
প্রায়ই আমার মনে পড়ে আমার ছোটবেলার অন্কন শিক্ষার হাতে খড়ির কথা। ঠিক কবে কখন আমি পৃথিবীর এই অষ্টম আশ্চর্য্যের চাইতেও বেশী অবাক করা, ভালোলাগার বিষয়টাতে আগ্রহী হয়েছিলাম সে কথা মনে করবার চেষ্টা করলেই, স্মৃতি বিস্মৃতির অতল গহ্বর খুড়ে প্রথম যে শিল্পীর আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছি বলে মনে পড়ে, সেই শিল্পী আর কেহ নন,স্বয়ং আমার মা।
একদিন তার হিসেবের ডায়েরীর এক পাশে ছোট্ট করে আঁকা দেখলাম একটি মেয়ের মুখ। মনে হয় রোজকার বাজারের ফর্দ বা হিসেব নিকেশের যোগ বিয়োগ করতে গিয়েই, আনমনে কলমের একটানে এঁকেছিলেন তিনি সে প্রট্রেইটখানি আর সেই ছবিই সেদিন সূচনা করে দিলো একজন সম্ভাবনাময়ী, ভবিষ্য শিল্পীর অন্কন চর্চার সুদূর ইতিহাসের স্বর্ণযুগের। সে ছবিটির একমাত্র মুগ্ধ দর্শক যে আমি ছিলাম সে আর কেউ জানুক না জানুক, আমার মা জননী জেনে গিয়েছিলেন খুব অচীরেই।
কারন ঠিক তার এক মিনিট পর থেকেই তার হিসেবের খাতায় যেখানে সেখানে, যত্র তত্র সেই মেয়ের মুখখানি একটানে, দুইটানে, তিন, চার বা পাঁচটানেই মনের মত করে আঁকবার ব্যার্থ প্রচেষ্টারত, আমার মত অক্লান্ত পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী শিল্পীর অব্যাহত অন্কন চর্চার কথা তিনি কি আর না জেনে পারতেন?

যাইহোক একেবারে ঠিকঠাক মায়ের মত আঁকতে না পারলেও চেষ্টা করলে যে কোনো জিনিসের ১০০% এর প্রায় কাছাকাছি যে চলে যাওয়া যায়, সে আমি খুব অল্প দিনেই বুঝে গেলাম। তবে সে ছবির প্রায় কাছাকাছি এঁকে ফেলতে পেরেই খ্যান্ত হলাম না আমি। এর পর চললো ফুল, পাতা, পাখি, বিড়াল, শিয়াল, কুকুর, গরু, ছাগল যা দুচোখের সামনে দেখি তাই এঁকে ফেলার আমরণ প্রচেষ্টা।
খাতাপত্র, বই এর পিছের সাদা পাতাটা, দেওয়াল, টেবিল, আলমারীর গা, ক্যালেন্ডারের পাতা দিনে দিনে চিত্র বিচিত্র হয়ে উঠতে লাগলো আমার শিল্পকর্মে। তবে প্রায়ই এসব অপূর্ব চিত্রকর্ম সৃষ্টির পুরষ্কার স্বরুপ কিচেন থেকে বা বাইরে থেকে ফিরে আসা মায়ের চিত্রকর্মও চলতো আমার সাথে সাথেই সামন্তরাল ও সুনিপুনভাবে। আর তার ক্যানভাসটা ছিলো আমার পিঠ।


এরই মাঝে আবিষ্কার করে ফেললাম খাতাপত্র, বই, ক্যালেন্ডার, টেবিল, চেয়ার ছাড়াও অন্কন চর্চার আরও নানা উপকরন সামগ্রী। আমার নানুবাসার নতুন কাজের মেয়েটা হলো আমার সেই শিক্ষার গুরু। ইটের টুকরো কুড়িয়ে সে শেখালো মেঝেতে কেমন করে মহানন্দে ছবি আঁকা যায়।আমি তো সেই মেয়ের বিরাট প্রতিভা ও জ্ঞানে সত্যি তখন বিমোহিত। পারলে ওকে অন্কনে নোবেল পুরষ্কার দিয়ে দেই।

খুব শিঘ্রী আমি চিনে গেলাম মেঝের কোন কোন জায়গায় বেশ ভালো ছবি আঁকা যায়। নানুবাড়ি, দাদুবাড়ি ও নিজের বাড়ির মেঝের কোন জায়গাটা খরখরে যেখানে ইটের টুকরোর দাগ ভালো বসে আর কোন কোন জায়গাগুলো রোজ রোজ মুছে মুছে তেলতেলে করে ফেলা হয়েছে,


