ভাই, গতকালও মোবাইল ফোনের সংক্ষিপ্ত বার্তায় (এসএমএস) সুন্দরবনকে ভোট করেছি। অনেককে ভোট দিতে উৎসাহ দিয়েছি। কিন্তু এখন শুনতেছি ওই ভোটাভুটি নাকি ভুয়া। নির্বাচক-প্রতিষ্ঠান এভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশপ্রেমকে পুঁজি করে এভাবে ব্যবসা! চিন্তা করা যায়? এখন নিজেকে ভীষণ প্রতারিত মনে হচ্ছে।' কথাগুলো বলছিলেন উত্তর ধানমন্ডির এক বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ'র শিক্ষার্থী মাহফুজুল হক জনি।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই কারওয়ান বাজারের এক রিকশাচালক আবদুল আওয়াল জানালেন, 'আমিও ভাই কয়েকটা ভুট দিছি। এই ভুটাভুটি কি শ্যাষ অইব না? আবার হুনতাছি এইডা নাহি ভুয়া।' শুধু ওই শিক্ষার্থী ও রিকশাচালক আওয়ালই নন, দেশের অসংখ্য মানুষ এখন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য বা সপ্তমাশ্চর্য নির্বাচনের দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়াটি নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়েছেন। বিশেষ করে ওয়েবসাইটের দিনপঞ্জিতে (ব্লগ) এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে একজন খেটে খাওয়া মানুষ যেমন নিজের দেশের পক্ষে ভোট করছেন তেমনি রাষ্ট্রের কর্ণধার প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীও ভোট করছেন। এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। এসএমএস এবং সরাসরি ফোন করে ওই ভোট করা যাচ্ছে।
দেশের টেলিভিশন-ব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষার বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক প্রচার চালিয়েছিলাম। এখন জানতে পারছি এটা বহুজাতিক কোম্পানির অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার একটা অপচেষ্টা। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. গীতিআরা নাসরিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে ওয়েবসাইটের দিনপঞ্জিতে (ব্লগ) পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখালেখি হচ্ছে।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সিনিয়র এক সাংবাদিক বিষয়টি নিয়ে তার নিজস্ব ওয়েবে বেশ কিছু লেখালেখি করেছেন। এখনো লিখে যাচ্ছেন। তিনি ওয়েবসাইটের একটি লেখায় বলেছেন, তথাকথিত সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে সুন্দরবনকে বিজয়ী (?) করতে দেশে এখন মাতামাতি চলছে। বিষয়টি এখন 'কান নিয়ে গেল চিলে'র মতো ঘটনা। কেউই একবার প্রশ্নও করছে না যে কে বা কারা তাদের ওই দায়িত্ব দিয়েছে সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের? আমাদের সুন্দরবন এমনিতেই সুন্দর। ভোট দিয়ে এটাকে সুন্দর প্রমাণের কিছু নেই। এসএমএস ব্যবসার মাধ্যমে টাকা কামানোর অপচেষ্টা এটা।
ওয়েব সূত্রে জানা যায়, 'নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন' নাম দিয়ে সুইস চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগ্রাহক বার্নার্ড ওয়েবার এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটার সঙ্গে সুইস সরকারের কিছু সম্পর্ক আছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। পর্তুগালের লিসবনে তারা তাদের প্রথম প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করে ২০০৭ সালের জুলাইয়ে। তারা দাবি করে, প্রায় ১০ কোটি ভোটার এসএমএস ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই প্রতিযোগিতায় ভোট দিয়েছিলেন। প্রথম দিকে বিভিন্ন ছোট ছোট দেশ প্রতিযোগিতার ব্যাপারে বিরাট আগ্রহ দেখায়। তবে এক পর্যায়ে তাজমহল কম ভোট পেয়ে বাদ যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ভারতে এটি নিয়ে বিরাট হৈচৈ পড়ে এবং ভারতীয় মিডিয়ার আগ্রহের কারণে এই প্রতিযোগিতা হালে পানি পেয়ে যায় এবং ভারত থেকে কোটি কোটি ভোট পড়তে থাকে।
সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে ভোট করার উত্তেজনা শুধু সাধারণের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্দানের রানী রানিয়া নিজে প্রচারে নেমেছেন। রানিয়ার ৭০ লাখ লোকের দেশ জর্দান থেকে এক কোটি ৪০ লাখ পেট্রার পক্ষে ভোট পড়ে বলে ধারণা করা হয়। ব্রাজিলের ফোন কোম্পানিগুলো ফ্রি এসএমএস ও কল করতে দিয়ে তাদের রিডিমার স্ট্যাচুকে জিতিয়ে দেয়। ভারতেও একই রকম কাণ্ড হয়েছিল। একজন লোকের একাধিক ভোট দেওয়ার এবং যত খুশি ভোট দেওয়ার ক্ষমতা থাকায় এই প্রতিযোগিতার সততা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শুরুতে মনোনয়ন দেওয়ার সময় ইউনেস্কো তাদের সহযোগিতা করলেও পরে তারা ঘোষণা দিয়ে এই কাজ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। ইউনেস্কো থেকে আরও বলা হয়, 'এই প্রতিযোগিতা একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ। এর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি পৃথিবীর সব ধরনের মানুষ নয়, বরং ইন্টারনেট ও ফোন ব্যবহারকারীদের মতামত মাত্র।'
ওয়েব সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশে তারা এই এসএমএস ভোটিংয়ের আয়োজন করছে। আমাদের বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এই প্রতিযোগিতার জন্য এসএমএস পাঠানোর বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, প্রতিটি সিম থেকে ২০টি এসএমএস পাঠালে বাংলাদেশ ১০০ কোটি ভোট পাবে। মজার বিষয় হলো এই প্রতিযোগিতার আয়োজকরা ভোটের কম বেশি দিয়ে বিজয়ী নির্বাচন করেন বলে স্বীকার করেন না, ভোটের সংখ্যাও প্রকাশ করেন না। প্রতিটি এসএমএসের জন্য খরচ হবে দুই টাকা। তাহলে সম্ভাব্য আয় ২০০ কোটি টাকা। এর থেকে ৬৮ পয়সা পাবে সেই আয়োজক সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন। তার মানে মোট ৬৮ কোটি টাকা পাবে সংগঠনটি। যে নম্বরটিতে এসএমএস পাঠাতে হবে সেই ১৬৩৩৩ নম্বরটির মালিক কে বা কারা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই নীরব থেকেছেন। এই নম্বরটির মালিক যদি কোম্পানিগুলো হয় তবে তারা পাবে বাকি ১৩২ কোটি টাকা। আর যদি এই নম্বরটির মালিক হন কোন ব্যক্তি তবে তিনি এই ১৩২ কোটি টাকার অন্তত ৪০ ভাগ পাবেন।
এদিকে মালদ্বীপ সরকার প্রতিযোগিতা থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ২৪ এপ্রিল তাদের মন্ত্রিসভার বৈঠকে তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কটি দেখুন Click This Link
ইন্দোনেশিয়াও এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের পর্যটন মন্ত্রণালয়কে এই আয়োজকরা পুরস্কার বিতরণীর সব খরচ বহন করে হোস্ট নেশন হতে চাপ দিয়েছিল। (প্রয়োজনে এই লিঙ্কটি দেখুন Click This Link এবং এই লিঙ্কটি দেখুন Click This Link)।
অনেকে বলছেন, এই সংগঠন না বললেও আমাদের সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ম্যানগ্রোভ বন। ইউনেস্কো একে এরই মধ্যে পৃথিবীর সম্পদ বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তাই কোথাকার কোন সংগঠন একে প্রথম না দ্বিতীয় বানাল তাতে কিছু আসে যায় না।
জাল ভোট!_ জানা গেছে, মোবাইল এসএমএসের মাধ্যমে তথাকথিত সেভেন ওয়ান্ডার্স নির্বাচনে একটি মোবাইল থেকে যত খুশি তত ভোট দেওয়া তথা জাল ভোট দেওয়ার মওকা দক্ষিণ এশিয়া থেকে একটি মাত্র দেশ নিয়েছে এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই দেশের নাম বাংলাদেশ! সুন্দরবনের অংশীদার ভারত এই অনৈতিক সুযোগ নেয়নি। পুরো দেশ হিসেবে সেভেন ওয়ান্ডার্সের ধান্দাবাজির তালিকাভুক্ত মালদ্বীপও নেয়নি এ অনৈতিক সুযোগ। কারণ জাল ভোট দেওয়ার মওকা নিয়ে একটি স্থানকে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন করার মতো মানসিক দৈন্যতার পরিচয় তারা দেয়নি।
ওয়েব সূত্রে জানা যায়, এনসাইক্লোপেডিয়া কিম্বা উইকিপিডিয়ায় তালিকাভুক্ত অনেক রকম সেভেন ওয়ান্ডার্স আছে। কিন্তু সেসব সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেউ পয়সা কামানোর ধান্দা করেনি, যেটি করেছে সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন। এই আয়োজনটার পেছনে বার্নার্ড ওয়েবার (সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডশনের মালিক) নামে এক ভদ্রলোক কাজ করলেও আইডিয়াটা ছিল এক মাস্টার মাইন্ডের, যার নাম ফিলিপ কোটলার। মোটা অর্থের বিনিময়ে পৃথিবীর যে কোনো জিনিসকে পণ্য বানিয়ে টাকা কামানোর উপায় বাতলে দেন তিনি। যেমনটি তিনি করেছেন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে।
by: লুৎফর রহমান হিমেল
Copy & paste from: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০:২৪