আমেরিকান কংগ্রেসম্যান ‘পিটার কিং’ কে চিনেন??
না চিনলে নামটা বাংলায় লিখেই সার্চ দেন গুগোলে, প্রথম ৫ পাতা সলিড রেজাল্ট পেয়ে যাবেন। শিরোনামগুলো এক নজর দেখে মনে হবে ইনি বুঝি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আওয়ামী লীগ বিষয়ক মন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব কংগ্রেসে আওয়ামী লীগের পক্ষ হয়ে যে কোন প্রচার-প্রচারণা, বিবৃতি প্রদানে নেতৃত্ব দেন এই প্রভাবশালী রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীকে কেন্দ্র করে উনার মন্তব্য ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি ডেড ইস্যু।
তত্ত্বাবধায়ক ডেড ইস্যু
এছাড়াও জিএসপি ফিরিয়ে দেওয়া, শেখ মুজিবের হত্যাকারী রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল, বিএনপির আন্দোলন বন্ধে জন কেরির কাছে ১১ জন কংগ্রেসম্যানের বিবৃতি প্রদান; এরকম অনেক বিষয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা দিচ্ছেন পিটার কিং।
শেখ হাসিনার কাছে পিটার কিং এর মর্যাদা এতোই উপরে যে জাতিসংঘ সম্মেলন উপলক্ষে আসন্ন আমেরিকা সফরে ২৫শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পিটার কিং এর সাথে একটি বৈঠক পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে। গত ৬ বছরে পিটার কিংও বিভিন্ন সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলনে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করে গেছেন।
আমেরিকায় পিটার কিং এর পরিচয় একজন ইসলামফোবিক হিসেবে। ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে “যুক্তরাস্ট্রের মসজিদগুলো ঘরের ভিতর শত্রু” উল্লেখ করে ডেমোক্রেটদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন।
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি বিবৃতি দেন। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির চেয়ারম্যান হবার পর জঙ্গিবাদের অভিযোগ তুলে যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদগুলোতে কড়া নজরদারী এবং বাহির থেকে সাহায্য আসার পথ বের করে দেন।
মূলত, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার মসজিদ, মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বাহিরের সাহায্যে জঙ্গিবাদের প্রসার নামে যেই অভিযোগ তুলে, তার মূল মন্ত্রণাদাতা এই পিটার কিং।
এখন আসুন, আরেকজন ব্যক্তির কথা জানি।
উনার নাম গোলাম মেহরাজ, একজন নিউইয়র্ক নিবাসী বাংলাদেশী। খুব পড়াশোনা জানা কোন ব্যক্তি নন, ৯০ এর দশকে আরও অনেকের মতোই ভাগ্যের আশায় আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিলেন, ইদানীংকালে উনার নামের আগে মুক্তিযোদ্ধা ব্যবহৃত হয়। তো এই ব্যক্তির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটু জানুন।
১। নিউইয়র্ক জাপার সাবেক সভাপতি, বর্তমান উপদেষ্টা।
২। আমেরিকা-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এসোসিয়েশনের সভাপতি (নামকাওয়াস্তে সংগঠন, এরকম সংগঠন বহুগুলো আছে)
৩। গ্লোবাল এলায়েন্স ফর হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ভাইস চেয়ারম্যান
৪। বাংলাদেশের বসুন্ধরা গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিষয়ক উপদেষ্টা।
অতীতে জাপা সভাপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ আমেরিকা সফরে গেলে এই গোলাম মেহরাজ বিভিন্ন ফুট ফরমাশ খেটে এরশাদের কাছ থেকে নিউইয়র্ক জাপার সভাপতি পদটি বাগিয়ে নেন।
এরশাদের বামে স্যুট পড়া গোলাম মেহরাজ
বিএনপি ক্ষমতায় আসলে, নিউইয়র্কস্থ বিএনপি নেতাদের সাথেও তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। এইভাবেই ২০০৩ সালে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি নামে নিউইয়র্ক ভিত্তিক একটি সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করার সুযোগ মিলে
২০০৩ এ খালেদা জিয়ার সাথে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সাক্ষাৎ
পরবর্তীতে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মেহরাজ দূতাবাসে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেন এবং দূতাবাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত নিমন্ত্রণ পান। শমসের মুবিন চৌধুরী রাষ্ট্রদূত থাকাকালে ২০০৫ সালে পিটার কিং এক অনুষ্ঠানে আসলে তার সাথে পরিচিত হন গোলাম মেহরাজ। পিটার কিং সেই সময় প্রথম দফায় হোমল্যান্ড সিকিউরিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। নিজেকে সেক্যুলার হিসেবে পরিচয় দিয়ে দ্রুত পিটার কিং এর বিশ্বস্ততা অর্জন করে নেয় গোলাম মেহরাজ।
