খেলা মানেই শুধু নিখাদ বিনোদন নয়, এর পিছনে থাকে মর্যাদা এবং গৌরবের লড়াই; তা সেটি যে পর্যায়েরই হোক না কেন। নিজেদের মাঝে কে ভালো খেলে, তা নিয়ে হয়তো ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কেয়ামত পর্যন্ত লড়াই করে যাবে। আবার জাতীয় পর্যায়ে দুটি দেশের সম্পর্কও এই খেলার মাঝে এনে দিতে পারে বাড়তি উত্তেজনা, যেমনটি ঘটে ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান এবং কিছুটা হলেও ফুটবলে জার্মানি-ইংল্যান্ড এর মাঝে। আভ্যন্তরীণভাবেও সাধারণত দেশের শীর্ষ দুটি দলের মাঝে লড়াইয়ে অন্যরকম একটা আবহ থাকে, যেমন- ম্যান ইউ আর লিভারপুল, আমাদের দেশের আবাহনী-মোহামেডান । তবে, এ সব কিছুকেই যেন ছাড়িয়ে গেছে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দুটি দল বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। শত বর্ষের পুরান রক্তক্ষয়ী ইতিহাস, সামরিক জান্তার প্রভাব, খেলোয়াড়দের বিশ্বাসঘতকতা আর সাম্প্রতিক সময়ের মেসি-রোনাল্ডো সবকিছু মিলিয়ে এই দ্বন্দকে পৌঁছে দিয়েছে একটি ভিন্ন মাত্রায়।
ইউরোপে ফুটবলের নতুন মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে এল ক্লাসিকোর একটি ম্যাচও হয়ে গেছে। হোম ম্যাচে বার্সেলোনা জিতলেও রিয়াল সুবিধাজনক পরাজয় আদায় করে নিয়েছে। তো এমনই জমজমাট মুহূর্তে চলুন জেনে নেওয়া যাক তাদের এই বিখ্যাত লড়াইয়ের জমজমাট ইতিহাসটুকুও।
ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও জাতি আর ভাষাগত সমস্যা কখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি স্পেন। কাস্তালিয়ান-কাতালান দ্বন্দ আর সেই সাথে স্বাধীনতাকামী মুসলিম বাস্ক জাতি গোষ্ঠীর বিদ্রোহে গত শতকের শুরু থেকেই স্পেন ছিল উত্তাল। সুবিধা বঞ্চিত কাতালানরা দাবী আদায়ে সোচ্চার হলেই খড়গহস্ত হত কাস্তালিয়ান শাসিত মাদ্রিদ ভিত্তিক প্রশাসন। শ্রমিকপ্রধান কাতালানরা তাই নিজেদের আধিপত্য দেখানোর জায়গা হিসেবে বেছে নেয় ফুটবলের মাঠকে। ১৯০২সালে বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদের মাঝে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচটিতে ৩-১ গোলে জয় পায় বার্সা।
রিয়েল মাদ্রিদ ১৯০৫
আর্থিক এবং অন্যান্য দিক দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ সরকারের মদদপুষ্ট হলেও একদিক দিয়ে বার্সেলোনা সবসময়েই এগিয়ে ছিল, তা হল সমর্থকদের ভালোবাসা। বার্সেলোনা ক্লাবের সদস্য হওয়াকে তারা কাতালান আদর্শের একটা অংশ বলেই বিবেচনা করত। অপরদিকে মাদ্রিদ ছিল জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্দীপ্ত, স্পেনের অভিজাত পরিবারগুলো ছিল এর প্রধান ভরণ-পোষণকারী। বড় বড় সরকারী কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর জেনারেলরা হতেন মাদ্রিদের প্রথম সাড়ির সদস্য।
এরই মাঝে ১৯৩৬সালে স্পেনে শুরু হোল গৃহযুদ্ধ। একদিকে নাজি জার্মান এবং ফ্যাসিস্ট ইটালি সমর্থিত ন্যাশনালিস্ট বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিল জেনারেল ফ্রাঙ্কো অন্যদিকে সোভিয়েত সমর্থিত কাতালান, বাস্ক এবং বাম সমন্বয়ে গড়া রিপাবলিকান বাহিনী। ৩বছর ধরে চলা যুদ্ধে রিপাবলিকানরা পরাজয় বরণ করে, সমস্ত স্পেন ফ্রাঙ্কোর একক শাসনে চলে আসে। এর ফলে মাদ্রিদের সুসময়ের সূচনা হলেও যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বার্সেলোনার অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়, যুদ্ধে নিহত হয় বার্সার প্রেসিডেন্ট জোসেপ সুনিওল। নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্রাঙ্কো নিযুক্ত এনরিকে পিনারিও’কে, বার্সার প্রেসিডেন্ট হয়ে সে উল্টা বার্সার দলীয় সঙ্গীত এবং পোষাকে লাল, হলুদ রঙের কাতালান মনোগ্রাম নিষিদ্ধ করে।