যাইহোক সেই মেয়ে আমাকে আরো এক মজার উপকরনে ছবি আঁকা শিখিয়েছিলো। সে হলো মাটির চুলা থেকে তোলা কয়লা। আজ ভাবি কতইনা সুন্দর ছিলো সেসব উপকরণ। ফেবার কেসল বা লুনা কালার পেনসিল বা প্যাস্টেল, জল রঙেও কি আছে সে সব মজা? সামান্য এক কয়লার টুকরোও মুচমুচে হয়ে যখন ঝরে পড়তো ভেঙে ভেঙে অবাক চোখে দেখতাম আমি কয়লারও যে নানা রঙ আছে। কোনোটা গাঢ় কালো, একদম কুচকুচে আর কোনো কোনোটা আবার ছাই ছাই বা ফিকে কালো রঙ। কোন কয়লায় কেমন রঙ হবে সেটাও আমি তখন বেশ জানি ঠিক এক নং দুই নং বা জিরো নামবার ব্রাশে কেমন কেমন আঁচড় পরে অনায়াসে জানে বড় বড় শিল্পীরা।

পেনসিল, ইটের টুকরো, কয়লা, কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁচড় দিয়ে ছবি আঁকা, বালুর পর আঁকিবুকি সেসব তখন নস্যি। একদিন বিকেলে দেখি মা গোল খোপখোপ করা খুবই সুন্দর কুমকুমের বক্স থেকে সাদা প্লাসটিক কাঠির মত একটা কিছু দিয়ে কপালে টিপ আঁকছেন। আমি চুপচাপ ভালোমানুষি মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম তার কপালে টিপ আঁকা। মা বললেন কি দেখিস এত ভালোমানুষি চেহারা করে? আমিও উত্তর দিলাম ততোধিক ভালোমানুষি চেহারা বানিয়ে যে, কি সুন্দর টিপ আঁকছো তাই দেখি মা। যেন আমার মত ভালো বাচ্চা আর দুনিয়াতে একটাও হয়ইনা।

এরপর মা বাইরে যেতেই একছুটে দৌড়ে গেলাম ড্রেসিং টেবিলের কাছে।




দাদুর সাদা ধপধপে শাড়ীটা যখন ঝকঝক করে ধুয়ে, মাড় দিয়ে টান টান করে রোদে শুকুতে দেওয়া হলো এক দুপুরে। আমি তখন মা আর দাদুর দুপুরের ভাত ঘুমের সৌজন্যে সেই সাদা ধপধপে শাড়ী আর মায়ের কুমকুমের বাক্সটা বুকে করে নিয়ে সোজা চলে গেলাম কোনার ঘরটায়। তারপর আচ্ছা মতন মনের সাধ মিটিয়ে রাঙিয়ে দিলাম নানান রঙে সাদা ধপধপে শাড়ীটা। লাল, নীল, হলুদ, কমলা, বেগুনী নানান সব রঙে শাড়ীটা কি যে সুন্দর লাগছিলো। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম নিজের সৃষ্টির দিকে।
তারপর .......



Click This Link
যাইহোক এসব যে বলছি সবই আমার স্কুলে যাবার আগের কথা। স্কুলে ঢুকবার পর আমার সামনে খুলে গেলো আমার চিত্রশিল্পী হবার সম্ভাবনার নতুন দূয়ার।

আমার এক অতি প্রিয় টিচার আক্তার স্যার, যার নাম আমার হৃদয় আকাশে এখনও উজ্জল নক্ষত্রের মত জাজ্বল্যমান। তিনি সবাইকে বললেন পরদিন একটা করে যার যা ইচ্ছা ছবি এঁকে আনতে।
আমি বাসায় ফিরে মাকে বললাম, আর তারপর আমার এতদিনের অবিরল চিত্রকর্ম চর্চা করা বিষয়গুলো থেকেও কি আঁকবো কি আঁকবো করে কিছুই ভেবে পেলাম না। বরং কি আঁকবো কি আঁকবো করে মায়ের জীবন অস্থির করে তুললাম। বিরক্ত হয়ে মা একটা চিঠি লেখা প্যাডের সাদা কাগজ ছিড়ে কলসী কাঁখে নদীর ধারে গাঁয়ের বধু এঁকে দিলেন। বললেন, যা এইটা নিয়ে স্যারকে দিয়ে দে আর আমার জান বাঁচা এইবার।


আহা আমি এত বড় চিত্রশিল্পী হয়ে নিজের আঁকা ছবি না দিয়ে মায়ের আঁকা দেবো কেনো?


