
মানসাংক, পাটীগণিত, এ্যলজেব্রা, জ্যামিতি, ত্রিকোনমিতি। আমার ছেলেবেলায় এসব একেকটা নাম যেন এক এক ডিগ্রী কম্প দিয়ে জ্বর ওঠানো একেকটা শব্দ ছিলো আমার কাছে। বিশেষ করে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার সময় মানসাংক( যা করা হয় মনে মনে, মানে খাতা কলম ছাড়াই নাকি শুধুমাত্র বুদ্ধির জোরে করে ফেলা যায়!) আবার যা কিনা কিছু মানুষের কাছে মহা ফূর্তীর ব্যাপার। সেই মানসাংকের ভীতি ইহজনমে ভোলা হলোনা আমার। আজও মাঝে মধ্যেই স্বপ্নে অংক পরীক্ষা হলের বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি আর তারপর কাটাই বিনিদ্র রজনী ।
আমি নিশ্চিৎ অংক নিয়ে এমন ভীতি অনেকেরই আছে। আর একদল আছেন অংকের জাহাজ (যেমন ম্যাভেরিক ভাইয়া)। যাইহোক ছেলেবেলায় অনেক শুনেছি মেয়েরা নাকি হয় অংকে লাড্ডু গুড্ডু আর বিশেষ করে যেই সব মেয়েরা নাচা গানায় বেশী বেশী আসক্ত হয়, তারা নাকি অংকে শুধু লাড্ডু গুড্ডুই না রসগোল্লাও পায় অনেক অনেক।
এমনি ধারণা ছিলো আমার অনেক বড় হয়ে যাবার পরও।এটা নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথাও ছিলোনা আমার । তবে হাইপেশিয়া।
এই অবাক করা নারীটি আমার ধারণা আমূল বদলে দিলো। আর সাথে সাথে তার জীবনের করুণ পরিনতির উপাখ্যানটি এক বুক কষ্ট নিয়ে হলেও, যেন এই পরম বিস্ময় রমণীটির প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি আর ভালোবাসা আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো।
আশ্চর্য্যজনক বুদ্ধিমতী ও ভবিষ্যৎবক্তা খনা বা অবাক করা সঙ্গীতের যাদুকর তানসেনের মতই হাইপেশিয়াও আরেক বিস্ময় আমার জীবনের। তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য্য মেধার গণিতজ্ঞ।বলা হয় পৃথিবীর সমগ্র নারীকুলে মধ্যে তিনিই প্রথম প্রসিদ্ধ গণিতবিদ । তিনি দার্শনিকও বটে। শোনা যায়, ইউক্লিডের পর আলেকজান্দ্রিয়াতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এত বড় গনিতজ্ঞের আর জন্ম হয়নি ।তার জন্ম ৩৭০ খ্রীষ্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়াতে। সে সময় মেয়েরা ছিলো চরম হেয় ও অবমাননার পাত্র। এরিস্টোটলের নারীবিদ্ধেষী শিক্ষার সুদূরপ্রসারী প্রভাবই হয়তো এমন মনোভাবের কারণ ছিলো।

আলেকজান্দ্রিয়ার খ্যাতিমান গণিতজ্ঞ এবং দার্শনিক থিওন ছিলেন তার বাবা এবং হাইপেশিয়ার শিক্ষার পিছনে তার ভূমিকাই ছিল সবচাইতে বেশী। শুধু তাই নয় এই বিদুষী রমনীটিকে সৌন্দর্য্যে দেবী এথেনার সঙ্গেও তুলনা করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর অনেক লেখক ও সাহিত্যিকেরা তাদের সাহিত্যে তাকে এমনি ভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁকে বলা 'Le souffle de Platon et le corps d'Aphrodit'- অর্থাৎ, 'পরমাসুন্দরী আফ্রোদিতির দেহে প্লেটোর আত্মা’! ৪০০ সালের দিকে তার দর্শনধারা খ্যাতির চরম শিখরে আরোহণ করেন।
কিন্তু তার শিক্ষা দীক্ষা, দর্শন বা গণিত চর্চা কিছুই কন্টকমুক্ত ছিলোনা।
সে সময়ে এ ধরণের শিক্ষাকে প্যাগান রীতিনীতি ও সংস্কৃতির সাথে একীভূত মনে করা হত এবং এর ফলে জ্ঞানের বিকাশের পথে বাঁধার সৃষ্টি হয়, আর এ কারণেই তাকে অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়।
সেই আমলে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিতজ্ঞের পদেও আসীন হয়েছিলেন তিনি। আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছিলেন অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষক। এরিথমেটিক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দর্শন এসবের উপর তার ভাষ্যগুলো সত্যিই অবাক করা। তার বিখ্যাত দার্শকিন উক্তি,
১।তোমার চিন্তা করার অধিকার সংরক্ষণ কর। এমনকি ভুলভাবে চিন্তা করা একেবারে চিন্তা না করা থেকে উত্তম।
২।কুসংস্কারকে সত্য হিসেবে শিক্ষা দেয়া একটি ভয়ংকরতম বিষয়।
তার এমন চিন্তাধারাই সেসময়কার খৃস্টান জনতাকে উন্মত্ত করে তুলেছিলো আর তার করুণ পরিণতিতে জীবন দিতে হয়েছিলো হাইপেশিয়াকে। কিন্তু মৃত্যু তাকে দিয়েছে অমরত্ব । তার জীবন নিয়ে চার্লস কিংসলি লিখেছেন "হাইপেশিয়া" বিখ্যাত উপন্যাস।

আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের একটি বিশাল কক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় হাইপেশিয়া বক্তৃতা দিতেন। হাইপেশিয়া তাঁর বক্তৃতায় প্লেটো, আ্যারিস্টটলের দার্শনিক কাজকর্ম নিয়ে প্রচুর কথা বলতেন, তাদের পর্যালোচনা করতেন আর দূর দুরান্ত থেকে আসা লোকজন সম্মোহিত হয়ে শুনতেন তার কথা । তার মধ্যে একজন ছিলেন সাইরিনের সিনেসিয়াস (Synesius of Cyrene). হাইপেশিয়াকে হত্যার পর তাঁর সমস্ত কাজ কর্মও ধ্বংস কের ফেলে খ্রীষ্টান মৌলবাদীরা। হাইপেশিয়ার কাজকর্মের যেটুকু জানা যায়, তার মধ্যে একটা বড় উৎসই এই সিনেসিয়াসের লেখা চিঠিপত্র।হাইপেশিয়া কখনো বিয়ে করেননি; ধারণা করা হয় এমন কাউকে তিনি পাননি যিনি তাঁর মনন ও দর্শনের সমকক্ষ হতে পারেন।
হাইপেশিয়ার মৃত্যু সূচনা করেছিল মানব ইতিহাসের এক ঘোর কৃষ্ণ অধ্যায়ের, যে সময়ে জ্ঞানচর্চ্চা, বিজ্ঞান,শিল্পচর্চা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এ সময় সেসবের বদলে চর্চা করা হয় ধর্মীয় কুসংস্কার, অরাজকতা আর বর্বরতার। এই সময়টিকে ইতিহাসবিদরা আখ্যায়িত করেন 'অন্ধকার যুগ' বা Dark Age নামে।
http://www.myspace.com/urania48/blog/322698619

আমেরিকান বিজ্ঞানী J.W.Draper স্পষ্ট করেই বলেন, 'হাইপেশিয়া ছিলেন ধর্মের বিপরীতে বিজ্ঞানের নিবিড় সমর্থক।'হাইপেশিয়ার অনেক বক্তব্যই ছিলো গোঁড়ামী বিরোধী আর মুক্তবুদ্ধির প্রতি সমর্থনসূচক, যা নিঃসন্দেহে কট্টরপন্থিদের উষ্মার কারণ ঘটিয়েছিল। এ ধরনের স্বচ্ছ কথাবার্তা যে যুগে যুগে মৌলবাদীদের ক্ষিপ্ত করেছ।
হাইপেশিয়াকে হত্যা করা হয় ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে। তখন তার বয়স মাত্র ৪৫। হাইপেশিয়ার হত্যাকারীদের তালিকায় ছিলো মূলতঃ সিরিলের জেরুজালেমের চার্চের প্যারাবোলানস, মৌলবাদী সন্ন্যাসী, নিটৃয়ান খ্রীষ্টীয় ধর্মবাদীরা।

