পৃথিবীর ইতিহাসে মানবতার আইন লঙ্ঘন করে যত প্রথা চালু ছিল, তার মাঝে বোধকরি সর্বাপেক্ষা বর্বর এবং ব্যাপৃত ছিল দাসপ্রথা। মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দীর্ঘদিন পৃথিবীর মাটি মানব রক্তে রঞ্জিত করেছে এই জঘন্য প্রথা।
পৃথিবীর প্রথম দাসটি কে হয়েছিল, তা কখনোই জানা যাবে না। তবে, যেদিন মানুষ প্রথম দলবদ্ধ ভাবে অন্য দলকে অস্ত্রের আঘাতে পরাভূত করল, সেদিন হতেই মানুষের মাঝে প্রভুত্বের জন্ম নিল; আর পরাজিত পক্ষ পরিণত হল ক্রীতদাসে।
ইতিহাস হতে দেখা যায় সর্বপ্রথম খ্রিষ্ট পূর্ব ৮০০০ সালে আফ্রিকার ‘বুশম্যান’দের একটি সম্প্রদায় প্রাচীন মিশরীয়দের দাসত্ব স্বীকার করেছিল। 10,000 BC মুভিটিতেও আমরা প্রাচীন মিশরের দাস প্রথার স্বরূপ দেখতে পাই। গিজার পিরামিডগুলোর প্রতিটি পাথরেই অসংখ্য মানুষের ঘাম, রক্ত মিশে আছে।
চাবুক হাতে দাসদের কাজ করানো হচ্ছে
এরপর মানব সভ্যতার কর্তৃত্ব পারস্য, গ্রীস, রোমানদের হাতে এল; দিন দিন সভ্যতা আধুনিক থেকে আধুনিকতর হল। কিন্তু কখনো পিরামিডের পাথরে, কখনো সুরম্য প্রসাদের অন্ধ কুঠুরিতে আবার কখনো কলোসিয়ামের বদ্ধ এরিনায় অসহায় ক্রীতদাসের আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে। আমাদের এই ভারত বর্ষেও আর্যরা এসে দাসত্বের শেকল পড়িয়েছে স্থানীয় অধিবাসীদের গলায়। যেখানেই হোক, দাসরা কোথাও যথাযথ মানুষের মর্যাদা পায়নি; সারাদিন অবর্ণনীয় পরিশ্রমের পরে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত মানুষগুলোর সামান্য পান থেকে চুন খসলেই চাবুক মেরে রক্তাক্ত করা হত।
দাস ব্যবসার রমরমা অবস্থা চলে রোমান সাম্রাজ্যের সময়। রোম বাদে সাম্রাজ্যভুক্ত সকল অঞ্চলের অধিবাসীরাই দাস বলে বিবেচিত হতো। গ্রীক, ফ্রেঞ্চ, আফ্রিকান কেউই বাদ যায়নি রোমানদের দাসত্বের তালিকা হতে। ধারণা করা হয়, ১০০মিলিয়ন ক্রীতদাস কেনা বেচা হয়েছে এই রোমান সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বকালে। কিন্তু দাসদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এবং তাদের মাঝে অনেক মল্লযোদ্ধা(gladiator) থাকায় প্রায়ই রোমান সাম্রাজ্যকে ‘দাস বিদ্রোহ’ সামাল দিতে হত। এর মাঝে ‘স্পার্টাকাসে’র নেতৃত্বে সংগঠিত ‘তৃতীয় দাস বিপ্লব’ রোমান ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে আছে। তবে প্রতিটি বিদ্রোহের পরেই পরাজিত দাসদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
দাসদের শ্রমে গড়ে তোলা প্রাচীন রোম
এরপর মধ্যযুগে দাস ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র হয়ে হঠে রোমান বায়জেন্টাইন এবং গোটা আরব এলাকা। আরব, গ্রীক, ইহুদী এবং ভাইকিং বণিকগণ এসব অঞ্চলে নিয়মিত দাস সাপ্লাই দিত। তবে, ১,০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ইরাকে পূর্ব আফ্রিকান ‘যানজ’ গোষ্ঠীর বিদ্রোহের ফলে আরবে আফ্রিকান ক্রীতদাসের চাহিদায় ধ্বস নামে। ইসলামী খলিফার শাসন চলাকালীন ইউরোপে বিভিন্ন অভিযান হতেও খ্রিস্টান দাস সংগ্রহ করা হত। এদিকে উত্তর আফ্রিকার জলদস্যুরা প্রায়ই ইউরোপের বিভিন্ন উপকূলে হানা দিয়ে, ক্রীতদাস যোগাড় করে এনে মরক্কো, ইয়েমেন এবং আলজেরিয়ার বাজারে বিক্রি করত। মধ্য এশিয়ার বর্বর তাতারদের হাতেও প্রায় দশ লক্ষাধিক পূর্ব ইউরোপিয়ানকে দাসত্ব বরণ করতে হয়।
পূর্ব ইউরোপের একটি দাস বাজার
সমগ্র দুনিয়াতেই এভাবে একসময় দাসপ্রথার শিকড় বিস্তৃত হয়েছিল। কিন্তু যখন মানবতা মুক্তির জন্য হাঁসফাঁস করছে, তখনি এর গলা টিপে ধরে আরও আড়াইশ বছরের জন্য একে অতলে পাঠিয়ে দেওয়া হল নতুন বিশ্ব বলে পরিচিত আমেরিকায়। জন মানবহীন অনন্ত বিস্তৃত উর্বর ভূমি, নতুন ভবিষ্যতের হাতছানি; ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল হতে দলে দলে মানুষ পাড়ি জমাল আমেরিকার উদ্দেশ্যে। আর এই নতুন বিশ্বকে মানুষের আবাসস্থলের উপযুক্ত করে তোলার কাজে দলে দলে ক্রীতদাস পাঠানো হলো জাহাজে করে। এই দাস ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল ইংরেজদের হাতে, যার পথ প্রদর্শক ছিল স্যার ফ্রান্সিস ড্রেকস।
