শ্রুতিনাট্য বা শ্রুতিনাটক শব্দটি শুনলেই, এটি যে শ্রবনেন্দ্রীয় সম্পর্কিত কোনো নাটক বা নাট্য তা আর বলে দেবার অপেক্ষা রাখেনা। মনে পড়ে আমার ছেলেবেলা। তখনকার দিনে টিভি এখনকার দিনের টিভির মত দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা অন করলেই চলে উঠতো না। টিভি শুরু হত সেই সন্ধ্যাবেলা কিন্তু রেডিওটা বাজতো সারাদিনই।
ছোটদের অনুষ্ঠান, ছড়া বলা, বড়দের আবৃতি, গান, সিনেমার ট্রেইলর থেকে শুরু করে ছুটির দুপুরের মা চাচীদের সাথে বসে রেডিওতে নাটক শোনাটাও ছিলো আমার বিশেষ প্রিয় একটি কাজ। ছোট থেকেই সাংস্কৃতিক ব্যাপার স্যাপারগুলোর প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষন থাকায় আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম সে সব! কি করে শুধু মাত্র কন্ঠ বৈচিত্রের তারতম্যের মাধ্যমে নাটকের অদেখা পাত্র পাত্রীরা চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতো নানারকম দৃশ্যকল্প! অবাক হতাম আমি! কখনও সমুদ্রের তীরে, কখনও বা পাহাড়ের চূড়ায় অথবা কখনও ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে যাওয়া কোনো ফুল্ল সৌরভিত মালঞ্চে ঘুরে বেড়াতাম আমি তাদেরই মনোমুগ্ধকর কন্ঠশৈলীতে, তাদেরই সাথে সাথে।
টিভিতে দেখা দৃশ্যমান নাটকগুলো তো কোনো ঘটনা বা দৃশ্যকে কথপোকথন বা সংলাপের সাথে অঙ্গ ভঙ্গি ও পরিবেশ পরিস্থিতির কম্পোজিশনে ফুটিয়ে তোলা হয়। কিন্তু রেডিওর নাটকগুলো! সেসব তো দেখা যায়না! সে যাই হোক, খুব অবাক করা আরেক ম্যুভির কথাও মনে পড়ে, সে নির্বাক চলৎচ্চিত্র।একটাও সংলাপ উচ্চারণ না করে কি সাবলীলভাবে সেখানেও দৃশ্যের পর দৃশ্যকল্প ফুটিয়ে তোলা হয়। ঠিক তেমনি অদেখা পাত্র পাত্রীরাও রেডিও নাটকে শুধু মাত্র বাকযন্ত্রের ব্যাবহারে দৃশ্যের পর দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে চোখের সামনে। সেই থেকেই মুগ্ধতা আমার। বড় হবার পর জেনেছি একেই বলে শ্রুতি নাটক।
শ্রুতিনাটক বা শ্রুতিনাট্য যদিও মঞ্চেও পরিবেশন করা হয় তবুও আমার কাছে প্রকৃত শ্রুতি নাটক বলতে রেডিওতে শোনা সেই আমার ছোটবেলার প্রিয় নাটকগুলোই।
আবৃত্তি ও শ্রুতিনাটক-
কিছু কিছু গদ্যকবিতার আবৃত্তিভঙ্গি বা যুগল অথবা দলীয় আবৃতি শুনে শ্রুতিনাটক বলে ভুল হতে পারে। তবে কবিতায় কবি যে কোনো দৃশ্য বা ঘটনাকে কাব্যিক উপস্থাপন করেন, আবৃতিকার বের করে আনেন সেটা তার কন্ঠশৈলীতে কিন্তু পক্ষান্তরে শ্রুতিনাটক যেন একটু সরল, একটু সাচ্ছন্দ্যময় আমার কাছে। যদিও আমার কাছে শ্রুতিনাটক মানেই সেই ছোটবেলার রেডিওর নাটক । তবে একটু বড় হবার পরে জেনেছি অন্যকথা।
ইতিহাসে শ্রুতিনাটক-
একটা সময় বাংলার শ্রুতিনাটককে উত্তর চব্বিশ পরগণা, এবং অন্যান্য জেলায় বারাসতের দেবদত্ত, ইছাপুরের মোতিলাল সেন, শ্যামনগরের অঞ্জন বাগচি, ব্যারাকপুরের সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সোদপুরের সুখেন্দু বিশ্বাস একটা অন্যরকম মাত্রা দিয়েছিলেন। কলকাতার বাংলা একাডেমি ও রেলওয়ের মেইন লাইনে শ্রুতি নাটকের চাষ হতো। তবে নাটকের সময়সীমা ছিল বারো থেকে পনেরো মিনিট। বারাসতের "বৃহস্পতি" দাবি করল, সময় বাড়াবার। তাদের দাবি কেউ মানলো না। অবশেষে বৃহস্পতি "দানব" নাটকটি নিয়ে প্রতিযোগিতার বাইরে থেকে নানা মঞ্চে প্রযোজনা করলো। সংগঠকরা বুঝলেন, তিরিশ মিনিটেও উপভোগ্য শ্রুতিনাটক হয়। ধীরে ধীরে নানা দলের জন্ম হল। আজও শ্রুতি নাটক হয়, তবে সেই দম্ভ আর নেই।
