শেষ পোস্ট দেওয়ার প্রায় ৫ বছর হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই পুরানোরা অনেকেই নেই, যে ক’জন আছেন তাদেরও হয়তো এই চান্দুকে মনে করতে কষ্ট হবে। মূলত ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করতাম আর টুকটাক রাজনীতি করতাম, এই ছিল ব্লগিং।
অনেকদিন পর সেই পুরানো ইতিহাস নিয়েই একটু বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা হলো। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পরবর্তী ইসলামের রাজনীতি-দ্বন্দ্ব এবং আরও কিছু জানা-অজানা বিষয় যথাসম্ভব ইতিহাসবিদ, গবেষকদের দৃষ্টিকোন থেকেই কিছু নির্মোহ ইতিহাস তুলে ধরার প্রচেষ্টা।
পুরোটা পড়তে কষ্ট হবে জানি, ধীরে ধীরে পড়বেন। কোন প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞাসা করবেন।
ঘাদির ডোবা রহস্য
চিত্রঃ ঘাদির খুম
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এক অমীমাংসিত, সাংঘর্ষিক একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট ৬৩২ সালের হজ্ব পরবর্তী এই ঘাদির খুম তথা ঘাদির কুয়ার ঘটনাবলী। মূলত এ সম্পর্কিত যতো গৌরবোজ্জ্বল ব্যাখ্যা তা শিয়া সাহিত্যেই পাওয়া যায়। সুন্নি অধিকাংশ ইতিহাসে এই ঘটনা কোন বিশেষ গুরুত্ব ছাড়াই উল্লেখ করা করা হয়েছে মূলত শিয়া মতবাদের পাল্টা ইতিহাস হিসেবে,।
ঘটনাটি অনেকটি ছিল এরকম, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উনার বিদায় হজ্জ্ব শেষে মক্কা-মদীনার মাঝামাঝি 'ঘাদির খুম' নামক পুকুরের পাশে তাঁবু খাঁটিয়ে দূর দূরান্ত থেকে আসা হাজীদের বিদায় দিচ্ছিলেন। এমন সময় হযরত আলী (রাঃ) কে নিয়ে একটি বিবাদ শুরু হয়, সেসময় নবীজী বিবাদকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'সেই ব্যক্তি যে আমাকে মওলা হিসেবে মেনেছে, সে আলীকেও তার মওলা হিসেবে পেয়েছে'- সহীহঃ আল-আলবানী।
ঘাদির খুমের ঘটনাটির এতোটুকু সত্যতা উভয় পক্ষই মেনে নেয়। এখন দেখি শিয়াদের দাবীতে কি বলে? তাদের মতে বিদায় হজ্জ্বের পর নবীজীর উত্তরসূরি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপরের ঘিদার খুম সমনের মাধ্যমে হযরত আলীকে উনার পরবর্তীে প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করে করে যান।
প্রথমত শিয়ারা তাদের মতবাদের ন্যায্যতা দাবী করে ঘটনার সময়কাল বিবেচনা করে। সে সময় মক্কা-মদীনার বাহিরেও অনেক শক্তিশালী নেতা, গোত্র ইসলাম গ্রহণ করেছিল। নবীজী নিজেই শেষ হজ্ব ঘোষণা করায় উনার পরবর্তীতে ইসলামের নেতৃত্ব নিতে যেসব সাহাবীরা বিবেচিত ছিলেন তাদের মাঝে একটা কলহ সৃষ্টি হওয়াই ছিল স্বাভাবিক।
দ্বিতীয়ত হযরত আলী ৬৫৮ সালে কুফায় খিলাফত প্রতিষ্ঠার সময় তার দাবীর সমর্থনে নবীজীর এই ঘিদার খুমের উক্তিকে উল্লেখ করেই হযরত মুয়াবিয়ার উপর নিজের অধিকার দাবী করেন।
শিয়াদের আরেকটি প্রচারমতে ঘিদার খুম ঘটনার পরেই কোরআনের সর্বশেষ আয়াত সূরা আল মায়িদার তৃতীয় আয়াত নাজিল হয় “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম”। তাদের দাবীমতে এই আয়াত দ্বারা হযরত আলী’র খিলাফত মনোয়ন সম্পন্ন হওয়াকেই বুঝানো হয়েছে। এজন্য তারা ঈদ উল আজহার ৮ দিন পর ‘ঈদ উল ঘাদির’ নামে বছরে তাদের তৃতীয় ঈদ উদযাপন করে।
চিত্রঃ শিয়াদের দৃষ্টিতে ঘাদির খুম
অপরদিকে সুন্নি মতবাদের ইতিহাসবিদদের অনেকেই ঘটনাটি হয় উল্লেখই করেননি না হয় একেকজন একেকভাবে করে ঘটনাসমূহ পরস্পর থেকে অনেক ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর মাঝে ইবনে কাথিরের বর্ণনা থেকে অন্তত একটা ভিন্নধর্মী স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ‘হযরত আলীর প্রবল ন্যায় নিষ্ঠতা উনার নেতৃত্বে থাকা অনেক মুসলিম যোদ্ধার পছন্দ ছিল না। গণিমতের মালামাল দেদারছে নিজ সম্পত্তি হিসেবে ভোগ দখলে উনি বাঁধা দিতেন। এই যোদ্ধারাই হজ্ব শেষে নবীজীকে নালিশ জানালে উনি এই বক্তব্য দেন, যা শিয়ারা অতিরঞ্জিত করেছে’।
এই ঘটনার কোন চূড়ান্ত সমাধান ইতিহাস থেকে দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু দুই পক্ষে প্রচলিত অজস্র ধর্মীয় মতবাদের কোনটিই দুই পক্ষের জন্যই মেনে নেওয়ার মতো কিছু নয়, প্রায় সবগুলোই সাংঘর্ষিক এবং বিভক্তির উন্মোচন করে।
হযরত ফাতিমা রাঃ এর ঘরে হামলা
অনেকের ধারণা নবীজীর মৃত্যুর পর খিলাফত নিয়ে হযরত আবু বকর এবং হযরত আলী’র মাঝে প্রথম দ্বন্দ্ব হয়েছিল; সেই সাথে নবীজীর মৃত্যুর পর যেমন একটি শোক বিহ্বল মদীনা আমরা জেনে এসেছি, বাস্তবে ঠিক সেরকমটা ছিল না।
