সন্ধ্যা আগতপ্রায়। অমরাবতীর অলকানন্দা তীরে সান্ধ্যভ্রমণ শেষে একটি প্রস্তরখন্ডের উপরিভাগে উপবেশন করতঃ যুধিষ্ঠির শ্রমলাঘব করিতেছিলেন।
অন্যদিকে স্বর্গধামের বিনোদনগৃহে নৃত্যগীতবাদ্য, সোম এবং সঙ্গদান নিমিত্তে মেনকা অপেক্ষমান।
- "যুধিষ্ঠির..."
চিন্তাসূত্র ছিন্ন হইলো। চকিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া যুধিষ্ঠির দেখিলেন এক সৌম্যদর্শন পুরুষ দন্ডায়মান,- তাঁহাকে পূর্বপরিচিত প্রতীয়মান হইলো।
যুধিষ্ঠির বিনীতভাবে কহিলেন, "মহাত্মন, আপনার পরিচয়দান করিয়া আমার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করুন।"
আগন্তুক কহিলেন, "আমি যক্ষ, ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া দ্যুলোকে আসিয়াছি। তাই চিনিতে পারিতেছো না।"
যুধিষ্ঠির বিস্মিতকন্ঠে কহিলেন, "আপনি ! আপনার কর্মক্ষেত্র তো ভূলোকে, এইস্থানে আগমনের হেতু কি?
- " তুমি নিশ্চয় বিস্মৃত হও নাই যে, তোমাদিগের বনবাসকালে সরোবরতীরে বকরূপ ধারণ করিয়া সাতটি প্রশ্ন করিয়াছিলাম।"
- "বিলক্ষণ স্মরণে আছে। ইহাও স্মরণ করিতে পারি যে, আমি যথার্থ উত্তরদান করিয়া আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করিয়াছিলাম। এতোদিন পরে সেইকথা স্মরণ করাইবার নিমিত্তে কি এতোপথ পরিভ্রমণ করিয়া স্বর্গধামে আসিয়াছেন?"
- "যুধিষ্ঠির, আসমূদ্রহিমাচলে তুমি 'সত্যবাদী' বলিয়া সুপরিচিত। এক্ষণে বলো, সেইদিন আমার প্রশ্নের উত্তরে তুমি যাহা যাহা বলিয়াছিলে সকলই কি সত্য ছিলো?"
- "আপনার সন্দেহের কারণ আমার বোধগম্য হইতেছে না।"
- "কারণ, ভূলোকে তোমার পরবর্তী কার্যকলাপ আমি প্রত্যক্ষ করিয়াছি। তাহাই কি যথেষ্ট নহে?"
- "মহাত্মন, আমি এক্ষণে স্বর্গধামের অধিবাসী, আপনার অধীনস্থ নহি। সুতরাং বর্তমানে আপনার প্রশ্নের উত্তরদান করিতে আমি বাধ্য নই। তবুও আমি জীবদ্দশায় কাহারও সহিত দুর্ব্যবহার করি নাই বলিয়া সুনাম রহিয়াছে, সেইহেতু এক্ষণে আমি ধৈর্য্যসহকারে এবং নম্রকন্ঠে আপনার প্রশ্নের উত্তরদান করিবো। এক্ষণে শ্রবণ করুন। 'সত্য' শব্দটি আপেক্ষিক। অভিধানমতে, যাহা ঘটিয়াছে এবং ঘটিতেছে তাহাই সত্য। কিন্তু সত্যেরও বিবিধ রূপ এবং মাত্রা রহিয়াছে। বক্তার উদ্দেশ্য এবং স্বার্থের উপর এর অর্থ নির্ভর করে।"
- তাহা হইলে তুমি সেইসময় আমার প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যাচরণ করিয়াছিলে? আমার তখনই সন্দেহ হইয়াছিলো।"