শ্রুতিনাটক ও নাট্যকলা-
যে কোনো ত্রিমাত্রিক আয়তনে এক বা একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক অপর এক বা একাধিক ব্যক্তির সামনে কোন ক্রিয়া উপস্থাপনকেই ‘নাট্য’ বলা যেতে পারে। উল্লিখিত উপস্থাপনাটি হতে পারে সম্পূর্ণভাবে পূর্বনির্ধারিত এবং লিখিত পাঠভিত্তিক, অথবা হতে পারে তাৎক্ষণিক উপায়ে মৌখিকভাবে সৃষ্ট। সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণে বাংলাদেশের নাট্যরীতির ক্রমবিকাশ বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় নাট্য ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত এবং এর সঙ্গে পরবর্তীতে কিছু মাত্রায় ইউরোপীয় প্রভাবের মিশ্রণ লক্ষণীয়। শ্রুতিনাটক নাট্যকলারই একটি শাখা।
নাট্যকলার ক্রমবিকাশ তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: সংস্কৃত ও তৎদ্ভূত নাট্য, দেশজ নাট্য এবং ইউরোপীয় রীতি প্রভাবিত নাট্য।
সংস্কৃত ও তৎদ্ভূত নাট্য
প্রাচীন যুগ খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে বাংলার বৃহদংশ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হলে উত্তর গাঙ্গেয় আর্যসংস্কৃতি এ অঞ্চলে প্রবেশ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের কারণে গড়ে ওঠা নগরকেন্দ্রগুলিতে এ সময় শিল্প-সংস্কৃতি ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। এর ফলে উল্লিখিত নগরকেন্দ্রগুলিতে ধ্রুপদী সংস্ক্বত নাট্যচর্চা বিশেষভাবে বিত্তবান শ্রেণির সাংস্কৃতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুথিগত সাক্ষ্য থেকেও এর জোরালো সমর্থন পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বাংলার বিখ্যাত বৈয়াকরণ চন্দ্রগোমী রচিত সংস্কৃত নাটক লোকানন্দ-এর নাম উল্লেখ করা যায়। প্রস্তাবনাসহ এ নাটকটি চার অঙ্কে রচিত। ভারতবর্ষের পাঁচটি রাজ্যের সকল মানুষ গীত ও নৃত্য সহযোগে নাটকটি পরিবেশন করেন।
সেন রাজারা সংস্কৃত ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত অভিনয়রীতির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রাজা বিজয়সেন এবং ভবদেব ভট্ট বহু মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে দেবদাসী রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত ঐতিহ্যানুসারে ধ্রুপদী নৃত্য ও গীতে পারদর্শী এ সকল দেবদাসী রাজদরবাদের সভাসদবৃন্দের জন্য এবং মন্দির প্রাঙ্গণে জনগণের জন্য অভিনয় করতেন। এ যুগের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে ‘নট’ নামে একটি পৃথক বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আধুনিক যুগ উনিশ শতকে বেশ কিছু সংস্কৃত নাটক বাংলায় অনূদিত হয়। তন্মধ্যে কৃষ্ণমিশ্রের প্রবোধচন্দ্রোদয়, কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল (১৮৪৮) ও শ্রীহর্ষের রত্নাবলী (১৮৪৯) উল্লেখযোগ্য।
ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জিত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে উনিশ শতকের মধ্যভাগে সংস্কৃত নাট্যরীতি সমসাময়িক সামাজিক বৈশিষ্ট্য চিত্রণের ক্ষেত্রে দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে সংস্কৃত প্রভাবজাত নাট্য বাংলা নাট্য বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় এ সময়ের সাহিত্য জগতের পুরোধা মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা নাট্যে ইউরোপীয় নাট্যনির্মাণ কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে সংস্কৃত প্রভাবমুক্ত আধুনিক নাট্য সৃজনের ক্ষেত্রে সার্থক ভূমিকা পালন করেন।
দেশজ নাট্য সংস্কৃত -
বাংলায় উদ্ভূত সকল প্রকার নাট্যরীতিকে দেশজ নাট্য আখ্যায়িত করা হয় যা সাধারণত লোকনাট্য হিসেবেও পরিচিত। দেশজ নাট্যের কলাকুশলিবৃন্দের মধ্যে রয়েছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী, গায়ক-গায়িকা, যন্ত্রশিল্পী এবং পুতুল নাচিয়ে। এঁদের অভিনয় উপস্থাপনায় কেবল গদ্য সংলাপ নয়, বরং তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নৃত্য, যন্ত্রসঙ্গীত, বচন । বাংলাদেশের দেশজ নাট্য বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিকে বিকশিত হয়েছে, যাকে সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: বর্ণনাত্মক, নাটগীত, অধি-ব্যঞ্জনাত্মক এবং শোভাযাত্রামূলক ও তৎদ্ভূত অভিনয় উপস্থাপনা।
ইউসুফ-জুলেখার (১৩৮৯-১৪১০) আবির্ভাব বাংলা নাট্যে এক নতুন বৈশিষ্ট্য (পারস্য-আরবীয় প্রভাব) আরোপ করে। ১৪৭৪ সালে নবীজী (সঃ)-র জীবনকাহিনী ভিত্তিক চরিতকাব্য রসুলবিজয় রচিত হয়। এখানে হিন্দু পৌরাণিক ঐতিহ্যের সমান্তরাল কাহিনী নির্মাণের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বকীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। উল্লিখিত দুটি কাব্যই রচিত হয়েছিল মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এরই মধ্য দিয়ে ইসলামি মৌল উপাদান সম্বলিত বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির সূচনা হয়। ষোলো শতক নাগাদ ইসলামি সৃষ্টিতত্ত্ব ও উপকথার ওপর ভিত্তি করে বিপুল সংখ্যক পুথির আবির্ভাব ঘটে। তন্মধ্যে মকতুল হোসেন, কাশেমের লড়াই, কারবালা, জঙ্গনামাইত্যাদি ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেনের করুণ মৃত্যু এবং তাঁদের কাল্পনিক সৎ ভাই হানিফার প্রতিশোধ গ্রহণের কাহিনী অবলম্বনে রচিত। অপর কিছু পুথিতে (রসুলবিজয়, নবীবংশ এবং আমীর হামজা) পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন নবী (সঃ)-র জীবনকাহিনী সম্পর্কিত বিবরণ এবং শেষে নবীজী (সঃ)-র জীবন ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা বর্ণিত হয়েছে। পুথিগুলির রচনাশৈলী থেকে বোঝা যায় যে, এর অধিকাংশই বর্ণনাত্মক অভিনয় রীতির মাধ্যমে পরিবেশিত হতো।
মুখোশ নাট্য-
গম্ভীরা উৎসবে যে মুখোশ নৃত্য দেখা যায়, তার উৎস কোচ নৃগোষ্ঠীর প্রাচীন কৃত্যানুষ্ঠান। খ্রিস্টীয় নবম শতক নাগাদ পূর্ব ভারতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধগণ কোচ মুখোশ নৃত্য আত্তীকরণ করে তাঁদের নিজস্ব মুখোশ নৃত্যের উদ্ভব ঘটান। বাংলায় চৈত্রসংক্রান্তিতে সাংবৎসরিক উৎসবে এই নৃত্য পরিবেশিত হতো।
