এই ছোট শহরের মধ্যে এমন সব বাড়ী আর কোন ছো্ট শহরে দেখেনি ফাহাদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরটা ছোট কিন্তু গড়ে উঠছে অত্যাধুনিক ভাবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেন বাড়ীর শহর। দোতলায় থাকে ফাহাদ। পাচতলার বাড়ীটাতে আর সবাই প্রবাসী পরিবার। অফিস থেকে ফিরে গেটে ঢুকতেই উপরে লক্ষ্য করতেই প্রতিদিন ফাহাদ দেখে কোন না কোন ভাবী ফোনে কথা বলছেই। বিদেশীদের এই এক সমস্যা। বউ দেশে রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন। আবার স্বামীর সাথে কথা শেষ হবার পর অন্য পুরুষের সাথে ফোন। বিদেশী স্বামীর স্ত্রী’রা শশুর-শাশুরী, ননদদের সামনেই পর পুরুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলে। একটু জিঙ্গেস করলে বলে- আপনার ছেলে ফোন করেছে আম্মা! ওহ! কেয়া বাত! এভাবে কথা বলতে বলতে বিদেশী বউদের তো বেশীরভাগই এখন মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফাহাদ সবার সাথেই ফ্রি। গেটে ঢোকার সময় উপরে তাকিয়েই- হাই ভাবী বলে একটা হাত তোলে- হাই। ভাবীরাও হাত উঠিয়ে অভ্যর্থনার জবাব দেয়- হায়! বাজারে গেলে বলে ভাবীরা কিছু লাগবে নাকি? ৫ তলায় থাকেন যে ভাবী তার স্বামী স্পেনে থাকেন, ৪র্থ তলার জন সৌদিআরব আর ৩য় তলার ভাবীর স্বামী থাকেন আফ্রিকা। যিনি তৃতীয় তলায় থাকেন, তিনি নতুন এসেছেন। প্রায় মাসচারেক হলো বিয়ে হয়েছে। স্বামী চলে গেছেন। একাই থাকেন। অনার্স ভর্তি হয়ে্ছেন। আফ্রিকা প্রবাসী বলে বাবা-মা জোড় করেই বিয়ে দিয়েছেন। উনাকে বেশী দেখা যায় না।
ফাহাদ মিশুক স্বভাবের। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এখণ তার বন্ধুবান্ধও জুটেছে বেশ। বিকেলে একা একা ফ্লাটে ভালো লাগেনা। শহরে কোন দোকানে অথবা পানির ট্যান্কের পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা দেয়। একদিন পুকুর পাড়ে বসে আছে। দেখে তৃতীয় তলার ভাবী পুকুর পাড়ের এ রাস্তা দিয়েই আসছে। অন্যমনস্ক হয়ে হাটছে ভাবী। কাছে আসতেই ফাহাদ বলে, হায় ভাবী, কোথায় যান? একটু থামে, তারপর তাকিয়ে বলে, ও আপনি.....! একটু ঔষধ আনবো। আমাকে বললেই তো পারতেন। আচ্ছা, চলেন যাই। আমার পরিচিত এক র্ফামেসী আছে। কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হলেও সাথেই চলতে থাকলো দুজন।
রিনি অনার্সে ভর্তি হয়েছে মাত্র। খুব ইচ্ছা লেখাপড়া করে কিছু করবে। বিয়েটা পরে করতো। কিন্তু পরিবার মানলো না। এখন রিনির পড়ালেখায় খুব অসুবিধা হয়। স্বামী ফোন করে বলে, প্রয়োজনীয়তা ছাড়া বের হওয়া যাবে না। দরকার থাকলেও প্রাইভেট পড়া হয়না রিনির। সেদিন ফাহাদের সা্থে যেতে যেতে এ কথাগুলো বলে রিনি। বলে- আপনি আমাকে ভাবী বলবেন না। আমি আপনার বয়সেও ছোট। তাই শুধুই রিনি। আর হ্যা আপনার ফোন নম্বর টা দিন তো? কিছু লাগলে আপনাকে ফোন করা যাবে।
সেদিনের পর থেকে আর কথা হয়নি ফাহাদের। একদিন রাত সাড়ে এগারোটায় ফোন করে রিনি। ফাহাদের কাছে নম্বর সেইভ ছিলো না।
ফাহাদ বললো, কে?
বললো, আমি আপনার মাথার উপরে।
মাথার উপরে মানে! বুঝলাম না
আমি রিনি। ও হা-হা-হা... ঠিকই তো আপনি তো আমার মাথার উপরে।
কেমন আছেন। ভালো, আপনি? প্রথমে কোন উত্তর দিলনা রিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো- ভালো।
ফাহাদ বললো, দীর্ঘশ্বাসটা কি জানতে পারি?