পিটার কিং এর বিভিন্ন নির্বাচনী তহবিলেও নিয়মিতভাবে চাঁদা প্রদান করতে থাকে সে, শুধু ২০১৪ এর এক হিসেবে দেখা গেছে পিটার কিং এর জন্য ৬৫৮০ ডলার চাঁদা সংগ্রহীত হয় মেহরাজের এলাকা "Woodside" থেকে, যার ৬৫০০ই দিয়েছে বাঙ্গালীরা এবং মেহরাজ নিজে দিয়েছে ২৯০০ ডলার। বিস্তারিত নীচের লিঙ্কে দেখে নিন।
গোলাম মেহরাজের সামগ্রিক নির্বাচনী চাঁদার রিপোর্ট
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে পিটার কিংকে সামনে রেখে নিজেকে ভাইস চেয়ারম্যান ঘোষণা করে গ্লোবাল এলায়েন্স ফর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইনক নামে একটি নন-প্রফিট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে গোলাম মেহরাজ।
view this link
২০০৯ সালে বানানো কোম্পানিটির অসমাপ্ত ওয়েব সাইটের লিঙ্ক
view this link
ডান থেকে তৃতীয় ব্যক্তিটিই হচ্ছে গোলাম মেহরাজ।
মূলত জেনারেল মইন ক্ষমতা দখলের পরই হোয়াইট হাউজে রিপাবলিকান কার্ট ওয়েলডন এবং পিটার কিং এর সহায়তায় বাংলাদেশ আর্মির লবিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করে এই সংগঠনটি। ২০০৭ সালেই ইয়াহুর একটি নিউজগ্রুপে সেই সম্পর্কে বলা হয়।
view this link
২০০৯ সালে সাইট খুললেও, গোলাম মেহরাজ কোম্পানির অফিসটি আগেই বন্ধ করে দেন। একই বছর মার্চ মাসে মেট্রো মাল্টিসার্ভিস নামে একটি কোম্পানির নিবন্ধন হয় একই ঠিকানায়।
view this link
নীচের লিঙ্কে গিয়ে গুগোল ম্যাপের স্ট্রিট ভিউ হতে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের এই ভবনটি দেখে নিন। চার তলায় এই নামের কোন কোম্পানির সাইনবোর্ড সেখানে নেই।
view this link
এই পর্যন্ত গোলাম মেহরাজের কর্মকান্ড স্বাভাবিকই চলছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার কংগ্রেস লবির কারণ আওয়ামী লীগের কাছে রীতিমতো একজন রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা লাভ করে সে। এই সময় বসুন্ধরা গ্রুপের মালিক আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম দুর্নীতি, জমি দখল, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, হত্যা ইত্যাদি মামলায় বিদেশে পালিয়ে থাকা অবস্থায় সজীব ওয়াজেদ জয়কে মোটা অঙ্কের টাকা প্রদানের মাধ্যমে নিরাপদে দেশে ফেরার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করে দেয় এই গোলাম মেহরাজ। ধারণা করা হয় টাকার পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার উর্ধে। অনলাইনে বেশ ক’জন বিএনপিপন্থী এক্টিভিস্ট এ নিয়ে ব্লগে, ফেসবুকে লেখালেখি করেছে পূর্বে।
view this link
পরবর্তীতে পলাতক থাকা অবস্থাতেই বসুন্ধরার মালিকের ছেলে হত্যা মামলার আসামী সানবীরকেও প্রায় সম পরিমাণ টাকার বিনিময়ে সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূতভাবে আদালত খালাস প্রদান করে ২০১১ সালের ১৫ই ডিসেম্বর। এই ডিলটিও গোলাম মেহরাজের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে টাকা প্রদান করা হয় বলে জানা যায়।
view this link
উভয় ক্ষেত্রে টাকার ভাগ পাওয়ার পাশাপাশি প্রতিদান স্বরূপ বসুন্ধরা গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এডভাইজার হিসেবে নিয়োগ পান একসময়ের অখ্যাত আমেরিকা প্রবাসী গোলাম মেহরাজ। নীচের কালের কন্ঠের লিঙ্কটি থেকে দেখে নিন বসুন্ধরার চেয়ারম্যানের সাথে গোলাম মেহরাজের পারমানবিক প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরকালীন একটি ছবি
view this link
কৈ এর তেলে কৈ ভাজার মতো গ্লোবাল এলায়েন্স ফর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ২০১১ সালে মার্কিন দূতাবাসে মন্ত্রী, এমপিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করে পুরষ্কার তুলে দেয় বসুন্ধরার মালিকের ছেলে সায়েম সোবহান এবং বাংলাদেশে কোম্পানি জালিয়াত হিসেবে কুখ্যাত, মাগুরা পেপার মিল দখলকারী, বসুন্ধরার সিস্টার অর্গানাইজেশন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়ার চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন এর হাতে। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিল সেই নাটের গুরু গোলাম মেহরাজ আর ধান্দাবাজির নাটকের প্রধান অতিথি ছিল সৈয়দ আশরাফ।