শেষমেশ রাত ১১টা অবধি একখানা ছবি দাঁড়া করালাম। গ্রামের খড়ের ছাউনি দেয়া কুড়েঘর, পাশে কলাগাছ, আকাশে সূর্য্য, মেঘ, পাখি সেসবও জুড়ে দিতে ভুললাম না। কিন্তু হায় ছবি শেষ করে যেই না রঙ করতে গেছি সারাবাড়ি তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলাম না আমার ক্রেয়ন বক্স।




এত রাতে কই পাই এখন ক্রেয়ন? দুঃখে শোকে চোখ ফেটে জল আসতে শুধু চাইলোই না আমার কান্নায় আর চিল চেঁচানীতে পাশের বাড়ি কুকুর টম হঠাৎ মনে হয় ডাকাত পড়েছে ভেবেই ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো, ছোটচাচীর বাবুটা ঘুম ভেঙে উঠে কাঁদতে লাগলো, দাদুর কাশী হঠাৎ বেড়ে গিয়ে আর থামতেই চায়না। আর কান্না গঙ্গা বয়ে গেলো আমার লেস লাগানো ফ্রকের ফ্রিলে। শেষে এগিয়ে এলেন আমাদের বাসার বুড়ো দারোয়ান জামালভাইয়া। পকেট হাতড়ে বের করে আনলেন তিনি হালকা সবুজ ক্রেয়নের ভাঙ্গা আধখানা টুকরা। বললেন, এটা দিয়ে কালার করো মামনি।

আমার কাছে তখন সেটাই সবে ধন নীলমনি। নানা নীলমনি না, সবুজমনি।

শুরু করলাম কলাগাছে রঙ লাগানো। বাহ!! কি সুন্দর লাগছে কলাগাছটা এখন, ঠিক যেন কলাগাছের মতই। কলাগাছের ছেড়া ছেড়া কচি কলাপাতা রঙ করা নিজের ছবিটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। তখন আবার বাসার সবাই ঘুমাতে গেছে। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই।
কিছুক্ষন পর মনে হলো আরে গায়ের বঁধুর শাড়িটাও কলাপাতা রঙ হতে পারে।



স্কুলের বেন্চের নীচে বুঝি পড়ে আছে আমার অতিসাধের ক্রেয়ন বক্স!!!




ধ্যাত দেই না হয় এবার আকাশটাকেও সবুজ রঙ করে। কি আর হবে!!!সন্ধ্যার দিকে আমি একবার সবুজ সবুজ অমন আকাশ দেখেওছিলাম কাজেই হতেই পারে আকাশ সবুজ। এর কিছুপর দিলাম বাড়িটাকেও সবুজ করে। পথে যেতে একবার সবুজ রঙ কার যেন টিনের বাড়ি দেখেছি আমি। এর পর সূর্য্য, নদী, ফুল, পাখি, পাতা, মেঘ, নৌকা, মাঝি, ঝোপ, ঝাড়, সব ঘচাঘচ সবুজ রঙ হতে লাগলো।

বাহ!!!!!!!!!!!! কি সুন্দর হলো এত ক্ষনে ছবিটা!!! রঙে রঙিন! সবুজ সজীবতা বা আমার চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ আর বাড়ি, নদী, মেঘ, সেসবও সবুজ।



পরদিন স্কুলে......
আক্তার স্যার একে একে সবার ছবি হাতে নিয়ে দেখছেন। আমার পালা আসতেই আমি হাসি হাসি মুখে স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই বুঝি স্যারের অবাক মুগ্ধ দৃষ্টি ঝরে পড়বে আমার ছবিখানির দিকে। কিন্তু একি!!! তার বদলে স্যারের আৎকে ওঠা!!

:এই সব কি করছো!!! ফুল, পাতা, লতা, ঘাস, বাড়ি, ঘর, নদী, মেঘ, আকাশ দীন দুনিয়া সব সবুজ রঙে রঙীন!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
আর এইটাই বা কি !!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!! খ্যান্ত বুড়ি নাকি !!!!!!!!!!!!!!!!!!!








































আম্মু................ আমি বাসায় যাবো...........



( আমার অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার পর অনিদ্র রাত কাঁটিয়ে আঁকা কলসী কাঁখে গায়ের তরুণী বঁধুটার মুখ ততক্ষনেই খেয়াল করে দেখলাম, আমি সেটা এঁকে ফেলেছি গাল তোবড়ানো আশী বছরের বুড়ির মত করে।



সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১২ রাত ১১:৫৪