মৃন্ময়ী -এই নামটি শুনলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে শ্যামল বরণ, প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু খুবই অশান্ত, চন্চলা হরিণীর মত একটি অবাধ্য বালিকাকেই। যদিও এই বুদ্ধিমতী বালিকাটি তার অসম্ভব দুরন্তপণার কারণে বেশীভাগ সময়ই তার নানা রকম অভিনব কর্মকান্ডে বুদ্ধিহীনতার পরিচয়ই দিয়ে থাকে তবে সেটাকে আমার বুদ্ধিহীনতা বা বোকামী না ভেবে একটু ড্যাম কেয়ার মনোভাবাপন্নতাই মনে হয়। আর তাই হয়তোবা বালিকাটি আমার আরও আরও বেশী প্রিয় হয়ে যায়।
হ্যাঁ আমি রবিঠাকুরের সেই অমর সৃষ্টি ছোট গল্প সমাপ্তি আর তার সেই গল্পের দুষ্টুমতী বালিকা মৃন্ময়ীর কথাই বলছি। আমার কিশোরীবেলা থেকেই মৃন্ময়ী নামের প্রিয় এই মেয়েটি গল্পের বই এর পাতা থেকে উঠে এসে জীবন্ত হয়ে আমার বুকের গলিপথে আজও হেঁটে চলে বেড়ায়। লক্ষী শান্ত, সভ্য ভব্য কত গল্পের নায়িকার কথাই তো পড়লাম এই জীবনে কিন্তু জানিনা কেনো এই অবাধ্য ড্যামকেয়ার মেয়েটাই আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় একটি প্রকৃত বালিকার প্রতিচ্ছবি হয়ে গেঁথে রইলো সারাটাজীবন।
অপূর্বকৃষ্ণ ওরফে অপূর্ব- শান্ত, ভদ্র, সুশিক্ষিত, বড়লোক জমিদার পুত্রের আদলে একজন প্রকৃত প্রেমিক। মৃন্ময়ীর জন্য তার চাইতে যোগ্য প্রেমিক বুঝি ইহজগতে আর হয়না। প্রেমিক হিসেবে অপূর্বকৃষ্ণের ধৈর্য্য সত্যি প্রশংসনীয়। একমাত্র এমন একটি মানুষকেই বুঝি ভালোবাসা যায় মৃন্ময়ীর মত মন দিয়ে আর প্রাণ দিয়ে। চুপি চুপি বলি সেই কিশোরীকাল থেকেই কত শত বার যে আমার মৃন্ময়ী হতে ইচ্ছে হয়েছিলো!!!
চন্দরা-এক তেজস্বিনী, নির্ভিক, সংকল্পপরায়ন নারীর প্রতীক যেন। সমাজের নীচু স্তরের কোনো এক হত দরিদ্র পরিবারের অভাগী এই মহিলাটির চরিত্রের যে দৃঢ়তা তা অবাক করে আমাকে!! সত্যি আমি অবাক হয়ে যাই!!! কি করে পায় এই একরত্তি, অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত এই মেয়ে এমন মানষিক শক্তি বা দৃঢ়তা!!! সবকিছু ছাপিয়ে অবাক করা তার অভিমান। এই সমাজ সংসার আর সর্বপরি ভালোবাসার মানুষটির উপর এক বিশাল অভিমানের বোঝা মাথায় নিয়েই যেন রুখে ওঠে মেয়েটি। আর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আজও আমার বুকের জমিনের আলপথে।
পুলিস যখন চন্দরাকে প্রশ্ন করিল, চন্দরা কহিল, "আমি খুন করিয়াছি।"
"কেন খুন করিয়াছো?"
"আমি তোহাকে দেখিতে পারিতাম না।"
"কোনো বচসা হইয়াছিলো?"
"না"
"সে তোমাকে প্রথম মারিতে আসিয়াছিল?"
"না"
"তোমার প্রতি কোনো অত্যাচার করিয়াছিল?"