হযরত আয়েশার ঘরে নবীজীর মৃত্যুর পর শত শত সাহাবী এসে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে যান প্রিয় নবীর উদ্দেশ্যে। এরপরই মদীনার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পক্ষের সাহাবীরা জড়ো হতে থাকেন, আলোচনার বিষয়বস্তু পরবর্তী নেতা নির্বাচন। শুরু থেকেই মদীনায় অবস্থানরত মুসলমানদের দুটি পরিচয় ছিল মুহাজির এবং আনসার। সময়ের সাথে তাদের যেমন একাত্মতা হয়েছে আবার নেতৃত্বের প্রশ্নে দূরত্বও হয়েছে।
মদীনার আনসারদের নেতা সাদ ইবনে উবাদা এমন সময় তাদের গোত্রের সাকিফা/আদালতে আনসারদের নিয়ে জড়ো হন এবং নিজেকে খলিফা হিসেবে মনোয়নের জন্য জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। খবর পেয়ে হযরত আবু বকর, উমর, আবু উবাইদা সেখানে হাজির হয়ে প্রতিবাদ জানান এবং আনসার নেতা উবাদা ও হযরত উমরের মাঝে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায় বলেও কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়। এরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মাঝেই নবীজীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং সর্বজন সম্মানিত আবু বকর খলিফা হিসেবে মনোনীত হন। সাদ ইবনে উবাদা তখন মেনে নিলেও উমরের সাথে তার শত্রুতা কখনো অবসান হয়নি। পরে হযরত উমর খলিফা হলে পিছন থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে উবাদার মৃত্যু হয়। বিষাক্ত তীরের কারণে উবাদার শরীর সবুজ হয়ে যায়; সেসময় গুজব রটানো হয় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব কারণে জ্বীন তাকে হত্যা করেছে, এজন্য সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।
চিত্রঃ মদিনার 'খাজরাজ' গোত্রের আদালত বা সাকিফার বর্তমান দৃশ্য
এদিকে সাকিফায় যখন হযরত আবু বকর খলিফা মনোনীত হচ্ছিলেন তখন নবীজীর নিকটাত্মীয় হিসেবে হযরত আলী এবং হযরত আব্বাস মৃতদেহের গোসল করাচ্ছিলেন। যখন সাকিফার খবর তাদের নিকট পৌঁছায় তখন তারা নিজেদের বঞ্চিত, প্রতারিত ভেবে রুষ্ট হন। এসময় হযরত আলী উল্লেখ করেন, ‘যদি নবীজী’র কুরাইশ গোত্রের হবার কারণে মদীনার আনসারদের উপর আবু বকর রাঃ খলিফা মনোনীত হতে পারেন, তবে একই সূত্রে আহলে বাইত’ও বাকি কুরাইশদের উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার রাখে’। নবীজীর দাফন শেষে আলীর অনুসারীরা তার সাথে হযরত ফাতেমার ঘরের সামনে অবস্থান নেয়, তখনো তারা আবু বকরকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়নি। এই অবস্থায় আবু বকর হযরত উমর এবং খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রেরণ করেন আলীর সাথে বোঝাপড়া করার জন্য।
এরপরের ঘটনাবলী সুন্নি বর্ণনাতেই অনেকগুলো পাওয়া যায়। দুই একজন বাদে সবারই মতে আলীর সহচরেরা সেখানে হযরত উমরের দলের হাতে হামলার শিকার হন এমনকি ফাতেমা রাঃ এর বাড়ির ভিতরেও চড়াও হয় আক্রমণকারীরা। অবশ্য এরপরের কাহিনীতে শিয়া এবং সুন্নি বর্ণনায় যোজন যোজন দূরত্ব পাওয়া যায়। সেই সময় হযরত ফাতেমা রাঃ গর্ভবতী ছিলেন। শিয়াদের মতে কেউ একজন তার পেটে লাথি চালালে শিশুপুত্র মোহসীন গর্ভপাত হয়ে মারা যায়। অপরদিকে সুন্নি ভিত্তিক ইতিহাস মতে এরকম কিছু হয়নি, শিশু মোহসীন স্বাভাবিক অবস্থায় জন্ম নিয়ে বছর খানেক পরে শিশু অবস্থাতেই মারা যায়।
ফাদাকের জমি
জমি নিয়ে মামলা মোকদ্দমা, মারামারি তো প্রতিদিনই দেখেন সংবাদপত্রে। কেউ কি কখনো ভাবতে পারেন এরকম একটি জমি পাল্টে দিয়েছিল গোটা মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস? লজ্জাস্কর বলেই এড়িয়ে যাওয়া। অথচ বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে খলিফায়ে রাশিদুনের পরবর্তী তিন খিলাফতেরই পূর্বসূরীরা প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িত হয় এই জমিকে কেন্দ্র করেই।
চিত্রঃ ফাদাকের সেই জমি, যা একসময় আরও সবুজ, উর্বর ছিল