view this link
এরপর বেসিক ব্যাঙ্কের ৫ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মূল হোতা শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুকে ২০১২ সালে নিজের হাতে স্বাক্ষর করা এক চিঠির মাধ্যমে গ্লোবাল এলায়েন্স ফর হোমল্যান্ড সিকিউরিটির এডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেন পিটার কিং।
view this link
বাচ্চুর জন্য পিটার কিং এর স্বাক্ষর করা চিঠি
খেয়াল করে দেখুন, এই সংগঠনটি মূলত বাংলাদেশের অসৎ, উচ্চবিত্তদের দিয়েই পরিচালিত হয়। মোজা বাবু, মে জেনারেল আব্দুর রশীদের মতো কট্টর আওয়ামী লীগার কিংবা বসুন্ধরা, বাচ্চু, নূর আলী, পুলিশের ডিজির মতো দুর্নীতিগ্রস্থদের নিয়েই বছর বছর সংগঠনের নামে অনুষ্ঠান আয়োজন করে গোলাম মেহরাজ।
২০১৫ এর প্রোগ্রাম
এখানে দেখুন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মূল হোতা সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডঃ সৈয়দ মোদাচ্ছেরের সাথে পিটার কিং এর যেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও আমেরিকার আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত থাকে না। থাকে এই গোলাম মেহরাজ। সরকারী প্যাডে এমব্যাসি থেকে যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়, তাতেও গোলাম মেহরাজের নাম উল্লেখ থাকে।
view this link
আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, কিসের কারণে এইসব দুই নাম্বার ধনী গোষ্ঠীর এতো ঝোঁক এই নাম সর্বস্ব সংগঠনটির প্রতি??? যেই কোম্পানির কোন অফিস পর্যন্ত নেই, তার নামে কিভাবে মার্কিন দূতাবাসে অনুষ্ঠান করা হয়!!
একটাই উত্তর হতে পারে, টাকা পাচারের নিরাপদ রুট এই সংগঠন। দুর্নীতিবাজ আব্দুল হাই বাচ্চুদের পিছনে শুধু শেখ হাসিনার মদদ নেই, পিটার কিং এরও ব্যাকিং আছে। যার কারণে আবুল মাল কিংবা দুদক বাচ্চুর কিছুই করতে পারে না।
আমরা জেড ফোর্সের পক্ষ থেকে খবর নিয়েছিলাম নিউইয়র্কে গোলাম মেহরাজের এলাকায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও তার তেমন কোন সম্পত্তিই নেই। উডসাইডে একটা এপার্টমেন্টে ভাড়া থাকে আর লংআইল্যান্ডে আরেকটা পুরানো বাড়িতে একটা ফ্ল্যাটের মালিক সে।
নিউইয়র্কে মেহরাজের স্থাবর সম্পত্তির হিসাব
সেখানকার অধিবাসীরা তাকে চিনলেও, তার এই প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে বেশীরভাগেরই কোন ধারণা নেই। নিয়মিত বাংলাদেশ আসা যাওয়া করলেও কেন যায় কিসের জন্য যায়, তাও কেউ বলতে পারে না। জাপার সাংগঠনিক কাজে বছরে দুই একবার আসা ছাড়া মানুষকে এড়িয়েই চলে মূলত। তার এমন আচরন তাকে আরও সন্দেহজনক করে তুলেছে।
এই লোক সেই জেনারেল মইনের আমল থেকে কোটিপতিদের লবিং করে আসছে, বসুন্ধরার মতো কোম্পানিতে যার উঠা বসা, সে তো নিউইয়র্কেও রাজার হালে থাকার কথা!! কিন্তু সে তার বৈভব প্রকাশ্যে উপভোগ করছে না কেন??
দেশের শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের সাথে গোলাম মেহরাজের মাধ্যমে পিটার কিং এর এসব যোগসাজশই বলে দেয় ভিতরে কোন গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমি বলছি না, পিটার কিং এসব দুর্নীতির ভাগ পাচ্ছে। কিন্তু হোমল্যান্ড সিকিউরিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার উপর পর্যায়ে প্রভাব থাকা তো স্বাভাবিক। এদের এক্সেসের বিনিময়ে, অর্থ পাচারের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে যদি এই দেশে জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ্য করা যায়, তার ইসলাম বিরোধী থিউরিগুলো প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবেই তো পিটার কিং স্বার্থক।
কখনো এফবিআই দ্বারা তদন্ত করানো গেলে থলে থেকে বেড়াল, বাঘ, সিংহ অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত।
ধান্দাবাজ গোলাম মেহরাজের আরও কিছু ধান্দাবাজি প্রতিষ্ঠান
Miss Bangladesh USA , Florida, Inc. - http://goo.gl/pJPpkg
Bangladesh Development Group USA Inc. (এটাও সেই হোমল্যান্ড অফিসের ঠিকানায় রেজিস্ট্রি করা) - http://goo.gl/7SYm1Q
US Bangladesh Education Foundation Inc- http://goo.gl/DKJS4L