আমাদের দোস্ত মাঞ্জা। মাঞ্জা মানে স্টাইল, স্টাইলটাকে সে এমন শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তাকে আমরা মাঞ্জা নামেই ডাকতাম। ওর একটা ভাল নামও আছে, যেটা আমরা প্রায়ই ভুলতে বসেছিলাম। অনিন্দ্য রায় চৌধুরি। চৌধুরি সাহেব টি শার্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি ধুয়ে বালিশের তলায় ভাঁজ করে রাখতো পরের দিন ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। দিগন্ত ৯/৫, সিলেট শহর, এই ঠিকানায় আমরা যে পাঁচ চিড়িয়া থাকতাম মাঞ্জা তাদের মধ্যে অন্যতম।
আমাদের পাশের ফ্লাটে ছোট্ট একটা ফ্যামিলি থাকত। হাজবেন্ড,ওয়াইফ আর ছোট একটা ৩-৪ বছরের বাচ্চা। মহিলা দেখতে মোটামুটি সুন্দর বলা চলে আর আমাদের তখন যে বয়স দেখতে সবই সুন্দর লাগে। স্বাভাবিক ভাবে আমরা উনাকে ভাবি ডাকতাম। পাশের বাসার এক বাচ্চার মাকে ভাবি ছাড়া অন্য কিছু ডাকার কথা মাথাই আসেনি। সিজার আপু আপু করত সারাদিন আর বিকেলে ওই পিচ্চি বাচ্চার সাথে বাসার সামনে খেলা ধুলা করত। মনে হয় নাইয়ারের ভয়ে। অনিন্দ্য আবার এক কাঠি সরেস, আন্টি ডাকে। কার ভয়ে সেটা অবশ্য আমাদের জানা হয়নি। ওই ভাবি, আপু বা আন্টির কাছে আমাদের সবার গুড বয় ইমেজ। সিজার পিচ্চির সাথে খেলে আর ভাবির সাথে ম্যাগি নুডলস রাঁধে, শেহাব ভাবির সাথে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বা বাচ্চার ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ করে আর আইপির মারুফ দূর থেকে লাজুক হেসে সালাম দেয়। আমিতো ভাবির সাথে দুনিয়ার সব বিষয়ে গল্প করি, ভাবির ছোট বোনকে কোন জেলায় বিয়ে দিলে ভাল হবে এই ধরণের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত দেই। অনিন্দ্য বেচারা আমাদের জন্য ফ্লোরই পায়না, তাই সে আদর্শ ভাতিজা হয়েই রইল। এভাবে গুড বয় ইমেজ নিয়ে আমাদের দিনকাল কাটছিলো। কাহিনী ঘটলো একদিন, রাত ১০ টা হবে মনে হয়। ভাবী দরজা নক করছেন। সবাই হাজির কে কার আগে দরজা খুলবে। দরজা খুলতেই ভাবি বললেন রাস্তার মাথার ভিডিও দোকানের ছেলেটা ভুল করে উনার বাসায় নক করেছে। আমরা দেখলাম পাশেই ছেলেটা দাড়িয়ে আছে। ছেলেটা বললো আমাদের বাসায় নাকি তার দোকান থেকে একটা সিডি আনা হয়েছে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল, ফেরত দেয়া হয়নি, কাস্টমার দাড়িয়ে আছে তাই নিতে এসেছে। আমি ভাবির সামনে বেশ ভাব নিয়ে বললাম সামান্য সিডির জন্য এতো রাতে ডিস্টার্ব করতে হবে। আমরাতো রেগুলার কত সিডি আনি, এখনো বেশ কয়েকটা আছে। দুমদাম এয়ার ফোর্স ওয়ান, ওয়াক ইন দ্যা ক্লাউড, ব্রেভ হার্ট এরকম দু চারটা ইংরেজি সিনেমার নাম ও ঝেড়ে দিলাম। ছেলেটা কিছুটা চিল্লাপাল্লা করে কাতর স্বরে বলল, ভাই ওগুলা রাখেন আরো কয়দিন কিন্তু বস্তির রাণী সুরাইয়া দিয়া দেন, কাস্টমার দাড়ায় আছে । আমিতো তখন অপেক্ষায় আছি কখন ফ্লোর দুই ভাগ হবে আমি ঢুকে যাব কিংবা উপর থেকে কেউ দড়ি ফেলবে আর আমি দড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাব। কিন্তু সেসব কিছুই হলনা। শেহাব আর মারুফ কখন যেন বই নিয়ে পড়তে বসে গেল, অনিন্দ্য তখন টিউশনিতে। আমি আর সিজার চোখা চোখি করে সব দোষ অনিন্দ্যের ঘাড়ে দিয়ে দিলাম। আর ভাবি দেখি কপট রাগ করে মুচকি মুচকি হাসেন। এরপর থেকে দেখি সিজারের সাথে ভাবির সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। ভাবিকে ফোন করে কোন ছেলে কি ডিস্টার্ব করে সেসব বিষয়ে সিজারের সাথে বুদ্ধি পরামর্শ করে।