তো কি হয়েছিল এই ফাদাকে? ঘটনার শুরু নবীজী মদীনায় হিজরতে থাকাকালীন; মক্কার কুরাইশদের পাশাপাশি খায়বারের ধনী ইহুদী গোষ্ঠীর সাথেও মুসলমদের শত্রুতা শুরু হয়। মদীনা হতে ১৫২ কিলোমিটার উত্তরে খায়বারের অন্তর্গত উর্বর, পানি সমৃদ্ধ এক মরুদ্যানের নাম ফাদাক/ফিদাক। সেখানে স্থানীয় কিছু ইহুদী গোত্র বাস করতো, তাদের সাথে তখনো মুসলিমদের কোন ঝামেলা হয়নি। কিন্তু তারাও খায়বারের বড় গোত্রগুলোর সাথে যোগ দিতে যাচ্ছে খবর পেয়ে নবীজী হযরত আলীর নেতৃত্বে ১৫০০ যোদ্ধা পাঠালেন সেখানের ইহুদীদের নিরস্ত্র করতে। তারা ভয় পেয়ে শান্তিচুক্তি স্থাপন করে এবং বিনিময়ে ফাদাক মরুদ্যান নবীজীকে উপহার প্রদান করে। এর অল্পকিছু দিন পরেই কামুস দুর্গে হযরত আলীর সেই বিখ্যাত দরোজাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নেতৃত্ব দেওয়া যুদ্ধে খায়বারে ইহুদীদের চূড়ান্ত পতন হয়। এই যুদ্ধটা এই কারণে অধিক গুরুত্বপূর্ণ যে এর মাস দুয়েক আগে হওয়া হুদায়বিয়ার সন্ধিকে এই যুদ্ধের ফলাফলের কারণেই মক্কার কুরাইশরা সম্মান করতে বাধ্য হয়, ফলে মক্কা বিজয়কালীন বড় কোন ক্ষতি ছাড়াই কোরাইশ গোত্রকে অক্ষত রাখতে হযরত মুহাম্মদ সাঃ সফল হয়েছিলেন।
তো সেই ফাদাকের জমি নবী নিজ পারিবারিক কার্যে এবং উনার ব্যক্তিগত দান-সদকার উৎস হিসেবেই খরচ করতেন। যেহেতু হযরত ফাতিমার বড় দুই বোন মৃত্যুজনিত কারণে পর্যায়ক্রমে সম্পদশালী হযরত উসমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, এবং পাশাপাশি আলীর উত্তরে অসাধারণ বীরত্বের জন্য ফাদাকের উপর হযরত ফাতিমার দাবীটা বেশীই ছিল। এবং সম্ভবত! জীবিত অবস্থায় উনার পিতার থেকে এই জমির মালিকানাও বুঝে নেন।
সমস্যা দেখা দেয় নবীজীর মৃত্যুর পর, যখন হযরত আবু বকর খলিফা হবার পর ফাদাকে বসবাসরত এবং নবী পরিবারের আশ্রিতদের সেখান থেকে উৎখাত করেন। ফাদাকের জমিকে ইসলামী খিলাফতের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। এই বাকি অংশের বর্ণনাও শিয়া-সুন্নি সূত্র থেকে প্রায় একই রকম পাওয়া যায়; নিজ গৃহে আক্রমণে ক্ষুব্ধ ফাতিমা রাঃ সম্পূর্ণ হতাশ এবং ভেঙ্গে পড়েন ফাদাকের জমি দখলে। নবী পরবর্তী সময়ে নারীদের মসজিদে যাওয়া আসা ছিল না, ফাতিমা রাঃ অতি সন্তর্পণে সহচরীদের সাথে ঘোমটা টেনে আমিরুল মুমেনিনের দরবারে পর্দার আড়ালে উপস্থিত হন। ক্রন্দনরত অবস্থায় ফাতিমা তার আর্জি পেশ করেন, আবু বকর রাঃ শান্ত ভাষায় জানান নবীজীর কোন উত্তরাধিকার নেই।
এসময় তিনি স্বীয় কন্যা হযরত আয়েশা রাঃ বর্ণিত হাদীস থেকে উদ্ধৃত করেন, ‘আমাদের (রাসুলদের) কোন উত্তরাধিকার নেই, আমাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি সদকা হয়ে যাবে- সহীহ মুসলিম’। সেসময় হযরত উমরও খলিফাকে সমর্থন জানান। কিন্তু হযরত ফাতিমা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান, প্রথমে তিনি সাক্ষী হিসেবে হযরত আলী, এবং সন্তান হাসান-হোসেনের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু আবু বকর রাঃ তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন নিজ আত্মীয়ের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। তখন ফাতিমা রাঃ হযরত আয়েশার হাদীস অস্বীকার করে বলেন নবীজী এমন কোন বিধান দিলে তা সর্বাগ্রে উনার কন্যাকেই জানাতেন। পাশাপাশি তিনি পূর্ববর্তী নবী রাসূল যেমন হযরত দাউদ আঃ, সোলেমান আঃ, ইয়াকুব আঃ প্রমুখদের উদাহরণ দেন যারা উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব এবং সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু হযরত আবু বকর এবং উমর তা কিছুতেই মানলেন না। রাগে, দুঃখে হযরত ফাতিমা নিজ গৃহে ফিরে যান এবং কিছু সূত্র হতে জানা যায় তিনি মৃত্যুর পূর্বে আর হযরত আবু বকরের সাথে কথা বলেননি। এই ঘটনার মাস কয়েকের মাঝেই হযরত ফাতিমা রাঃ মারা যান এবং শিয়া তথ্যমতে ফাতিমা রাঃ চাননি উনার জানাজায় আবু বকর বা অন্যরা অংশ নিক। এজন্যই রাতের বেলা গোপন স্থানে দাফন করা হয়। ধারণা করা হয় অসংখ্য সাহাবী এবং নবী পরিবারের অন্যদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থান মদীনার জান্নাতুল বাকিরই কোন এক স্থানে গোপনে উনাকে সমাহিত করা হয়, যা প্রথমবার ওহাবী/প্রথম সৌদ স্টেট আমলে মাজার পুজা দূর করার উদ্দেশ্য হিসেবে অনেকাংশে ধ্বংস করা হয় এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় সৌদ স্টেট তথা বর্তমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা সৌদ ১৯২৫ সালে শুধুমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর কবর বাদে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন।
চিত্রঃ ১৯২৫ সালে ধ্বংসের পূর্বে 'জান্নাতুল বাকী' কবরস্থান
উপরের ঘটনাগুলোকে ধরা যায় পরবর্তী শত-সহস্র বছরের বিভাজনের প্রথম অঙ্কুর। ইতিহাসের সেই সময়গুলোতে আলোকপাত করতে আমরা এখন সরাসরি দ্বন্দ্বের ইতিহাসগুলো দেখবো যা ইতিহাসে প্রথম ফিতনা, দ্বিতীয় ফিতনা নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর এই ঘটনাবলীর মূল নায়ক হিসেবে আমার কাছে বিবেচ্য এবং অধিকতর আলোচনার দাবী রাখেন তারা হচ্ছেন হযরত আলী রাঃ, হযরত মুয়াবিয়া রাঃ এবং আল-মারওয়ান ইবনে আল হাকাম।