কথা শুনে একটু নিজেকে আড়াল করতে- একটা হাসি দিলো।
ফাহাদ বললো, হাসিটাও স্পষ্ট হলো না। বললো আপনি বাংলায় পড়ালেখা করেছেন তাই না, ভাবাবেগ বেশী বোঝেন। কোন উত্তর দিলাম না।
ফাহাদ শুধু বললো, কি হয়েছে সেটা বলেন। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস। বললো, আসলে জানেন আজ আমার মনটা ভালো নেই। কেন? উপরে দেখেন সবাই সবসময় ফোন করছে, আর ও মাত্র দুমাস হয় গেছে প্রয়োজনের বেশী ফোন করেনা।
সেটা তো ভালো। কিন্তু ও যখন আমাকে ফোন করে তখন ওর ডিউটি সময়। কোন দিন বাসায় এসে ফোন করেনা।
ফাহাদ বললো, বিদেশে কাজ শেষে তাদের রান্না করে থেকে হয়, তারপর হয়েতো ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু তাই বলে একমিনিটও কথা বলতে পারেনা।
সেটা অবশ্য ঠিক।
আমি আজকে ওকে অন্তত: দশটা কল দিয়েছে কিন্তু কোন রিসিভ করেনি। হয়তো করবে কাল কাজে যাবার পর।
ফাহাদ বললো, হয়তো কোন সমস্যা থাকতে পারে। এটা নিয়ে আপনি শুধু চিন্তা করে নিজেকে কষ্ট দিবেন না। বিদেশ তো আমাদের দেশের মতো এতো সহজ নয়। হয়তো তার কোন অসুবিধা আছে। রিনির মনটা খারাপ। তাই আর বেশী কথা বাড়ায় না। সেদিন রাতে তাকে সহজে বুঝিয়ে ফোন রেখে দেয় ফাহাদ। তাই আর কিছু বললোনা রিনি।
হঠাত করে বিয়ের হিসাবটা জীবনে কোন ক্ষেত্রেই হিসাবে মেলাতে পারেনা রিনি। মানুষের অপ্রস্তুত অবস্থায় অনাকাংখিত বিয়ে অনেকটা জীবনে ঝড়ের মতো। রিনি কলেজে থাকতেই ওর দুই-তিন বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে বিদেশ প্রবাসীর সাথে। ওই সময় ও বান্ধবীদের ঠাট্রা করে বলেছিলো- বিদেশীদের বিয়ে করা মানে অসম্পূর্ণ জীবন। স্বামীরা অতিথি পাখির মতো আসবে আবার তিন মাস পর চলে যাবে। অতিথি পাখি বললেও ভুল হবে অতিথি পাখিরা বছরে একবার করে হলেও আসে কিন্তু যারা প্রবাসী তারা তো দু-তিন বছরের নিচে আসতে পারেনা। কি বলবে রিনি। অথচ আজ ওর জীবনেও এলো একই পরিণতি। এ জন্য নিজের বিয়ে বিষয়ে বান্ধবীদের পর্যন্ত কোন কিছু জানায়নি রিনি।
জীবটা এমন ঝড়ের মধ্যে পড়বে কোন দিন চিন্তাও করেনি রিনি। সন্দেহটাই সত্যিই হলো। রাশেদ যদি আফ্রিকাতে না থাকতো তাহলে হয়তো সত্যিটা জানতেই পারতোনা রিনি। রাশেদ রিনির খালাত ভাই। দীর্ঘদিন থেকে আফ্রিকা প্রবাসী। রাশেদ রিনিকে খুব ভালবাসতো। কিন্তু রিনি প্রবাসীদের কখনোই্ পছন্দ করতোনা। কাল হটাত রাশেদের ফোন পেয়ে রিনি ওর স্বামীর ঠিকানা দিয়েছিলো রাশেদকে। রাশেদ খোজ নিয়ে জেনেছে ওর স্বামী এখানে এক আফ্রিকানের সাথে কন্ট্রাক ম্যারেজ করেছে। ওদের একটা সন্তানও আছে। কাজ শেষ করে ওই আফ্রিকানের সাথে একই ফ্লাটে যাপন করে সে। রাশেদ খবরটা লুকাতে পারতো। কিন্তু লুকায়নি কারণ সে এখনও রিনিকে ভালবাসে। রিনিকে এখনও সে পেতে চায়। কিন্তু রাশেদ বলেছে, রিনি যেন কোন অবস্থাতেই এসব কথা কাউকে না বলে। এমনকি তার স্বামীকেও বুঝতে দেওয়া যাবেনা। ছোট বেলা থেকেই রিনি ঘরকুনো স্বভাবের। কোন সময় হৈ-হুল্লোর পছন্দ করতোনা। তাই ফ্লাটে একাকি থেকে থেকে নিরব কান্না আর ঝড় বয়ে চলে ওর মনে।
বেশ ক’দিন হয় রিনির কোন সাড়া শব্দ নেই দেখে ফাহাদ আশ্চার্য হয়। তাই রাতে একটা ফোন করে ফাহাদ। রিনি ফোনটা দেখেই রিসিভ করে। ওপাশ থেকে অনেকটা অনুনয়ের সাথে বলে ফাহাদ- আমি কি কোন ভুল করেছি রিনি? কষ্টে হাসতে পারেনা রিনি। তাও কষ্টে হাসে।
না- না কেন?