যুধিষ্ঠির শান্তকন্ঠে বলিলেন, "কদাচ নহে, 'মিথ্যা' শব্দটিতে চিরকাল আমার প্রবল অনীহা রহিয়াছে। সত্যকে উপযুক্তরূপে উপস্থাপন করিলে যদি আমার স্বার্থসিদ্ধি ঘটে, তাহা হইলে মিথ্যা বলিবার প্রয়োজন কি? তখন আমার ভ্রাতৃগণের জীবনরক্ষার্থে যেরূপ সত্যভাষণ প্রয়োজন ছিলো, তাহাই করিয়াছি। আপনার নিশ্চয় স্মরণে রহিয়াছে যে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মধ্যভাগে আমাদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যকে যখন বধ করিবার প্রয়োজন হইলো, তখনও আমি সত্য বলিয়াছিলাম, 'অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ"। মিথ্যা বলি নাই, সত্যই অশ্বত্থামা নামক একটি হস্তী বধ করিয়াছিলাম। অধিকন্তু সুক্ষ্মবুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া শেষের দুটি শব্দ ক্ষীণকন্ঠে বলিয়াছিলাম যাহাতে দ্রোণাচার্যের শ্রুতিগোচর না হয়। তাহাতেই অভীষ্ট সিদ্ধ হইয়াছিল।
এহ বাহ্য, অদৃষ্টগুণে প্রাপ্ত দ্রৌপদীর সহিত যখন মিলিত হইতাম, তখন সাবধানতার সহিত প্রণয়-সম্বোধন করিতাম। দ্রৌপদীও প্রীত হইতো। আমি 'প্রণয় করি'র পরিবর্তে 'প্রীতি করি' কহিতাম। তাহাতেই সে সন্তুষ্ট হইয়া প্রণয়ক্রীডায় সহযোগদান করিত। সে কোনোদিন ঘুর্ণাক্ষরে বুঝিতে পারে নাই যে, ইহার মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রহিয়াছে। তৎপরেও বলিতেছি, পাঞ্চালীকে আমি জয় করি নাই - ফাল্গুনী করিয়াছিলো। সেইহেতু আমাকে তাহার আকাঙ্খার প্রশ্ন উত্থিত হইবার কারণ নাই। তাহার এক পঞ্চমাংশ আমি মাতৃ-আজ্ঞায় পাইয়াছিলাম। মাতা কুন্তী যখন আমাদের পঞ্চভ্রাতাকে তুল্যাংশে ভাগ করিয়া লইতে বলিলেন, তখন আমি পাঞ্চালী-জয় বিষয়ে একটিও বাক্যব্যয় করি নাই, মিথ্যাও বলি নাই। কারণ, জনান্তিকে বলি, পাঞ্চালীর মতো অনিন্দ্যসুন্দর নারীর প্রতি আমিও কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হইয়াছিলাম। বুঝিয়াছিলাম, ব্যক্তিস্বার্থের নিমিত্তে সত্যভাষণ অপেক্ষা নীরবতাই শ্রেয়ঃ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীষ্ম প্রভৃতি গুরুজনদিগকে বধ করিবার নিমিত্তে শ্রীকৃষ্ণকৃত রণকৌশল ব্যক্ত করিবার ক্ষেত্রেও নির্বাক ছিলাম তথাপি মিথ্যা কহি নাই, নীরবতাকেই শ্রেয়জ্ঞান করিয়াছি। আপনাকে জ্ঞাত করি, আমার অনুমান- আমাদের কুশলী সত্যের ধ্বজ উড্ডীন রাখিবার প্রচেষ্টার মধ্যেই 'মিথ্যা' নামক বীজের জন্ম এবং অঙ্কুরোদগম ঘটিয়াছে।
ধর্মপুত্র এবং সত্যবাদী অভিধাপ্রাপ্তিহেতু ক্ষত্রিয় ধর্মানুসারে বহুদারগ্রহণ করি নাই যদিও একই বস্তুতে দীর্ঘদিন আকৃষ্ট এবং নিমগ্ন থাকা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।"
যক্ষ কহিলেন, "তাহা হইলে দীর্ঘ দ্বাদশবর্ষ বনবাসে থাকিলে কিরূপে, ক্লান্তিবোধ করো নাই?"
