এক
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন জামাল সাহেব। পাশে বসে আছে কয়েকজন নিকটাত্বীয়। আর মাথার কাছে বসে আছে পাঁচ জন বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার। মাত্র কয়েকদিন আগেও যেই জামাল সাহেব পালন করেছেন পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব , কোমরে পিস্তল গুজে দাবরে বেরিয়েছেন পুরো পুলিশ হেড কোয়ার্টার। আর নিজ হাতে হাতে পরিচালনা করেছেন প্রতিটি রিমান্ড সেই জামাল সাহেবই আজ কি না ভয়ঙ্কর হৃদরোগে আক্রান্ত!!! বিস্ময় যেন কাটছে না ডাক্তারদের। খুব দ্রুত ওপেন হার্ট সার্জারি করা প্রয়োজন। কিন্তু তাও সম্ভব হচ্ছে না। কারন রোগী একইসাথে দায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত।
“আচ্ছা ম্যাডাম জনাব জামাল সাহেবের এ রোগ কতদিনের?” নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করলেন এক ডাক্তার।
“রিটায়ারমেন্টের পর থেকে” মিসেস জামালের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
"কিন্তু হার্টের এত জটিল সমস্যা তো এত দ্রুত হতে পারে না। চাকরির শেষ দিনেও তো তিনি ক্রসফায়ারের মত বিরাট দায়িত্ব পালন করলেন????" ডাক্তারের এ প্রশ্নের জবাব কেউ দেয় না।
দুই
বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভুত হচ্ছে জামাল সাহেবের। সেই সাথে হাজারো ভাবনা আর স্মৃতি চারদিক থেকে ঘিরে ধরছে তাকে। মাত্র কয়েকদিন হল প্রশাসনিক বিভাগের সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। তার কর্মদক্ষতায় খুশি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারী দলের প্রতিটি কর্মী পর্যন্ত। বিশেষ করে মৌলবাদী জনগোষ্ঠী দমনে তার কৃতিত্ব ছড়িয়ে পরেছে দেশ ছেড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত। তাইতো এক সময়ের এক অতি সাধারণ জামাল দারোগা থেকে তিনি হয়েছিলেন পুলিশ প্রধান। শুধু কি তাই ? অবসরের সময় তার হাতে উপহার হিসাবে এসেছে কাল চকচকে একটি মার্সিডিস জীপ। দেয়া হয়েছে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একটি বিলাসবহুল ফ্লাট বাসা। কিন্তু কোন উপহারই বেশিদিন ভোগ করা হল না। আজ অসহায়ের মত হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন তিনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে জামাল সাহেবের। বুকের বাম পাশের ব্যাথাটাও বাড়ছে ধীরে ধীরে। চারপাশের সবকিছুই কেমন যেন ভাসা ভাসা মনে হচ্ছে তার কাছে। দূর থেকে একটা হাসির শব্দ ভেসে আসল তার কানে। আরে?? এ তো সেই ছেলেটি অবসরের কয়েকদিন আগে যার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছিলেন জামাল সাহেব। “ বাচাও, বাচাও” শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে ওঠেন জামাল সাহেব। কিন্তু তার মনে হল গলা দিয়ে কোন আওয়াজ হচ্ছে না। আরো জোরে চিৎকার করে উঠলেন জামাল সাহেব। কিন্তু এবার পরিস্থিতি হল আরো ভয়ঙ্কর। তার হনে হতে লাগল কে যেন শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে তার মুখ। তার কানে ভেসে এল একটি অদ্ভুদ শব্দ। কে যেন তেলাওয়াত করে যাচ্ছে। “ হায়! তোমরা যদি জালিমদেরকে সে অবস্থায় দেখতে পেতে যখন তারা মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাতে থাকবে আর ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বাড়িয় বলতে থাকবে নাও, এবার তোমাদের প্রান বের করে দাও।” জামাল সাহেবের এবার মনে পরল। গুলি করার আগ মুহূর্তে এ আয়াতগুলোই পরেছিল ছোট ছোট দারীওয়ালা সেই ছেলেটি। তাহলে তার মৃত্যুও এসে গেছে?? ঘার ফেরানোর চেষ্টা করেন জামাল সাহেব। হ্যা, ঐ তো কেমন যেন একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। গাঢ় কালো ছায়াটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আর ধীরে ধীরে স্পস্ট হচ্ছে ছায়ামুর্তিটি। কাল কুচকুচে লোকটির মাথা যেন আসমান ঠেকা। আর সারা শরীর জুড়ে থাকা বিশাল বিশাল লোমগুলো থেকে আগুন ছিটকে বেরুচ্ছে।
