একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে এর সাথে জড়িত নানান বিষয় সামনে চলে আসে। আমার ধারনা সারা পৃথিবীর মধ্যে খুব সম্ভবত আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সব থেকে খারাপ। এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো ভুল গুলোকে শুধরে দেবার বদলে ভুল গুলো নিয়ে চাপ সৃষ্টি করে থাকে। চাপ দেয় শিক্ষার্থীর উপর, চাপ দেয় অবিভাবকের উপর। ফলে এখন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অবিভাবক সবাই স্কুলের সময়টা হালকা থাকার বদলে মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। এখানে স্কুলের শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে সেটাই মুখ্য বিষয়। যেখানে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকেনা সেখানে ভাল কিছু আশা করা বোকামি নয়কি?
আমার কথাই যদি বলি। যখন ক্লাস সিক্সে নতুন স্কুলে ভর্তি হই তখন স্কুল আমার কাছে একটা ভয়ের জায়গায় রূপ নেয়। ইংরেজি না পারলে বেতের মার, কান ধরে বারান্দায় সবার সামনে দাড়িয়ে থাকা, ডিটেনশন ক্লাস থেকে শুরু করে অনবরত কান ধরে ওঠবস করার মত শাস্তি গুলো এক সময় আমার স্কুলের সকল আনন্দই কেড়ে নিয়েছিল। একটা সময় এমন হয়েছিল যে, সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে কান পেতে শোনার চেষ্টা করতাম রাস্তায় গাড়ির শব্দ শোনা যায় কিনা। কোন কারনে গাড়ি বন্ধ মানে স্কুল বন্ধ হবার সুযোগ।
পরিস্থিতি বদলে যায় ঠিক ক্লাস এইটে ওঠার পর। কিভাবে যেন স্কুলের শারীরিক শিক্ষা স্যার সহ আরও দুইজন স্যারের সাথে একটা প্রাণের সম্পর্ক হয়ে যায় আমার। স্কুলের প্রতি একটা টান অনুভব করা শুরু হয় আমার। ধিরে ধিরে আমি হয়ে উঠি স্কুলের ভলান্টিয়ার টীমের লিডার। দাপট বেড়ে যায় অনেক। মনের থেকে ভয় সরে গিয়ে আমি হয়ে উঠি স্কুলের অনেকের স্নেহের ছাত্র। তাই বলে যে আমি ইংরেজিতে ভাল হয়ে গিয়েছিলা তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমি যে বিষয় গুলোতে ভাল পারতাম তাতে দক্ষতা অন্য সকলের থেকে অনেক বেড়ে যায়। আমার মনে আছে আমি দশম শ্রেণীতে থাকতেই ক্লাসের অন্যদের হিসাব বিজ্ঞানের ক্লাস নিতাম আমি।
স্কুল জীবনের ঠিক দুটি বিপরীত চিত্র আমার জীবনের অংশ। প্রথম দিকে যখন স্কুল আমার কাছে শুধু শাস্তির জায়গা হিসেবে ছিল তখন স্কুল বন্ধ থাকা মানে আমার কাছে ঈদের আনন্দ। এর সাথে পরিক্ষার রেজাল্ট খারাপ হওয়া তো চলছিলো। পরে সেই স্কুলেই যখন কয়েকজন বন্ধুসম প্রাণের স্যারদের কাছে চলে গেলাম তখন স্কুল ঈদের সময় বন্ধ দিলেও মন খারাপ লাগতো।
মাঝে লন্ডন প্রবাসী এক আইনজ্ঞ বন্ধুর সাথে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম সেখানে স্কুলে শিক্ষার্থীদের মারা নাকি স্বপ্নের বাইরের বিষয়। শুধু তাই নয়, বাবা মায়েরাও নাকি শাসন করতে গিয়ে সন্তানের গায়ে হাত তুলতে পারেনা। এমন কোন ঘটনা ঘটলে স্কুল থেকে অবিভাবকদের যেমন ডেকে নেওয়া হয় তেমনি একই ঘটনা বারবার ঘটলে একসময় সেই সন্তান বাবা মায়ের কাছে অনিরাপদ ধরে নিয়ে সন্তানকে সরকারি হেফাজতে নিয়ে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে সেদিন কিন্ডারগার্ডেনে চাকুরীরত এক বোনের কাছ থেকে শুনতে পেলাম একটি শিশু শিক্ষার্থী ক্লাসের মধ্যে মল ত্যাগ করে কাওকে কিছু না বলার কারনে ঐ শিশুর মাকে খুব অপমানিত করেছে স্কুলের অন্য শিক্ষিকারা।
ছোট বেলায় শুনতাম, শিক্ষক যেখানে বেতের বারি দেয় সে জায়গা নাকি বেহেস্তে যায়। সত্য মিথ্যা জানিনা। কিন্তু বাবা মায়ের পরে স্কুল, স্কুলের পরিবেশ এবং স্কুলের শিক্ষকেরা যে একটি শিশুকে সুস্থ ভাবে সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার কারিগর সেটা থেকে যেন আমরা বহু দূরে সরে এসেছি।
মোবাইল সাথে নিয়ে পরিক্ষার দেওয়া অথবা মোবাইল ফোন থেকে নকল করে পরিক্ষা দেওয়া খারাপ। কিন্তু সেই খারাপকে কেন্দ্রে করে বাবা মায়ের সামনে, স্কুলের শিক্ষকদের সামনে, সম্পূর্ণ ক্লাসের সামনে অপমানিত করে তার থেকে কি ভাল ফল আমরা আশা করতে পারি? যখন আমি স্কুলে গিয়ে ভয়ে থাকতাম, তখন আমি পরিক্ষায় অনবরত ফেল করতাম। কিন্তু যখন ভয় কেটে যায় কয়েক জন প্রাণের শিক্ষকের কারনে তখন ক্লাসের সেরা ছাত্র হতে কেও আটকাতে পারেনি আমাকে।
তবে গত বেশ কিছু বছর ধরে অসুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সাথে অবিভাবকদেরও আমি অসুস্থ হয়ে যেতে দেখেছি। যেখান ইংরেজির শিক্ষক হিসাব বিজ্ঞান পারেন না, অথবা হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক বীজ গণিত পারেন না সেখানে আমাদের সন্তানদের সকল বিষয়ে গোল্ডেন জিপিএ পেতে হবে এ কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি আমরা? এই অসুস্থ প্রতিযোগিতাও কি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে না?
হয়তো কিছু দিনের মধ্যে আমার মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। এখন স্কুলে ভর্তি হবার পরে কোন ভুলের কারনে অথবা পড়া না পারার কারনে আমাকে বা তুবার মাকে স্কুলের শিক্ষিকারা ডেকে অপমান করবে, অথবা নোংরা প্রতিযোগিতার মানদণ্ডে ফেলে তুবার মান যাচাই করা হবে তা নিয়ে আমি সত্যি খুব শঙ্কিত। আমি জানিনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কবে আনন্দের হবে, কবে আমাদের সন্তানেরা ভুলের কারনে অপমানিত না হয়ে আদরে মায়ায় সেই ভুলটুকু বুঝতে শিখবে, আপনি জানেন কি?
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৫