ইতিপূর্বে দাসদের রকমফের থাকলেও আমেরিকায় এসে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গরাই চিরস্থায়ী দাসত্বের পরিচয় পায়। ১৬৫০ সালে 'এন্থনি জনসন' নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রথম আমেরিকায় আসে দাস হিসেবে।
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস 'এন্থনি জনসন'
মূলত দক্ষিনের রাজ্যগুলোর তুলা প্ল্যান্টেশনগুলোয় এই দাসদের কাজে লাগাতে হত। ইংল্যান্ড হতে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমেরিকায় উন্নতির জোয়ার এলে দাস ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে উঠে। পশ্চিম আফ্রিকার সীমান্তবর্তী দেশগুলো হতে এদের ধরে জাহাজে করে আমেরিকায় নিয়ে আসা হত। দাসদের সন্তানেরাও দাস হিসেবেই রয়ে যেত। তাদের মূল্য খুব একটা বেশী না হলেও যেহেতু তাদের কোন নিজস্ব উপার্জনের উপায় ছিল না, তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা দাস হিসেবেই রয়ে যেত। কোন মানুষ হিসেবে নয়, শুধুই খেঁটে খাওয়া পশুর মত বিবেচিত হত তারা। কাজে বিন্দুমাত্র ভুল হলেই বেঁধে নির্দয় ভাবে চাবুক পেটা করা হত তাদের। রোগে ভোগে মারা গেলেও তাদের কোন চিকিৎসা দেওয়া হতো না।
নির্মম প্রহারে ক্ষত বিক্ষত একজন কৃষ্ণাঙ্গ দাস
কিন্তু আশার কথা ছিল যে, দাসপ্রথা তুলা উৎপাদনকারী দক্ষিণাঞ্চলে যতোটা প্রকট ছিল, উত্তর অঞ্চলের মানুষ ছিল ততোটাই উদার। তাদের অনেকেই দাস প্রথার বিরুদ্ধে সরব ছিল। ১৭৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন উত্তর, পশ্চিমের রাজ্যগুলোতে আইন করে দাস প্রথা বন্ধের উদ্যোগ নিলেও মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। এরপর ১৮০৪ সালে ‘মেসন-ডিক্সি’ লাইনের উত্তরের রাজ্যগুলো একত্র হয়ে দাসপ্রথা বিলোপের উদ্যোগ নেয়। উত্তরের রাজ্য হতে এই অনাচার বিদায় নিলেও দক্ষিণের রাজ্যগুলো তাদের তুলা চাষ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে দাসপ্রথাও বহাল রাখে। কিন্তু দাসপ্রথা উঠিয়ে দেবার জন্য দক্ষিণের রাজ্যগুলোর উপর কেন্দ্রীয় সরকারের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে উত্তর-দক্ষিণের বিরোধ তুঙ্গে উঠে, ফলে ১৮৬১ সালে দক্ষিণের ১১টি কনফেডারেট রাজ্য আমেরিকা থেকে বেরিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়। অপরদিকে উত্তরের রাজ্য গুলো ইউনিয়নের দাবীতে একে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়; সূত্রপাত হয় 'আমেরিকান সিভিল ওয়ার'।
১৮৬২-৬৩ সালের একটি প্ল্যান্টেশন
কনফেডারেট অঞ্চলের দাসেরা মুক্তির জন্য পালিয়ে গিয়ে ইউনিয়ন বাহিনীতে যোগ দিতে থাকে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল কোন এক পক্ষের ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে খুব শীঘ্রই যুদ্ধের অবসান ঘটবে, কিন্তু দাসপ্রথা প্রশ্নে দুই পক্ষেরই অটল, অনমনীয় মনোভাবে যুদ্ধ গভীর থেকে গভীরে যেতে থাকে। এরই মাঝে আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালের ১লা জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে ‘Emancipation Proclamation’ জারি করেন। এর ফলে অধিকৃত কনফেডারেট এলাকার দাসদের মালিকের অধীনে থাকা, না থাকা তাদের ইচ্ছাধীন করে দেওয়া হল এবং একই সাথে ইউনিয়ন বাহিনী’তে যোগ দেওয়ার বিনিময়ে তাদের স্থায়ীভাবে মুক্ত ঘোষণা করা হলো।
Emancipation Proclamation ঘোষণার মুহূর্তে আব্রাহাম লিঙ্কন এবং তাঁর কেবিনেট
