেসে আসছে, যা সোহাগীর মৃত্যুর পর কাদির আলী ছাড়া কেউ শুনেনি। সাহস করে সোহাগীর নূপুর পড়া পা চেপে ধরেছিলেন একবার , লাভ হয়নি বরং তীব্র জ্বরে ভুগেছিলেন, আর কখনো ইচ্ছা বা সাহস করেননি। কিন্তু এরা তো বাড়ির বাহিরে দেখা দেয় না অনেক বছর তবে আজ জয়নালের শ্বশুর বাড়ির গ্রামে কেন উপস্থিত হচ্ছে??
হঠাৎ খেয়াল করলেন তার পাশেই চালের বস্তার উপর কোন শব্দ ছাড়াই নতুন কারা যেন এসে বসেছে। একবার তাকানোর পর বলে দিতে হলো না এরা আজকেই আত্মহত্যা করা বদর মাঝির বিধবা স্ত্রী এবং দুই সন্তান। মাথা নীচু করে লোভাতুর দৃষ্টিতে চালের বস্তার দিকে তাকিয়ে আছে তারা, সবার গলাতেই ফাঁসের কালো দাগ স্পষ্ট। হঠাৎ মহিলাটি সজোরে টান দিয়ে একটি বস্তা ছিঁড়ে ফেলতেই ভেতর থেকে ঝুরঝুর করে চাল পড়তে লাগলো। আর ছোট দুই বাচ্চা মুঠোতে নিয়ে চাল খেতে লাগলো, শক্ত চাল চাবানোর কটমট শব্দ হচ্ছে। এতোক্ষণে তারা যেন কাদির মেম্বারের দিকে নজর দেওয়ার ফুসরত পেল, দুই হাতের মুঠোতে চাল নিয়ে বাচ্চাদুটো হাত বাড়িয়ে দিল তার মুখের দিকে। কেন জানি কাদিরের মনে হলো তাদের মায়ের মুখে দুঃখের মাঝেও একটা প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।
গভীর রাতে জয়নাল ঘরে এসে কাদির মেম্বারকে মৃত পেয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন পুলিশ প্রচুর চালের বস্তার মাঝে কাদির মেম্বারের লাশ খুঁজে পায় এবং হত্যার অভিযোগে জয়নালকে খুঁজছে তারা এখন। বড়ই অদ্ভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে কাদির মেম্বারকে, তার খাদ্যনালী, শ্বাসনালী পর্যন্ত শক্ত চালের দলা দিয়ে ঠাসা, হাঁ হয়ে থাকা মুখে, নাকে শুধু চাল দিয়ে ভর্তি। কিন্তু কোনরূপ ধস্তাধস্তির প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তার চোখগুলো খোলা ছিল এবং অনেকের মতে সেই দৃষ্টি ছিল পিশাচের দৃষ্টির মতোই ভয়ংকর।