নয় বোন তারা, শিল্পকলা আর ছন্দের দেবী। গানের ছন্দ, কবিতার ছন্দ,নাচের ছন্দ, ধরণীর সব ছন্দকলায় তাদের অসামান্য বিচরণ। তাদেরই একজন কিন্নরকণ্ঠী ক্যালিওপি ছিলেন মহাকাব্যের দেবী। আলোর দেবতা; সৌন্দর্য, শিল্প ও সঙ্গীতের দেবতা অ্যাপোলোর ঔরসে এই ক্যালিওপির কোল আলোকিত করে জন্ম হয় অর্ফিউসের।
অর্ফিউস বেড়ে ওঠে অলিম্পাসের পাদদেশে পিমপ্লাইয়া শহরে। কৈশোরে সে মায়ের কাছে গানের শিক্ষা পায়। বাবা সূর্যদেব তাকে দিলেন নিজের সাধের বীণা। পাহাড়ে-পর্বতে-বনে-জঙ্গলে অর্ফিউস যখন বীণার ঝংকার ওঠায়, সমস্ত পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়। তার বীণার সুরে আকাশ ভরে ওঠে, সুরের আনন্দে গাছে গাছে ফুল ফোটে। সমুদ্রের কোলাহল, প্রবাহমান নদীর স্রোত থেমে যায়। বনের পশুরা হিংস্রতা ভুলে অর্ফিউসের পাশে এসে দাঁড়ায়। পাখিরা চুপ করে শোনে তার গান।
তারুন্যে অর্ফিউস স্বর্ণমেষের চামড়া আনার অভিযানে সঙ্গী হয় গ্রীক বীর জেসন, হারকিউলিস আর অন্যান্য আর্গোনটদের। তাদের নিয়ে জাহাজ 'আর্গো' পাড়ি দেবে সাইরেনাম দ্বীপ। সেখানে বাস সাইরেনদের। যাদের গানের সুরের ঐন্দ্রজালিক মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে জাহাজ সাইরেনামের পাথুরে উপকূলে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
অর্ফিউসদের নিয়ে জাহাজটি ভেসে চলেছে সাইরেনামের পাশ দিয়ে। কানে এলো সাইরেনদের সুরেলা গান। সেই গানের চেয়েও শ্রুতিমধুর বীণা বাজাল অর্ফিউস। আসন্ন ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল জাহাজ।
অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর একদিন এক বনপথে বনপরী ইউরিদাইসকে দেখে হৃদয় হারাল অর্ফিউস। ইউরিদাইসও ভালোবেসে ফেললো এই আশ্চর্য শিল্পীকে। কিছুদিনের মধ্যেই ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় দুজনের। বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের দেবতা হাইমেন স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হায়! সেখানেই দেখা গেল এক চরম দুর্লক্ষণ। হাইমেনের হাতের মশালটিতে আগুনের পরিবর্তে ক্রমাগত অশ্রুবর্ষণ হল। মশাল কোনভাবেই জ্বালানো গেল না। সবাই বুঝে নিল এই বিয়ের পরিনাম শুভ হবে না।
যে যাই বলুক, অর্ফিউস আর ইউরিদাইস একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে ভীষণ সুখী হল। তারা মনের আনন্দে বনে অরন্যে ছুটে বেড়ায়। অর্ফিউসের আনন্দ বীণার ঝংকারে পৃথিবী হাসে।
কিন্তু এত সুখ কি ধরণীতে সয়?
