আনারকলি-রুপবতী এক আহ্লাদী কন্যা।জন্মের পর পর আনারকলির মত মানে আনারের কুঁড়ির মত গাত্রবর্ণ দেখিয়া দাদাজান শখ করিয়া তাহার নাম রাখিয়াছিলেন আনারকলি। তাই বলিয়া কেহ যেন ভুল করিয়াও না ভাবিয়া বসে মোঘল হেরেমের রূপসী নর্তকী আনারকলির আদলেই তাহার নাম আনারকলি রাখা হইয়াছে।
তীতুমীর- অপরদিকে তীতুমীর একজন আধুনিক যুবক। সাংবাদিকতায় পড়ালেখা শেষ করিয়া দেশের খ্যাতনামা এক সংবাদ পত্র অফিসে চাকুরী করিতেছেন। হ্যাংলা পাতলা তীতুমীর সাহেবের নাম সেই দুঃসাহসী বীরের নামে হইলেও আদতে এই তীতুমীর সকল রকম ঝামেলা এড়িয়ে চলা লুতুপুতু প্রেমিক টাইপ আর তাই পাশের বাড়ীর অপরূপা কন্যার সহিত প্রেমপর্ব শেষে ইতিমধ্যে বিবাহ কার্য্য সমাধা করিয়া ফেলিয়াছেন। সারাদিন কর্মব্যাস্ততায়, অফিসের ধকল সামলিয়ে তীতুমীরের চোখে নামিয়াছে এখন রাজ্যের ঘুম।
আনারকলি ও তীতুমীর এই দুজন টোনাটুনির সংসারে আনারকলি মহারাণীর তেমন কোনো কাজ না থাকায় এবং দিনমান একাকী বাড়িতে হাসফাঁস করিয়া কাটাইবার পর এই মধ্যরাত্রীতেও তাহার চোখ নিদ্রাশূন্য। নাগরিক ঘনবসতির সুউচ্চ ভবনগুলির ফাঁক ফোকর দিয়া তাহাদের তিনতলা ভবনের জানালা হইত এক চিলতে আকাশ দেখা যাইতেছে। সেথায় উঠিয়াছে মস্ত বড় থালার মত একখানি ঝকঝকে চাঁদ! সেইদিকে তাকাইয়া আনারকলির পূর্বস্মৃতি উথলাইয়া উঠিলো আর ফোস করিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস তাহার বুক চিরিয়া বাহির হইয়া আসিলো। সে মনে মনে আউড়াইতে লাগিলো---
আনারকলিঃ
আসছে ভেসে জানলা দিয়ে চাঁদের কিরণ
উদাস হাওয়া, মন ভুলানো স্বপ্নছায়া,
পড়ছে মনে এমনি এক মধুর সাঝে
তোমার সাথে আমার দেখা !!
সেদিন আকাশ হাসছিলো আর ভাঙছিলো বাঁধ
চাঁদের হাসি, এত্তগুলো দিনের পরেও হয়নি বলা
তোমায় কত ভালোবাসি!!
মনের আবেগ আর রুধিতে না পারিয়া আবেগী আনারকলি তড়িঘড়ি ঘুমন্ত তীতুমীরকে ধাক্কা দিয়া নিদ্রা হইতে জাগাইতে চাহিলো.......
আনারকলিঃ
ঘুমিয়ে আছো, জেগে ওঠো
ওগো আমার রাজার কুমার।
জ্যোস্নাস্নানে ভিজবো চলো,
মৌনতা হোক সঙ্গী আবার।
আমাদের ক্লান্ত শ্রান্ত তীতুমীর সাহেবের দিনমান পরিশ্রমের পর কেবলি ঘুমটা গাঢ় হইয়া আসিয়াছিলো। হঠাৎ তিনি আনারকলির ডাকাডাকিতে ভয় পাইয়া, চমকাইয়া, ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন। তারপর বিষম রাগে জানিতে চাহিলেন....
তিতুমীর:
কি হয়েছে!!!
ডাকছো কেনো এমন করে?
পড়েছে কি ডাকাত ঘরে?
সারাদিনের শ্রান্তি শেষে, ক্লান্ত ভীষন,
বেহুশ আমি ঘুমের ঘোরে।
আনারকলিঃ ( আনারকলি তাহার রাগত স্বরে কান না দিয়া গদগদ হইয়া বলিলো)
পড়ছে মনে সেসব কথা---
ছাদের পরে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি আঁকাশ
পূর্নিমা চাঁদ, মেঘের খেলা লুকোচুরি
তোমার ঘরের বারান্দাতে দাঁড়িয়ে তুমি
হঠাৎ হলো চোখাচোখি।
তীতুমীরঃ (একটু নরম, নস্টালজিক সূরে)
হুম.........