প্রথম দুজনের সর্ব পরিচিতির তুলনায় তৃতীয়জনের পরিচিতি অনেক কম, বয়সেও অনেক ছোট। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত ভূমিকা ব্যাপক, তাই তাকে বাদ দিয়ে ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না। মক্কার কুরাইশদের বংশ তালিকা দেখলে জানবেন নবীজীর ৫ প্রজন্ম আগের পূর্ব পুরুষ আবু মান্নাফের সন্তান আবু হাশেম এবং অপর সন্তান আবু শামসের ছেলে উমাইয়ার থেকেই প্রধান দুটি গোত্র বনু হাশেমি এবং বনু উমাইয়া’র সৃষ্টি হয়। তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দুই দিকেই উমাইয়ারাই অগ্রসর ছিল। এই গোত্র থেকে যেমন হযরত উসমান রাঃ এর মতো শুরুর দিকের মুসলমানেরা ছিলেন, তেমনি মূলত মক্কায় কুরাইশদের শেষ প্রতিরোধ উমাইয়ারাই ধরে রেখেছিল।
চিত্রঃ বনু হাশিম এবং উমাইয়া বংশ তালিকা
মক্কায় সেই রয়ে যাওয়া উমাইয়াদের মাঝে আবু সুফিয়ানের মতোই আরেক ইসলাম বিরোধী, কাফের ছিল হযরত উসমানের চাচা আল হাকাম। আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করলেও আল হাকাম নবীজীর ক্ষমা পায়নি, সে তার পরিবারসহ তায়েফে নির্বাসিত হয়। আর সেই আল হাকামের সন্তানের নামই হচ্ছে আল-মারওয়ান। পরবর্তীতে হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরের আমলে আল হাকাম আর তার সন্তান আল মারওয়ান ফেরার আর্জি জানায়, কিন্তু সেই অনুরোধ দুজনেই বাতিল করে দেন। কিন্তু হযরত উসমান ৬৪৪ সালে খিলাফতে আসীন হবার পর তাদের পূর্ণ মর্যাদায় দেশে ফেরার অনুমতি দেন। চাচাতো ভাই আল মারওয়ান অল্প দিনেই উনার খুব প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন। এরপর থেকে ৬৮৬ সালে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ঘটনায় তার আলোচিত, সমালোচিত এবং কখনো রহস্যজনক ভূমিকা পাওয়া যায়।
প্রথম ফিতনা
৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ তথা হিজরি ৩৫ সালের ১৮ই জিলহজ্জ্ব মাসে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান রাঃ এর নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে মুসলিম ইতিহাসের প্রথম ফিতনা শুরু হয়। মূলত এই ফিতনার কারণ বিশ্লেষণের জন্যই হযরত উসমান রাঃ এবং তার আমল সম্পর্কে কিছু জানা জরুরী।
একজন ধার্মিক, দয়ালু, সৎ, কোরআনের সংকলক এবং একজন উল্লেখযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারী হিসেবে হযরত উসমান রাঃ ইতিহাসে চিরস্মরণীয় থাকবেন। ৬৪৪ সালে হযরত উমরের মৃত্যুর পর উনার মনোনীত প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে হযরত উসমান খলিফা হিসেবে মনোনীত হন। উমরের ইসলামী সাম্রাজ্য সম্প্রসারনের নীতি তার আমলেও অব্যাহত থাকে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, এতো বিশাল সাম্রাজ্য শাসনে উমর রাঃ যেমন কঠোরতা এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার তীব্র অভাব ছিল হযরত উসমানের রাঃ এর ব্যক্তিত্বে। উনার মূল ভরসা ছিল নিজের উমাইয়া বংশের সদস্যরা, মূলত উমাইয়া বংশ এবং নিজের ঘনিষ্ঠ জনদের মাঝে থেকেই তিনি কুফা, বসরা, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি স্থানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিন্তু এরা সবাই সমান সপ্রভিত ছিলেন না, তাদের দুর্বল-অনুপযুক্ত শাসনে কুফা, বসরা এবং বিশেষ করে মিশরে অসন্তোষ দেখা দেয়। এক খলিফা উমর নিযুক্ত মুয়াবিয়া রাঃ ছাড়া সর্বত্রই উমাইয়া প্রশাসকরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ধীরে ধীরে হযরত উসমান রাঃ এর প্রধান উপদেষ্টা হয়ে উঠা মারওয়ান বিন হাকামের হস্তক্ষেপের কারণে খলিফা উসমান উমাইয়া প্রশাসকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন।