"না"
এরুপ উত্তর শুনিয়া সকলে অবাক হইয়া গেলো।
ছিদাম তো একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল। তাহাকে বিধিমত জেরা করিয়া বার বার একই উত্তর পাওয়া গেল। বড়বৌ এর দিক হইতে কোনোরুপ আক্রমন চন্দরা কিছুতেই স্বীকার করিলনা।
একি নিদারুণ অভিমান!!! চন্দরা মনে মনে স্বামীকে বলিতেছে, " আমি তোমাকে ছাড়িয়া আমার এই নব যৌবন লইয়া ফাঁসিকাঠকে বরণ করিলাম- আমার ইহজনমের শেষ বন্ধন তাহার সহিত।
পার্বতী-শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবদাস ও তার নায়িকা পার্বতী যেন সহজ সরল, সতেজ ও সজীব একটি কলমি ফুলের মত এক গ্রাম্যবালিকার প্রতিচ্ছবি। তাকে আমার একটু শান্ত শিষ্ঠ ভোলেভালা টাইপ বালিকাই মনে হয় তবে অবাক করা তার ব্যাক্তিত্ব ও সম্ভ্রম। পিতার দারিদ্রতা তাকে পরাজিত করেনি তার ব্যাক্তিত্বের কাছে। তারপরও বুক ফাটে তো মুখ ফোটেনা টাইপ সেই চিরায়ত বাংলার নারীর মনের গহীনে ভালোবাসার যে আকুলতা তা যেন যে কোনো মানুষেরই হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
দেবদাস-ধনী, দাম্ভিক, রুঢ়, কঠোর, নির্দয়, নিষ্ঠুর এমন যে কোনো নেতিবাচক বিশেষনে বিশেষিত করতে ইচ্ছে হয় তাকে। তবুও যেন সে সংসার ও সমাজের শ্রেনীবৈষম্যের স্বীকার এক আকুল হৃদয় প্রেমিক পুরুষ। মদ্যপ, জুয়াড়ী, নীতিহীন এক বখে যাওয়া মানুষও হয়তো বলা যেত তাকে অনায়াসে কিন্তু তার প্রেমিক মন যেন শিশুর মতই সরল। তার ভালোবাসা যেন স্নিগ্ধ এক করবী ফুলের মতই পবিত্রতার প্রতীক। প্রচন্ড অভিমানী এই মানুষটির চাপা অভিমানটা ঠিক কার উপর আমি ঠিক বুঝিনা। সমাজ, সংসার, পরিবার নাকি তার নিজ নিয়তির উপরেই ?
তবে একটা জিনিস শেষ মূহুর্তে বুঝে যাই, সবকিছু বিসর্জন দিয়ে জীবনের শেষমুহুর্তের আশ্রয়স্থল হিসেবে সে বেছে নিতে চেয়েছিলো সবচেয়ে প্রিয়তম স্থানটি, তার ভালোবাসার মানুষটির পরম প্রিয় কোল। সবশেষেও আপ্রাণ চেষ্টা করেও প্রেমিকার বাড়ির দোরগোড়া্য এসেও তার মুখটি একটিবার না দেখতে পাওয়া তার ভালোবাসার স্বার্থকতাকে কমায় না সহস্রগুণ বাড়িয়ে দেয় আমি জানিনা। শুধু জানি দেবদাস আর পার্বতীর হৃদয়ের সেই হাহাকার আমার হৃদয়কেও শূন্য করে দেয়।
ললিতা ও শেখর- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সব সৃষ্টির মাঝে আমার আরও একজন মহৎ হৃদয় স্বপ্নপুরুষ পরিণীতা গল্পের শেখর। ললিতা ও শেখরের প্রেম যেন এক আত্মিক টান বা বিনি সুতোর বন্ধন। যা অলিখিত হয়ে ওদের হৃদয়ের দরজায় বহূযুগ ধরে লেখা ছিলো। ললিতার মত লক্ষী আর একজন মিষ্টি মেয়ের জন্য শেখরের মত উঁচুমনের প্রেমিক পুরুষ ছাড়া আর কাউকে মানায়ইনা।
জ্ঞানদা- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অরক্ষনীয়ার জ্ঞানদাকে ক'জনের মনে আছে জানিনা। সে কখনও কারো স্বপ্নকন্যা হতেও পারেনা। শুধু বয়স বাড়তে থাকা আইবুড়ো কালোমেয়েটির কষ্ট আর তার চাপা দুঃখের সাথে সাথে বার বার পাত্রপক্ষের কনে দেখা পরীক্ষাটিতে বসা ও যথারীতি অকৃতকার্য্য হবার দৃশ্যটি বুকের মধ্যে গেঁথে রয় বছরের পর বছর।
সমাজ সংসার ও বিশেষ করে কালো মেয়ে জন্ম দেবার অপরাধে মায়ের নিদারুন মর্মবেদনা ঘুচাতে যখন সে মরিয়া হয়ে নিজেই একদিন অপটুহাতে সাজসজ্জা করে পাত্রপক্ষের সামনে পরীক্ষা দিতে বসে আর তার সেই কিম্ভুতকিমাকার সাজসজ্জা দেখে পাড়াপড়শী, আত্নীয়স্বজন হাসি তামাসা শুরু করে । একটি ছোট বাচ্চা বলে ওঠে 'গেনিপিসি সং সেজেছে।' সেই মুহুর্তে জ্ঞানদার পাওয়া সেই কষ্ট, লজ্জা, অপমানটুকু জ্ঞানদার বুক থেকে আমার হৃদয়ে সন্চালিত হয় আর জেগে থাকে সুচিভেদ্য বেদনা হয়ে।
মহুয়া- তখন কেবল এস, এস, সি পাস করে সবে কলেজে উঠেছি। বসন্তের এক হলুদ বিকেলে গেলাম বইমেলা। একটি স্টলে কবিতার বই খুঁজছিলাম। হঠাৎ একটি ছেলে একটা বই বাড়িয়ে দিয়ে বললো, 'আপু এই বইটা নাও। গ্যারান্টি দিচ্ছি তোমার অনেক ভালো লাগবে।" এহ ছি! বইটার উপরে একটা ছেলে আর মেয়ের ছবি। কেমন যেন সিনেমা সিনেমা টাইপ। মোটেই ভালো বোধ হচ্ছিলোনা। তারপরও কি ভেবে যেন নিয়ে নিলাম।
তারপর বাড়ি ফিরে বইটা খুলে আর শেষ না করা পর্যন্ত উঠতেই পারলাম না। সেই আমার পরিচয় বুদ্ধদেব গুহের লেখা সুখের কাছে বইটার স্বপ্নকন্যা মহুয়ার সাথে। শিক্ষিত রুচিশীল, সংস্কৃতিমনা মহুয়ার ব্যাক্তিত্বের সাথে কখনই খাপ খায়না দুর্গম পাহাড়ি বনান্চলে দেখা হয়ে যাওয়া এক গাড়ির মিস্ত্রীর প্রেম।
তবুও সমাজের সকল নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে মহুয়া প্রেমে পড়ে সুখরন্জন বসু এর। চুপি চুপি সকলের অগোচরে বয়ে আনে নিজের মাঝে, নিজের শরীরে সেই ভালোবাসার স্মারকলিপি। যদিও বাংলা সিনেমার মত একটা ব্যাপার আছে সেখানে সুখরন্জন বসু প্রকৃতপক্ষে একজন সামান্য মিস্ত্রী নন তিনি একজন ইন্জিনীয়ার। অকাল প্রয়াত ভাই ও তার পরিবারের উপর দায়বদ্ধতা হতেই বেছে নিয়েছেন সেই বনবাস জীবন।
ভালোবাসার কাছে মহুয়ার নির্ভিক সমর্পন যা হয়তো আমার মত বাস্তববাদী ও ভীতু মানুষের পক্ষে স্বপ্নের অতীত। তাই মহুয়া হয়ে যায় আমার স্বপ্নকন্যা। সবকিছু উপেক্ষা করে নিজের মনের ইচ্ছের দাম দিতে পারার মত তার শক্তিশালী মনটার উপর বেড়ে যায় আমার শত সহস্রগুন শ্রদ্ধা। কিশোরীবেলার সেই মৃন্ময়ীর পর আবার আমার মহুয়া হয়ে যেতে ইচ্ছে করে খুব খুব !!! আমার আকাশলীনা কবিতায় মনে হয় এই ইচ্ছেটার একটু ছোঁয়া আছে।
Click This Link
রেনু- সমরেশ মজুমদারের এই আমি রেনু উপন্যাসের রেনু চরিত্রটি আমার স্বপ্নকন্যার চরিত্র নয়। তবে আমার ধারনা এটি অনেকটাই মানে শুধু অনেকটাই না অনেকের ক্ষেত্রেইআমাদের সমাজের অতি বাস্তব পরিস্থিতির একটি চেনা অচেনা চরিত্র। রেনু অসম্ভব আকর্ষনীয়া পাড়ার মিষ্টি মেয়েটি, যাকে দেখা মাত্র পাড়ার বখাটে যুবক থেকে শুরু করে ছেলে বুড়োএমনকি পাড়ার দাদারা পর্যন্ত তার প্রেমে পড়ে যায়। আর সেই সুযোগের সদব্যাবহারকারীনী রেনু মেয়েটি কারো ভালোবাসার আহ্বানই বুঝি উপেক্ষা করতে পারেনা। একের পর এক প্রেমে পড়ে বা সকলের সাথেই করে যায় প্রেমের অভিনয়। এমন মেয়ে মোটেও সমাজের চোখে ভালো মেয়ের আখ্যা পাবেনা। তবে আমি জানিনা এই মেয়ে কি শুধুই অভিনেত্রী নাকি সুযোগ সন্ধানী নাকি সে আসলেই খুঁজে পায়না কারো কাছে প্রকৃত প্রেম। কারণ শেষ পর্যন্ত সত্যিকারের ভালোবাসা দাবী দাওয়াহীন নিসম্বল সুমিতের কাছে হয় তার ভালোবাসার পরাজয়।
ধ্রুব - আমার ধারনা এপার বাংলা, ওপার বাংলার উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা সকল নারীহৃদয় হরনকারী চরিত্রটির নামই ধ্রুব। তাকে কি আর কারু কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়? শীর্ষেন্দুর দূরবীন উপন্যাসের ধ্রুবকে চেনেনা এমন নারী পুরুষ বুঝি বিরল বাংলাদেশে। এমন বেয়াড়া, অহংকারী, দাম্ভিক, উদাসীন, জগত সংসারের কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা না করে চলা বেপরোয়া এ যুবকের মাঝে কি যে আছে তা হয়তো তার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং শীর্ষেন্দুও জানেননা। তার হৃদয়ের হদিস কোনোদিনও কেউ খুঁজে পায়না। কোনো মেয়ের পক্ষেই হয়তো তা খুঁজে পাওয়া সম্ভবও না। সে এক অজানা রহস্য। তাই হয়তো এই রহস্যের পিছে ছুটতে গিয়েই আমরা এ চরিত্রটির প্রেমে আরও বেশী পড়ে যাই। কেনো যেন মনে হয় শীর্ষেন্দু বুঝি একটু দেবদাস একটু নিজের থেকেই নিয়ে গড়েছিলেন ধ্রুবকে। তাই ধ্রুবর সাথে সাথে আমি আমার প্রিয় লেখকের প্রেমেও পড়ে যাই। কবির ভাষায় জিগাসা করতে ইচ্ছে হয় তাকে, তুমি কেমন করে এমন লেখো হে গুণী!