আহা আহা সেসব স্মৃতি, রুপোলী সাঝ
সোনালু দিন, ভোরের তারা বাকুম বাকুম,
রাত্রী গভীর নয়ছয় ক্ষন,ঘড়ির কাঁটার
এদিক সেদিক, দিনরাত সব গড়াতো কই,
কোথায় কখন হারিয়ে যেত, ভালোবাসা খুনসুটিতে
শুধুই তুমি শুধুই আমি আর পৃথিবীর সবই মিছে,
কোত্থাও কোনো কিচ্ছুটি নেই।
আনারকলিঃ (আপ্লুত কন্ঠে)
চলনা যাই আবার তেমন, ভিজবো সারা রাত্রী নিঝুম
জ্যোস্নাস্নানে, কইবো কথা
পুরোনো সেই দিনের মত,
গান শুনাবো গুন গুন গুন।
যাই না চলো, ছাদের পরে,
চাদ উঠেছে থালার মতন,
উতল হাওয়া শনশনশন,
মনটা উদাস, ভালোবাসা উথাল পাথাল-
চলনা প্লিজ। ওগো আমার চন্দ্রকুমার।
তীতুমীরঃ (রাতদুপুরে এ প্রস্তাবে আৎকে উঠিলো)
মাথাটা ঠিক আছে তোমার?
আনারকলিঃ ( তার আপ্লুত আবেগে বাঁধাপ্রাপ্ত হইয়া বাঁঘিনীর রাগে চাঁপা ক্রোধে বলিলো)
কি মনে হয়? নেই মাথাটা ঠিকঠাক আর? তাও আমার?
তীতুমীরঃ (বাঘিনী চেহারা দেখিয়া ভয় পাইয়া আমতা আমতা করিয়া)
না মানে, মাথাটা ঠিক হয়তো আছে।
তবে ওটা ঠিক জায়গাতে নেই...
(তারপর একটু হে হে হাসিয়া তারপর গলায় বীর ভাব ফুটাইয়া একটু ফানের চেষ্টা)
হলফ করে বলতে পারি। আই এ্যাম শিওর।
নয়তো এই রাত দুপুরে,ভিজবে ছাঁদে,
কোত্থাও নেই এক ফোঁটা জল,খটখটে ঐ শুকনো আকাশ,
ফ্যাটফেটে ঐ চাঁদের আলো,জ্যোস্নাস্নানে ভিজবে সেথা,
কি বলো সব, বোগাস কথা?
না না তুমি এসব ছাড়ো। অফিস আছে কাল সকালে
কাব্য ছেড়ে লেপটা মুড়ে সটান ঘুমাও সেটাই ভালো,
সেটাই শ্রেয় বুদ্ধিমান আর বুদ্ধিমতীর কাজটা হবে।
(তিনি তাড়াতাড়ি কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমাইতে উদ্যোত হইলো)
আনারকলিঃ ( রাগে ভেংচি দিয়ে)
বুদ্ধিমান না বুদ্ধুমান ? কোনটা তুমি বলতে পারো?
তীতুমীরঃ ( রাগে তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে)
আরে আরে মুখ সামলে রাখো? নিজেকে কি ভাবো তুমি
মাদাম কুরী?এলিজাবেথ ? দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি?
(আবার নরম সূরে)
ওকে ওকে আচ্ছা বলো, হঠাৎ তোমার রাত দুপুরে
এমন কেনো ইচ্ছে হলো?
রাত দুপুরে ছাদের পর ভুতেরা সব খেলা করে
নাকি তুমি তাদেরই এক গোত্র কোনো! শাকচ্চুনী, হুতম পেঁচা।( একটু ফান করার চেষ্টা)
আনারকলিঃ( তাহার কথা শেষ না হইতেই আনারকলির চিল চিৎকার)
কি!!!!!!!!!! কি বল্লে তুমি! আমি ভুতের বংশধরা?
আমায় তুমি তুচ্ছ করো, এই তবে প্রেম ভালোবাসা!
এতদিনের পরে আমার শুনতে হলো এসব কথা!!!
তীতুমীরঃ ( তাড়াতাড়ি তাকে থামাইতে)
ওকে ওকে শোনো শোনো লক্ষী সোনা,চাঁদের কনা
এত রাতে ছাঁদ ভ্রমনে নেই কোনো চার্ম, নেই ভরষা, ভেবে দেখো
হিমের হাওয়া লাগতে পারে, বাঁধতে পারে জ্বর ও কাশি।
তাছাড়া, মা বাবারাও ঘুমিয়ে আছেন পাশের ঘরে.... ( একটু বুঝানোর চেষ্টা)
আনারকলিঃ (অবাক হয়ে)
কথায় কথায় মা আর বাবা, এটা বারণ সেটা শাসন
কোথায় ছিলো বিধিনিষেধ এমনতরো বাঁধা যখন
আমার পিছে ঘুরে ঘুরে, হয়েছিলে ভবঘুরে, ন্যাকা রোমিও
আচ্ছা আমি পাইনা ভেবে কে রেখেছে তোমার এমন
আশ্চর্য্য নাম, দুঃসাহসী বীরের নামে তী---তু---মী---র!!!!!!!!!!!
আসলে তার উচিৎ ছিলো তোমার মত কাপুরুষের জন্য
সঠিক নামটা রাখা এক নম্বরের ভী---তু---মী---র!!!!!!!!!!!!!!