পটুয়া গান -
দুটি তথ্যসূত্র থেকে প্রাচীন বাংলায় পটুয়া গানের অস্তিত্ব সম্পর্কে সুনিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায। প্রথমটি বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত (৭ম খ্রিস্টাব্দ) যেখানে যমপট্টিকার এ পরিবেশনা বিবৃত হয়েছে এবং দ্বিতীয়টি সাঁওতাল পটচিত্র উপস্থাপনা। সাঁওতাল গোষ্ঠীর মধ্যে পট পরিবেশনের দুটি রীতি বিদ্যমান: একটি সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক এবং অপরটি মৃত্যুর পর মৃতের পরকালে যাত্রা বিষয়ক । উল্লিখিত পরিবেশনা রীতিদুটি বাংলায় প্রাচীন পটুয়া গানের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। মধ্যযুগে রাম, কৃষ্ণ, মনসা ও চন্ডীবিষয়ক পটুয়া গান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। আঠারো শতক নাগাদ মুসলমানদের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে গাজীর পটের মাধ্যমে। পীর গাজীর মাহাত্ম্য বিষয়ক গাজীর পট এখনও বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় পরিবেশিত হতে দেখা যায়।
আমার রচিত পুতুলনাট্য
পুতুল নাট্য -
দক্ষিণ এশীয় ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে পুতুল নাচ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শেষ দিকে বাংলায় প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। বাংলায় পুতুল নাচের প্রাচীনতম পুথিগত সাক্ষ্য পাওয়া যায় ইউসুফ-জুলেখা কাব্যে। উল্লিখিত তথ্য থেকে এও অনুমেয় যে, এ সকল পুতুল ছিল সুতার দ্বারা পরিচালিত। সম্ভবত দেব-দেবীর কীর্তি-কাহিনী অবলম্বনে মৌখিক রচনার ওপর ভিত্তি করেই এই পুতুল নাচ বা পুতুল নাট্য পরিবেশিত হতো। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজরচিত চৈতন্যচরিতামৃত সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ষোলো শতকে বাংলায় পুতুল নাচ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।
শোভাযাত্রা-
ষোলো শতক নাগাদ বৈষ্ণবদের মধ্যেও শোভাযাত্রামূলক অভিনয় উপস্থাপনা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ সময়ের বিখ্যাত স্মার্ত পন্ডিত রঘুনন্দন বিষ্ণুর সম্মানে বছরে ১২টি শোভাযাত্রা আয়োজনের বিধান চালু করেন। বৈষ্ণব শোভাযাত্রামূলক অভিনয় উপস্থাপনায় ধীরে ধীরে সংযুক্ত হয় রথের উপর স্থাপিত বৈষ্ণব পুরাণাদির গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যসম্বলিত ট্যাবলো। ভক্তগণ এই রথ টেনে বৈষ্ণব অধ্যুষিত এলাকা প্রদক্ষিণ করতেন। ব্যাপক জনসমর্থন অর্জনের জন্য চৈতন্য স্বয়ং শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিলেন। তাঁর অনুসারীদের নৃত্য, গীত ও বাদ্য সহযোগে এ সকল শোভাযাত্রা সংকীর্তন নামে পরিচিত ছিল। এমন একটি সার্থক নগর সংকীর্তনের কথা বর্ণিত হয়েছে চৈতন্যভাগবতে।
যাত্রা-
আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগে পেশাদার অভিনয় দল বিভিন্ন ধরনের কৃষ্ণলীলা অভিনয় শুরু করে। এ অভিনয় কোন প্রাকৃতিক পরিবেশে নয় বরং নাটমন্ডপ, গৃহাঙ্গন কিংবা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত মাঠে কোন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে কিংবা আয়োজকদের ইচ্ছানুসারে যে-কোনো দিন অনুষ্ঠিত হতো। সাধারণত ‘কালীয়দমন যাত্রা’ নামে পরিচিত এ সকল কৃষ্ণলীলা বিষয়ক নাট্যাভিনয় নবদ্বীপের রাজসভার সংস্কৃত নাট্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। কালীয়দমন যাত্রা ছিল মুখ্যত গীতাশ্রয়ী। দলের অধিকারী বৃন্দা বা রাধার সখী অথবা মুনি গোঁসাই বা নারদ চরিত্রে অভিনয় করতেন এবং সূত্রধারের ন্যায় তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট গদ্যে অথবা পূর্বে রচিত পদ্যে/গীতে অংশবিশেষ বর্ণনার মাধ্যমে সমগ্র নাট্যক্রিয়া পরিচালনা করতেন। নাট্যের অপর অংশ অভিনীত হতো তাঁর ও অন্যান্য চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে। সম্ভবত শিশুরাম অধিকারী আণুমানিক ১৮শ শতকে ছিলেন এই অভিনয় উপস্থাপনা রীতির পথিকৃৎ।
ইউরোপীয় রীতি-প্রভাবিত নাট্য -
১৭৫৭ থেকে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি সমাজে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়, যা বাংলার সকল ক্ষেত্রে বিশেষত জ্ঞানচর্চায় গুণগত পরিবর্তন আনে। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শহুরে ও গ্রামীণ সংস্কৃতির পৃথকীকরণ লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী ক্ষুদ্র এক গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট শহুরে উচ্চবিত্তের সংস্কৃতি ইউরোপীয় আদলে গড়ে ওঠে। প্রবল জীবনী শক্তির অধিকারী এই শহুরে ইউরো-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি এবং তার ফসল ইউরোপীয় রীতি-প্রভাবিত নাট্যচর্চা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও তাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত দেশজ নাট্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিশ শতকের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়। ফলে দেশজ নাট্যের অনেক রীতির ভেতর ফসিলীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এর পাশাপাশি ইউরো-প্রভাবিত নাট্যচর্চা বেগবান হয়, কারণ এর সঙ্গে যুক্ত হন মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা দ্বারা পুষ্ট শহুরে বুদ্ধিজীবীরা।
নাট্যকলা সম্পর্কিত তথ্যসূত্র-
লেখক সেলিম আল-দীনের মধ্যযুগের বাংলা নাট্য, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬ বই হতে নেওয়া।
এই গেলো নাট্যকলার শতকলার সাত, আট, দশ, বারো বা আরও বেশি কাহন। বলছিলাম শ্রুতিনাট্যের কথা। আমার জীবনে নানারকম সাধগুলো আমি খুব একটা অপূর্ণ রাখিনি তাই শ্রুতিনাটক রচনার সুযোগ আসতেই লুফে নিলাম সে প্রস্তাবটা। আমার শ্রুতিনাটকটি ছিলো পুরোটাই নারী কন্ঠাভিনয়ে পরিবেশিত। নাটকে কোনো পুরুষকন্ঠ ছিলোনা। নাটকের নাম পুরানো সেই দিনের কথা। রিটেন বাই মি। গুলশান ক্লাবে পরিবেশন করেছি আমরা শ্রুতিনাট্যটি। সময় ছিলো ১০ মিনিট। শ্রুতিনাটকটির স্ক্রিপ্ট এখানে দিলাম-
শ্রুতি নাটক- পুরানো সেই দিনের কথা