হাইপেশিয়া-হত্যার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় পনের শতকে সক্রেটিস স্কলাসটিকাসের রচনা হতে 'পিটার নামের এক আক্রোশী ব্যক্তি অনেকদিন ধরেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো, একদিন হঠাৎ সে হাইপেশিয়াকে কোন এক জায়গা হতে ফিরবার পথে তার দলবল নিয়ে হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ী থেকে টেনে হিঁচড়ে কেসারিয়াম (Caesarium) নামের একটি চার্চে নিয়ে যায়। সেখানে তারা হাইপেশিয়ার কাপড়-চোপড় টেনে হিচড়ে খুলে তারপর ধারালো অস্ত্রে তাঁর চামড়া চেঁছে ফেলে, তার শরীরের মাংস চিরে ফেলে, আর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত হাইপেশিয়ার উপর তাদের অত্যাচার চালিয়ে যায়। মারা যাবার পর হাইপেশিয়ার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে সিনারন (Cinaron) নামের একটি জায়গায় জড় করা হয় আর তারপর পুড়িয়ে তা ছাই করে দেয়া হয়'।
'তুচ্ছ নারী'র মেধা, মনন আর জ্ঞান অনেক সময়ই পরাক্রমশালী পুরুষতন্ত্রের কাছে নিতান্ত অসহনীয়। তার মধ্যে আবার সে নারী যদি হয় বিজ্ঞানমনস্ক মুক্ত-বুদ্ধির চর্চাকারী, রাজনীতি সচেতন এক স্বাধীনচেতা রমণী!

হাইপেশিয়াকে নিয়ে রচিত ম্যুভি
প্রখর বুদ্ধিমতি, আত্মমর্যাদাশীল, জ্ঞান গরীমায় মহিমান্বিত এই রমণীর জীবনের এই করুন পরিনতির উপাখ্যান যেন আজও আধুনিক সুসভ্য সমাজকে ব্যাঙ্গ করে। যুগে যুগে জীবন ও সমাজের বহু ক্ষেত্রেই নারীর অবদান অনস্বীকার্য্য কিন্তু তা যেন মেনে নেওয়াটা সমাজের কিছু কিছু দাম্ভিক মানুষের জন্য বড়ই লজ্জাস্কর।
যাইহোক মৃত্যুর পরেও মৃত্যু হয়নি হাইপেশিয়ার। তার মেধা মনন ও জ্ঞানের সাক্ষ্য হয়ে আছে বিভিন্ন সাহিত্যিক ও পন্ডিৎগনের রচনা।
হাইপেশিয়ার সমসাময়িক পণ্ডিতগন প্রায় কাব্যময়ভাবে তাঁর কথা বলে গিয়েছেন। ধর্মতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক সক্রেটিস, নিসেফোরাস এবং ফিলোস্তোরজিয়াস ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী হলেও তাঁর প্রশংসা করেন উদারভাবে।

অনেক অনেকগুলো বছর পরেও তাই হাইপেশিয়া অমর হয়ে রয়েছেন কোটী মানুষের হৃদয়ে।
হাইপেশিয়া সন্মন্ধে সর্বপ্রথম আমি জানতে পাই মেঘ আপুর কাছ থেকে আমার খনা পোস্ট দেবার পরে। তার থেকেই জানতে পারি,যুগে যুগে নারীর উপর নেমে আসা পুরুষের খড়গহস্ত হতে যে মেধা ও মননে উন্নতির শীর্ষে পৌছে যাওয়া নারীরাও রক্ষা পায়নি তার জলন্ত উদাহরন খনার মতই করুন পরিনতির শিকার হাইপেশিয়া। আর তারপর হাইপেশিয়া সম্পর্কে আরও আরও জানতে পাই ইন্টারনেট থেকে। তবে সবশেষে ম্যাভেরিক ভাইয়ার এই লেখাটি থেকে যা জানতে পাই তা আমার এইটুকু জীবনের জন্য হয়তোবা যথেষ্ঠ।
Click This Link
হাইপেশিয়াকে নিয়ে এত সুন্দর বর্ননা ও তার সৃষ্টি ও কৃতিত্বের বিশদ বিবরণ মনে হয়না এই পৃথিবীর আর কোনো লেখক বা সাহিত্যিক তার মত করে দিতে পেরেছেন। তাই তার বিনা অনুমতিতেই লিন্কটি এইখানে শেয়ার করলাম।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের পক্ষ হতে হাইপেশিয়ার প্রতি সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আর আমার এ লেখাটি আমি ম্যাভেরিকভাইয়া ও মেঘ আপুকেই উৎসর্গ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১২ দুপুর ২:১৫