তীতুমীরঃ (বিষম অবাক হয়ে)
ভী--- তু---মী---র---!!!!!!!!!!!!!!!!!!
ও আচ্ছা তাই ! তোমার নাম তো আনারকলি, নৃত্যগীত পটিয়সী
যেমনি ছিলো রুপের বাহার তেমনি সে এক গুনবতী।
তোমার নামটা রাখার সময় সে কথা কেউ ভেবেছিলো?
হাঁটলে কাঁপে দালান কোঁঠা , ডাকলে পালায় চিল কাকেরা
হস্তিনীদের গোত্র তুমি, শকুন পেঁচার মতন গলা!
আনারকলিঃ (অবাকের ওপর অবাক!)
কি বল্লে? কি বল্লে তুমি? আমি শকুন! আমি পেঁচা?
হস্তিনীদের বংশ আমি? আমি কানী? আমি বোঁচা?
তোমাদের যে আবলুশ রঙ, বাজখাই হাঁক, হেড়ে গলা
গঠন গাঠন হাতির মতন, ওরাং ওটাং লাফিয়ে চলা।
কুৎসিত সব দেখতে যেমন, বিদ্যাবুদ্ধি সেটাও তেমন
বোকা ভীতুর হদ্দ সবাই, কথার রাজা, আর কাজেতে রসগোল্লা,
ঠনঠনঠন, বাতাস পোরা খালি কলসী।
তীতুমীরঃ ( বিষম রাগে চিৎকার দিয়ে)
শেষবারটা বলছি আমি মুখ সামলে।
আনারকলিঃ (ততোধিক রাগে)
আস্ত একটা নিলাজ তুমি, বিয়ের আগে কত কথা,
সিন্দাবাদের মতন সাহস, রবিনহূডের মতন হিরো
রবিনসন ক্রুশোর মতন তখন নির্বাসনে যেতে পারো।
আসলে তুমি ঝগড়াটে আর একশো% গোল্লা জিরো।
তখন আমি ক্লিওপেট্রা তখন আমি বনলতা
এখন আমায় পেঁচী লাগে, এমন তোমার মিথ্যা কথা!
খুব তো তখন কাব্য প্রেমী, খুব তো তখন কাব্য শেখা
আর এখন সেসব কোথায় গেলো?ঝগড়া ফ্যাসাদ হেড়ে গলা
থাকো তোমার স্বভাব নিয়ে, চললাম আমি বাপের বাড়ি
তালাকনামা পাঠিয়ে দেবো কাল সকালে-
ততক্ষনের জন্য আড়ি। (এবার ফিচ ফিচ কান্না শুরু হলো)
তীতুমীরঃ ( তীতুমীর বিষম ভয় পেয়ে আর কান্না দেখে দুঃখিত হয়ে তাড়াতাড়ি ছেলেদের চিরদিনের মিথ্যাবাদী রং ঢং স্টাইলে ধোকাবাজী দিয়ে আনারকলিকে ভুলাতে শুরু করলো )
আরে আরে কি সব বলো অলুক্ষুনে,মিথ্যা কথা
বলেছি কি তুমি পেঁচী, তুমি শকুন তুমি টিয়া?
ভুল করেছি, ঘাট মেনেছি, একটুখানি ফান করেছি
জানোই তোমার সোনার বরণ, রাগলে লাগে টুকটুকে রঙ
সেটা দেখতে ভালোবাসি, ওগো আমার হৃদয়বাসী,
আরে তোমার কাছে ফেইল করে যে বিশ্বখ্যাত ঐশ্বরিয়া,
বাড়ির ছাদের পরে তোমার চাঁদপনা সে মুখটি দেখে
ভুল করেছি কোনটা চাঁদ আর কোনটা তুমি সেটাই ভেবে।
কোথায় লাগে নুরজাহান আর কোথায় লাগে তিলোত্তমা
তুমি সবার উর্ধে সেরা, ক্ষমা করো প্রিয়তমা।
আর হবেনা এমন ভুল আর একটু হাসো বাসো ভালো
চাঁদ দেখবো বাইরে কি আর তুমি আমার চাঁদের আলো।
আর বোকা আনারকলি সেসব মিথ্যে কথায় আবারও ভুলে গেলো!!!
( অনেকদিন আগে মুনতাসীরভাইয়া আর ভাবীর ঝগড়ার একটা গল্প পড়ে এত মজাই পেয়েছিলাম। তখন থেকেই সেটার কাব্যরুপ দেবো ভেবেছিলাম। দেবো দেবো করে অনেক দেরী হলো। আর এই কাব্য আমি আমার রাজপু্ত্রভাইয়া, যুগলশব্দভাইয়া, শতদ্রুভাইয়া আর জেনরসিভাইয়াকে উৎসর্গ করছি। রাজপুত্র ভাইয়া ছাড়া যুগলশব্দ ভাইয়া একটু ঝগড়াটে কিন্তু বাকী দু'জন খাঁটি ঝগড়াটে। )
মোনতাসীর ভাইয়ার সেই গল্পটা
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৯