ব্যাক-গ্রাউন্ড- স্লো মিউজিক- পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় ও সে চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়
(মিউজিক স্লো হবে--ও ব্যাকগ্রাউন্ডে লোতে বাজতে থাকবে।)
১ম সখী ( লাবন্য)- আমরা তিন সখী।
২য় সখী ( দেবলীনা)-আমি দেবলীনা চ্যাটার্জী
তৃয় সখী ( সুরাইয়া) - আমি সুরাইয়া খাতুন
লাবন্য-আর আমি লাবন্য। আমার রবীন্দ্রপ্রেমী মা বড় শখ করে আমার নাম রেখেছিলেন লাবন্য। আজ কত বছর বাদে যে আমাদের দেখা হলো। অথচ আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে একসাথে। আমরা তিনজন ছিলাম হরিহর আত্মা। একই পাঠশালা, একই গ্রাম, কত স্মৃতি, কত আনন্দ।
সুরাইয়া- মনে পড়ে দেবলীনা। তোদের বাড়ির সেই দোলপূর্নিমার স্ম্বতি। কাকীমার হাতে সেই নাড়ু, মুড়কি! আহ অমৃত। সেই স্বাদ, সেই পূজোর ধুপ ধুনোর গন্ধ জানিস চোখ বুজলে আমি আজও দেখতে পাই। তোদের বাড়ির জাফরি কাটা ঝুল বারান্দা, উঠোন, তুলসীতলা। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই সুবাসী সন্ধ্যাগুলোয়! ভাসানের দিনে প্রতীমা ডুবানোর মুহুর্তে কত যে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছি তোরই সাথে সাথে! এস,এস,সির রেজাল্ট না হতেই বিয়ে হলো আমার। আমেরিকা প্রবাসী সুপাত্র! বড় দূর্লভ!সেই থেকে আমি দূরে। আচ্ছা তোর দীপকদা কেমন আছেরে সে? নিশ্চয় অনেক ভালো আছে। সুখে আছে।
লাবন্য- হা হা হা দীপকদার কথা বলতে মনে পড়লো সেই ঘটনাটা। সুরাইয়া সেই যে সন্ধ্যাবেলা তোদের বাড়িতে লুকিয়ে তোর সাথে দেখা করতে এসে, চাচার হুংকারে দৌড়ে পালাতে গিয়ে সোজা গিয়ে পড়লো কাঁচা নর্দমায়।
দেবলীনা- হা হা হা আর বলিস না। নর্দমায় পড়ে নোংরা মেখে ভুত হয়ে ফিরলো বাড়ি। মা বললেন, এই কাপড় কাঁচা সাবান পুরো শেষ করে তারপর ঘরে ঢুকবি। হা হা হা দাদা মাকে বলেছিলেন জানিস, কুকুরের তাড়া খেয়ে নর্দমায় পড়েছেন নাকি তিনি। হা হা হা কিন্তু আসল সত্য তো জানতাম আমরা।
সুরাইয়া- সে যাইহোক, আজও সাঁঝ আকাশে যখন জ্বলে সন্ধ্যাতারা, আমি ঠিক ঠিক শুনতে পাই তোদের বাড়ীর সন্ধ্যাকালের উলুধ্বনীর সুমধুর সেই সূর। নিজের মনে অস্ফুটে বলি। ফের কি ফিরে যাওয়া যায়না সেই সোনালী ছেলেবেলায়?
দেবলীনা - সুরাইয়া শুধু কি দোল পূর্নিমা বা ভাসানের দিন? তোদের বাড়ির ঈদের সেমাই, চাচীর হাতের শব-ই-বরাতের নেসেস্তার হালুয়া। রোজার সময় তোদের বাড়ি থেকে কুরশি কাঁটায় বোনা ঢাকনী দেওয়া রেকাবের ইফতার।উফ জিভে জল এসে যায়। তুই কি জানিস আমরা ভাই বোনেরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতাম সেইসব হালুয়া, রুটি কিংবা পেঁয়াজু, বেগুনী বা তোদের বাড়ি হতে পাঠানো খোরমার জন্য। প্রতি ঈদে চাচীমা কিন্তু আমাকেও সেলামী দিতে কখনও ভুল করেননি। ঈদের আগের দিন চাঁদরাত হতে শুরু করে , মেহেদী লাগানো, তারাবাজী আর সারাটাদিন টই টই করে এবাড়ি ওবাড়ি ফিরনী সেমাই খেয়ে বেড়ানো। আহা কি এক আনন্দঘন সময় ছিলো আমাদের! কোথায় আজ হারালো তারা! কপোতাক্ষের তীরের এক জমিদার বাড়িতে বিয়ে হলো আমার। হারালাম আমার শৈশব, কৈশর আর তার আনন্দময় দিন গুলি।
