১
বিজ্ঞান একাডেমীর সভাপতি মহামান্য ক্লাউস তার সুবিশাল কক্ষের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একমনে ভাল্কারাই-X840 গ্রহের দ্বিতীয় সূর্যের অস্তকালীন সৌন্দর্য অবলোকন করছেন। কিন্তু তাঁর মনটি আজ খুবই বিক্ষিপ্ত অবস্থায়!! কোনকিছুই যে ঠিক ভাবে হচ্ছেনা। যেই ‘বায়োবট প্রজন্ম' উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি হয়েছিলেন, তাঁর কোন কিছুরই আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছেনা।
যখনই তিনি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন তখনই স্মরণ করেন ক্রুগো’কে। মূল কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণকারী অষ্টম প্রজন্মের কম্পিউটার এই 'ক্রুগো', একজন মানুষের যাবতীয় মানবীয় গুণাবলীর সমন্বয় ঘটানো হয়েছে এই কম্পিউটারের মাঝে।
শূন্য কক্ষে এক ভরাট কণ্ঠ ভেসে এল - আপনার সেবায় হাজির মহামান্য ক্লাউস।
গলায় বিরক্তি নিয়ে মহামান্য ক্লাউস বললেন – দয়া করে চুপ যাও, তোমার সেবাই তো আমাকে ধ্বংস করেছে ক্রুগো। যেখানে এখন সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ের রোবটটিও পঞ্চম মাত্রার বুদ্ধিধারণ করে, সেখানে তোমার কথামত নিনীষ স্ক্লেলে তৃতীয় মাত্রার সব নির্বোধকে বিজ্ঞান পরিষদে নিয়োগ দেওয়া হোল। এখন এরা সবাই মিলে ক্রিপটন গ্রহের তেজস্ক্রিয় মেঘের মত গভীর হতাশায় আমাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু ধূর্ত ক্রুগো জানে, এসময় কিভাবে ক্লাউস’কে শান্ত করতে হয়।
বলল - মহামান্য ক্লাউস স্বল্প বুদ্ধি নিয়েও কিন্তু তারা নিরলসভাবে আপনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা আপনার পিতা মহান গ্রুটাসের নামে দুই ধরনের রোবট, তিনটি কুরু ইঞ্জিনবিশিষ্ট মহাকাশযান এবং একটি নক্ষত্রের নামকরণ করেছে মহামান্য।
এইবার যেন মহামান্য ক্লাউস একটু নরম হয়ে আসলেন, বললেন - তা ঠিক, ওরা অনেক কিছুই করছে কিন্তু তাদের বর্তমান আচরন এবং চিন্তা ভাবনা অনেক দুর্বোধ্য ঠেকছে আমার কাছে।
আমরা হাজার বছর ধরে এই গ্রহে বাস করে আসছি এবং এখানে আমাদের ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু তার আগের কিছুই আমাদের জানা নেই, কারণ আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা অত্যন্ত কৌশলে এই তথ্যগুলো মূল তথ্যভাণ্ডার মুছে দিয়ে গেছেন।
তোমাকে দায়িত্ব দেওয়া হোল, সদস্যদের এই আচরনের কারণ জেনে আমাকে জানাবে।
২
দ্বিতীয় সূর্যের রেশ মিলিয়ে যেতেই কেন্দ্রীয় নিওক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ফুয়েল রডগুলো পাল্টে দিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হোল ‘রুকাস’। সে আর কতগুলো চতুর্থ পর্যায়ের রোবট মিলেই প্ল্যান্টের এই যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের কাজগুলো করে থাকে। এখন তার অধীনে প্রায় আড়াই হাজার রোবট কাজ করে এই প্ল্যান্টে, কিন্তু আশ্চর্যের কথা কিছুদিন পূর্বেও এই বিষয়ে তার কোন দক্ষতাই ছিলনা; বাড়ি বাড়ি ঘুরে পানির লাইন ঠিক করাই ছিল একমাত্র পেশা। কিন্তু মহামান্য ক্লাউসের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হয়, ‘যে পানির পাইপ পাল্টাতে পারে সে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টও ঠিক করতে পারে। আসলে নাট এবং বল্টু চিনতে পারাই মূল কথা’। এরকম যোগ্যতাবলে ইতিমধ্যে সে বিজ্ঞান পরিষদের একজন সদস্যও হয়ে গেছে।
ঘরে ফিরে একটা উত্তেজক পানীয়তে চুমুক দিতে দিতে যোগাযোগ মডিউলটা চালু করল রুকাস, তারপর সারাদিনে গ্রহে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো একে একে দেখতে লাগল।
প্রথম খবরটি দেখেই হাসি পেয়ে গেল তার, গাঢ় বেগুনী রঙের নিউ পলিমারের পোশাক পরে বিজ্ঞান পরিষদের সদস্যা মহামতি ত্রানা’কে দেখাচ্ছে। গ্রহে এখন সবাই স্বচ্ছ নিউ পলিমারের পোশাক পরলেও ত্রানার জন্য আইন করে গাঢ় বেগুনী পলিমারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, কারণ প্রথমদিকে স্বচ্ছ পলিমারে তাঁকে দেখার পর গ্রহের অনেকেরই মানবিক বৈকল্য দেখা দিয়েছিল। এমনকি মহামান্য ক্লাউস পর্যন্ত টানা কয়েক রাত দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন।
স্বভাবসুলভ ভাবেই ত্রানা তার বক্তব্য দিলেন- রোবটরা ইদানিং কোন ইভটিজিং করেনি, কাজেই কপোট্রনের অবস্থা বিগত ১০ সৌর-গ্রহনের মাঝে সবচেয়ে ভালো আছে।
কিন্তু দ্বিতীয় খবরটি দেখেই রীতিমত চমকে উঠল রুকাস। বিজ্ঞান পরিষদের নবনিযুক্ত সদস্য ফিহা’র বাইভার্বালের চালক রোবটটি হঠাৎ বিগড়ে গিয়ে বাইভার্বাল সহ প্রতিরক্ষা রোবটদের সিকিউরিটি সিস্টেমে ঢুকে পড়ে এবং 'বাইভার্বালে নিউরো-কপোট্রন আছে' বলে চিৎকার করতে থাকে। উল্লেখ্য নিউরো-কপোট্রন বহু আগেই আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু নিজের বুদ্ধিহীনতা ঢাকতে অনেকেই অবৈধভাবে এটি ব্যবহার করে।
ফিহা’র এই দুর্দশা দেখে মনে মনে খুশি হয়ে উঠল রুকাস, ‘ব্যাটা অনেক বাড় বেড়েছিল। প্রায়ই তাদের বুদ্ধিহীন বলে কটাক্ষ করত’।
এখন সে বুঝতে পারবে- 'ব্ল্যাকহোল ধরলেও ছেড়ে দেয় কিন্তু ক্লাউস ধরলে কাউকে ছাড়েনা’।
এমন খুশির একটি দিন এখন প্রিয়বন্ধু ত্রাশুলের সাথে পালন না করলেই নয়। ত্রাশুল খুবই ভালো বন্ধু, বিজ্ঞান পরিষদে একটি ছোট পদ পেয়েও এদিক সেদিক করে অনেক ক্রেডিট জমিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আসলে ত্রাশুলের মত এমন উদ্যমী ছেলে কমই আছে, এখনো নিয়মিত ২ঘণ্টা দৌড়ায় সে। কারণ মহামান্য ক্লাউস বলেছেন, ‘বিজ্ঞান পরিষদের সদস্যপদ টিকিয়ে রাখতে হলে বুদ্ধি নয়, শারীরিক সক্ষমতাই বড় গুন’। এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার প্রাত্যহিক দৌড় পর্ব শেষ হয়ে এসেছে; দুই বন্ধু মিলে আরও কিছু উত্তেজক পানীয় পান করতে করতে আর সাথে 'ইভুজ' নামক এক জনপ্রিয় শিল্পীর গান শুনতে শুনতে সুন্দর করে সন্ধ্যাটা পার করে দিবে।
৩
বিজ্ঞান পরিষদের এক জরুরী সভা আহ্বান করা হয়েছে। ছোট বড় সকল সদস্য বিশাল হলরুমটিতে জড়ো হয়েছে। কিন্তু কারও মুখে কোন কথা নেই সবাই ভীতদৃষ্টিতে সভাপতি ক্লাউসের টেবিলের দিকে নিচু করে রাখা মাথার দিকে চেয়ে রয়েছেন। তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছেনা, কাজেই অভিব্যক্তি বুঝারও কোন উপায় নেই। অবশেষে যখন বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি মুখ তুললেন, সবাই দেখতে পেল হতাশার গভীর মেঘ তাঁর মুখে জড়িয়ে আছে। অজানা আশঙ্কায় সবারই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল।
শেষ পর্যন্ত বলতে শুরু করলেন ক্লাউস -- মাননীয় সদস্যবৃন্দ, অনেক আশার মাঝে দিয়ে আমাদের এই পরিষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। গতকয়েকদিনে আপনারা একের পর এক কাজ করে গেছেন যা ছিল এই গ্রহের সিস্টেম কোড-১ এর সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কিন্তু এজন্য আপনাদেরকে কোন দোষ দিবনা আমি, কারণ আমি নিজেও এর বাহিরে নই।
আমাদের এই আচরনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ক্রুগো একটি অতিআশ্চর্য ঘটনা আবিষ্কার করেছে। তা হোল, আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে পৃথিবী নামক এক গ্রহে বাংলাদেশ নামক এক দেশ ছিল। সেই দেশে একসময় এক ভয়ঙ্কর শাসক ক্ষমতায় বসেছিল। সে এবং তার মন্ত্রীসভার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একসময় দেশের মানুষ তাদের সকলকে মহাকাশযানে করে সুদূর এনড্রোমিডার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয় এবং বিনোদনের জন্য সাথে ঐসময়ের একজন কুখ্যাত গায়িকাকেও তাদের সাথে পাঠায়।
তারাই এসে এই গ্রহে জীবনের সূত্রপাত ঘটায়; যা পরবর্তী হাজার বছর ঠিকমতই চলছিল। নতুন প্রজন্মরাও নিজেদের অনেক শুধরে নিয়ে ক্রমশই উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু ক্রুগো পরীক্ষা করে দেখেছে যে, এক হাজার বছর পরে তাদের সেই জিন একই বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবারো আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে এবং এই কারণেই আমরা এই ধরনের কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়, সেই কুখ্যাত গায়িকার বৈশিষ্ট্য পর্যন্ত বর্তমানের ইভুজ নামক একজন জনপ্রিয় গায়িকার মাঝে পাওয়া গেছে।
মহামান্য ক্লাউসের মুখে এমন অবিশ্বাস্য, আশ্চর্যজনক কথা শুনে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল, কি বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। অবশেষে সাহস করে ত্রাশুল মুখ খুলল – মহামান্য ক্লাউস, আমাদের তো এখনই ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই। আমরা যদি আবার নিয়ন্ত্রিত আচরন করতে পারি তাহলেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
মহামান্য ক্লাউস উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন – সবকিছু শেষ হয়ে গেছে ত্রাশুল, ইতিমধ্যে আমরা চরম সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি। গ্রহের সমস্ত জনগণ এক হয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে, আবারো তারা আমাদেরকে মহাকাশযানে করে অজানার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিবে। আরও ভয়ঙ্কর যে, ইভুজ’কেও আমাদের সাথে পাঠানোর জন্য এরই মধ্যে মহাকাশযানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এই সভা শেষ হলেই প্রতিরক্ষা রোবটরা আমাদেরকেও সেইখানে নিয়ে যাবে।
কেউ আর কোন কথা বলল না। অমানুষিক ভীতি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, ‘কখন ক্রুগো সভার সমাপ্তি ঘোষণা করবে.........’