বার্সা-রিয়াল ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনাটি ১৯৪৩ এর কোপা ডেল এর সেমিফাইনালের সময়। প্রথম লেগটি ৩-০তে জিতে এগিয়ে ছিল বার্সা। কিন্তু দ্বিতীয় লেগে ম্যাচের আগে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীসহ বার্সেলোনার ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করে ফ্রাঙ্কোর স্বরাষ্ট্র সচিব, সরাসরি খেলোয়াড় এবং তাদের পরিবারের জীবনের উপর হুমকি দেওয়া হোল। ম্যাচ শেষে ফলাফল দাঁড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সাঃ ১১-১। মর্যাদার প্রশ্ন কতটা তুঙ্গে উঠলে রাষ্ট্রজান্তা এমনটা করতে পারে, ভেবে দেখুন। :-&
ঐতিহাসিক সেই খেলার স্কোরবোর্ড
পরবর্তীতে ক্লাব সভাপতির পালা বদলে আবারো ঘুরে দাঁড়ায় বার্সেলোনা, ইতিমধ্যে কাতালানাদের স্বাধীন, দৃঢ়চেতা মনোভাবের জন্য স্পেনের অন্যান্য ছোট জাতিগুলোরও প্রিয় দলে পরিণত হয়েছে তারা। সবকিছুই ঠিকমত চলছিল, এরই মাঝে আবারো এক ঝামেলা বাঁধল। এবার ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু এক আর্জেন্টাইন, অনেকের মতে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় আলফ্রেড ডি স্টেফানো; আর নেপথ্যে আবারো সেই ফ্রাঙ্কো সরকার। ডি স্টেফানো কলম্বিয়ায় খেলার সময় নজরে পড়ে বার্সেলোনার স্কাউট দলের, দেরী না করে ফিফার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বার্সার পক্ষে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয় তাকে দিয়ে।
রিয়ালের পক্ষে জেতা ট্রফি সাথে ডি স্টেফানো
কিন্তু পুরোই বেঁকে বসল রিয়াল, কিছুতেই ডি স্টেফানোকে বার্সায় খেলতে দেওয়া যাবেনা। খোদ স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন নেমে এল রিয়ালের পক্ষে। সকল বিদেশী খেলোয়াড়কেই নিষিদ্ধ করতে উদ্যত হোল, এক পর্যায়ে ফিফার হস্তক্ষেপে এই সমস্যার সমাধান হোল এইভাবে, ডি স্টেফানোর ৪ বছর চুক্তির মধ্যে প্রথম ২বছর খেলবে বার্সায় এবং পরের ২বছর রিয়ালে। শেষপর্যন্ত এই সামান্য সুখটুকুও বার্সার কপালে থাকলো না, বন্দুকের মুখে স্টেফানোকে পুরো ৪বছরের জন্যই নিজেদের করে নিল রিয়াল।
খেলার মাঠে কাতালানদের বিক্ষোভ
১৯৭৫এ ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর খেলাধুলার উপর রাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু সমর্থক এবং ক্লাব অফিশিয়ালদের মাঝে সেই পুরান উত্তেজনাটা ঠিকই জিইয়ে থাকে, এক ক্লাবের খেলোয়াড় অন্য ক্লাবে খেলতে যাওয়ার উপর একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হয়। আর যুগে যুগে এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমর্থকদের চোখে ভিলেনে পরিণত হন মাইকেল লাউড্রপ, ফিগো, ইতোর মত সুপার স্টারেরা। দলবদলের পর যখনি আবার পুরান ক্লাবের মাঠে খেলতে গিয়েছেন, কপালে জুটেছে সমর্থকদের দুয়োধ্বনি আবার কখনো সমর্থকদের ছুঁড়ে দেওয়া বস্তুর আঘাতে মাঠ থেকেই চলে আসতে হয়েছে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা পাওয়া এসব খেলোয়াড়দের।
বিশ্বাসঘাতক(!) লুই ফিগোকে লক্ষ করে শুয়োরের মাথা নিক্ষেপ করে বার্সা সমর্থকরা
এই হোল, খেলার মাঠে বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া কাতালান-কাস্টালান লড়াইয়ের শত বর্ষের পুরান ইতিহাস, যার ধারা এখনো বয়ে চলেছে এবং সাম্প্রতিক কালের মেসি-রোনাল্ডো শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই আবারো ঘি ঢেলেছে এই আগুনে। আর আমরাও হাজার মাইল দূরে থেকেও বার্সা-রিয়াল শিবিরে ভাগ হয়ে কখনো শামিল হচ্ছি কাতালান বিপ্লবে আবারো কখনো স্প্যানিশ জাতীয়তাবাদী পতাকাতলে।
পোষ্টটি উৎসর্গ করলাম দুজন ছোট ভাই এবং সেই সাথে সহব্লগারকে;
১। একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হলেও মেসির হ্যাট্রিকের দিন রাতে রিপোর্ট লেখার সময় যে রাইটার্স ব্লকের শিকার হয়- নিশাচর ভবঘুরে
২। ফেসবুকে রিয়াল মাদ্রিদের ফ্যান পেজ খুলে লাইকের অভাবে হতাশায় ভোগা একজন পেজ এডমিন- বিরোধী দল।