- ইচ্ছাবিরূদ্ধে বাধ্য হইয়া বনবাসে কালাতিপাত করিয়াছি। জানিতাম কোনরূপে দ্বাদশবর্ষ বনবাস এবং অতিরিক্ত একবর্ষ অজ্ঞাতবাসকাল অতিক্রম করিতে পারিলে সিংহাসনপ্রাপ্তি এবং স্বর্গারোহণ দুইই সম্ভব। স্বর্গবাসের আকাঙ্খা আমার দীর্ঘদিনের।
কুরুক্ষেত্রের রক্তপাতের পরবর্তীতকালে সিংহাসনে সমারূঢ় হইয়াও অধিককাল তৃপ্তিবোধ করিলাম না। আপনাকে পূর্বেই বলিয়াছি, একই বস্তুতে আমি দীর্ঘকাল আগ্রহবোধ করিনা। সেইহেতু আমি পরীক্ষিতের হস্তে রাজ্য ও সিংহাসন সমর্পণ করিয়া স্বর্গযাত্রা করিলাম।"
যক্ষ নির্বাক বিস্ময়ে যুধিষ্ঠিরের এমত বাক্যসমুহ শ্রবণ করিতেছিলেন। সম্বিৎ ফিরিলে জিজ্ঞাসা করিলেন, "অতঃপর?"
যুধিষ্ঠির বলিলেন, "স্বর্গযাত্রায় একটি সারমেয় পথপ্রদর্শক হিসাবে আমার অনুসরণ করিয়াছিলো। আমি তাহাকে পরিত্যাগ করি নাই, কারণ তখন আমার অভীষ্ট ছিলো স্বর্গভূমি এবং পথ ছিলো অজ্ঞাত। তাহাকে আমার প্রয়োজন ছিলো। আকৃতি এবং প্রকৃতিতে সারমেয় হইলেও সেইই আমাকে সঙ্গদান করিয়া স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইয়া দিয়াছিলো। কোনোকোনো ক্ষেত্রে ইতরপ্রাণীর মধ্যেও মানবিক গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়।
যাহাহউক, দ্রোণাচার্য্যকে কুশলী 'সত্য' বলিবার কারণে কিয়ৎকালের জন্য আমাকে নরকদর্শনও করিতে হইলো।"
- " হে জ্যেষ্ঠপান্ডব, এখন তুমি কুশলী সত্য কহিতেছো, না শুদ্ধ সত্য কহিতেছো?" যক্ষ জিজ্ঞাসা করিলেন।
- " স্বর্গভূমে কুশলী সত্যের প্রয়োজন নাই, ভূলোকে রহিয়াছে। কারণ, আমাদের মহাপ্রপিতামহ মহর্ষি মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রাচ্যভূম বিশেষতঃ হিমালয় পাদদেশ এবং গাঙ্গেয় উপত্যকার প্রেক্ষাপটে আমাদিগকে সম্যকরূপে জ্ঞানদান করিয়া গিয়াছেন। প্রতীচ্যে এইরূপ বাক্যকুশলতার প্রয়োজন নাই, তাহারা যন্ত্রকুশলতায় অধিক আগ্রহী। তাহারা শষ্যচূর্ণনির্মিত পিষ্টকখন্ডের উপরিভাগে দুগ্ধজাত নবনীর প্রলেপ পাইলেই আনন্দিত হয়, উপরন্তু যবসুরা পান এবং শকটভ্রমণ করিতে পারিলেতো ইহাদিগের বাক্যস্ফূর্তি হয় না- নীরব বিনোদনে মগ্ন হইয়া থাকে। পুরুষগণ নারীগণের সহিত যান্ত্রিক সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী, প্রাচ্যদেশীয়গণের ন্যায় জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে শিল্প-অন্বেষণে অস্থির নয়।
যাহাহউক, তখনও পর্য্যন্ত আমার দেবরাজ ইন্দ্রের দর্শনলাভ ঘটে নাই, শঙ্কিত ছিলাম, স্বর্গ হইতে কোনো তুচ্ছ কারণে বিতাড়িত হই। হঠাৎ কাকতালীয়ভাবে ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত'র দর্শন পাইলাম। তিনি তখন বৃত্রাসুরকন্যার প্রেমে উদভ্রান্ত হইয়া ইতস্ততবিক্ষিপ্ত ভ্রমণ করিতেছেন। তাঁহার সেমত বিপদকালে আমি তাঁহাকে অসুরকন্যাকে হরণ করিয়া পাতাল অর্থাৎ সমূদ্রগর্ভে শুক্তির অন্তরালে লুক্কায়িত থাকিবার পরামর্শ দিয়াছিলাম। তিনি আমাতে আস্থা রাখিয়া তাহাই করিলেন, অসুররাজ স্বর্গমর্ত তন্নতন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিয়াও তাঁহার কন্যার দর্শন পাইলেন না।
ইন্দ্রপুত্র আমার উপকার বিস্মৃত হন নাই। পরবর্তীতে তিনিই তাঁহার পিতা দেবরাজকে অনুরোধ করিয়া স্বর্গভূমে আমার বসবাস করিবার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন।
যাহাহউক, স্বর্গভূমিতেও এই নিস্তরঙ্গ যান্ত্রিকজীবনে আমি মাঝেমাঝে অস্থির বোধ করি। কিন্ত একপ্রকার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি, সেই শৃঙ্খল, একই শয্যায় শয়নপূর্বক নিরাপদ আহার্য্যপানীয় গ্রহণ এবং নিদ্রা। নিস্তরঙ্গ অথচ নিরাপদ স্বর্গবাসের এক স্বেচ্ছাবৃত শৃঙ্খলমাত্র ।
এই একাদিক্রম হইতে মুক্তির জন্য ক্বচিৎ অরণ্যভ্রমণ, মৃগয়া, জলকেলি ইত্যাদিতে প্রবৃত্ত হই যেমন বনবাসকালে জলকেলি করিতে গিয়া আমার ভ্রাতৃগণ বকরূপী আপনার কোপানলে পতিত হইয়াছিলো। কিন্ত জনান্তিকে আপনাকে বলি, ..... থাক, যথাতথা আপন গুপ্ত 'সত্য'র অকপট প্রকাশ সমীচীন নহে।
মহাত্মন, আমার বাক্যসকল শ্রবণ করিয়া, প্রতীয়মান হইতেছে, আপনি বাকরুদ্ধ হইয়াছেন। আপনার ন্যায় আরও একজন দিগ্বিজয়ী মহাবীর যবনসম্রাট আলোকসুন্দর ওরফে সিকান্দর শাহ ওরফে আলেকজান্ডার এই মহাভারতীয় উপত্যকায় বীরদর্পে যুদ্ধাভিযান করিয়াছিলেন।
তিনিও আমাদের বহুমাত্রিক 'সত্য' শ্রবণ করতঃ প্রথম এবং শেষবারের মতো এমত বাক্য, - 'সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ...' উচ্চারণ করিয়া পশ্চাদপসরণ করিয়াছিলেন এবং এই 'সত্য'র ভার বহন করিতে ব্যর্থ হইয়া পথিমধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ করিয়াছিলেন।
যাহাহউক, একদা আমার ভ্রাতৃগণের জীবনরক্ষা করিয়াছিলেন সেইহেতু আপনার সহিত দীর্ঘপ্রহর ক্ষেপণ করিলাম। এইক্ষণে আপনি বিদায় হউন। একটি বাক্য স্মরণে রাখিবেন, বর্তমানে আমি আপনার অধিকারের বাহিরে। যাহা বলিলাম, তাহাও একদা ভ্রাতৃগণের জীবনরক্ষার কৃতজ্ঞতাহেতু।
সন্ধ্যা আগত, বৃথা কালক্ষেপণ নিরর্থক। চন্দন, অগুরু, লোধ্ররেণুতে প্রসাধিত হইয়া মেনকা অপেক্ষমান, নৃত্যগীতবাদ্যের সূচনা হইয়াছে। কিঙ্কিণী-ঝঙ্কার এবং পানপাত্রের মধুর ধ্বনিব্যঞ্জনা একত্রিত হইয়া আমাকে আহ্বান করিতেছে -আমি চিত্তচাঞ্চল্য অনুভব করিতেছি। এক্ষণে কিঞ্চিৎ স্খলিতচিত্তে আপাত-আনন্দযজ্ঞ অভিমুখে যাত্রা করিলাম। বিদায়।
সত্যমেব জয়তে !"