বস্তির রাণী সুরাইয়া কিন্তু আসলে আমাদের পাঁচ জনেরই চয়েস ছিল। আমাদের মুভি চয়েস সাধারণত অনিন্দ্য করত। পোষাক আশাক, খাওয়া দাওয়ার মত এখানেও তার রুচি ভাল ছিল। ওর বদৌলতে আমাদের সেইরকম সব মুভি দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেই সাদা কালো সময়ের বাংলা ইংরেজি থেকে শুরু করে রিসেন্ট বের হওয়া গুলি পর্যন্ত। উচ্চ মার্গীয় সিনেমা দেখতে দেখতে সবাই ভাবলাম রুচি পরিবর্তন করি। সবাই মিলে গেলাম সিডি নিতে, পরিচিত মামারে (ভিডিও দোকানের মালিক) আমাদের খায়েসের কথা বললাম। মামা আমাদের রিকমেন্ড করল বস্তির রাণী সুরাইয়া। সিডির কভার উল্টে পাল্টে দেখে পাঁচজনেই পছন্দ করলাম। সিজার নরম মনের ছেলে, স্বল্প বসনা নায়িকা দেখে ওর মন কেঁদে উঠলো। মারুফের তখন যে কাউকেই ভাল লাগে অবস্থা। শেহাব বস্তির রাণী সুরাইয়ার মধ্যে শ্রেনী বৈষম্য, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন আর নারীর প্রতি যুগ যুগ ধরে চলা অত্যাচার নিপীড়নের প্রতিবাদি চরিত্র খুঁজে পেল। অনিন্দ্য বস্তির রাণী সুরাইয়া আর নায়কের ড্রেসের কালার কম্বিনেশনের সমস্যা গুলি নিয়ে গাই গুই করছিল। নায়িকার স্বাস্থ্য খানিকটা ভাল এটাও অনিন্দ্য মেনে নিতে পারছিলনা। অনিন্দ্যের গাই গুই পাত্তা না দিয়ে আমিও বস্তির রাণী সুরাইয়ার পক্ষেই ভোট দিলাম।
আমাদের ক্যাম্পাসে আমাদের সময়ে মাঞ্জাই ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বেশি স্টাইলিশ (ছেলে ও মেয়ে সব মিলিয়ে)। এক এক দিন চুলের এক এক স্টাইল, দামি ও ভাল ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু, বডি স্প্রে আর আফটার শেভ। জামা কাপড়ের ব্যাপারে ও ছিল খুব চুজি। জিন্স ছাড়া ওর চলবেনা, টি শার্ট কালেকশনও সেই রকম। এমনকি বাসার ভিতরেও সে ড্রেসের ব্যাপারে আপোষহীন। মাঞ্জার এই ফ্যাশন সচেতনতা শুধু যে জামা কাপড় আর সাবান শ্যাম্পুতে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও তার চয়েস সেই রকম। আমরা যেইটা গো গ্রাসে গিলতাম মাঞ্জা প্রায়ই সেটা না খেয়ে উঠে যেত। খাওয়ার অপচয় যেহেতু গুনাহের কাজ আমি সেটা খেয়ে ফেলতাম। তাই মাঞ্জা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিল আর আমি মোটা হয়ে যাচ্ছিলাম, যেটা এখনো থামছেনা।
আমরা যে সময়ে মানিব্যাগে টাকা রাখতাম চৌধুরি সাহেব সে সময় স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাঙ্কের কার্ড রাখত। স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাঙ্কের সামনে দিয়ে গেলে পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ শক্ত করে ধরে রাখতাম যদি অটোমেটিক টাকা কেটে রাখে এই ভয়ে। আর সেই ব্যাঙ্কের সামনের এটিএম বুথ থেকে কড়কড়ে নতুন পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে বের হত মাঞ্জা প্রতি মাসে কয়েক বার। তবে মজার বিষয় ছিল মাঞ্জা টাকা আনতে কখনো একা যেতনা, সাথে নিয়ে যেত আমাদের। আর রাস্তার উল্টা দিকে ছিল বনফুল যেখানে সেই সময় সিলেটের সবচেয়ে হাই ফাই বার্গার, স্যান্ডউইচ আর হটডগ পাওয়া যেত। আর ছিল দীর্ঘশ্বাস ফেলার মত অনেক কিছু। থাক সেসব কথা, আমরা সবাই বিয়ে শাদি করে ফেলেছি।