হিজরি ৩৫ সালের হজ্বের সময় কুফার বিদ্রোহীরা হযরত যুবায়ের রাঃ এর পক্ষে, বসরা থেকে হযরত তালহা রাঃ এর পক্ষে এবং মিশর থেকে হযরত আলী রাঃ এর পক্ষের বিদ্রোহীরা দলে দলে মদীনায় এসে হাজির হয়। এই অবস্থায় হযরত উসমান সাহায্য চান হযরত আলীর কাছে। হযরত আলী এবং আনসার নেতা হযরত মাসলামা রাঃ এর মধ্যস্ততায় বিদ্রোহীদের দাবী মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তারা একপর্যায়ে মদীনা ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু মিশরের বিদ্রোহীরা যখন ফেরার রাস্তায় ছিল ঠিক সেসময় মদীনা থেকে আগত একজন বার্তাবাহক তাদের হাতে ধরা পড়ে যায়। তার কাছে থাকা হযরত উসমানের সীলমোহর যুক্ত চিঠি খুলে দেখতে পায় যেখানে বিদ্রোহীদের মিশর ফেরা মাত্রই কঠোর শাস্তি দেওয়ার জন্য গভর্নরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেখা মাত্রই বিদ্রোহীরা আবার মদীনায় ফিরে হযরত উসমানের বাড়ি অবরোধ করে। হযরত উসমান এই চিঠির বিষয়ে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন, ধারণা করা হয় মারওয়ান বিন হাকাম স্ব-প্রণোদিত হয়ে এই চিঠি পাঠান।
এবার আর হযরত আলীর পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়নি। না পারলেন বিদ্রোহীদের শান্ত করতে, না পারলেন হযরত উসমান’কে মারওয়ানের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে বুঝাতে; বিদ্রোহীরা খলিফার বাড়ির ভিতর খাবার পানির সরবরাহ বন্ধ করে দিলে উনি শেষবার চেষ্টা করেছিলেন মীমাংসার, কিন্তু ব্যর্থ হন। হযরত হাসান, হযরত হোসেন, ইবনে জুবায়ের, মারওয়ানসহ কয়েকজন হযরত উসমানের বাড়িতে পাহারায় থাকেন, টানা কয়েকদিন ধরে অবরোধ চলতে থাকে। মদীনার অনেকেই বিদ্রোহীদের সাথে যুক্ত হয়, এক পর্যায়ে তারা প্রহরীদের পেরিয়ে হযরত উসমানের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পাশের বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে হযরত উসমানের ঘরে প্রবেশ করে। তিনি তখন রোজারত অবস্থায় কোরআন শরীফ পড়ছিলেন; সেই অবস্থাতেই বিদ্রোহীরা হত্যা করে উনাকে।
মুসলিম জাতির ভবিষ্যত চিরদিনের জন্য বদলে যায় এই ঘটনার পর। কারবালাসহ আরও শত শত করুণ ঘটনার বীজ রোপিত হয় এই অন্যায় হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। হত্যাকারীদের মাঝে মিশরীয় নেতা আল-গাফিকি, ইয়েমেনী সুদান ইবনে হামরান, হুকাম ইবনে জাবালা, আবদুল্লাহ ইবনে সাবা প্রমুখ উল্লেখ্য।
আবদুল্লাহ ইবনে সাবা এবং আদি শিয়া রহস্য
শিয়াদের কাছে খোদা এবং নবীর পর হযরত আলীই সর্বেসর্বা, তাই নবীর আমল থেকে খলিফায়ে রাশিদিনের যুগে যারা আলীকে সমর্থন যুগিয়েছে তারাও বিশেষভাবে সম্মানীয় শিয়াদের কাছে। এদের মাঝে সর্বাগ্রে থাকে ফোর কম্প্যানিয়ন খ্যাত চার সাহাবা আবু জহ্র আল গিফারী রাঃ, সালমান বিন ফারসী, আমর ইবনে ইয়াসির, আল মিকদাদ। তো হযরত আলীর এই সহচরদের ‘শিয়ায়ে আলী’ বা আলীর কমরেড নামে অভিহিত করা হতো। এটা হতেই শিয়া নামের উৎপত্তি। কিন্তু শিয়াদের এই অতিরিক্ত আলী বিশ্বাসের উৎসটা কি?
এখানেই নাম আসে আবদুল্লাহ ইবনে সাবা নামক ইহুদী হতে ধর্মান্তরিত রহস্যময় ব্যক্তির কথা। যাকে প্রথমত সুন্নিরা অভিযুক্ত করেছে হযরত উসমানের হত্যাকারী এবং শিয়ারা আলীকে নবীজীর উপর বিশ্বাস করে এই তত্ত্বের প্রবর্তক হিসেবে।
দ্বিতীয়ত শিয়ারা একে অভিযুক্ত করে ‘প্রথম গুলাত’ অথবা ধর্মের অতিরঞ্জনকারী বা অপব্যাখ্যাকারী হিসেবে, যে হযরত আলীকে খোদা (আস্তাগফিরুল্লাহ) এবং নিজেকে তার নবী ঘোষণা করে। এই অপরাধে হযরত আলী তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। পরবর্তী শিয়া ইমামগণও একে অভিশাপ দিয়ে গেছে।
আর তৃতীয়ত, অধিকাংশ আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে ইবনে সাবা সম্পূর্ণ কাল্পণিক একটি চরিত্র। হযরত মুয়াবিয়া বিশেষ প্রয়োজনে ইবনে সাবা চরিত্রের জন্ম দেন, কারণ হযরত উসমান রাঃ এর হত্যায় মদীনার অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরা ইন্ধন যুগিয়েছিল যাদের সাথে উমাইয়াদের সর্বোপরি ভালো সম্পর্ক ছিল। তাই তাদের আড়াল করতেই ইহুদী খল চরিত্র ইবনে সাবার জন্ম দেওয়া হয়। আর উমাইয়া খিলাফতের যুগে এটা সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে শিয়ারাও একে তাদের ধারায় আলীর ধর্মভীরুতা হিসেবে বর্ণনা করেছে।উপরোক্ত ঘটনাগুলো ছাড়া আগে পরে কোন যুদ্ধ বা ঐতিহাসিক ঘটনায় ইবনে সাবার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
উটের যুদ্ধ
একটা ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই হযরত আলী রাঃ নীরব থাকলেও কিংবা ইমাম হাসান হযরত উসমানের বাড়ি পাহারা দেওয়া অবস্থায় আহত হলেও উনার সমর্থকরাই বেশী ভূমিকা রেখেছিল ঘটনায়। মিশরের বিদ্রোহীরা পুনরায় ফিরে আসলে উনি হযরত উসমান এবং বিদ্রোহীদল দুই পক্ষের সাথেই বসেন, কিন্তু মারওয়ানের বাঁধার কারণে তিনি আশি ছুঁই ছুঁই বয়োবৃদ্ধ খলিফাকে বুঝাতে ব্যর্থ হন এবং নীরবে মঞ্চ ত্যাগ করেন। যাই হোক, শুধু আলীর খিলাফত মান্যকারী মিশরীয় বা ইয়েমেনীরা না, মদীনা-কুফা-বসরার অনেক বড় গোত্র বা পরিবারের ইন্ধনও ছিল তাতে। তাই হযরত আয়েশা যখন হযরত আলীর কাছে খলিফার হত্যাকারীদের শাস্তি দাবী করলো আলী সেটা দুর্বলতা বা অপারঙ্গমতার কারণেই হোক পালন করতে ব্যর্থ হন। তার পরিণামে বসরার প্রান্তরে মুখোমুখি হয় হযরত আলী এবং হযরত আয়েশার বাহিনী। হযরত উসমান রাঃ এর বিরোধী হলেও হযরত আয়েশা এসময় পাশে পান হযরত তালহা, হযরত যুবায়ের এবং