আমার খোকাভাই ও আমি নিরুপমা- খোকাভাই নামটা যখনই মনে পড়ে আমার ঠোঁটে ফুটে ওঠে মুচকি হাসি। দারুন মজা পাই আমি এই ভেবে যে একমাত্র আমিই জানি তার সৃষ্টির সত্যিকার রহস্য।
যাইহোক আমার খোকাভাই। একান্নবর্তী পরিবারের মৃত বড়চাচার একমাত্র সন্তান। বিধবা মায়ের অন্ধের ষষ্ঠী। এই মাকেই বিয়ে করা নিয়ে পারিবারিক মনোমালিন্যের শিকার তার বাবা। বউ বাচ্চা নিয়ে ছিলেন বাড়ি থেকে বহূ বছর নির্বাসিত। বাবার মৃত্যুর পর বিধবা মা, এ বাড়ির বড় বৌ কোথাও কোনো কুলকিনারা না পেয়ে শেষে ছেলের হাত ধরে এসে উঠেছিলেন শ্বসুরের ভিটায়।
টলটলে বড় বড় চোখের মায়াময় চেহারার বড় নাতির মুখ দেখে বৃদ্ধ শ্বসুর ফেলে দিতে পারেননি তাকে আর। তবে এত বছর পর অন্যান্য ভায়েরা আর তাদের বৌ ঝিয়েরা নতুন কোনো আপদকে সাদরে সম্বর্ধনা দিতে পারেননি। ছেলেসহ বড় বৌ এর ঠায় হয়েছিলো বাড়ির কোনে প্রায় পরিত্যাক্ত এক অন্ধকার কুঠুরীতে। সারাদিন হেসেলে খেঁটে আর সকলের মন যুগিয়ে বুঝি বড় বৌ পুসিয়ে দিতে চাইতো তার সকল অজানা অপরাধের ক্ষতিপূরণ।
আর একটু বড় হবার পর ভীষন চুপচাপ, গম্ভীর আর নিজের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রাখা খোকাভাই এর থাকবার জায়গা হয়েছিলো ছাদের চিলেকোঠার ছোট্ট এক খুপরীতে। অনেকগুলো বছর পর নিজের পৈতৃক বাড়িতে আগমনের পরেও আজন্ম পরিচয়ের ব্যাবধানে বাড়ির অন্যান্য সকলের সাথে আর সখ্যতা হয়নি তার। সকলে যেমন এড়িয়ে চলতো তাকে, খোকাভাই নিজেও বুঝি নিজের মত নিজে একাকী থাকতেই পছন্দ করতো বেশী।
শুধুই দুই বেনী দুলানো, ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেজচাচুর মেয়েটার কেনো যেন এক অকারণ কৌতুহল আর ভাব জমানোর আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো তার সাথে। কারণে অকারণে তার চিলেকোঠার রুমটায় উঁকিঝুকি। তার অনুপস্থিতিতে তার সব জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি। আচার, চকলেট,চুইংগাম থেকে শুরু করে মাছ মাংস কাবাব পর্যন্ত তার জন্য লুকিয়ে আনা। অগোছালো ঘর গুছিয়ে রাখা। ফুল, কার্ড, নিজে হাতে আঁকা ছবির মত নানারকম ছেলেমানুষী উপহারে তাকে ভরিয়ে দেওয়া। তার সাথে ভাব জমানোর আপ্রাণ চেষ্টার কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়েছিলো খোকাভাই।
যদিও তার একছত্র আধিপত্যে নানা রকম অত্যাচারও সহ্য করতে হতো তাকে। ছুটির দিনের এক দুপুরে মুখ ভর্তি তার অতি প্রিয় এক দঙ্গল দাড়িগোঁফের মাঝে নিরুপমার নির্দয় কাঁচি চালনা বা খুব লুকিয়ে চুপিচুপি রাত্ জেগে লেখা কবিতা চুরি করে বান্ধবীদেরকে নিয়ে পড়ে হাসাহাসি করা এসব অনেক অন্যায় অত্যাচারই নীরবে সহ্য করে যেতে হতো তাকে। রাখতে হতো তার নানা রকম উদ্ভট আবদার। তবুও প্রচন্ড রাগী, একটু একরোখা খোকাভাই এর কাছে নিরুপমার সাত দুগুনে চোদ্দ খুন ছিলো মাফ।এমন দূর্বোধ্য অবাধ্য আর জীবনের প্রতি উদাসীন খোকাভাই এর পৃথিবীতে তখন প্রিয়জন বলতে শুধুই দুজন, এক মা আরেক নিরুপমা। আর কোথাও কেউ নেই। ভালোবাসার কাছে বড় বড় অন্যায় আবদার অত্যাচারও আসলে তুচ্ছ।
আর নিরুপমা বা নিরুপমার বয়সী যেকোনো মেয়েরই হয়তো সে বয়সে এমন কোনো নেশা থাকে দূর্বোধ্য, অবাধ্য কোনো বন্যকে বশীভুত করবার নেশা। পুরোপুরি নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করবার মত কোনো নেশা। সেটা কি ভালোবাসা!! অবশ্যই হ্যাঁ। নতুবা আজও কেনো কারণে অকারণেই মন কাঁদে ঝুম বরষায়!