ক্যাম্পাস লাইফে বেচারা মাঞ্জার প্রেম ট্রেম করা হয়নি। হবে কি করে, ক্যাম্পাসে ওর পছন্দ হবে সেরকম কেউ থাকতে হবেতো। বেচারার মন পড়ে ছিল মনিকা বেলুচ্চির দিকে, কেট উইন্সলেটের দিকে। জয়া আহসান বা রিচি সোলায়মানের কম কারো কথা সে ভাবতেই পারতোনা। শারাপোভার মুখের দুএকটা দাগের কথা মনে করিয়ে দিলে ক্ষেপে উঠতো। মুটিয়ে যাওয়ায় সানিয়া মির্জার উপর ও খুব বিরক্ত ছিল। এহেন পোলা কি আর যার তার সাথে প্রেম করিতে পারে।
আমাদের পাঁচ জনের কেউ ধর্ম কর্মের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিল সেটা মনে পড়ছেনা পরীক্ষার আগের রাতে নামাজ পড়া ছাড়া। তবে রমযান মাসে কিছুটা সিরিয়াস হতাম, রোজা রাখতাম। মাঞ্জাও প্রায়ই না খেয়ে থাকত স্বভাব সুলভ ভাবেই। ইফতারির সময় দেখা যাচ্ছে ওই সবচেয়ে সিরিয়াস, ইফতারি কেনাকাটা থেকে শুরু করে সাজানো পর্যন্ত ওর সেইরকম উত্সাহ। আসলে পোলাটা ভাল ছিল। আমরাও এমন ফাউল বন্ধু কোন দিন ধন্যবাদ দেইনি ওরে। চৌধুরী সাহেব নিয়মিত মন্দিরে না গেলেও পুজার সময় খুব সিরিয়াস ভাব নিয়ে আমাদের সাথে নিয়ে মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে বেড়াত। দুষ্টু লোকেরা বলত পুজা নয় পুজারিনি দেখাই উদ্দেশ্য। হয়ত একই কারণে মাঞ্জা ও আমাদের কাছে মসজিদ মন্দিরে যাওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপুর্ণ ছিল পুজা ও ঈদের শপিংএ যাওয়া ।
মাঞ্জার মন ছিল সেই রকম বড় সড়। সেদিন ওর বার্থডে ছিল। আমরা বাকিরা প্ল্যান করছি কিভাবে মাঞ্জা থেকে খসানো যায়। ব্যাটা আবার সহজে ধরা দিতে চায়না, খালি মাগুর মাছের মত পিছলায়। আমরা ওরে অনেক পাম্প পট্টি দিয়ে খাওয়াইতে রাজি করালাম। আমাদের এক্সপেক্টেশন ছিল সর্বোচ্চ হালিম পরোটা। ওমা চৌধুরী সাহেব আমাদের নিয়ে গেল সেই বনফুলে। খাওয়ালো বার্গার, মিষ্টি আর কোল্ড ড্রিঙ্কস। আমরা মনে মনে হাসি আর খাই। বনফুল থেকে বের হয়ে ওরে জানালাম আমাদের এক্সপেক্টেশন কি ছিল। তখন ব্যাটা শুরু করল গজ গজ আর শপথ করল আমাদের মত বন্ধু বেইমানদের আর কোনদিন খাওয়াবেনা। যদিও তাকে এরকম আরো অনেকবার খাওয়াতে হয়েছে। বার্থডের ট্রিট নিলেও সেদিন ওকে সেভাবে ফর্মালি উইশ করা হয়নি, আজও করলামনা। গত কাল মাঞ্জার আরো একটা বার্থডে ছিল। মাঞ্জা তার শারাপোভাকে নিয়ে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভালো থাকিস দোস্ত, আমাদের যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করিস আমরা তোকে ভুলতে দিবনা শয়তান। দেখা হলেই বলব সানিয়া মির্জা মোটা হয়ে যাচ্ছে কিংবা শারাপোভার মুখে দাগ বেড়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ২:১২