আমি আমার পিতৃকুল এবং মাতৃকুল উভয়দিকেই প্রথম সন্তান হিসেবে জন্মাইয়া ছিলা্ম। ইহার দরুন আমিই ছিলাম সক্কলের চক্ষের মনি।যেথা আমার মাতা মহের বাটী সেথা সবে সুখে শান্তিতে বসত করিত। সে এক প্রত্যন্ত পাড়া গাঁ, শহর হইতে অনেক দূরে।ছবির ন্যায় সাজানো সেই গ্রাম খানি। বাঁশঝার,সতেজ সবুজ ধানের খেত,বাটির পাশ দিয়া সদা বহমান একখানি নদী। বিচিত্র সব পাখ পাখালির পসরা বসিত। ঝোপ ঝাড় আর নানা গাছ গাছালিতে পূর্ণ ছিল তাহার চারপাশ। বাটীর ভিতর বড় ঊঠান,পাশে মস্ত দীঘি দেখিয়াছি সঁন্ধ্যা নামিলে খুব ভাল লাগিত। পাড়াগাঁর নিস্তব্ধতা আর রাত্রির আধাঁর পৃথিবীকে আরও মায়াবী করিয়া তুলিত। তখন মনে হইত পৃথিবীতে হাজার বছর বাঁচিয়া থাকি। জোনাকি পোকার টিপটিপ আলো মনে এক্ষণও জলিয়া রহিয়াছে যেন। পল্কা বাতাস বৃক্ষের পত্র দুলাইয়া মৃদু বহিয়া গেলে হিয়া জুড়াইত।আমি দুইতলার চিলে কোঠা ঘরে যাইয়া আসন পাতিয়া একাকী বসিতাম। চুপ্টি করিয়া থাকিতেই যেন সুখী লাগিত। অপেক্ষা করিতাম কবে সেই খানে যাওয়া হইবে। মন চাহিলেই সেইখানে যাইবার সুযোগ মিলিত না। অপেক্ষা করিতে হইত বিদ্যালয় ছুটি হইবার জন্য।
আমার বিদ্যালয়ে যাইবার কড়াকড়ি ছিল। একদিন বিদ্যালয় কামাই হইলে বড় দায়।শিক্ষক শিক্ষিকা আড়ষ্ট হইতেন । সপ্তাহে একদিন ড্রিল ক্লাস করিতে হইত। সেইদিন ভিন্ন রকমের জামা পরিয়া যাইবার নিয়ম ছিল। কিন্তু আমি প্রায়শ ভুল করিয়া ফেলিতাম । ড্রিলের দিন সকালের দুই ক্লাস করিতে হইত না। সাবাই বিদ্যালয় মাঠে যাইয়া নানা কসরত করিত। উহার আগে ড্রিল মাস্টার তাহার যথা সাধ্য উচ্চ মানের কসরত প্রদর্শন করিয়া দেখাইত,তাহার পরে ওইসব আমাদের করিবার নিয়ম ছিল। উহাতে শিক্ষক সাহেবের চাকুরি বোধ করি টিকিয়া গিয়াছিল। আমি হল্প করিয়া বলিতে পারি তাহার চাকরীর প্রতিদ্বন্দী বা হুমকি হইবার আর কেহই ছিল না। কেহ সেই বিচিত্র কসরত দেখিয়া দম ফাটাইয়া হাসিয়া ফেলিলে তাহার কপালে মেঘের ঘনঘটা দেখা যাইত।“কে হাসিল রে” বলিয়া ব্যাঘ্রের ন্যয় হুঙ্কার দিয়া উঠিতেন। তারপর উপযুক্ত ছাত্রের মুখ খানি আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইলে শিক্ষক ছাত্রের চার নেত্র মিলন হইত। আর ছোট্ট বালকের পরান পাখি যেন উড়িয়া যাইত ভয়ে। মাষ্টার মশাই বত্তিশ দাঁণ্ত প্রসারিত করিয়া এমন বিকট ধমক মারিতেন যে সেই আওয়াজ ছাত্রদের লাইন ছাড়াইয়া গিয়া বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর স্পর্শ করিয়া প্রতিধ্বনিত হইয়া ফিরিয়া আসিত।ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হইত না আমাদের,স্যারের জ্বালা কি? এম্নিতেই সারা সপ্তাহে একদিন ড্রিল ক্লাস,উহাউ যদি ঠিক মত না হয়! চাকুরী থাকিয়াও বেকার। প্রিন্সিপাল আর বাকি শিক্ষক শিক্ষিকা মহোদয় বিকট মুখ করিয়া এই সম্বন্ধীয় কার্যাদি অবলোকন করিতেন এক সারিতে সারি বদ্ধভাবে দাড়াইয়া।