তবুও দুর্বোধ্য খোকাভাই একসময় নতুন নেশায় জড়ালো। যা নিরুপমার চাইতেও তখন তার কাছে অধিক শক্তিশালী। নিরুপমার হাজারও প্রচেষ্টা পরাজিত হলো সেই সর্বনাশা নেশার কাছে। হেরে গেলো নিরুপমা আর তার ভালোবাসা সেই মরন গ্রাসী ভয়াল আসক্তির কাছে। এক সময় খোকাভাই ফিরে এলো। কিন্তু তখন নিরুপমা অনেক দূরে। হারিয়ে গেছে তার চিরচেনা, হাত বাড়ালেই পেয়ে যাওয়া গন্ডির আওতার বাইরে।
এই সেই নিরুপমা আর খোকাভাই এর গল্প। এখন আমি আর নিজেও জানিনা এর কতখানি সত্যি আর কতখানি মিথ্যেয় গড়া। শুধু জানি খোকাভাই নামটি নিয়েছিলাম আমি নির্মলেন্দু গুনের অমীমাংসীত পুরুষ কবিতায় পাওয়া খোকাভাই এর নামটি থেকে। যার আড়ালে ঢেকে গেছে আমার সত্যিকারের কোনো খোকাভাই এর নাম।খোকাভাই নামটির পিছে গড়া আমার খোকাভাই শুধুই আমার সৃষ্টি। তার সাথে এই পৃথিবীর আর কারো কোনো লেখার মিল নেই। হয়তো সে একজন পরাজিত অথবা অপরাজেয় মানুষ। আমার কাছে- তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।
যাইহোক, আমাদের গল্প উপন্যাসে পড়া কত শত প্রিয় চরিত্ররাই তো লুকিয়ে থাকে আমাদের মনের গহীনে। তাদের কথা প্রায়শই মনেও পড়ে যায় আমাদের কারণে অকারনে। তবে কিছুদিন আগে সমুদ্রকন্যার লেখা এই পোস্টটি বই এর পাতার স্বপ্নপুরুষেরা
পড়েই আমারও ইচ্ছে হয়েছিলো বই এর পাতার আমারও প্রিয় কিছু স্বপ্নকন্যা ও স্বপ্নপুরুষদেরকে নিয়ে লিখবার কথাটা।
সেখানে সরলতা, সমুদ্রকন্যা আর ত্রাতুলের কমেন্ট দেখে মনে হলো সাথে আমার খোকাভাইকে নিয়েও কিছু লেখা উচিৎ আর তাই এই লেখাটার আইডিয়াটা মাথায় এলো।
আর একারনেই আমার এ লেখাটা আমি উৎসর্গ করছি গভীরতার মেয়ে সমুদ্রকন্যা, সরলতার প্রতীক ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখায় দীপান্বীতা সরলতা আর গুরুগম্ভীর ভাবসাধক লেখক ত্রাতুলকে।
সবাইকে জানাই ভালোবাসা।
আমার খোকাভাই সমগ্র-
খোকাভাই-১
খোকাভাই-২
খোকাভাই-৩
খোকাভাই-৪
খোকাভাই-৫
খোকাভাই-৬
খোকাভাই-৭
খোকাভাই-৮