“ভূত ভুত’ চিৎকার করতে চাইলেন জামাল সাহেব। কিন্তু এবারও কে যেন তার মুখ টিপে ধরল।
পাশ থেকে একজন পরে উঠল, “আর মৃত্যু; সে তোমরা যেখানে থাক না কেন তোমাদের নাগাল পাবেই। তোমরা কোন মজবুত প্রাসাদে অবস্থান করলেও।“
বিশালদেহী কাল লোকটার একটি হাত ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল জামাল সাহেবের দিকে।
“পানি দাও পিপাসায় মরে গেলাম” আবার চিৎকার করে উঠল জামাল সাহেব। কিন্তু লাভ হল না। কে যেন তার মুখের উপর ঢেলে দিল উত্তপ্ত তরল। আর বলল, “ পানি চেয় না। বরং তোমার প্রিয় পানীয় সেই রক্ত চাও যা তুমি দুনিয়ায় চুষে খেতে।“
কাল লোকটির একটি হাত এবার স্পর্স করল জামাল সাহেবের বুকের বাম পাশ। সাথে সাথে সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। তার মনে হতে লাগল কেউ যেন তার প্রতিটি পশমের গোড়া দিয়ে মোটা পেরেক ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর পাশ থেকে একজন পাশ থেকে তেলাওয়াত করতে লাগল “যারা মুমিন নারী পুরুষদের উপর জুলুম করে তারপর তওবা করে না তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি”
হঠাৎ তওবার কথা মনে পরে গেল জামাল সাহেবের। আল্লাহর নাম স্মরন করলেন তিনি।
কিন্তু সেই ব্যক্তি এবার তেলাওয়াত করতে লাগল, "তওবা ঐসব লোকের জন্য নয় যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খারাপ কাজ করেই যেতে থাকে। এবং যখন তাদের মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন বলে আমি এখন তওবা করলাম"
"যেদিন তোমার রবের কোন সুস্পষ্ট নিশানি প্রকাশিত হবে সেদিন এমন কোন ব্যক্তির ঈমান কোন কাজে লাগবে না যে আগে ঈমান আনেনি অথবা যে তার ঈমানের সাহায্যে কোন কল্যান অর্জন করতে পারেনি"
এদিকে জামাল সাহেবের যন্ত্রনা বেড়েই চলছে। আর একটির পর একটি আয়াত পরে যাচ্ছে তেলাওয়াতকারী সেই ফেরেশতা।
"তোমরা জাহান্নাম দেখবে। আবার শুনে নাও তোমরা একেবারে স্থির নিশ্চিতভাবেই তা দেখবে"
জামাল সাহেবের মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটি কোষে যেন আলাদাভাবে আঘাত করা হচ্ছে।
তার মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসতে লাগল রক্তের ধারা। কিন্তু সেই তরুনদের মত টগবগ করে ফুটতে থাকা উত্তপ্ত রক্ত নয় বরং বিশ্রী দুর্গন্ধযুক্ত কালো রক্ত।
মালাকুল মউত রুহকে বন্দী করে ফেলল তারপর নিয়ে যেতে লাগল রবের দরবারে। আর সেই তেলাওয়াতকারী ফেরেশতা তেলাওয়াত করতে লাগল, "যারা আল্লাহর আয়াতগুলো মেনে নিতে অস্বীকার করে তাদের উপর আল্লাহ, তার ফেরেশতা এবং সমস্ত মানবজাতির লানত"
এক সময় সে পৌছে গেল মহান রবের দরবারে। আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করা হল জালিমের রুহ। আর আল্লাহ বললেন, "দেখ, এখন তুমি ঠিক তেমনি নিঃসঙ্গ ও একাকী আমার সামনে হাজির হয়ে গেছ যেমনটি প্রথমবার তোমাদের সৃষ্টি করেছিলাম। যা কিছু তোমাদের দুনিয়ায় দিয়েছিলাম তা সব তোমরা পেছনে রেখে এসেছ এবং তোমাদের সাথে তোমাদের ঐসব শরীকদেরও দেখছি না যাদের ব্যপারে তোমরা মনে করতে কার্য সম্পাদনের ব্যপারে তাদেরও কিছুটা অবদান আছে। তোমাদের মধ্যেকার সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমরা যেসব ধারনা করতে তা সবই তোমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে।"
উৎসর্গঃ সেসব পুলিশ অফিসার যারা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্ত প্রবাহিত নরকীয় আনন্দ পায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৪৩