লাবন্য- প্রতিবছর বৈশাখীমেলায় বাবার সাথে মেলায় যেতাম আমরা। মাটির পুতুল, হাতীঘোড়া কত রকম খেলনা... হাওয়াই মিঠা, বাতাসার স্বাদ... আচ্ছা মনে আছে তোদের? আমার অধ্যাপক বাবা যেন বাঙ্গালীর উৎসব গুলোতে শিশুটি হয়ে যেতেন। আমাদের সবাইকে নিয়ে নাগরদোলা বা চরকী চড়া, বায়োস্কোপ দেখা, বাবাও যেন ফিরে যেতেন তার শৈশবে।
দেবলীনা- সেবার তো বসন্ত উৎসবের মেলায় লোকে লোকারন্য! হঠাৎ সুরাইয়া তোকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলোই না। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ ! অথচ কোথাও তুই নেই। শাহীনঃ আরে আমি তো হাওয়াই মিঠাওয়ালার পিছে কখন যে হাঁটা জুড়েছিলাম নিজেও জানতাম না।
লাবন্য- ছোটবেলা থেকেই পেটুক ছিলি তুই। যেখানেই খাবারের গন্ধ সেখানেই তুই। হা হা হা ।কি মধুর ছিলো সে অতীত।
আমার স্কুল শিক্ষিকা মায়ের কাছেই কিন্তু আমরা সকলে শিখেছিলাম সেই অসাধারণ অর্চনা সঙ্গীত - তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে। তব পুন্য কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে। সে এক আরাধনা। জাতি, ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে মানুষ হয়ে ওঠার গল্পের শুরু কিন্তু সে যেন এক রূপকথা আজ। চারিদিকে হানাহানি রেষারেষি, হিংসা দ্বেষ, বিভেদ আজকাল। বড় কষ্ট হয় রে! সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করে সেই ছেলেবেলায়। যেখানে ছিলো নিস্বার্থ কিছু ভালোবাসা ভালো লাগারা।
শেষ পর্ব- (আমি মাতবর )
ওরা তিন সখী। বহুদিন বাদে আজ ওদের দেখা। ছেলেবেলার উজ্বল অম্লান স্মৃতিতে উদ্বেল আজ তারা। কত স্মৃতি, কত আনন্দ, কতই না গানে কেটেছে তাদের শৈশব, কৈশোর বা তারুন্যের দিনগুলো। সে সোনালী অতীত স্মৃতি রোমন্থনে স্মৃতি কাতর আজ তারা কিন্তু তবুও কেনো ? কেনো ওদের মনে আজ এ সংশয়? কেনো এ ভীতি! কেনো দুচোখ জুড়ে আজ বেদনার বন্যা। এমনটি তো হবার কথা ছিলো না। যে শৈশব, কৈশোরে তারা কাটিয়েছিলো নিষ্কলুষ,আনন্দময়, দ্বিধাহীন দ্যার্থ জীবন। আজ এতগুলো দিন পরে এসে কেনো সেই স্মৃতি কাতরতায় শিউরে উঠছে তারা? বর্তমান বিভিষিকাময় জগৎজুড়ে মানুষে মানুষে দ্বন্দ, বিভেদ, সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য! এমন তো হবার কথা ছিলো না। সভ্যতার উন্নয়ন ও প্রগতীর সাথে সাথে আমরা তো হতে চেয়েছিলাম মানুষ। শিক্ষা, মনন, সততা ও সভ্যতায় মানবিক গুণ সম্পন্ন এক একজন শতভাগ খাঁটি মানুষ! মনে পড়ে জাতীয় কবি নজরুলের সেই কবিতা-
"মানুষ"-
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-...
হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।
একই দেশ, একই জাতি অথচ কত ভেদাভেদ,রেষারেষি! সব বিভেদ বৈষম্য ভুলে আমরা চাই একটি সুন্দর সমাজ, একটি সুন্দর দেশ।
মেসেজটি ছিলো সাম্প্রদায়িকতা, মানুষে মানুষে বিভেদ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এই পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর জন্য নিশ্চিৎ করি নিরাপদ জীবন। জগতের সকল প্রাণী সুখে থাকুক। ভালো থাকুক।
শ্রুতিনাট্য- পুরানো সে দিনের কথা
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫০