মহিলা ওলিদের মধ্যে হজরত রাবেয়া বসরী রহমাতুল্লাহ আলাইহি ছিলেন অন্যতম এবং তিনি অত্যধিক পর্দানশীল ও আল্লাহর খাস বান্দি ছিলেন। সর্বদা তিনি আল্লাহর প্রেমে ডুবে থাকতেন। জাহেরি_বাতেনি পবিত্রতায় তাঁকে মরিয়মে সানি অর্থাৎ দ্বিতীয় মরিয়ম বলা হতো। তিনি সর্বদা আল্লাহতায়ালার ইবাদতে রত থাকতেন, যার ফলে তিনি আল্লাহর দিদার লাভ করেছিলেন।
হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর নামকরণে কথিত আছে, তাঁর পিতা এতই দরিদ্র হয়ে পড়েছিলেন, যে রাতে রাবেয়া জন্মগ্রহণ করেন, তখন ঘরে বাতি জ্বালাবার তেল এবং প্রসূতি ও সন্তানের পেটে মালিশ করার তেল পর্যন্ত ছিল না। রাবেয়ার আগে তাঁর পিতার আরো তিনটি কন্যা হয়েছিল। তিনি চতুর্থ নম্বর বলে তাঁর নাম রাবেয়া রাখা হয়। আরবি ভাষায় রাবেয়া অর্থ চতুর্থা। রাবেয়ার জন্মের রাতে এ ধরনের বিপদগ্রস্ত হয়ে তাঁর মাতা স্বামীকে বলেন, 'অমুক পড়শির কাছ থেকে বাতি জ্বালাবার কিছু তেল নিয়ে আসুন।' স্বামী এর পূর্বে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কারো কাছ থেকে কোনো কিছু কর্জ করবেন না। তবুও স্ত্রীর একান্ত অনুরোধে পড়শির ঘরে গেলেন, কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, সেই পড়শি ঘরের দরজা পর্যন্ত খুলল না। এই দুঃখ ও ক্ষোভে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন এবং সেই অবস্থায় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলেন_রাসুলুল্লাহ যেন বলছেন, 'চিন্তা করো না, মনে রেখ তোমার এই কন্যা কালে অতি মহান ও বেহেশতের অগ্রবর্তিনীদের মধ্যে অন্যতমা হবে। হাশরের দিনে আমার ৭০ হাজার উম্মত তার সুপারিশে মুক্তি পাবে। এখন তুমি বসরার আমির ঈসার কাছে যাও এবং এক টুকরো কাগজে এই কথা লিখে দেবে, তুমি দরূদ পাঠ করো আর জুমআর রাতে ৪০০বার পড়ো। গত বৃহস্পতিবার রাতে দরূদ পড়োনি, সে জন্য তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ৪০০ দিনার এই রাতে দান করবে।'
রাবেয়ার পিতা এরপর জাগ্রত হয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং উক্ত স্বপ্নের বাণীসমূহ একখণ্ড কাগজে লিখে পরদিন একজন লোক মারফত তা আমিরের কাছে প্রেরণ করেন। আমির পরদিন এই পত্র দেখে অবাক হলেন এবং তখনই ৭০ হাজার দিরহাম দরিদ্রদের মধ্যে দান করলেন। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তাঁকে মনে করেছেন, তার শোকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) প্রকাশই এই দানের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাবেয়ার পিতাকে ৪০০ দিনার প্রদানের জন্য আদেশ করলেন।
রাবেয়া বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাঁর মাতা-পিতা ইন্তেকাল করেন। তাঁদের ইন্তেকালের অল্প পরেই বসরায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হয়। রাবেয়ার ভগি্নরাও তাঁর কাছ থেকে পৃথক হয়ে পড়েন। সে সময় এক জালেম তাঁকে পেয়ে সামান্য কয়েকটি মুদ্রার পরিবর্তে এক ধনবান ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে। সে লোকটি রাবেয়াকে সামান্য বাঁদীরূপে কঠোর পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করে। রাবেয়ার এই মনিব অতিশয় নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিল। রাবেয়াকে সে এত কঠোর কাজে নিযুক্ত করত যে তিনি তা সম্পূর্ণ করে উঠতে পারতেন না। এ জন্য অনেক সময় তাঁকে ভীষণ প্রহার সহ্য করতে হতো।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন রাবেয়া মনিবের বাড়ি থেকে অন্যত্র পালাতে গিয়ে পথে আছাড় খেয়ে একটি হাত ভেঙে ফেলেন। তখন অন্য উপায় না দেখে তিনি মাটিতে বসে পড়লেন এবং সিজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন_'হে আল্লাহ, আমি এতিম ও নিরাশ্রয় বান্দি। এর ওপর হাতখানাও ভেঙে গেল। এতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি কেবল তোমার সন্তুষ্টি কামনা করি। আমার প্রতি করুণা করো। তোমার অফুরন্ত দান আমার প্রতি বর্ষণ করো। হে আল্লাহ! তুমি এ অধমের ওপর সন্তুষ্ট কি অসন্তুষ্ট জানাবে কি?' তখনই রাবেয়া (রহ.) এই গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেলেন_'রাবেয়া, চিন্তা কোরো না। শিগগিরই কিয়ামতের মাঠে তোমার গৌরব এতদূর বর্ধিত হবে যে ফেরেশতারাও তোমাকে মোবারকবাদ দেবেন।' এই সান্ত্বনার বাণী শুনে রাবেয়া (রহ.) নিজ মনিবের গৃহে ফিরে যান। তখন থেকে সারা দিন মনিবের খেদমতে ও সারা রাত দরূদ পাঠে এবং নামাজে মশগুল থাকেন। হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর ইবাদত বন্দেগি দেখে তাঁর মনিব তাঁকে মুক্ত করে দেন। তারপর তিনি মনিবের অনুমতি নিয়ে ঘর থেকে বের হলেন এবং আল্লাহতায়ালার ইবাদত ও কঠোর সাধনায় মশগুল হলেন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তিনি দিন-রাতের মধ্যে হাজার রাকাত নামাজ আদায় করতেন। তিনি একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করে সেখানে নীরবে দিন-রাত ইবাদতে রত থাকতেন। মক্কা শরিফেই হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর বাকি জীবনের অবসান হয়। খোদাতায়ালার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অসাধারণ। খোদাতায়ালার ভালোবাসা সম্পর্কে কেউ তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি বলতেন, সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত তা থাকবে এবং আঠারো হাজার সৃষ্টির মধ্যে যে কেউ তার এক ফোঁটা পান করেছে, সে-ই আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজেকে হারিয়েছে এবং সে-ই প্রেমাস্পদ হতে সঙ্গে সঙ্গে এই এক আদেশ পেয়েছে_যে আল্লাহতায়ালাকে প্রেম করে, আল্লাহতায়ালাও তাকে প্রেম করেন। আবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো_আচ্ছা, আপনি যাঁর উপাসনা করেন, তাঁকে দেখেন কি? তিনি উত্তরে বললেন, যদি তাঁকে না দেখতাম তবে তাঁর ইবাদত করতাম না।
হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.) সব সময় কাঁদতেন। একবার তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করল, আপনি সব সময় কেন কাঁদতে থাকেন? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহর প্রেম হতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে। কেননা, তাতে আমি অভ্যস্থ হয়ে গেছি। আল্লাহ না করুন, যদি মৃত্যুর সময় সেই প্রেমাস্পদ হতে হুকুম হয় যে তুমি আমার এই দরবারের উপযুক্ত নও, তখন আমি কী করব? এটাই আমার কাঁদার কারণ। আবার তাঁকে জিজ্ঞেস করল, গুনাহগার তওবা করলে আল্লাহ তা কবুল করেন কি না? উত্তরে তিনি বললেন, গুনাহগার তওবা করলে আল্লাহতায়ালা তাকে তওবার তৌফিক (ক্ষমতা) দান করেন, অন্যথায় কিভাবে সে তওবা করবে? তিনি তওবার ক্ষমতা না দিলে কেউ কখনো তওবা করতে সক্ষম হবে না। তিনি এটাও বলতেন, ওহে মানবরা! শুধু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় না। হাত, পা, জিহ্বা এবং কান দিয়েও তা সম্ভবপর নয়। কারণ কান শ্রোতা ও পদদ্বয় চালক মাত্র। কিন্তু তাঁর সম্পর্ক শুধু কলবের সঙ্গে। কলবকে জাগ্রত রাখতে চেষ্টা করো। যার কলব জাগ্রত, তার বন্ধুর প্রয়োজন নেই। যে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর প্রেমে বিলীন) হয়ে গছে, সে-ই জাগ্রত। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেমে ডুবে গেছে তার অন্য বন্ধুর প্রয়োজন কী। একেই প্রভুর সত্তায় নিজকে বিলিয়ে দেওয়া বলে।
সঠিকভাবে তওবা সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, শুধু মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করা মিথ্যাবাদীর কাজ, নিজে নিজেই তওবা করাই যথেষ্ট; অন্যের সাহায্যে তওবার প্রয়োজন নেই। তিনি আরো বলেন, যদি ধৈর্যশীল হতে, তবে দাতা হতে। তিনি বলেন, মারেফতের ফল হলো আল্লাহর দিকে মুখ করা। তিনি প্রকৃত আরেফ (তত্ত্বজ্ঞানী) যিনি মাওলার কাছে অন্তঃকরণ চান এবং যখন তিনি তাকে অন্তঃকরণ প্রদান করেন, তখন তিনি মাওলা পাককে উক্ত অন্তঃকরণ ফিরিয়ে দেন, যেন লোকচক্ষুর আড়ালে তার কাছে তা সুরক্ষিত থাকে।
একদিন একদল আল্লাহর ওলি হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর কাছে উপস্থিত হন। তাঁদের মধ্যে একজনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন_আচ্ছা, আপনি আল্লাহর ইবাদত কেন করেন? তিনি বললেন, দোজখের সপ্ত স্তর বড়ই ভীষণ এবং সবাইকে একদিন তার ওপর দিয়ে গমন করতে হবে। সেই দোজখের শাস্তি ও ভয়েই আমি ইবাদত করি। অপর একজন বললেন, বেহেশতের সৌন্দর্যময় অট্টালিকারাজি এবং নানাবিধ আরামের ও নেয়ামতের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ওয়াদা বিদ্যমান আছে, তার জন্যই আমি এই ইবাদত করছি। এটা শুনে হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.) বললেন, যে ব্যক্তি দোজখের শাস্তির ভয়ে ও বেহেশতের লোভে স্বীয় প্রভুর উপাসনা করে, সে বড়ই হেয় ও হতভাগ্য। তাঁরা বললেন_'আচ্ছা, বলুন তো, কার ইবাদত করছেন? আপনার কি কোনো বাসনা নেই?' তিনি বললেন, 'আমার পক্ষে বেহেশত-দোজখ তো উভয়ই সমান। তিনি ইবাদত করার জন্য আদেশ করেছেন, আমার জন্য কি এটাই যথেষ্ট নয়? বেহশত না থাকলে কি তাঁর উপাসনা করা কর্তব্য হতো না? কোনো শাস্তির ভয় বা লোভনীয় কিছু না থাকলেও তাঁর ইবাদত করা মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য নয় কি?'
হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.) কখনো কারো মুখাপেক্ষী ছিলেন না। সব সময় তিনি খোদার ওপর ভরসা করতেন এবং অন্যদেরও বলতেন, যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার নিন্দা করে, তিনি তারও জীবিকা বন্ধ করেন না। যেদিন থেকে আমি সেই খোদাকে জেনেছি ও চিনেছি, সেদিন থেকে লোকের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে আমি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছি।
হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.) অধিকাংশ সময় মহান খোদাতায়ালার কাছে এ প্রার্থনাই করতেন_'হে খোদা! এই সংসারে আমার কাজ এবং আমার আকাঙ্ক্ষা কেবল তোমাকে মনে করা এবং পরকালে তোমার পবিত্র দর্শন লাভ। একমাত্র তুমি আমার আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য। হে মাওলা! তুমি আমাকে একনিষ্ঠ অন্তঃকরণ দান করেছ এবং আমার অসম্পূর্ণ নামাজ তুমি কবুল করো।'
হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.)-এর যখন জীবন-সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তখন বহু মহৎ ও বুজর্গ ব্যক্তি তাঁর শিয়রে উপবিষ্ট ছিলেন। হজরত রাবেয়া বসরী (রাহ.) সবাইকে বললেন, আপনারা অনুগ্রহ করে উঠে যান এবং মাওলার দূতদের জন্য স্থান খালি করে দিন। সবাই এটা শুনে বাইরে চলে করলেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। অতঃপর সবাই শুনতে পেলেন_হে পবিত্র আত্মা, তোমার প্রভুর দিকে সন্তুষ্টচিত্তে প্রত্যাবর্তন করো। এরপর কতক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো শব্দই শ্রুত হলো না দেখে সকলে আবার ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁরা দেখলেন, হজরত রাবেয়া বসরী (রহ.) ইহধাম ত্যাগ করে গেছেন, ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।