১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ইডেন হোটেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে দলের নেতৃত্ব এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদেশে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। এ নির্বাচনের পেছনে দুটি কারণ বিদ্যমান ছিল বলে সর্বমহল থেকে বলা হয়েছে। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাজনীতি যেভাবে দক্ষিণপন্থীদের হাতে চলে যাচ্ছে তাকে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন। এক সময়কার প্রগতিশীলদের এক বড় অংশই ক্ষমতার লোভে সামরিক শাসকের সহযোগী হয়ে সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। এমনই পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কাছে শতভাগ আস্থাশীল নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দেয়। এছাড়া পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং বাস্তব অবস্থার নিরিখে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দলের দায়িত্ব প্রদানের দাবী ওঠে দেশের সর্বস্তরে।
নেতা-কর্মীদের আশা আকাঙ্খা এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুভব করে বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং বিশ্বস্ত নেতৃত্বের অনেকেই দিল্লী গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করে তাঁকে রাজি করাতে সমর্থ হন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ সেলিম, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, ডা. এসএ মালেক এবং দলীয় নেতাদের মধ্যে জিল্লুর রহমান, আইভি রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, আবদুর রাজ্জাক, কোরবান আলী, সাজেদা চৌধুরী প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে দিল্লী গিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার খোঁজ-খবর নেন এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। অবশেষে ভারতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে প্রথমবারের মতো সভাপতিমণ্ডলী গঠন করা হয়।
কমিটির মূল কাঠামো হলো সভাপতি : শেখ হাসিনা
সভাপতিমণ্ডলী : আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, কোরবান আলী, জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল মমিন তালুকদার, ফণিভূষণ মজুমদার।
সাধারণ সম্পাদক : আবদুর রাজ্জাক
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক : বেগম সাজেদা চৌধুরী ও আমির হোসেন আমু
সম্পাদক মণ্ডলী :
সাংগঠনিক : তোফায়েল আহমদ
প্রচার : সরদার আমজাদ হোসেন
দফতর : সৈয়দ আহমদ
শিক্ষা ও গবেষণা : এস এম ইউসুফ
সমাজকল্যাণ : মফিজুল ইসলাম কামাল
মহিলা : আইভি রহমান
শ্রম : এস এম তালেব আলী
কৃষি : অধ্যাপক মোঃ হানিফ
যুব : মোঃ নাসিম
আন্তর্জাতিক : আবদুল জলিল
সাংস্কৃতিক : শফিকুল আজিজ মুকুল
কোষাধ্যক্ষ : ফজলুল করিম
২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেশে প্রত্যাবর্তনসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকা থেকে দিল্লী আসেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ আজাদ, জোহরা তাজউদ্দীন, এম কোরবান আলী, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আইভি রহমান প্রমুখ। পূর্ব থেকেই ছিলেন ডাঃ এসএ মালেক। এ সময় দিল্লীতে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ড. কামাল হোসেন এবং সাজেদা চৌধুরীকে রেখে বাকিরা সবাই দেশে ফিরে যান। এদের দু’জনের ওপর দায়িত্ব ছিল শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা। ঠিক হলো ১৭ কিংবা ২৬ মার্চ শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু পরবর্তীতে ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা এবং কন্যা পুতুলের জলবসন্ত দেখা দেয়ায় শেখ হাসিনার দেশে ফিরে যাওয়া বিলম্বিত হয়।
অবশেষে ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর নির্ধারিত হয় ১৭ মে ১৯৮১ শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে আসবেন। সে এক উত্তেজনাকর আবেগময় ঘটনা। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য দলের পক্ষ থেকে দিল্লী এলেন আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৬ মে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে দিল্লী থেকে কলকাতা এলেন শেখ হাসিনা, কন্যা পুতুল এবং আবদুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। ১৭ মে বিকেলে ঢাকায় বিমান থেকে নামেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রথম এলেন। পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা, তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই আর জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট খুনীদের উন্মত্ততায় নিহত হলেন তারা সবাই। ৩২ নং সড়কের সেই বাড়িটি এখন এক মৃত্যুপুরী। জেনারেল জিয়ার সরকার বাড়িটিতে তালা মেরে পুরো বাঙালী জাতিকে শৃঙ্খলিত করতে চেয়েছেন। সেদিন আকাশে ছিল মেঘ, ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতি যেন শোকের চাদর গায়ে মলিন বদনে শেখ হাসিনার জন্য প্রতীক্ষা করছিল। বিমান থেকে নামার পর শুরু হলো অঝোর ধারার বৃষ্টি যেন শেখ হাসিনার অশ্রু জল হয়ে ভরিয়ে দিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তর। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুপ্রেমির স্লোগানের মাঝে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চৌষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিটি লোকালয়ে। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ১০-১৫ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিল সে সংবর্ধনায়।
এরপর শেখ হাসিনার শুরু হলো এক নতুন জীবন। দলকে পুনর্গঠন আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী তখনও কারাগারে বন্দী। মিথ্যা মামলা আর হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনকে ধ্বংস করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাকে রুখে দিতে হবে। ভয়ভীতি প্রদর্শন আর অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দল ভাঙা, নেতাকর্মীদের ক্ষমতাসীন দলে ভেড়ানোর চেষ্টা এবং কখনও কখনও দলীয় কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় রাখার ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করতে হবে। সারাদেশে দলকে পুনর্জীবিত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।
একই সঙ্গে দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামও শুরু করেন। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের ফলে যে সমস্ত অবৈধ নির্দেশ ও কালাকানুন জারি করে পরবর্তীতে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তা বাতিল এবং পরিবর্তনের দাবি জানান শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংবিধানের চার মূলনীতি পুন:স্থাপনের দাবিও উত্থাপন করেন তিনি। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী এবং জেলহত্যাকারীদের বিচার করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার ও অভিযোগ থেকে মুক্তি, চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতি করার সুযোগদানের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, ঘুষ-দুর্নীতি এবং অবৈধ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধেও তিনি দেশবাসীকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
৭৫ থেকে ৮১- কেমন ছিল বাংলাদেশ?
গোলাম কুদ্দুছ
দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৬ রাত ১:৩৮