ঝড়ো বাতাসের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে নীরার। মেঘে চারদিক একদম অন্ধকার হয়ে এসেছে। রিমোট চাপতে চাপতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। ঘড়িতে কেবল এগারোটা ,কাজের বুয়াটাও আসেনি আজ । বিছানা ছেড়ে কাপড় আনতে ছাঁদে যায় নীরা। ঈশান কোন থেকে কালো মেঘরাশি একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছে বিশাল আকাশটাকে। বাতাসে নীরার চুল ওড়ে, ওড়ে শাড়ির আঁচল। দুয়েকটা পাখি এলোমেলো বাতাসে দিকভ্রান্ত হয়ে কোথায় উড়ে যাচ্ছে যেন নিজেরাও জানে না। হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় নীরা । মনে হয় সবসময় গন্তব্যে উড়ে গেলে ওরা হয়তো আর পাখি থাকতো না । পাখিদের এলোমেলো ওড়াউড়ি আজ ভালো লাগে নীরার ।
আচ্ছা এসব অদ্ভুত ভাবনা ভাবছে কেন ও-ভাবে নীরা । ও তো কখনো এমন ছিলো না । এমন কতো মেঘলা দিন বৃষ্টির দিন গেছে। তখন হয়তো জোরে রক মিউজিক চালিয়ে দিতো কিংবা বান্ধবীরা মিলে একসাথে গান ধরতো ,কিন্তু এমন উদাসীনতা কখনও ধরতে পারেনি ওকে । বান্ধবীরা যখন চুটিয়ে প্রেম করতো ও তখন এসাইনমেন্ট কিংবা আড্ডায় ব্যস্ত।এইসব চাঁদ ,ফুল,জ্যোৎস্নার আবেগ ঠুনকো ওর । মানুষের জীবনে ক্যারিয়ারটাই সবচেয়ে বড় কথা । সবকিছুর পর স্টাটাস দিয়েই মানুষকে বিচার করা হয়। এমন প্রাকটিক্যাল ভাবনার প্রতিদানও পেয়েছে নীরা।ভালোভাবেই আর্কিটেক্ট পাশ করেছে সে ।বিয়ের পর চাকুরী না করলেও নিজেকে একজন আর্কিটেক্ট ভাবতে ভালোই লাগে তার।
তবু ইদানিং বার বার শূন্যতার অনুরণন হয় নীরার মধ্যে ।গন্তব্যে এসেও কিসের শূন্যতা তা বার বার খোঁজে নীরা।একসময় বৃষ্টি নামে। কাপড়গুলো সিড়ির রেলিং এরেখে বৃষ্টিতে ভিজে নীরা ।সাইনাসের সমস্যা আছে ওর ।বৃষ্টি নামলেই সবসময় দৌড়াদৌড়ি শুরু করতো ও। বৃষ্টিস্নাত নিজেকে নিজের কাছেই অচেনা লাগছে নীরার ।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় ,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।রাশেদের জন্য অপেক্ষা করে নীরা। ইদানিং অফিস থেকে অনেক দেরী করে ফিরে ও। রবীন্দ্রসংগীত শোনে নীরা।আগেও শুনত ,কিন্তু এখন যেন আরও বেশি অনুভব করতে পারে ।নিজেকে নিয়ে ভাবনা কমে না নীরার ।ঢাকায় থাকতে এমন হতো না।রাশেদের পোস্টিং এর পর মফস্বলের একাকিত্বই কী এরজন্য দায়ী ? নিঃসঙ্গতা কী মানুষকে নিজেকে বুঝতে শিখায়?
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ কিছুদিন আগে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার পদে প্রমোশন পেয়েছে ।সাথে সাথে ব্যস্ততাও বেড়েছে,জানে নীরা । তাই এখন আর কোন অভিযোগ করে না।অভিমানগুলো প্রকাশ না করাই ভালো,নয়তো সেগুলো অভিযোগের মতো শোনায় ।তাই কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলে,বরং আগের চেয়ে বেশিই বলে যেন নিজের মনের আকস্মিত অজানা এই পরিবর্তন লুকেয়ে রাখা যায় । তবু রাতের খাবার খেতে বসেই হঠাৎ প্রশ্ন করে রাশেদ,
-‘মন খারাপ কেন ?’
-কই না,কেন?
-মনে হলো
-তোমার সব ধারনা তো সঠিক নাও হতে পারে ।
রাশেদের প্রশ্ন শুনে হঠাৎই মন ভালো হয়ে যায় নীরার ।এজন্যই এই মানুষটাকে ওর এতো ভালো লাগে ।ওদের মধ্যে সম্পর্কটা যেন কেমন ।সমবয়সী বন্ধুক্তের উচ্ছলতা নেই , ‘কেমন আছো?’ এমন অপ্রয়োজনীয় কথা বলার দিন ফুরিয়ে গেছে কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো কখনো বলাও হয় না ভালোবাসি ;তবু রাশেদের এই প্রশান্ত হূদয়ের অটল গাম্ভীর্য ,দৃঢ়তা নীরা উপভোগ করে। যেন একটু অনুযোগে শুধু সান্তনা নয়,ওর সব সমস্যা দূর করে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে ।রাশেদের উপর সব ভার দিয়ে সহজেই নিশ্চিত থাকতে পারে নীরা ।এমন নির্ভরযোগ্য দায়িত্ববান পুরুষই তো চেয়েছিলো সে –যা ওর সমবয়সী ছেলেদের কাছে পায়নি। ওদেরর মধ্যে আবেগ ছিলো কিন্তু পরিপক্কতা ছিলো না ,তাই বয়সের ব্যবধান একটু বেশি হলেও বিয়েতে অমত করেনি নীরা ।
খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় নীরা । চৈত্র শেষের এই হাওয়াটা অসম্ভব ভালো লাগে তার। কোথাও হয়তো ঝড় হচ্ছে নীরা জানে না ।
-‘কি করছো?’ রাশেদকে ডাকে নীরা ।
-‘এইতো, ল্যাপটপটা খুললাম’।
-‘অফিসের কাজ বাসায় আনো কেন ?
-‘এটা অফিসের কাজ নয় ,ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ’।
গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে থাকে নীরা। চৈত্র শেষের ঝড়ের এলোমেলো হাওয়া ভিন্ন দিক থেকে বইতে শুরু করে ।
-“তুমি কেমন যেন রোবটিক হয়ে উঠছো আজকাল ।”
-‘এতকিছু মাথার হার্ডডিস্কে জমা রাখতে গেলে রোবটই হতে হয় ।আর তুমি তো রোবটিক ইঞ্জিনিয়ারকেই বিয়ে করেছো,ভাতে মরা কবিকে তো করো নি ।রোবট না হলে কী তোমায় পেতাম ?” হেসে জবাব দেয় রাশেদ ।
হেসে বললেও রাশেদের এই অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিতে পারে না নীরা ।আবারো ভাবনায় ডুবে যায় নীরা। কলেজে একটা ছেলে প্রায়ই কবিতা লিখতো ওকে নিয়ে –কী যেন নাম ভুলে গেছে । কত ছেলেই না পাগল ছিলো ওর জন্য। কেউ ধৈর্য হারিয়ে হূদয়হীনা বলতো ওকে ।কেউ নিজে নিজে কষ্ট পেলে তাঁর কী করার আছে ?-ভাবতো ও ।যখন ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে সেখানে ভালোবাসা উথলে উঠতো ওর জন্য,ও তখন অবজ্ঞা করে একরকম পৈশাচিক আনন্দ পেতো ।
আজ বার বার ওদের কথা মনে পড়ছে কেন বুঝতে পারে না নিরা । ওদেরতো কোন প্রয়োজন নেই ,সবই আছে ও –যা চেয়েছিলো –কিন্তু এই অসময়ে অপ্রয়োজনেই যেন খুঁজছে ওদের,ওদের সেই চাঁদ হাতে এনে দেয়ার মতো মেকী মন ভোলানো কথাগুলো শুনতে ইচ্ছা করে ওর ।
রাশেদকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল নিরা,
-“আমি মরে গেলে কী করবে তুমি ? পরদিনই একটা বিয়ে করবে না ?”
-“হুম”
_ “মানে ?” হাসি থামিয়ে চমকে উঠেছিল নীরা ।
-“দেখো ,যা সত্যি তাই বললাম। মানুষের জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না নীরা ।আজ আমি মরে গেলে কী করবে নীরা? ক’দিন খুব কষ্ট হবে ।তারপর একসময় অভ্যস্ত হয়ে যাবে ।পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিথ্যে কথা হলো ,তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না ।এসব ছেলেভুলানো কথা আমার ভাল লাগে না ।আমি বাস্তববাদী মানুষ । জীবনে ভালো থাকাটাই সব”।
সত্যিই ভালো থাকাটাই কী সব ?আজ এতদিন পর সন্দেহ জাগে নীরার ।একসময় বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পরে সে। তারপর সকাল হয় ।এভাবে রাতের পর দিন হবার মতোই অত্যন্ত সহজ,স্বাভাবিক আর সঠিকভাবে নীরার দিন কেটে যাচ্ছিলো ।কিন্তু পরদিন বিকেলে নীরার মোবাইলে একটা ফোন আসে ।অপরিচিত নম্বর,অপরিচিত কন্ঠ ।
-“হ্যালো?”
-“হ্যালো, আমি সুপার ক্লিনিক থেকে বলছি, শুভ্র নামের একজন অ্যাকসিডেন্ট করেছেন।সম্ভবত আপনার বন্ধু।
-“শুভ্র? কোন শুভ্র?”
-“কী বলছেন ?চিনতে পারছেন না ? আপনার নাম্বারটি নীরা বুয়েট লিকে সেভ করা । জ্ঞান হারাবার পূর্বে আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলেন ।আপনি কী আসতে পারবেন?”