কিন্তু লিঙ্কন এই ব্যবস্থা নিয়েও সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, কারণ আদালত যে কোন সময় তার এই আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে দিতে পারে; তাই তিনি সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিলেন। রিপাবলিকান অধ্যুষিত সিনেটে ১৮৬৪ সালে এই আইনটি পাশ হয়ে গেলেও, কেন্দ্রীয় কংগ্রেসে এর ভবিষ্যৎ ছিল অনিশ্চিত; এর জন্য যে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দরকার। যুদ্ধের ময়দানের পাশাপাশি এবার রাজনীতির মাঠেও খেলা জমে উঠল। দক্ষিণের রিপাবলিক ভোট এবং উত্তরের ডেমোক্রেটিক আসনগুলো হয়ে উঠল মূল লক্ষ্যবস্তু, দুই দলের কাছেই এরা ছিল ঘরের শত্রু বিভীষণের মত।
ভোটের জন্য রিপাবলিকান ফিল্ড অফিসাররা নানা প্রলোভন দেখিয়ে ডেমোক্রেট ভোট আদায়ে সচেষ্ট হয়। অপরদিকে ডেমোক্রেটরা চাচ্ছিল, ভোটগ্রহণ পিছিয়ে দিয়ে যেন যুদ্ধের পরে করা হয়; তাহলে হয়তো পরাজিত সাউদার্নরা আবারও একতাবদ্ধ হয়ে দাসত্বপ্রথা বহাল রাখার সুযোগ পাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন তাদের এই সুযোগ দিতে নারাজ। এক পর্যায়ে উত্তর-দক্ষিণের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের গুজবও ছড়ানো হয়, কিন্তু সকল কিছু ভেস্তে দিয়ে অবশেষে ১৮৬৫ সালের ৩১শে জানুয়ারি এই আইনের পক্ষে সংবিধান সংশোধনের জন্য হাউজে উত্থাপন করা হলো। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, খুব সামান্য ব্যবধানে(১১৯-৫৬) দুই তৃতীয়াংশ ভোট অর্জনের মাধ্যমে এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়, যায় ফলে আমেরিকার সংবিধানে যুগান্তকারী এই পরিবর্তনটি আনতে আর কোন বাঁধা রইল না। ইতিহাসে এটি 'মহান ত্রয়োদশ সংশোধনী' নামে পরিচিত। এর মাধ্যমেই দাস প্রথা আমেরিকায় সম্পূর্ণরূপে বিলোপ হয়, দীর্ঘদিন ডুকরে কাঁদা মানবতা অবশেষে মুক্তি পায়।
এরপর, ১লা ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন এই সংশোধনীতে স্বাক্ষর করেন এবং ১৮৬৫ সালের ৬ই ডিসেম্বর হতে এই আইনের বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়।
প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনের স্বাক্ষরকৃত আমেরিকার 'Thirteenth Amendment'
দাসত্ব প্রথা বিলোপের শেষ কাঁটা হয়ে ছিল আমেরিকা, এখানে বিলোপ করার মাধ্যমে পৃথিবীকে এই জঘন্য প্রথা হতে মুক্তি দিতে আর বাঁধা থাকলো না। যদিও প্রকৃত মানুষের মর্যাদা পেতে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের আরও শত বছর লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছিল।
আর এই আইন পাশের মাত্র চার মাসের আমেরিকার ইতিহাসের এই মহান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। কিন্তু উনার নাম পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে আছে, আমেরিকানরা শ্রদ্ধা ভরে এই মহান নেতাকে স্মরণ করে, এমনকি বিরোধী ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এই মহান প্রেসিডেন্টের ব্যবহৃত বাইবেল ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত, স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘লিঙ্কন’ মুভিটিতে এই ঐতিহাসিক ঘটনার চমৎকার দৃশ্যায়ন দেখতে পাবেন।
'লিঙ্কন' মুভিটির একটি দৃশ্য এবং ডাউনলোড লিঙ্ক http://thepiratebay.se/torrent/7959483
পৃথিবীর বুকে আভিধানিক দাসত্ব প্রথা হয়তো আর সেভাবে নেই, কিন্তু এখনো আমাদের বাসগৃহে দরিদ্র গৃহ-পরিচারিকার উপর চালানো হয় বর্বর নির্যাতন, এটা দাসত্ব ছাড়া কিছুই নয়। অল্প বয়সী বাচ্চাগুলো পিতা মাতা ছেড়ে আমাদের গৃহে সেবা করে যাচ্ছে; তাদেরও তো স্নেহ দেওয়া যায়, লেখা পড়া শিখিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া যায়।
(প্রিয় লেখক, আপনাকে ভুলে যাচ্ছি, আসলে মানুষ তো এমনই হয়। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।)