সর্বোপরি উমাইয়া বংশকে। তার পক্ষে আরও উপস্থিত ছিল মারওয়ান বিন হাকাম। মারওয়ানের কর্মকান্ড এই যুদ্ধকে এমন কিছু ঘটনার জন্ম দিয়েছে যার বর্ণনা করা দুঃসাধ্য।
চিত্রঃ উটের যুদ্ধে হযরত আয়েশা রাঃ এর উট। এই উটের নামেই যুদ্ধের নামকরণ হয় কারণ আলীর বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল এই উটটি। কথিত আছে একে রক্ষা করতে গিয়ে আয়েশার অনুসারীদের লাশের পাহাড় জমে যায়।
অপরদিকে আলীর সাথেও অনেক সাহাবা, বিভিন্ন প্রদেশের সৈন্যসহ নবীজীর নিজ হাশেমি বংশ হযরত আলীর পক্ষে ছিলেন; হযরত আবু বকরের দুই ছেলে হযরত আব্দুর রহমান এবং মুহাম্মদ বিন বকরও নিজেদের বোনের বিপক্ষে হযরত আলীর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন।
এসময় একদল লোকের কথা না বললেই নয়। প্রচলিত ধারার মাঝেই হঠাৎ যেমন কিছু উগ্রপন্থী গজিয়ে উঠে; যেমনটা ছিল আইএস বা হলি আর্টিজানের জঙ্গিরা। ঠিক তেমনি আলীর বাহিনীতে একদল যুদ্ধবাজ উগ্রপন্থীর আবির্ভাব ঘটে। কোরআনের কট্টর অনুসারী বলে ‘কোরা’ নামে অভিহিত করা হতো। অনেক সাহাবীর হাদীসের বর্ণনায় নবীজী এদের সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, মদীনার পূর্ব দিক হতে একদল লোকের আগমন হবে যাদের মুখে সবসময় কোরআনের কথা থাকবে কিন্তু অন্তরে কোরআনের বাণী পৌঁছাবে না। যেমন; সূরা হুজুরাতের ৯ নং আয়াতে বলা আছে, “যদি বিশ্বাসীদের দুই পক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয় তবে তাদের মাঝে শান্তি স্থাপন করো, যদি এদের মাঝে এক পক্ষ বিদ্রোহী হয় তবে খোদার শাসনে না আসা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর”। এখানে স্পষ্টতই বিদ্রোহী বলতে খোদাদ্রোহী বুঝানো হয়েছে, কিন্তু তারা যেকোন বিদ্রোহীকেই এই পরিণতির যোগ্য বিবেচনা করে এবং শান্তিচুক্তি বলে কোন কিছু অস্বীকার করে। সেই সাথে কোরআনে বলা হয়েছে 'তোমরা আখিরাতের জন্য দুনিয়ার জীবন ত্যাগ করো'। এটাকেও তারা আক্ষরিকভাবেই জীবন দান করা বুঝে থাকে।
তো উটের যুদ্ধের শুরুতেই বিভিন্ন সাহাবা এবং গোত্রগুলোর মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের উত্তেজনা অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যায় এবং একটা শান্তিচুক্তির দিকে এগুতে থাকে। এই অবস্থা দেখে সেই কোরা’রা এবং যারা হযরত উসমান হত্যায় জড়িত ছিল তারা শাস্তির এড়ানোর জন্য নির্দেশ অমান্য করেই যুদ্ধে এগিয়ে যায়। একটা বিশৃঙ্খল দ্বিধাময় যুদ্ধের মাঝেই হযরত আলীর বাহিনীর হাতে হযরত আয়েশা এবং উমাইয়া বাহিনীর পরাজয় ঘটে। সবাইকে ইসলামী আইন অনুযায়ীই বিচার করা হয় এবং হযরত আয়েশাকে তাঁর ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে মদীনায় ফেরত পাঠানো হয়, যেখানে বাকি জীবন তিনি হাদীস সংকলন এবং ধর্ম চর্চায় ব্যয় করেন।
তো যে কারণে মারওয়ানের কথা শুরুতে বলেছিলাম। মধ্যস্ততার মাঝে যখন কোরা’রা আক্রমণ করলো, তখন হযরত তালহার মন যুদ্ধ থেকে উঠে গেছে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করছেন, এটা দেখে নিজ পক্ষেরই মারওয়ান ছুটে এসে বিষাক্ত তীর দিয়ে বিদ্ধ করে তাকে এবং সে আঘাতেই পরে রক্তক্ষরণে মারা যান নবীজীর এই প্রিয় সাহাবী।
সিফফিনের চূড়ান্ত যুদ্ধ এবং খারিজী’র জন্ম
উটের যুদ্ধ হযরত আলীর বাহিনীর জন্য ছিল রিহার্সাল মাত্র। হযরত আলীর খলিফা হওয়ার পথে প্রধান বাঁধা হযরত মুয়াবিয়া তখনো সিরিয়ায় উমাইয়া বংশের নিশান উড়িয়ে চলছেন।
ইসলামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং উমাইয়া খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুয়াবিয়া রাঃ সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। ৬৩০ সালে মুসলিমদের মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান এবং তার সন্তান মুয়াবিয়া এবং ইয়াজিদ ছিল ইসলামের ঘোরতর শত্রু। মক্কা বিজয়ের পর পরই তারা ইসলাম গ্রহণ করে। পূর্বে উহুদ, খন্দকে কুরাইশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া মুয়াবিয়াকে হযরত আবু বকর তার বড় ভাই ইয়াজিদের অধীনে হযরত আবু উবাইদার বাহিনীতে যুদ্ধ করার জন্য সিরিয়ায় প্রেরণ করেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার প্রকৃত বিকাশ এবং উত্থান দুইই ঘটে হযরত উমরের আমলে। কিছু কিছু বর্ণনা থেকে জানা যায় মুয়াবিয়াকে নিজের সন্তানের মতোই দেখতেন হযরত উমর। সিরিয়া অভিযানকালীন প্লেগে পরপর গভর্নর আবু উবাইদা এবং মুয়াবিয়ার বড় ভাই হযরত ইয়াজিদ মারা যান। এবং তাদের স্থালাভিষিক্ত হন মুয়াবিয়া রাঃ অসাধারণ কূটনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী মুয়াবিয়া সমগ্র শ্যাম (সিরিয়া, জর্দান, ফিলিস্তিন) ইসলামী খিলাফতের অধীনে নিয়ে আসেন। শক্তিশালী নৌবাহিনী বানিয়ে বাইজেন্টাইনদের সাগর থেকে বিতাড়িত করে সিসিলি পর্যন্ত দখল করেন। উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার অনেক দেশও তাঁর সিরিয়ান বাহিনী বিজয় করে হযরত উমর এবং হযরত উসমানের খিলাফতকালীন।
উমাইয়া গোত্রীয় ভাই হযরত উসমানের মৃত্যু এবং উটের যুদ্ধে আয়েশার রাঃ এর পরাজয় মুয়াবিয়াকে আলীর মুখোমুখি অবস্থানে ঠেলে দেয়। হযরত উসমানের রক্তমাখা জামা এবং হত্যাকারীদের হাতে খন্ডিত হওয়া উনার স্ত্রীর কাটা আঙ্গুল প্রদর্শন করে সিরিয়ানদের মাঝে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এদিকে হযরত আলী মক্কা-মদীনা-কুফা-মিশরীয়দের বিশাল বাহিনী নিয়ে ফোরাত নদী পেরিয়ে সিরিয়ায় উপস্থিত হলেন। অবশেষে জ্বিলহজ্ব মাসে দুই বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয়। ইসলামী ইতিহাসবিদদের মতে হযরত আলীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৮০ হাজার, অপরপক্ষে হযরত মুয়াবিয়ার সিরিয়ান বাহিনীতে ছিল প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য।
এবারও দুই পক্ষ যুদ্ধ শুরুর আগে শান্তি আলোচনা চলাকালীন আলী’র বাহিনীর কোরা’রা হামলা চালিয়ে বসে। তিনদিন ব্যাপী সেই যুদ্ধে আলীর সামরিক কৌশলের কাছে মার খেয়ে সিরিয়ান বাহিনী অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তার পরেও উভয় পক্ষেরই মূল বাহিনী অক্ষত ছিল। আরও অধিক ক্ষতি এবং ইসলামকে বদনামের হাত থেকে রক্ষা করতে দুই বিচক্ষণ নেতাই যুদ্ধ থামিয়ে শান্তিচুক্তিতে সম্মত হলেন। চুক্তি অনুযায়ী সকল বিবাদ মীমাংসার জন্য উভয় পক্ষ থেকে মধ্যস্থতাকারী নিযুক্ত করা হলো। হযরত মুয়াবিয়া হযরত আলী জীবিত অবস্থায় নিজেকে খলিফা দাবী না করলেও সমর্থকদের মাঝে এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিলই। মধ্যস্থতাকারীরা একবার এই বিরোধ নিরসনে ভোটের প্রস্তাব দিলেও আলী তা মানতে রাজি হননি।
দুই পক্ষের মাঝে যখন এরকম আলোচনা, সমাঝোতা চলমান তখন আর কোরা’রা নিজেদের ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলো না। তারা আলীর পক্ষ ত্যাগ করলো এবং মহানবীর হাদীস অনুযায়ী তারা কোরআনের অপব্যাখ্যাকারী ‘খারিজী’ নামে অভিহিত হলো। হযরত আলী তাদের এই পক্ষ ত্যাগ মেনে নিতে পারলেন না, নাহরাওনের যুদ্ধে তিনি খারিজীদের বাহিনীকে পরাজিত করলেন। প্রচুর সংখ্যক খারিজী নিহত হয় সেই যুদ্ধে, বাকিরা দেশ ত্যাগ করে বা আত্মগোপনে চলে যায়। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসের ফজরের ওয়াক্তে খারিজী গুপ্তঘাতকরা একই সাথে সাথে কুফায় এবং দামেস্কে হযরত আলী এবং হযরত মুয়াবিয়ার উপর হামলা চালায়। মুয়াবিয়া সামান্য আঘাত পেয়ে জীবনে বাঁচলেও হযরত আলী বিষাক্ত তলোয়ারের আঘাতে মৃত্যবরণ করেন।
শুধুমাত্র খারিজীদের ইবাদী ব্রাঞ্চটিই ওমানে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ওমানের মুসলিম জনসংখ্যার ৭০% ইবাদী ইসলামের অনুসারী।
চিত্রঃ খারিজীদের বর্তমান চিত্র
পরিণতি
হযরত আলী স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুর আগে প্রতিনিধি নির্বাচন করে যেতে পারেননি, কিন্তু তিনি আহলে বাইত’কে গুরুত্ব দিতেন সবসময়। তাই তার মৃত্যুর পর ভক্তরা হযরত হাসান রাঃ’কে খলিফা মনোনীত করেন। স্বাভাবিকভাবেই মুয়াবিয়ার এই সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি, তিনি ৬০ হাজার সিরিয়ান সৈন্য নিয়ে ইরাকের দিকে অগ্রসর হন। হযরত হাসানের পক্ষেও তার সেনাবাহিনী সমবেত হয় বসরা এবং কুফা থেকে। এর মাঝের ঘটনা কিছুটা অস্পষ্ট। ইমাম হাসান হঠাৎ যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, এর মাঝে শিবিরে এক খারিজীর আক্রমণে আহত হলে আরও মনোবল হারিয়ে ফেলেন। নেতার এমন অবস্থা দেখে নবীজীর চাচা হযরত আব্বাসের ছেলে, বসরার গভর্নর উবায়েদ আল্লাহ ১০ লক্ষ দিরহামের বিনিময়ে মুয়াবিয়ার সাথে চুক্তি করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। ওদিকে মুয়াবিয়া-হাসান শান্তিচুক্তিও স্থাপিত হয়; চুক্তি অনুসারে মুয়াবিয়াকে খিলাফত প্রদান করা হয় বিনিময়ে মুয়াবিয়া কথা দেন কখনো তার বংশধরকে খলিফা মনোনীত করতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তীতে উনি তার ওয়াদা রাখতে ব্যর্থ হন, যার কারণে দ্বিতীয় ফিতনা শুরু হয়।
এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, সেই মারওয়ান তখনো অক্ষত, বহাল তবিয়তেই ছিলেন। মুয়াবিয়ার আমলে মদীনার গভর্নর এবং উমাইয়া গোত্র প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। হযরত মুয়াবিয়া ক্ষমতা চাইলেও বনু হাশেমি নির্বংশ করার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু উনার মৃত্যুর পর মারওয়ানের পরামর্শে মুয়াবিয়া পুত্র ইয়াজিদ এবং পরবর্তীরা হাশেমি বংশের সদস্যদের হত্যার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এই হাশেমি বংশ থেকেই পরবর্তীতে হযরত আব্বাস এবং হযরত আলীর ধারায় দুটি খিলাফতের জন্ম হয় যথাক্রমে আব্বাসী এবং ফাতেমি খিলাফত।৬৮০ সালে কারবালায় ইমাম হোসেন রাঃ এর মৃত্যু হলে ইয়াজিদ আরও তিন বছর শাসন করে মারা যায়, এরপর তার ছেলে দ্বিতীয় মুয়াবিয়া ক্ষমতায় আসলে মাত্র তিন সপ্তাহের মাথায় প্লেগে মৃত্যু বরণ করে। এসময় উমাইয়া খিলাফতে এক শুন্যতার সৃষ্টি হয়, এমন একটা সময়ের জন্যই এতো যুগ অপেক্ষমান ছিলেন মারওয়ান। সিরিয়ান সেনাপতিদের সাহায্য নিয়ে ৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো মারওয়ান বিন আল হাকাম। উমাইয়া খিলাফতের মধ্যে থেকেও পরিবর্তন আসলো, আবু সুফিয়ানের বংশধারা থেকে মারওয়ানিদ উমাইয়া ধারার শুরু হলো।
লেখকের কথা
এতো বড় লেখা দেওয়ার উদ্দেশ্যটা শুধুই ইতিহাস জানানো জন্য ছিল না। তাও এতো নেগেটিভ ইতিহাস তুলে ধরার। কিন্তু এগুলো আড়াল করতে গিয়ে ভক্তদের ‘Missing Link’ এর জায়গায় ‘Missing Lies’ গেলানো হয়। তাও একেক জনেরটা একেক রকম। ইতিহাস নিয়ে আরও অনেক পোস্ট লিখেছি, কিন্তু আরও কোন পোস্টের জন্য এতো পড়তে, লিখতে, মাথা খাটাতে হয়নি। বই করলেই সুবিধা হতো, বেঢপ ব্লগ পোস্ট বানাতে গিয়েই সমস্যায় পড়েছি। অসংখ্যা ইতিহাস, মতবাদ বাদ রয়ে গেছে বা বর্ণনা করা হয়নি সবাই জানেন বলে।
এখানে দুটি বিষয় মুখ্য
প্রথমত, ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি তবে ইসলামের সাহাবীদের একেকজন বিশ্বের যে কোন রাজার দরবারে মন্ত্রী বা সেনাপতি হবার যোগ্যতা রাখতেন। কেউ আরব উপদ্বীপ জয় করছে, কেউ সিরিয়া, কেউ ইয়েমেন, কেউ ইজিপ্ট, কেউ বা নৌবাহিনী নিয়ে সিসিলি দখল করে বসে আছে। এরকম প্রতাপশালীরা পাশাপাশি অবস্থান করলেই আগুন ছাড়াই ধোঁয়া উড়বে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মাঝে সাহাবাদের ফেরেশতা রূপে গণ্য করার একটা পূজনীয় ভাব আছে। অথচ এমন কোন বিধান কোথাও নেই। কলব সাফ নবীজীর হয়েছিল, সাহাবাদের নয়। একজন মানুষের সব গুণাগুণই তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। জিব্রাইল আঃ-মিকাইল আঃ এর মাঝে গ্রুপিং হয়েছে এমন কোন উদাহরণ নেই। কিন্তু সাহাবাদের মাঝে হয়েছে, মারওয়ানের মতো চরিত্র সমাজের বাহিরের কেউ নয়। এটাই রাজনীতি, বিশ্বের অধিকাংশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেই অতি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু এটা নিয়ে ১৪০০ বছর ঘৃণার চাষাবাদ করা বোকামি। প্রতিটি খিলাফতেরই অনেক ভালো ভালো কাজ আছে। সেগুলা নিয়ে বন্ধুত্ব না করে বিবাদ ধরে টানাটানি করলে সমাধান হবে না। দোষ সবারই ছিল, শিয়ারা পরবর্তী যুগে পালিয়েই বেড়িয়েছে ইহুদীদের মতো। তাদের ভাগ হয়েছে শতধা, হাজারটা মতবাদ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু আমি তাদের ভালো দিক দেখি মিশর শাসন করার পরেও সেখানের জনগণকে কনভার্ট করেনি।
আমেরিকা, ইউরোপের অনেক চার্চে গলায় সাপ নিয়েও প্রার্থনা হয়। তাদের কেউ মারতে যায় না কিংবা আপনি মুসলমান হয়ে মারতে গেলেও সবাই মিলে ঠ্যাঙাবে। কিন্তু মুসলমানদের উল্টা, আমেরিকা ইরানে বোমা মারলেও অনেকের ঈদ লাগে আর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উল্টাপাল্টা ইতিহাস বলে। হিংসা দূর হোক, সবার মাঝে ঐক্য আসুক।
সবাই ভালো থাকুন।