যাহা হউক শেষ অবধি সেথা গাঁয়ে যাইবার মওকা মিলিল। ছোট মামা আমাদের বাড়ি আসিয়া হাজির হইলেন। দু’চার দিন থাকিয়া আমাকেও যাইবার সময় তৎসঙ্গে লইয়া যাইবার বায়না ধরিলেন। আমার পিতৃদেব উহাতে কিঞ্চিত আপত্তি জানাইলেন বটে তবে তাহার আপত্তি টিকিল না। বাড়ি যাওয়া হইবে ভাবিয়া আমার চিত্ত চঞ্চল হইল। অবশেষে মামা ভাগ্নে বাটি পৌছাইয়া গেলাম। আহা! কি সুখ। কেবল সুখ। কত সুখ! এক কেজি না দুই কেজি তাহা বাটখারায় ওজন না দিয়া বলিতে পারিব না। তবে হৃদয় ভরা সুখ বুঝিতে পারিলাম।
আমার সে সুখ সেবার যেন কপালে সহিল না। আমার মাতৃ দেবী আমার আগমনের কয়দিন পরেই আসিয়া হাজির হইলেন । এইবার স্বাধীন বিহঙ্গ হইতে কিছুটা পরাধীন হইলাম । এখন আর ফুরৎ ফুরুৎ এদিক সেদিক যাইবার উপায় হয় না।তাহাতে কি হইয়াছে। মামা ভাগ্নে এক সঙ্গে থাকিলে পরোয়া কি ! ভাবিয়া গেলাম টুর্নামেন্ট খেলিতে। ধান কাটা হইয়া গিয়াছে। সেথা এখন মাঠ ভাবিয়া বাইশ জনে বল কাড়া কাড়ি চলিতে লাগিল ।উহা যে ফুটবল খেলা তাহা বুঝিতেই পারিতেছিলাম না।বল কেবল পায়ে থাকার কথা,কিন্তু না তা মাঝে মাঝে হাতেও খেলা হইতেছিল,ফুটবল হইতে খেলা ক্রমেই হ্যান্ডবল ভলিবল এর রুপ ধারন করিল।
ফুটবল আন্তরজাতিক খেলা বলিয়া জানিতাম । কিন্তু গাঁও গেরামে সেই খেলার নিয়ম রাগবি খেলার রুপ লইয়াছে ভাবিয়া বিস্মিত হইলাম। যাহা হোক ফুটবল খেলার নামে বিচভলিবল টাইপ রিমিক্স খেলা চলিতেছে। কখন পায়ে কখন হাতে খেলা তাই বোঝা মুশকিল ঠেকিতেছিল ।এদিকে খেলা বেশ জমিয়া উঠিয়াছে। ম্যারাডোনা খেলার এই রুপ দেখিলে হয়তো আনন্দ অনুভব করিতেন,কেননা তিনি হাত দিয়া গোল করিয়া নামদার হইয়াছিলেন।আর পেলে এই রুপ ফুটবল দেখলে হয়তো কষ্টে মূর্ছা খাইতেন। আমি তবু খুব মন দিয়া খেলিতেছি। মামা কৌশল গত কারনে আমার বিপক্ষে খেলিতেছিল । সেই সময় এক দুর্বিপাক ঘটিল । কাহারো গরু মাঠে চড়াইয়া শেষে আপন মনে গোয়ালে ফিরিয়া যাইতেছিল । কি ভাবিয়া গরুর চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল। আমি সেদিকে লক্ষ করিয়া উঠিতে পারিনাই। গভীর মনেযোগ দিয়া বল দখলে রাখিতে ব্যাস্ত।
