রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে লেখার আগে বলে নেওয়া ভালো যে, এই একই ভারতীয় কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারত সরকার অনুমতি দেয়নি। বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য, জীব বৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান, জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ নির্মাণ করা যাবে না। একই কারণে ভারত সরকার তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে এ ধরনের তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। ভারতের এনটিপিটি সুন্দরবনের গা ঘেঁষে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে জেনে পরিবেশ সচেতন নরওয়ে সরকার ২০১৪ সালেই ওই কোম্পানির জন্য দেয়া ৪৩০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
যদিও আমরা শুধু মাত্র রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু অনেকেই জানিনা যে ওরিয়ন নামে একটি দেশীয় কোম্পানি যারা কিনা যাত্রাবাড়ী-গুলিস্থনের মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার তৈরি করে নিচের প্রায় ১০ কিঃমিঃ এলাকার উন্নয়ন, জীবন ধারার মান নষ্ট করে দিয়েছে, তারা সুন্দরবনের আরও কাছে অনুরূপ আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ করতে চলেছে, যেখান থেকে ৬৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে জানানো হয়েছে। একই ভাবে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী বাঁশখালী উপজেলায় একটি ঘনবসতি এলাকায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে জনবসতি উচ্ছেদ হবে। পরিবেশও দূষিত হবে।
রামপালের এ কেন্দ্রটি হবে ভারতীয় এবং বাংলাদেশের যৌথ মালিকানায়। তবে এই মালিকানায় রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রকল্পের ৩০ ভাগ অর্থ ১৫ ভাগ করে দুই দেশ যোগান দেবে। বাকি ৭০ ভাগ অর্থ আসবে বিদেশ থেকে ঋণের মাধ্যমে। সব থেকে মজার যে বিষয় সেটা হল, এ ঋণ আসবে ভারত থেকে। সুদ হবে চড়া। চড়া সুদেড় এ অর্থ দিয়ে আবার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেওয়া হবে। এর মানে দাঁড়ালো মালিকানার ৫০ ভাগ লাভ, ঋণ দিয়ে চড়া সুদ আদায়, ভারতীয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি সরবরাহের মুনাফা সহ সব কিছুই ভারতীয় সুবিধা আদায়ের প্রকল্প এটি।
ভারতীয় এ অংশীদারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অতিরিক্ত মুনাফা করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আবার এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের ঘাড়ে। সরকার যেখানে অন্য তিনটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবন চড়া থেকে ৩টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে। সেখানে সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানির প্রস্তাব চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দিয়ে পি ডি বি এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবো সেটা নিশ্চিত। এখানেও সেই ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য মুনাফার ডালা সাজানো।
বাংলাদেশ তাহলে কি পাচ্ছে? বাংলাদেশ পাচ্ছে বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ ছাড়া বাংলাদেশ শুধুই হারাচ্ছে। ১৮৩০ একরধানী জমি অধিগ্রহণের ফলে ৮০০০ পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যাবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্ম সংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের, ফলে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে বাকি প্রায় ৭৫০০ পরিবার। শুধু তাই নয় আমরা প্রতি বছর হারাবো কয়েক কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন।
এ ধরনের কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রতি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। রামপালের প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা নিঃসন্দেহে মেটানো হবে পশুর নদী থেকে। পশুর নদীর পানি নোনা ও মিঠা জলের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের প্রয়োজন মেটাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই নদীটির সাথে ওই গোটা অঞ্চলের সামগ্রিক জীব বৈচিত্র্যের সংযোগ রয়েছে। এটি ওই অঞ্চলের জনবসতির ক্ষেত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী। কিন্তু এই প্রকল্প তৈরি করতে গিয়ে আমরা সেই নদীর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে ফেলছি।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নদী পথে পরিবহন করা হবে। ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি সুন্দরবনের ইকো সিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে ইআইএ রিপোর্টে আশংকা করা প্রকাশ হয়েছে। ড্রেজিং এর ফলে নদীর পানি ঘোলা হবে। ড্রেজিং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হলে তেল- গ্রীজ ইত্যাদি নিঃসৃত হয়ে নদীর পানির দূষিত হবে। পশুরনদীর তীরে যে ম্যানগ্রোভ বনের সারি আছে তা নির্মাণ পর্যায়ে জেটি নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে কাটা পড়বে। নদী তীরের ঝোপঝাড় কেটে ফেলার কারণে ঝোপঝাড়ের বিভিন্ন পাখিবিশেষ করে সারস ও বক জাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে। এর পরে আসছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র অপারেশনে থাকার সময়কার প্রভাব- ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইডও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে।
পশুর নদী থেকে প্রতি ঘন্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে। যতই পরিশোধনের কথা বলা হোক, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রায় দূষণকারী উপাদান থাকবেই যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বেলায় 'শূন্য নির্গমণ' বা 'জিরো ডিসচার্জ' নীতি অবলম্বন করা হয়। এনটিপিসিই যখন ভারতে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রনির্মাণ করে তখন 'জিরো ডিসচার্জ' নীতি অনুসরণ করে অথচ রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে- 'পরিশোধন করার পর তরল বর্জ্য বা ইফ্লুয়েন্ট ঘন্টায় ১০০ ঘনমিটার হারে পশুর নদীতে নির্গত করা হবে।' যা গোটা সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ধ্বংস করবে। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে ২৭৫ মিটার উচু চিমনী থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে তাপমাত্রা হবে১২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস ফলে আশে পাশের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রেবছরে ৭,৫০,০০০ টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লক্ষ টন বটম অ্যাশ উৎপাদিত হবে। এতে বিভিন্ন ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, পারদ,সীসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম,বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়াম মিশে থাকে। কিন্তু আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একদিকে বলা হয়েছে এই বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে ব্যাপক দূষণ হবে অন্যদিকে এই ছাই দিয়েই প্রকল্পের মোট ১৮৩৪একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এই বর্জ্য ছাই এর বিষাক্ত ভারী ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানি সাথে মিশে, চুইয়ে প্রকল্প এলাকার মাটি ও মাটির নীচের পানির স্তর দূষিত করবে যার প্রভাব শুধু প্রকল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
উৎপাদিত বর্জ্য ছাই সিমেন্ট কারখানা, ইট তৈরি ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্পে ব্যাবহারের সম্ভাবনার কথা ইআইএ রিপোর্টে বলা হলেও আসলে বড় পুকুরিয়ার মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত দৈনিক ৩০০ মেট্রিক টন বর্জ্য ছাই কোনো সিমেন্ট কারখানায় ব্যাবহারের বদলে ছাই এর পুকুর বা অ্যাশ পন্ডে গাদা করে রেখে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, জেনারেটর,কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা উঠানো নামানো, পরিবহন ইত্যাদির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে ভয়াবহ শব্দদূষণ হয়। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার, নাইট্রোজেন,কার্বন ইত্যাদির বিভিন্ন যৌগ কিংবা পারদ, সীসা, ক্যাডমিয়াম, ব্যারিয়াম ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণ ছাড়াও কুলিং টাওয়ারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণেও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক আকারে নিউমোনিয়া জাতীয় রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
নিজেকে মেরে ফেলে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেবার নাম করে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনকে ধ্বংসের জন্য করা হচ্ছে সে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তো দেশের অন্য কোন জায়গাতেও করা যায়। সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্যই করতে হবে তার হিসেব মেলানো যায় না।
বিঃদ্রঃ লেখাটির বিভিন্ন তথ্য ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:০৫