তখন আমরা ভার্সিটিতে পড়ি। আমাদের মধ্যে একজনের বাড়ি ছিল সুনামগঞ্জ। ওর মাধ্যমেই সুমনের সাথে আমাদের পরিচয়। সিলেটে আসলে আমাদের বাসায় উঠতো। খুব হাসি খুশি আর মিশুক ছেলে। দোষের মধ্যে ছিল সারাদিন সিগারেট টানা আর রুপার সাথে ফোনে কথা বলা আর বাদ বাকি সময় আমাদেরকে রুপার গল্প শুনতে বাধ্য করা। নিজেরা সিঙ্গেল হয়ে কাহাতক আর একজনের প্রেমের গল্প শুনা যায়। ও বাসায় এলেই মোটামুটি ভয়ে ভয়ে থাকতাম, আবার সেই একই গল্প গুলি শুনতে হবে। রুপাকে সকালে কেমন সুন্দর লাগে, বিকেলে কেমন, শনিবারে কেমন, রবিবারে কেমন, আবার বাংলা মাসে আর ইংরেজি মাসে নাকি ভিন্ন ভিন্ন রকম সুন্দর লাগে।
সুমন আর রুপার দিন গুলি ভালই কাটছিল। সুমনের বাইকে করে সিলেট-সুনামগঞ্জ হাইওয়ের প্রতিটা গাছই রুপার চেনা হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বোর হয়ে গেলে ওরা সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে পড়তে যেত। সুমন এর মধ্যে আবার কলেজের রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে পড়েছিল। রুপার আবার এসব একেবারেই পছন্দ না। কি দরকার এসব ঝুট ঝামেলার। প্রায়ই ক্যান্টিনে সুমন তর্কাতর্কিতে লেগে যায়, মিছিলে যায়, রুপাকে কলেজ শেষে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আবার কলেজে আসে কি সব মিটিং এর জন্য। রুপার মাঝে মাঝে ভয়ও হয়। কিন্তু যখন কলেজের অনেক ছেলে মেয়ে সুমনকে একটু বস মানে সেই হিসেবে রুপাকেও একটু পাত্তা দেয় তখন আবার নিজেদের কেমন যেন হিরো হিরোইন মনে হয়। একটু ভাল লাগা খেলে যায় মনের মধ্যে।
সেদিন রুপা ক্যান্টিনে ঢুকতেই দেখে সুমন তিন চার জনের সাথে বেশ উত্তেজিত ভাবে কথা বলছিল, হঠাত কি হল, মারামরি শুরু হয়ে গেল, রীতিমত চেয়ার নিয়ে মারামারি। এর মধ্যে সুমনের বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব এগিয়ে এসে মারামারি থামাল। রুপা এসে সুমনকে টেনে নিয়ে গেল বাইরে। সুমন তখনও রাগে কাঁপছে। রুপা এবার সুমনের সাথে চিৎকার শুরু করলো। সুমন রুপাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো। রুপা কিছুই শুনতে রাজি না। তার এক কথা সুমনকে এইসব মাস্তানি, রাজনীতি ছাড়তে হবে। রুপা এও বলল, যে ছেলে গুলির সাথে মারামারি হয়েছে তাদের সাথে যেন মিটমাট করে নেয়, কি দরকার শত্রুতা রাখার। সুমনের এটা বেশ পছন্দ হলো। সেও চায়না কারো সাথে শত্রুতা রাখতে। সুমনের সেই ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে রুপাকে এবারের মত শান্ত করলো আর বাইকে করে দুজনেই কলেজ থেকে বের হয়ে গেল।
মাস খানেক কলেজ বন্ধ ছিল, আজ খুলল। সুমন আর রুপার জন্য খুব খারাপ ছিল বন্ধের সময়টা, ছোট্ট জেলা শহরে আত্নীয় স্বজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা সাক্ষাত করা রীতিমত দুরুহ ব্যাপার। আজ সুমন পড়েছে রুপার প্রিয় সাদা শার্টটা আর রুপা সুমনের প্রিয় নীল জামাটা। সুমন ভাবল সিলেট-সুনামগঞ্জ হাইওয়ে দিয়ে বাইকে করে সোজা সিলেট চলে আসবে, দুপুরে সিলেটের ইস্টিকুটুমে লাঞ্চ করবে, আমাদের সাথে রুপার পরিচয় করিয়ে দিবে আর বিকেলের মধ্যে ফিরে যাবে। রুপা প্রথমে রাজি হচ্ছিলনা, এত দুরের পথ, আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাসায় খবরই আছে। সুমনের চাপাচাপিতে কি আর রাজি না হয়ে উপায় আছে। তাছাড়া রুপারওতো ভালই লাগে সুমনের সাথে বাইকের পেছনে বসতে। নিজেকে কেমন যেন ফড়িং ফড়িং মনে হয়। হাওয়ার মধ্যে উড়ার ফিলিংস। সুমন বাইক বেশ স্পিডে চালায়। রুপা মাঝে মধ্যে কপট রাগ দেখায়। চোখের পলকে ওরা সুনামগঞ্জ শহর ছেড়ে বেরিয়ে হাইওয়েতে উঠে গেল। দুজনেই বেশ খুশির মুডে আছে। সুমন মাঝে মধ্যেই বাইক নিয়ে নানারকম কসরত করছিল। মাঝখানে এক জায়গায় থেমে ছবিও তুললো। আবার চলা শুরু করলো। হঠাত সুমন খেয়াল করলো চার পাঁচটা বাইক তাকে ফলো করছে। তার মধ্যে দু তিনজনকে সে চিনতে পারলো। ওই ছেলে গুলি যাদের সাথে সে কয়েক দিন আগে মারামারি করেছিল ক্যান্টিনে। পেছনের বাইক গুলির দুটি স্পিড বাড়িয়ে তার সামনে চলে গেল, বাকি গুলি ওর পেছনে। মোটামুটি তাকে ঘিরে ফেলার মত। রুপা ভয়ে প্রায় আধ মরার মত হয়ে গেল। সুমন রুপাকে বলল শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে আর দিল বাইকের স্পিড বাড়িয়ে। ফলো করা বাইক গুলিও স্পিড বাড়িয়ে ধাওয়া করতে লাগলো। সুমন মোটামুটি ওদের থেকে বেশ এগিয়ে, সামনে থেকে আসছে বিশাল ট্রাক। সেই ট্রাককে সাইড দিয়ে আর ব্যালান্স রাখতে পারলোনা। সোজা গিয়ে রাস্তার পাশের সেই গাছটার সাথে............. যেই গাছটার নিচে ওরা কত সময় বসে থেকেছে আর ভেবেছে বুড়ো হলে এখানে নাতি নাতনি নিয়ে পিকনিক করবে। বড্ড প্রিয় ছিল গাছটা ওদের দুজনের। সুমনের হ্যালমেট বরাবরের মতই রুপার মাথায়। শুধু মাথাটাই রক্ষা। বাকি শরীর দুমড়ে মুচড়ে যাবার মত হয়ে গেল। রুপা জ্ঞান হারানোর আগে শুধু দেখল সুমনের সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে গেছে। আর কিছু মনে নেই।
তিন দিন পর রুপার জ্ঞান ফিরল। রুপার আমাদের সাথে পরিচিত হতে আসার কথা ছিল, আমরাই গেলাম ওর সাথে পরিচিত হতে আর সুমনের ফ্যামিলির সাথে দেখা করতে। যেই পুকুরের মাছ দিয়ে সুমন কোন এক সময় আমাদের খাওয়াবে বলেছিল সে পুকুরের মাছ দিয়েই সুমনের মা আমাদের ভাত খাওয়ালো কাঁদতে কাঁদতে, শুধু সুমন নেই। সুমনের কলেজের বন্ধুরা সুমন আর রুপার ফ্যামিলির জন্যে এই দুঃসময়ে যা যা করা দরকার সবই করছিল। আমরা যথারীতি সিলেটে ফিরে আসলাম আর আমাদের নিজেদের কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তবে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতাম। প্রায় তিন মাস পরে রুপা সুস্থ্য হয়ে উঠলো। রুপার জ্ঞান ফেরার পরেই সে সুমনের বন্ধুদের থেকে সুমনের রক্তে ভেজা শার্টটা নিয়েছিল। এই তিন মাস সে রাত দিন এই শার্টটা আকঁড়ে ধরে রাখত। রুপার মা প্রথম প্রথম নিয়ে নিতে চাইত। কিন্তু ডাক্তার নিষেধ করল মেন্টালি শকড হতে পারে ভেবে। সুস্থ্য হওয়ার পরেও রুপা এই শার্ট হাত ছাড়া করতে রাজি না। রুপা আস্তে আস্তে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিল। যাকেই দেখে জিজ্ঞেস করে শার্ট টা সাদা ছিল, লাল হলো কেন। রুপার মা চিন্তায় অস্থির। এমনিতে এই ঘটনা পুরা দুনিয়া জানে। তার উপর মেয়ে যদি এমন পাগলামি করে তাহলে কেমনে কি হবে, এই মেয়ের বিয়ে দিবে কেমনে। ডাক্তার, বৈদ্য, সাইক্রিয়াটিস্ট, ওঝা কিছুই বাদ রাখলোনা, কিছুতেই কিছু হয়না। চিন্তায় চিন্তায় রুপার মা ই অসুস্থ্য হওয়ার মত দশা। এর মধ্যে একদিন দুপুরে রুপার মায়ের কাছে এক অদ্ভুত বয়স্ক মহিলা ভিক্ষা চাইতে এলো, পড়নে ময়লা সাদা শাড়ি, মাথা ভর্তি ময়লা, হাত পা অসম্ভব রকমের ময়লা। কিন্তু চোখ দুটো অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বল, মনে হয় ভিতরের সব পড়তে পারে। রুপার মায়ের কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো। ভিক্ষা দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিতে চাইলেন। ভিক্ষা নিয়ে মহিলা বললো কোন উপকার না করেতো ভিক্ষা নেইনা, মহিলা আরো জিজ্ঞেস করলো তোমার মেয়ের কি হয়েছে। রুপার মা পুরাই ভড়কে গেল, রুপা ওর রুমে শুয়ে আছে, এই মহিলা জানলো কিভাবে তার মেয়ে আছে বা সেই মেয়ের সমস্যা আছে। ডুবন্ত মানুষ খড় কুটো আকঁড়ে ধরেও বাঁচতে চায়, রুপার মা এই মহিলার মধ্যে সব সমস্যার সমাধান দেখতে পেল। সব কিছুই খুলে বলল। মহিলা বললো, ওহ এই তাহলে সমস্যা, আজ রাতে রুপা যখন ঘুমাবে ঠিক ভোর হওয়ার আগে আগে রুপাকে ঘুম থেকে তুলে এক গ্লাস দুধ খাওয়াতে হবে। আবার ঘুমিয়ে পড়ার আধ ঘন্টা পরে রুপার থেকে ওই শার্টটা নিয়ে একটা ভাল সাদা শার্ট দিতে হবে। এই বলে মহিলা চলে গেল। রুপার মায়ের বুকের উপর থেকে পাথর নামল মনে হয়। রাতের জন্যে আর তর সইছিলনা। যাই হোক রুপার আম্মা ওই মহিলা যা যা বলেছিল সবই করল। সকালে ঘুম থেকে উঠে রুপা মোটামুটি পুরা বাড়ি মাথায় তুলল, তার ওই পুরনো শার্ট চাই। রুপার মা চোখ মুছতে মুছতে আবার শার্ট টা দিয়ে দিল আর মনে মনে বুড়ির চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছিল। দুপুরে আবার সেই মহিলা আসলো। রুপার মা কিছু বলার আগেই বলল কাজ হয়নি বলেইতো আবার আসলাম। উপকার না করেতো ভিক্ষা নেইনা। মহিলা এবার রুপার মা কে বলল ওকে অন্য শার্ট দিলে হবেনা, এটাই দিতে হবে। তবে আজ রাতে ও যখন ঘুমাবে তখন শার্ট টা ধুয়ে দিতে হবে যেন রক্তের দাগ না থাকে। খুব ভালো ভাবে ধুতে হবে যেন দাগ না থাকে। ও ঘুম থেকে উঠার আগেই শুকিয়ে ওর কাছে ফেরত দিতে হবে। দরকার হলে পর পর তিন রাত ধুতে হবে। মহিলা চলে গেল। এবার শুরু হল রাত্রে রুপার মায়ের যুদ্ধ। রুপার মা যতই ধোয় রক্তের দাগ আর যায়না। প্রথম রাতে না পেরে সেটা চুলার উপর ধরে শুকিয়ে রেখে দিলেন। পরের রাতে হুইল সাবান দিয়ে ট্রাই করলেন। এবারও হলনা। তৃতীয় রাতে হুইল পাউডার দিয়ে অনেক চেষ্টা করলেন। তারপরও দাগ যায়না। রুপার মা ভাবলেন রুপাকে মনে হয় আর ভালো করতেই পারলেননা। ঠিক তিন দিন পরে আবার বুড়ি আসলো। রুপার মা কাঁদতে কাঁদতে বলল রক্তের দাগ তো যায়না। সাধারণ সাবান দিয়ে ট্রাই করলাম, হুইল সাবান, হুইল পাউডার দিয়েও ট্রাই করলাম। কিভাবে যে এই রক্তের দাগ যাবে। বুড়ি তখন পান চিবাতে চিবাতে বলল কেন সার্ফ এক্সেল অছেনা?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:০৫