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে নীরা। তারপর বলে আমি আসছি।
ক্লিনিকে পৌছায় নীরা।শুভ্রকে আইসিইউ থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফিরেছে ওর ।শুভ্রর কাছে এগিয়ে যায় নীরা ।
খুব কাছের কেউ নয়।এক বান্ধবীর ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো, চিনতে পারে নীরা ।বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছিলো ।শুভ্রর সামনে গিয়ে দাড়ায় নীরা।
-“কেমন লাগছে এখন ?”
-“ভালো,তুমি কেমন আছো ?” ক্ষীণস্বরে জবাব দেয় শুভ্র।
-“ভালো”।
-“তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে ।অ্যাকসিডেন্টটা করে মনে হচ্ছিলো মরে যাচ্ছি। তখন একসময় হঠাৎ মনে হলো তোমার সাথে আর দেখা হবে না ।তোমার মুখটাও কেমন ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো, মনে করতে পারছিলাম না ।অনেকদিন দেখা হয়নি তো তোমার সাথে । তোমার সাথে শেষ কবে দেখা হয়েছিলো মনে আছে নীরা ?”
প্রলাপের মতো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলো শুভ্র।শেষ কবে দেখা হয়েছিল মনে করতে পারে না নীরা। শুভ্রকে নিয়ে তেমন কোন স্মৃতিই মনে নেই নীরার ।
-“তমার গায়ে হলুদের দিন ।সবাই এতো করে ধরলো না গিয়ে পারলাম না ।অনেক মজা করেছিলাম সেদিন তাই না ? আজ অপারেশন থিয়েটারে কেমন আধো ঘুম আধো জাগরন অবস্থায় ছিলাম ।তখন অনেককিছু মনে করতে পারছিলাম ।তোমাকে দারুণ লাগছিলো সেদিন ।সুমনের জন্মদিনের কথা মনে আছে তোমার ?”
-“শুভ্র!”ডাকে নীরা।ডাকে সাড়া দেয় না শুভ্র,যেন কিছুই শোনে নি ।অন্যদিকে তাকিয়ে বলে যেতে থাকে যেন বুকের গভীর থেকে ভেসে আসছে সেই স্বর ।
-“ অনুষ্ঠান শেষে একসাথে বাড়ি ফিরেছিলাম আমরা ।তারপর রিকশায় ...অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো সেদিন চাঁদটাকে”।
হঠাৎ নীরার দিকে তাকায় শুভ্র,
-“তোমার হাতটা একটু দেবে ?কখনো ছুঁয়ে দেখা হয়নি তোমাকে”।
শুভ্রকে হাত বাড়িয়ে দেয় নীরা ।
-“ভালবাসতে, বলো নি কেন কোনদিন ?”
-“ভালোবাসি বললেই কি ভালোবাসা হয় ? তবে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম আমি নীরা,কিন্তু তোমাকে স্বপ্ন দেখাবার সাহস ছিলো না আমার নীরা ।ইচ্ছে করলেই স্বপ্ন দেখা যায় নীরা কিন্তু চাইলেই কাউকে স্বপ্ন দেখানো যায় না ।আমি পারিনি নীরা”।
হঠাৎ যেন কেমন করে শুভ্র।ডাক্তার ডাকে নীরা ।
-“আপনি এখনও কথা বলে যাচ্ছেন !জ্বর তো ভীষন বেড়েছে !”
একটা ইঞ্জেকশন দেয় ডাক্তার ।
-“ভাইয়া ঘুমিয়ে পড়েছে ।আপনি এখন বাসায় যেতে পারেন ।আমরা আছি এখানে”।শুভ্রর ছোটবোন ,বুঝতে পারে নীরা।
পরদিন সকালে আবার ক্লিনিকে আসে নীরা ।এসে দেখে ওয়ার্ডে কেউ নেই ।
-“উনারা তো চলে গেছেন ।আপনি নীরা ?আপনাকে এটা দিয়ে গেছেন”।নার্স বলে ।
কাগজের লেখা ক’টি পড়ে নীরা ।
-“সকালে ঘুম ভাঙার পর প্রথমে ভেবেছিলাম আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি ।অনুর কাছে শুনতে মনে পড়লো আপনি সত্যিই এসেছিলেন। কাল জ্বরের ঘোরে কীসব বলেছি নিজেই মনে করতে পারছি না এখন ।আমার একটা ইন্টারভিউ আছে কাল ।তাই এখনই হাসপাতাল থেকে চলে যেতে হচ্ছে ।আপনার সাথে দেখা করে যেতে পারলাম না ।ভালো থাকবেন”।
আস্তে আস্তে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে আসে নীরা। নীরার মনে হয় ওর সবকিছুই ভুল। ওর সংসার,প্রাপ্তি সবকিছুই ভুল ,ভুল গন্তব্যে এসে পৌছিয়েছে সে।শুধু শুভ্র আর শুভ্রর অযৌক্তিক,অবাঞ্চিত প্রেমটাই পৃথিবীর একমাত্র সত্য।অনেককিছুই পেয়েছে সে,শুধু পৃথিবীর বিশুদ্ধতম ভালোবাসা টা পায়নি ।পৃথিবীর বিশুদ্ধতম ভালোবাসাটা বাস্তবতার জালে আটকে যায় ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:২৫