কেউ কিছু বলিবার আগে আর আমিও কিছু বুঝিবার আগেই আমার পাশ্চাত দেশে স্ববেগে একটা কিছু ধাক্কা অনুভব করিলাম। আমার শরীর দুলিয়া উঠিল,আমি হাম্বা ডাক শুনিয়া পিছন পানে তাকাইলাম। ইহা আমি কি দেখিলাম,আহা! তাহার কাজল দিঘীর ন্যায় ডাগড় ডাগড় আঁখি, একেবারে চাঁদ বদন! যাহা দেখিলাম তাহা দেখিয়া আমার পিলে চমকাইয়া গেল,ভ্রু প্রকম্পিত হইল। একটা আস্ত গরু তার দুইটা শিং তাক করিয়া আমাকে গুতা মারিবার জন্য পায়ে মাটি খনন করিতেছে।আমি শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা! আমার পশ্চাত দেশ তথা জান বাঁচাইবার নিমিত্তে দৌড়াইয়া পাগার পার হইবার শেষ চেষ্টা করিলাম।গরু দৌড়ায় আমিও দৌড়াই। স্পেন দেশের কথা আমার মনে ভাসিয়া উঠিল । সেইখানে ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের সাথে মানুষের লড়াই হয়।কি কান্ড! স্পেন দেশীয় সেই দৃশ্য যেন দৈবাত বাংলার জমিনে পয়দা হইল। আমার নেত্র স্থির থাকিলেও আমি স্বজোরে ছুটিয়াছি।আমার সামনে জল কাঁদা ,কিছুপর আমি দুই নেত্রে তারাবাতি দেখিলাম।পাখির ন্যায় আকাশে উড়িবার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা হইল। আমার পশ্চাত দেশ কিছুটা প্রকম্পিত হইলে আমি আছাড় খাইয়া ভুমিতে গড়াইয়া পড়িলাম।জন্তু জানোয়ারের সাথে মনুষ্য লড়াই। অসম বিভীষিকাময়। সকলেই বিচলিত হইল বটে,কপালে ভাজও ফেলিল বটে কিন্তু কেহই ছুটিয়া সাহায্য করিতে আসিল না।খেলার মাঠ হইতে প্রাক যুগের ময়দান হইয়া গেল। আমাকে বাঁচাইবার আল্লাহ ছাড়া আর কেহ নাই।আমার ভূলোক কাপিয়া উঠিল।অতঃপর নিজেকে হালকা কাঁদা পানিতে খুঁজিয়া পাইতে সমর্থ হইলাম। বাঁচিব কি মরিব জানিনা, তবু আমি সাহস সঞ্চয় করিয়া টিকিয়া থাকিবার চেষ্টাই করিলাম।ওদিকে ষন্ডা গাই ঢুস মারিতে কাঁদায় আসিয়া তাল রাখিতে পারিলনা,আমি সেই সুযোগে তাহার পেট বরাবর একটা ঢাউস লাত্থি মারিয়া দেই।ইহাতে কাজ হইল,গরূ আকাশ জমিন ওলোট পালোট দেখিলো যে চোখ উল্টাইয়া কাত হইয়া পড়িয়া রহিল। সকলেই হই হই করিয়া ছুটিয়া আসিল আমার দিকে। আমার ঠোঁট কাটিয়া রক্ত ঝরিতেছিল।ততক্ষনে চিৎকার চেঁচামেচি শুনিয়া আমার মাতামহের বাড়ি হইতে সকলেই ছুটিয়া আসিয়াছে। আর অনেকেই তামাশা দেখিতেছিল। আমার গর্ভধারিণী আসিয়া সেই দৃশ্য দেখিয়া হতভম্ব ! রুদ্র মূর্তি ধারন করিতেই কেহ কেহ পালাইয়া গেল। কাহার গরু তাহার প্রতি সমন জারি হইল। তাহার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার হইবার পালা। তাহার আগে আমাকে নির্দেশ করিয়া তদ মূর্তি ধারন করত: বলিতে লাগিলেন “বেশ হইয়াছে,উহাকে গরুটি মারিল না কেন” ? বলিয়া ফোঁসফাস করিতে লাগিলেন...ওদিকে গরু ভুমিতে পড়িয়া রহিল...আমি এ যাত্রায় বাঁচিয়া গেলাম {সত্য ঘটনা অব্লম্বনে