বৃহস্পতিবার দুপুর গড়াতে না গড়াতেই গুলিস্তান থেকে শাওন, শামসুদ্দিন, কায়সার ও আমি যাত্রা করলাম ঐতিহাসিক লালবাগ কেল্লা দর্শনের উদ্দেশ্যে। লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে বইপত্রে পড়েছি, টিভিতে দেখেছি কিন্তু সুযোগ পেয়ে চোখে দেখবনা তা কি করে হয়!
লালবাগ কেল্লা ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত মুঘল আমলের একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি পুরনো ঢাকার লালবাগে অবস্থিত বলে নাম লালবাগ কেল্লা। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ ২০১২ সাল থেকে এটিকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
লালবাগ কেল্লার ইতিহাস: মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর তৃতীয় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ সালে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে কেল্লাটির নকশা ও নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তখন এর নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। এক বছর পর নির্মাণ কাজ বন্ধ করেই আজম শাহ পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে মারাঠাদের বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে দিল্লি চলে যান। ১৬৮০ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁ পুনরায় এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির মৃত্যু হলে তাকে দরবার হল ও মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। পরী বিবির সাথে আজম শাহের শাদী মোবারক এর কথা চলছিল। পরী বিবির মৃত্যু হলে সকলেই কেল্লাটিকে অপয়া ভাবতে থাকে। ফলে ১৬৮৪ সালে পুনরায় এর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ কেল্লাটি উত্তরাধিকারীদের দান করে আগ্রা চলে যান। ১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামক একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান কেল্লার উন্নয়ন কাজ শুরু করেন। তখন থেকে এটি লালবাগ কেল্লা নামে পরিচিত হতে থাকে।
সংক্ষিপ্ত বিবরণ: কেল্লার চত্বরে একই সারিতে তিনটি স্থাপনা রয়েছে। সেগুলো হল:
১. কেন্দ্রস্থলের দরবার হল ও হাম্মাম খানা
২. পরী বিবির সমাধি
৩. উত্তর পশ্চিমাংশে শাহী মসজিদ।
কেল্লার তিনটি দরজার মধ্যে মাঝের দরজাটি জনসাধারণের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত। প্রবেশের সময় বরাবর সামনে যে ভবনটি চোখে পড়বে সেটি হল পরী বিবির সমাধি। সাইনবোর্ডে লেখা তথ্য থেকে যা জানা যায় তা হুবহু তুলে ধরা হচ্ছে: এই অনন্য ইমারতটি মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্য বিবি পরীর সমাধি সৌধ হিসেবে সুপরিচিত। বাংলাদেশে এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে আভ্যন্তরীন নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষ গুলির ছাদও করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরের তৈরি। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্ভুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতি এই সমাধি সৌধটি ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে নির্মিত হয়।
পরী বিবির সমাধির সাইনবোর্ডটি পড়ার সময় হাতের বা’দিকে তাকালে যে ইমারতটি চোখে পড়বে সেটিই হচ্ছে দরবার হল ও হাম্মাম খানা। লালবাগ কেল্লার স্থাপত্য নিদর্শনের পাশাপাশি মুঘল আমলের জীবনধারা সম্মন্ধে আরও কিছু আলোকপাত করার অভিপ্রায়ে সে আমলের কিছু প্রতিনিধিত্ব মূলক নিদর্শনাদি দিয়ে দরবার হলটিকে বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে মুঘল আমলের তৈরি তীর, ধনুক, বর্শা, বল্লম, হাত কুঠার, ছোরা, তরবারী, ঢাল, পারকাশন লক বন্দুক ও রাইফেল, ফ্লিন্টলক পিস্তল, লোহার জালের জামা, হাতে লেখা পারসী ও আরবী কোরআন শরীফ, রাজকীয় ফরমান, চিনামাটির পাত্র, বক্ষ বর্ম, পরী বিবির মাজারে প্রাপ্ত কালো পাথরের উৎকীর্ণ লিপি, মুঘল চিত্রকলা ইত্যাদি। দরবার হলটি দ্বিতল হলেও উপর তলাটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখন বন্ধ রয়েছে।
কেল্লার সর্ব উত্তর-পশ্চিম অংশে রয়েছে তিন গম্ভুজ বিশিষ্ট শাহী মসজিদ। আজম শাহ এটি নির্মাণ করে দিল্লি চলে যান। মসজিদটিতে জামায়াতে নামাজ হয়।
লালবাগ কেল্লায় বেশ কয়েকটি পানির ফোয়ারা, একটি শুকনো পুকুর, গোপন পথের মুখ বা সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। দক্ষিণ দেয়ালের ছাদের উপর ছিল বাগান। কেল্লা এলাকার মনোরম সৌন্দর্য দেখতে ছাদে উঠতে হয়।
যেভাবে যাওয়া যায়: লালবাগ কেল্লার কিছু ইতিহাস ঐতিহ্য তো জানা হল। ঐতিহাসিক এই স্থানটিতে পা রাখতে হলে আজিমপুর বাসস্টান্ড, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, গুলিস্তান, শাহবাগ বা কার্জন হলের সামনে থেকে রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশাযোগে যাওয়া যায়।
সময়সূচী: কেল্লাটি গ্রীষ্মকালে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত থাকে খোলা থাকে। রবিবার পূর্ণদিবস সরকারি ছুটি এবং সোমরার অর্ধদিবস ছুটি থাকে। তাই সোমবার দুপুর ২ টা থেকে খোলা থাকবে। মাঝখানে বেলা ১ টা থেকে ত্রিশ মিনিটের বিরতি থাকে। শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২ টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বিরতি থাকে।
টিকেট মূল্য ও প্রাপ্তিস্থান: কেল্লার দরজার ডান ও বাম পাশে টিকেট কাউন্টার রয়েছে। দেশী পর্যটকদের জন্য ২০ টাকা, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ টাকা, বিদেশীদের জন্য ২০০ টাকায় টিকেট ক্রয় করতে হবে। তবে সার্কভূক্ত বিদেশী পর্যটকদের জন্য টিকেট মূল্য ১০০ টাকা।
কর্মব্যস্ত সময়ের ভীড়ে কিংবা ছুটির দিনে মন ও শরীরের ক্লান্তি দূর করতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন লালবাগ কেল্লা থেকে। তাছাড়া বাড়তি চমক হিসেবে অদূরেই দেখতে যেতে পারবেন ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির! তাহলে আর দেরী কেন?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:০৫