না, দেখছি সেদিন কথা বলার পর আপনার কোন দেখা নেই।
এমনিতেই আমার শরীরটা ভালো ছিলোনাতো তাই।
না শরীর ভালো না থাকলে তো মানুষের এমন হবার কথা নয়।
আপনার শুধু বাড়াবাড়ি.....!
আর বেশীদুর যায়না ফাহাদ। আনমনে শুধু বলে, ভালো থাকলে ভালো।
বেশ কয়েকদিনের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে রিনি। দু:খ কষ্ট গুলো কর্পুরের বিষাদের মতো উরিয়ে দিয়েছে সে। ইতিমধ্যে ফাহাদকেও কয়েকবার ফোন করেছে সে। ফাহাদের সাথে ফোন করে নিজের সব কষ্টগুলো ভুলে যায় সে। ফাহাদকে কেন জানি খুব ভালো লাগে রিনির। কিন্তু নিজের কোন হিসেব মিলাতে পারেনা রিনি। এখন সে তার জীবনের আর কোন হিসেবও মেলাতে চায়না রিনি। মনের মধ্যে একটা জেদ চেপে বসেছে রিনির। নিজেকে মেলে ধরবে এখন সে খোলা আকাশে। উন্মুক্ত করবে তার হৃদয়। ইচ্ছার ডানায় ভেসে চলবে দুরন্ত গতিতে।
রাত এগারটার দিকে ফাহাদকে একটা ফোন করে রিনি। রিসিভ করেতেই ফাহাদকে বলে,
আপনিকে ঘুমিয়ে পড়েছেন? না.... কেন?
আপনি কি একটু উপরে আসতে পারবেন?
এত রাতে....! রিনি একটা হাসি দিয়ে বলে-কেন ভয় পাচ্ছেন...?
না..হ। আসছি। উপরে যাওয়ার জন্য সিড়ির দিকে পা বাড়ায় ফাহাদ। দেখে বাতাস বইছে। বাইরে ঘোর অন্ধকার। এখন কালবেশাখী ঝড়ের সময়। বেশীক্ষণ দেরী করবেনা সে। উপরে গিয়ে দরজা খোলা দেখেই ঢুকে পড়ে ফাহাদ। গিয়ে সোফায় বসে।
বলে, কিজন্য ডেকেছেন?
কথার উত্তর না দিয়ে আগে দরজাটা বন্ধ করতে যায় রিনি।
দেখে ফাহাদ বলে, এখনই তো চলে যাবো।
রিনি শুনে একটা হাসি দিয়ে বলে- এতরাতে আপনাকে আমার এখানে দেখলে উপরের তলার ভাবীরা আপনাকে মন্দ বলবে, এই বলে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এরই মধ্যে বিদ্যুত চলে যায়। সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। খোলা জানালা দিয়ে হু-হু করে বাতাস বইতে থাকে। বাইরে কাল বৈশাখী ঝড় বইছে। আকাশে বিদ্যুতের একটু খানি চমকানী আলোকিত করে ঘরটাকে। ভেতরে দুজন নর-নারীর একটা অন্যরকম উন্মাদনার ছবি ভেসে ওঠে। আবার অন্ধকার। বাইরে প্রকৃতির ঝড়ের মতো ভেতরেও কাল বৈশাখী ঝড় বইছে দুটি মানুষের শরীরে। মনের যন্ত্রণার মাঝে রিনি খুজে ফিরে একটু খানি প্রশান্তির মরুদ্যান। ফাহাদ ভরা নদীতে বন্যার স্রোতের প্রতিকূলে শক্ত হাতে বৈঠা বাইয়ে নৌকা নিয়ে চলে তার ঘাটের কিনারে। রিনির মনের ঝড় থামে। এরপর অবসাদ পেয়ে রিনি নিজের হাত দিয়ে তার বুকের উপরে তুলে দেওয়া জগদ্দল পাথরটাকে এখন সরাতে চায় কিন্তু তখনও বৈঠা বাইতে থাকে ফাহাদ দুরন্ত গতিতে। রিনি হারের যন্ত্রনা সইতে সইতে যখন ফাহাদের ঝড় থামে তখন মুহুর্তেই রিনি কেবল মুখ টিপে হাসে। ফাহাদ আচমকা বলে ওঠে, কি ব্যাপার! রিনি অমনি বলে, বোকা...! মনের খেলা, এমনই এক খেলা, যেখানে মেয়ে প্রতিপক্ষরা কেবল পরাজয় বরণ করে আনন্দ লাভ করে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৬ রাত ৯:৩৭