সুন্দরী ইউরিদাইসকে একদিন বনের পথে একাকি দেখে মুগ্ধ হল মৌমাছির দেবতা অ্যারিষ্টিউস। কামতারিত হয়ে তার পিছু নিল। সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য ছুটল ইউরিদাইস। ঘাসের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা একটি সাপ দংশন করলো তাকে। মরনঘুমে লুটিয়ে পরল ইউরিদাইস।
অর্ফিউস প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে শোকে পাগল হয়ে গেল। তার বীণার তারে হাহকাকার করে উঠল করুন সুর। সেই সুরে কাতর হয়ে কেঁদে উঠল দেবদেবীদের মন। দেবরাজ জিউস বললেন-
"যাও তবে পাতালপুরীতে যমরাজ হেডিসের কাছে। তোমার প্রেয়সীর প্রান ভিক্ষা করে নিয়ে আসো। কিন্তু জেনো, এ বড় দুঃসাধ্য কাজ। প্রানের মায়া যদি থাকে তবে এমন কাজে যাবার আগে দুবার চিন্তা করে দেখো।"
অর্ফিউস নির্ভয়ে বীণা বাজিয়ে চলল পাতালের দিকে।
জীবিত কেউ যাতে পাতালে প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে পাতালের প্রবেশদ্বার পাহারা দেয় হেডিসের তিন মাথা বিশিষ্ট কুকুর। অর্ফিউসকে দেখে সে কুকুরের ছয় চোখ জ্বলে উঠল, নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এলো আগুন। কিন্তু অর্ফিউসের বীণার সুর তার কানে আসতেই সে শান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো।অর্ফিউস অবাধে পাতালে প্রবেশ করল।
পাতালের দেয়াল কাপিয়ে বীণার ঝংকার বেজে উঠল। সেই শব্দে যমদূতের হুঙ্কার আর পাপীদের চিতকার মুহূর্তে থেমে গেল। জলে আকণ্ঠ ডুবে থাকা অত্যাচারী ট্যান্টেলাস, পিপাসায় পাগল অথচ পান করতে গেলে জল সরে যায়; বীণার সুরে সেও পিপাসা ভুলে গেল। মহাপাপী ইক্সিওন, নরকের ঘুরন্ত চক্রে ঘুরতে ঘুরতে এতদিন পর বিশ্রাম পেল; ঘুরন্ত চক্র স্তব্ধ হয়ে গেল। নিষ্ঠুর সিস্ফাস, চিরকাল ধরে পাহাড়ের ওপর পাথর গড়িয়ে তুলছে, যতবার তোলে ততবার পাথর পড়ে যায়- সেও দারুন শ্রমের কষ্ট ভুলে গেল।
অর্ফিউস হেডিসের সিংহাসনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যমরাজ হেডিস আর তার রানী পার্সিফোন গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। তাদের পায়ের কাছে নিয়তিরা তিন বোন জীবনের সুতা নিয়ে খেলা করে। তাদের সামনে বীণার সুরে ঝংকার তুলল অর্ফিউস।
তার অনিন্দ্য সঙ্গীত প্রার্থনায় হেডিস ও পার্সিফোন মুগ্ধ হলেন, নিয়তিরা প্রসন্ন হল। আদেশ হল- "ইউরিদাইসকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। সে পৃথিবীতে ফিরে যাক।" কিন্তু একটা শর্ত দিলেন পাতালরানী পার্সিফোন- "পাতালপুরীর সীমানা পার হবার আগে ইউরিদাইসের দিকে ফিরে তাকানো যাবে না।"
তাইই সই।
অর্ফিউস মনের আনন্দে বীণা বাজিয়ে চলল। তার পেছনে চলল ইউরিদাইস। পাতালপুরীর সীমানায় এসে অর্ফিউস নিষেধের কথা ভুলে ফিরে তাকাল। অমনি তার চোখের সামনেই ইউরিদাইসের অপূর্ব সুন্দর মূর্তি বিদায়ের ম্লান হাসি হেসে শুন্যে মিলিয়ে গেল।
অর্ফিউস তার ভুল বুঝতে পারল। কোনো রকমে মর্ত্যভূমিতে ফিরে এসে নীরব নিস্পন্দ অবস্থায় পাগলের মতো পড়ে রইল। তারপর বনে জঙ্গলে পাহাড়ে পাগলের মত খুজতে লাগল ইউরিদাইসকে। মনে হল গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের নিশ্বাস বলছে ইউরিদাইস, ইউরিদাইস।
এমনই অস্থির মনে যখন সে ঘুরছে, তখন একদিন মদের দেবতার উপাসনাকারী একদল বনবিহারিনী মাতাল হয়ে ঘিরে ধরল অরফিউসকে। তাকে বলল আনন্দের বাজনা বাজতে, তাদের যে উৎসব! কিন্তু আরফিউস যে সুখের সুর ভুলে গেছে। তার দুখের সুর শুনে মাতাল নারীরা মেরে ফেললো তাকে। টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল জলে। সে দেহ ইউরিদাইসের নাম উচ্চারন করতে করতে ভেসে চলল।
তারপর।
শুন্যে ভেসে আসলো আনন্দধ্বনি। অর্ফিউস যে ফিরে পেয়েছে তার ইউরিদাইসকে। জলে, স্থলে, নদীর স্রোতে, ঝরনার ঝর ঝর শব্দে আনন্দ কোলাহল বেজে উঠল আবার।
-----------------------
উৎসঃ
গ্রীক মিথ।
সুকুমার রায়ের লেখা "অর্ফিউস" এর উপর ভিত্তি করে লেখা।
অন্যান্য তথ্যসুত্রঃ
প্রাচীন গ্রিসের গানের মানুষ অর্ফিউস- ইমন জুবায়ের
অর্ফিউসকে নিয়ে ইন্টারনেটে প্রকাশিত অন্যান্য লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১১ ভোর ৪:০২